১.
ক.
রিপন, শিপন আর দীপনের পর মনোয়ারা বেগমের কোল আলো করে চতুর্থ সন্তানটিও ছেলে হিসেবেই দুনিয়ায় আসলে কন্যা সন্তানের জন্য সূক্ষ্ম আফসোসটুকুর পাশাপাশি আরো একটা ছোট্ট সমস্যায় পড়ে যায় তাদের বাপ। সেটা নবজাতকের নাম রাখা নিয়ে। রিপন, শিপন আর দীপনের সাথে পুরোপুরি মিলিয়ে আর কোন নামই তার মাথায় আসেনা। তার মেট্রিক পাস বউ মনোয়ারা পেপার-পড়া জ্ঞানের বদৌলতে মিন মিন করে জাপান দেশের প্রতিশব্দ "নিপ্পন" নামটিকে প্রস্তাব করলেও ছেলেদের খুঁতখুঁতে বাপের কিছুতেই ঐ বাড়তি "প"টুকুকে পছন্দ হয়না। শুনতে অদ্ভুত শোনালেও, গোঁয়াড় স্বামীর গায়ের জোরে রাখা নাম "টিপন"কেই অগত্যা মেনে নিতে হয় মনোয়ারার।
তবে মনোয়ারার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। কারণ, মনের কষ্ট খুব একটা বেশী দিন চেপে রাখতে হয়নি। "এটা কোনো মানুষের নাম!", "এইটা কোন কিসিমের নাম যেইটার কোনো অর্থ নাই!" -- আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবদের মুখে আড়ালে আবডালে এজাতীয় শ্লেষাত্মক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে অদৃষ্টের বিধানের মতো টিপনের নামটিও শেষমেষ "টিপু"তে এসেই থামে।
মায়ের পেটে কিছুকাল কাটানোর কারণে হোক বা অন্য যে কোন কারণেই হোক, ছেলের রুচিও মায়ের রুচির সাথে মিলে যায়। ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে সেভেন পর্যন্ত সব ক্লাসের খাতাগুলোতে তাই আসল নামের পাশে ব্র্যাকেটের ভেতর "টিপু"ই লিখে এসেছিলো সে। বাপের দেয়া নাম কাঁটছাঁট করা যে বাপ পছন্দ করেনা তা সে বুঝতো, এ নিয়ে একটা বিড়ম্বনা বা সূক্ষ্ম অপরাধবোধও তার ছিলো। অবশ্য সৌভাগ্যবশত কিনা বলা কঠিন, তবে মায়ের মতো খুব বেশীদিন সেই বিড়ম্বনার বোঝা তাকেও বইতে হয়নি। পড়াশোনায় কখনো ভালো তো দূরের কথা মোটামুটি মানেরও না হওয়ায় ক্লাস এইটে ওঠার পরই টিপু টের পেয়ে যায় যে তাকে অন্য লাইন ধরতে হবে। কলোনীর বিশালাকায় "পানির টাংকি"র চিপায় দাঁড়িয়ে মাশুক ভাইয়ের কাছ থেকে প্রথম যে "মাল"টি হাতে পায় সে এক বৃহস্পতিবার রাত দশটার দিকে, সেটি ছিলো চকচকে রূপালী একটা চাইনীজ কুড়াল। আকারে একটা হাতুড়ির চেয়েও ছোট হবে, বেল্টের চিপায় গুঁজে রাখা যায়।
গমগমে কন্ঠে মাশুক ভাই তার চরিত্রের বিপরীতে যাওয়া খাঁটি শুদ্ধ বাংলায় মাস্টারদের ভঙ্গিতে বলেছিলো,
"প্রথম প্রথম প্রত্যেকদিনই মনে হবে কাউকে না কাউকে দেই এক কোপ, বুঝলে? তবে হ্যাঁ! সে ইচ্ছেটুকুকে সামলে চলতে হবে। প্রথম দু'মাস কারো উপর প্রয়োগ করা যাবেনা। সবার আগে বেল্টে গুঁজেও কিভাবে দৌড়ে পালানো যায় সেটা শিখবে, কেমন?"
সাম্রাজ্যপ্রাপ্তির অভিষেক হচ্ছিলো যেন টিপুর, চকচকে চোখে বাধ্য শ্রোতার মতো মাশুক ভাইয়ের কথা গিলছিলো।
সম্ভবত উপযুক্ত শিষ্য তৈরী হবার আশু সম্ভাবনার কারণেই, বেশ উৎসাহের সাথেই মাশুক ভাই আরো অনেক সবকই দিয়েছিলো। এবং সবার শেষে যোগ করেছিলো,
"আর একটা কথা বলে রাখি। এই লাইনে যখন এসেছো, তখন প্রেম ভালোবাসা এসবের কথা আপাতত ভুলে যাও, বুঝলে? মিলি না মিনি কি যেন নাম? বুঝলে টিপু, আমরা সব খবরই পাই, হা হা হা।"
মাশুক ভাইয়ের অন্য কথাগুলো যতটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিলো টিপুর মনে, ততটা উৎসাহ এই দফা আর দেখাতে পারলোনা সে। এই উপদেশ পালন করতে পারা তো দূরের কথা পালন করার কোন চেষ্টাও সে কোনদিন করেনি।
"প্রেম ভালোবাসা আর মাস্তানি সব আমি একলগে কইরা দেখায়া ছাড়ুম" এই ছিলো তার মাস্তানী ক্যারিয়ারের ইনিশিয়াল মটো।
খ.
মাশুক যাকে "মিলি" বা "মিনি" বলে নিজেকে সর্বজ্ঞ হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেছিলো তার নাম আসলে মিমি। কলোনীতে টিপুদের কোয়ার্টারের সামনে আরো দুটো বিল্ডিং পেরুলেই মিমিদের বাসা। টিপুর চেয়ে বছর খানেকের ছোট হবে। যখন টিপুর হাতে চাইনিজ কুড়াল ওঠে তখন মিমি ক্লাস এইটে পড়ে, বৃত্তির কোচিং করে। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা। শুধু যে ছাত্রী হিসেবেই খুব ভালো মিমি তা না। আচার আচরণেও ভদ্র, কোন উগ্রতা নেই, অভিভাবকদের চোখে এই বয়েসী ছেলেমেয়েদের উচ্ছন্নে যাবার যেসব লক্ষণ ধরা পড়ে সেসবের কিছুই তার মধ্যে নেই। যেমন, বিকেল থেকে সন্ধ্যা নাগাদ কলোনীর কোয়ার্টারগুলোর ছাদ আর বারান্দায় অনেক উঠতি বয়েসী কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীকে দেখা যেত। হাতের ইশারায়, চোখের ভাষায়, এমনকি মাঝে মাঝে শুধু নিজের উপস্থিতি দিয়েও এরা একে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। অদ্ভুত এক কমিউনিকেশন সিস্টেম। তবে লক্ষ্মীমন্ত ভদ্র মেয়ে মিমিকে এসবের মধ্যে কেউ কখনও দেখেনি।
শুধু তাই না। দেখতেও অপরূপা, তা নাহলে অবশ্য টিপুর মতো উঠতি মাস্তানের আগ্রহের কারণ হবারও কথা না তার। মিষ্টি চেহারা, টান টানা চোখ, লম্বাটে গড়ন। মিমির চোখে সবসময়েই যেন কাজল থাকে, তবে তা কি কাজলের কারুকাজ নাকি মিমির চোখই অমন সে নিয়েও কিছুটা ধন্দ ছিলো টিপুর মনে। তার ওপর মিমি হাঁটেও খুব সুন্দর করে, যেন এক ধরনের ছন্দের তালে। হাঁটুটাকে খানিকটা উপরে উঠিয়ে সামনে ঠেলে দেয়, অনেক দূর থেকে দেখেও টিপু বুঝে ফেলে মিমি আসছে, অথবা যাচ্ছে। এসব মিলিয়েই, চাইনীজ কুড়াল হাতে নেয়ার কয়েকমাস আগে থেকেই মিমির প্রেমে পড়ে যায় সে।
লিটনের কনফেকশনারীর উত্তর পাশে দাঁড়ালে স্কুলের গেট সরাসরি চোখে পড়ে, বেলা আড়াইটা থেকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রতিদিনের রুটিনওয়ার্ক। তিনটা বাজার খানিক পরে মিমি বের হয়, বান্ধবীরাসহ। ছন্দের তালে তালে হাঁটে, লিটনের কনফেকশনারীর কিছু যন্ত্রপাতি, যেগুলো ঠিক কি কারণে ব্যবহৃত হয় জানেনা টিপু, সেসবের শব্দের সাথে সাথে তার বুকের কাছেও কোথাও ভীষন দ্রুততায় ড্রামের শব্দ হতে থাকে, ঢিম্, ঢিম্, ঢিম্! ঢাম্, ঢাম্, ঢাম্!
চাইনীজ কুড়াল হাতে আসার পর শুধু ড্রামের শব্দে সন্তুষ্ট থাকতে চায়না টিপু। প্রায়ই কিছু বলতে ইচ্ছে হয় মিমিকে। কিন্তু সমস্যা হলো, মিমির পরিবার আর টিপুর পরিবারের খুব ভালো পরিচয় ছিলো। কি করতে কি করে ফেলে, তারপর কোন ধরনের কেলেংকারী বাঁধে এই নিয়ে একটা দ্বিধার কারণে কোমরে চাইনীজ কুড়াল গুঁজেও ঠিকমতো সাহস করে উঠতে পারেনা সে। মাঝে মাঝে ভাবে এভাবেই পাহারা দিয়ে রাখবে, তারপর সময় হলে একদিন উঠিয়ে নিয়ে যাবে। এদেশে মাস্তানদের বিয়ে করার এটাই সহজ পথ। কিন্তু এসব ভাবনার মাঝেই মিমির ব্যক্তিত্বটা ভেসে ওঠে তার মনে, কিছুটা হলেও দমে যায়।
চৌদ্দ বছর বয়েসের বাচ্চা মেয়ে হলেও মিমির হাঁটা-চলা, আচার আচরণে একটা গাম্ভীর্যের ছাপ অনুভ করে টিপু। সেটার বাস্তব অস্তিত্ব আসলেই আছে নাকি তার মনের ভেতরে তৈরী হওয়া, তা নিয়ে মাথা অবশ্য সে ঘামায়না। কিন্তু ভয় পায়। বিশেষ করে যখন যে কল্পনা করে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মিমির পাশে হঠাৎ করে গিয়ে থেমে তাকে উঠিয়ে নিতে যাচ্ছে সে, মিমির একটা কড়া চাহনি সে দেখতে পায়। মিমি ওভাবে তাকালে একটু নড়তেও পারবেনা সে -- ঠিক এরকম করে না মনে হলেও কাছাকাছি একটা অনুভূতি হয় তার। অস্বস্তিদায়ক।
মাস্তানদের মুখ সাধারণত আলগা হয়। নিজের বাহাদুরী জারী রাখতেই হয়তো, পঁচিশকে আড়াই হাজার বলে প্রচার করতে হয় তাদের। সেটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই হয়তোবা, টিপুর বন্ধুবান্ধবদের সাবাই জেনে যায় মিমির কথা। প্রথম প্রথম সবাই জানতো মিমিই টিপুর প্রেমে পাগল, চাইনিজ কুড়াল দেখে প্রেমে পড়েছে। পুরোটাই টিপুর বাড়িয়ে বলা। একদিন লিটনের কনফেকশনারীর পাশ দিয়ে যাবার সময় টিপুর সাথে চোখাচোখি হয়ে যায় মিমির, বুকের ভেতরের ধুপধাপ শব্দের ঝামেলায় যখন টিপু বুঝতে পারছিলোনা কি করা উচিত, তখন মিমিই বলেছিলো,
"টিপু ভাইয়া, ভালো আছেন?"।
উল্লেখ্য, মিমি তখনও টের পায়নি টিপু এখানে কেন দাঁড়ায়।
"হ্যাঁ ভালো। তুমি ভালো আছো? আঙ্কেল আন্টি কেমন আছে?" হড়বড় করে বলেছিলো টিপু।
"ভালো", মিষ্টি হাসির সাথে ছোট্ট করে উত্তর দিয়েছিলো মিমি।
সেই কথা বন্ধু মহলে ফুলে ফেঁপে ছড়ায়। কমনসেন্সটা সাধারণ মানুষের চেয়ে একটু ভিন্ন মাত্রার হওয়ায় এদের এটা ধরতে বেশ সময় লেগে যায় যে মিমির মতো মেয়ের টিপুর প্রেমে পড়ার কোন কারণ নেই। টিপু দেখতে খুবই সাধারণ। এ ধরনের প্রসঙ্গগুলো আসে ঠিকই, তবে এরা অনেক অপটিমিস্টিক। "আল্লার দুইন্যায় কখন কি ঘটে কিছু কওন যায়?" এ ধরনের নানান স্লোক তাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে টনিকের মতো কাজ করে।
গ.
সময়ের সাথে সাথে ব্যাপারটা নিয়ে বন্ধুদের উৎসাহ বাড়ে। টিপু হয়তো কিছু বলেনা বা বলার সাহস পায়না অথবা হয়তো লজ্জা পায়। কিন্তু মিমি যখন লিটনের দোকানের পাশ দিয়ে যায়, বন্ধুদের মধ্যে দু'য়েকজন শিস্ দিয়ে উঠে। মাঝে মাঝে অতিউৎসাহী কেউ একজন সুর করে ডেকে ওঠে,
"টিপুউউউউ, তুমি গ্যালা কই?
আবার কখনও শুধু চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, "আইলোরেএএএ"।
দু'চারজনের হাসিতে ফেটে পড়ার শব্দও শোনা যায়।
বন্ধুদের এসব আচরণের প্রেক্ষিতে মিমি কি প্রতিক্রিয়া করতে পারে তা নিয়ে টিপু মনে মনে অনেক কিছু ভেবেছিলো। হিন্দী সিনেমার নায়িকাদের মতো হয়তো স্যান্ডেল হাতে তাড়া করবে? অথবা মুখ ঝামটা মেরে গটগট করে হেঁটে যাবে? অথবা ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলবে,
"অসভ্য কোথাকার!"
অথবা হয়তো টিপুর বাসায় গিয়ে নালিশ করে আসবে মিমির বাবা-মা।
কিন্তু বছরখানেকের মাথায় টিপু বুঝতে পারে যে তার কল্পনার এসব প্রতিক্রিয়ার কোনটাই মিমি করেনা। তবে কি মিমি তাকে পছন্দ করে? কিছুটা এলোমেলো বোধ করে সে। মিমি কি সাহসী ছেলেদের পছন্দ করে? সিনেমা নাটকের প্রভাবে ঢিসুমু-ঢুসুম টাইপের সাহসী পুরুষের কাছে মেয়েরা নিজেকে সঁপে দেয় এরকম একটা "সত্য" সে নিজেনিজেই আবিস্কার করে ফেলেছিলো। এহেন নানান চিন্তার প্রেক্ষিতেই, টিপুর স্বপ্ন দীর্ঘায়িত হয়। সাথে বাড়ে বুকের ভেতরের দ্রিম দ্রিম, আর একইসাথে মনের অন্য কোণায় বাড়তে থাকে আফসোস। মাঝে মাঝে তার মনে হয় মাস্তানী ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনায় ফিরে যায়। দিনরাত মুখ গুঁজে পড়বে, সারাদিনে আঠারো ঘন্টা করে পড়লে নিশ্চয়ই সেও মিমির মতো ভালো ফলাফল করতে পারবে। দুয়েকবার প্রচেষ্টাও নিয়েছিলো, কিন্তু আঠারো ঘন্টা তো দূরের কথা ঘন্টাখানেকও চালাতে পারেনি। একবার পাশের কলোনীতে কি একটা "ক্যাচাল" (মাস্তানপক্ষদের মধ্যে পারস্পরিক মারামারি বা ঝগড়াবিবাদ) লাগলো, শার্টের নিচে বেল্টের ভেতর চাইনিজ কুড়াল গুঁজে বের হয়ে গিয়েছিলো। আরেকবার সম্ভবতঃ অনেকদিন পর কোন এক বন্ধু বেড়াতে এসেছিলো কলোনীতে। বন্ধুর চেয়ে পড়াশোনা বা অধ্যবসায় কোনকালেই বড় ছিলোনা তার কাছে।
মোদ্দাকথা, মিমির প্রতি আকর্ষণ বোধের কারণে পড়াশোনায় ফেরা উচিত এমন একটা তাগিদ অনুভব করলেও, বাস্তবে টিপুর পক্ষে আর সে পথে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মনে মনে তাই সে ঠিক করে রেখেছিলো বছর পাঁচেক মাস্তানী করে লাখ পাঁচেক টাকা কামাবে, তারপর বছর তিনেক কন্ট্রাকটারী করবে। তিন বছর কন্ট্রাকটারী করে কিভাবে বাড়ী গাড়ী করে ফেলা যায় মাশুক ভাইর কাছে সেসব গল্প অনেক শুনেছে সে। বাড়ি গাড়ি হয়ে গেলে তবেই মিমিকে বিয়ের প্রস্তাব দেবে সে, রাজী না হলে সোজা তুলে নিয়ে যাবে -- এই হলো তার অস্টবার্ষিক পরিকল্পণা।
ঘ.
টিপুর অস্টবার্ষিক পরিকল্পণা যে বাস্তবের চেয়ে অনেক দূরে সেটা খুব করুণভাবে প্রথম সে টের পায় আরো বছরখানেক পরে। তখন ক্লাস টেনে পড়ছে মিমি। জাপানী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা দল এসেছিলো বাংলাদেশে। দেশের শীর্ষস্থানীয় আটটা স্কুল পরিদর্শন করে সবচেয়ে ইম্প্রেসিভ বত্রিশজন হাইস্কুল ছাত্রছাত্রীকে তারা জাপানে নিয়ে যায় পনেরো দিনের এক শিক্ষাসফরে। ছোট্ট কলোনীর পরিমন্ডলে এ ছিলো এক বিরাট খবর। এক ধরনের সাড়া পড়ে যায়। মিমির বাবার নাম আফতাব আহমেদ, লোকের মুখে মুখে আফতাব সাহেবের ছেলেমেয়েদের প্রশংসা। মিমির সাথে সাথে তার বুয়েট পড়ুয়া বড় ভাইয়ের প্রশংসার ব্যাপারটিও নতুন করে চলে আসে লোকের আলোচনায়।
যে মেয়ের প্রেমে গত দুবছর ধরে বুঁদ হয়েছিলো টিপু, তার ব্যাপারে চারদিকে এত প্রশংসা শুনে ভালো লাগার কথা তার। যেমন, যখন তার কোন বন্ধু প্রথমবারের মতো মিমিকে দেখে মিমির রূপের প্রশংসায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে, এক ধরনের গর্ব অনুভব করে টিপু। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটনা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে টের পায় যে তার ভেতরে একটা অংশ এখন প্রাণপণে চাইছে মিমির জাপান যাবার দিনটি আবার ফিরে আসুক। এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেনটাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে আসবে সে।
টিপুর মনে জন্ম নেয়া অদ্ভুত ধরনের এই অনুভূতি, যাকে ঈর্ষা অথবা বাস্তবতার উপলব্ধিজনিত একাকিত্ব যেটাই বলা হোক না কেন, সেটা পরিপূর্ণতা পায় যেদিন কলোনীর এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বিরাট আয়োজন করে মিমিকে সংবর্ধনা দেয়া হয় সেদিন। কি স্বতঃস্ফুর্তভাবে বান্ধবীদের একে ওকে জড়িয়ে ধরছে মিমি! ভালো ছাত্র বলে কলোনীতে যে ছেলেগুলোর নাম আছে ওরাও মিমির আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। কারো কারো সাথে খুব হেসে হেসে কথাও বলছে মিমি। কারো হাত থেকে বই, কারো হাত থেকে সিডি নিচ্ছে। সংবর্ধনা মঞ্চের কাছাকাছি জায়গাটা যেখানে মিমিরা ছিলো, সেখানে কি সুন্দর একটা উৎসবমুখর পরিবেশ!
জায়গাটা থেকে মাত্র বিশ-ত্রিশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জল মিমি আর তার বন্ধু-বান্ধবীদের দেখছিলো টিপু। সব দেখে গা রি রি করতে থাকে মোটামুটি এলাকার ত্রাস হিসেবে পরিচিত টিপুর। কলোনীর সবচেয়ে "সম্ভাবনাময়" মাস্তান এখন সে। তার "এলাকায়" তার নাকের ডগায় এসব ঘটছে! অবশ্য একইসাথে তারও ইচ্ছে হচ্ছিলো মিমির বন্ধুবান্ধবীদের মধ্যে গিয়ে ওদের একজন হতে, হেসে হসে কথা বলতে, মিমির হাতে একটা সুন্দর ফাউন্টেন পেন তুলে দিতে। সেও তো ওদেরই সমবয়েসী। কিন্তু এসব ভাবতে ভাবতে যখন নিজের মাঝে ব্যাপারটা নিয়ে এক ধরনের অপারগতা আবিস্কার করে, ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রথমবারের মতো সে অনুধাবন করে, সে আসলে এখন আর এদের কেউ হতে পারবেনা। এদের মাঝে তাকে আর মানাবেনা। এক ধরনের অদৃশ্য শেকলে বাঁধা দু'পায়ের অস্তিত্ব অনুভব করে টিপু।
সেদিনই প্রথম, চাইনিজ কুড়াল হাতে নেবার পর সেদিনই প্রথম সে মাথা নিচু করে বাড়ি ফেরে। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা বাবা আর বড় ভাইকে পাত্তা না দিয়ে নিজের ছোট্ট খুপরীর মতো ঘরটার দিকে চলে যায়না। সোফায় বসে বাবার দিকে তাকায়, ভাইয়ের দিকে তাকায়। কেউ কিছু একটা বলুক, তীব্রভাবে অনুভব করে সে। অথচ কেউ কিছু বলেনা। একজন প্রায় শব্দ ছাড়াই টিভি দেখছে, আরেকজন মুখ গুঁজে পড়ছে বাসি পেপার। কি অসহ্য রকমের নীরবতা। কোথাও তার কেটে গেছে, অথবা দেয়াল তৈরী হয়ে গেছে, সেদিনই প্রথম টের পায় টিপু।
সেই শুরু। তারপর শুধু ঐ দেয়ালটার অস্তিত্ব পুরুভতে থাকে টিপুর ভেতর। এরমধ্যে বাবা-মায়ের জোরাজুরিতে প্রাইভেটে এসএসসি পরীক্ষা দিতে বসে পরের বছর। মিমিও পরীক্ষা দিচ্ছে, তাই কোনভাবেই পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপারে তার উৎসাহ ছিলোনা। কিন্তু বাবা কিভাবে যেন মাশুক ভাইকে ম্যানেজ করে ফেলেন। মাশুক ভাইয়ের কথা ফেলার সাহস হয়না টিপুর, বিশেষ করে যখন সেটা আসে আদেশের সুরে। এসএসসি পরীক্ষা ছেলেখেলা নয়, বিশেষ করে প্রায় বছর তিনেক বইয়ের সাথে কোন যোগাযোগই রাখেনি যে ছেলে, তার জন্য এটা অগ্নিপরীক্ষার মতোই। মিরাকল অপাত্রে ঘটেনা, পরীক্ষায় সাত সাবজেক্টেই ফেল করে সে।
ওদিকে বোর্ডস্ট্যান্ড করে কলোনীতে দ্বিতীয়বারের মতো সাড়া ফেলে দেয় মিমি। পত্রিকায় মিমির নাম আসে, ছবি ছাপায়। মিমিদের বাসায় সাংবাদিকেরা ভীড় করে, এমনকি টিভির এক অনুষ্ঠানেও দেখা যায় মিমিকে। পুরো কলোনী জুড়ে সাড়া পড়ে যায়। টিপুর যে বন্ধুরা কিছুদিন আগেও এমন ভাব দেখাতো যে দুনিয়ায় এমন কোনো শক্তি নেই যা টিপু-মিমির সফল পরিণতি ঠেকাতে পারে, তারাও যেন হঠাৎ এবিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অনেক দেরীতে হলেও তারা টের পায় একটা দেয়াল ঠিকই আছে। মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেই সব হয়না। দুয়েকজন ঠোঁটকাটা গোছের বন্ধু টিপুকে বলেও ফেলে,
"তুই হালায় পুরাই আবাল। দুইন্যায় আর মাইয়া ছিলোনা! অহনে আর কি করবি? হার্ট খুইল্যা জাম্বাক ডল।"
ঙ.
পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ আরো করুণ মোড় নেয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে যা হয় তাই। মাস্তানীর সাথে সাথে ফেন্সিডিল ধরে টিপু। নতুন যাত্রা শুরু। নতুন নতুন "মাল" আসে হাতে, পাশাপাশি মাশুক ভাইয়ের পকেট ভারী হয়। টিপু আর তার চ্যালাদের এই পয়সার জন্ম দিতে হয় চিরাচরিত ছিনতাই আর "ডাইলে"র ব্যবসা করে। "মাল" পয়সা আনে, পয়সায় নতুন "মাল" আসে -- অর্থনীতির চিরন্তন চক্র।
এর বছর কয়েকের মধ্যেই পীরবাগ থেকে মোটর সাইকেল চুরির অভিযোগে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় টিপু আর তার স্যাঙাৎ জিসানকে। অবশ্য শাপে বর হয়। এলাকার নেতার নেকনজরে পড়ায় দু'মাসের মাথায়ই হাজত থেকে বের হতে পারে তারা। ফিরে আসে মহাসমারোহে, কয়েক র্যাংক উপরের মাস্তানের বেশে। এলাকার বাজারে ব্যানার টাঙানো হয়, "টিপু-জিসান ঘরের ছেলে, থাকবে কেন জেলের সেলে"। নতুন মাত্রায় শুরু হয় চাঁদাবাজি, ড্রাগ, অস্ত্রের ব্যবসা, বস্তিব্যবসা -- সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেয়া শুরু করে টিপু। এমনকি দু'বছরের মধ্যে মাশুককেও আউট করে দেয় সে সুযোগ বুঝে।
সারাদিন নেশাগ্রস্ত টিপু আর ওর দলের ছেলেপিলেদের পড়ে থাকতে দেখা যেত লিটনের কনফেকশনারীর পাশে তৈরী করে নেয়া চালাঘরে। রাতে চলে চাঁদাবাজী, নতুন মাস্তান তৈরীর প্রশিক্ষণ, মালের আদান-প্রদান, আর ফুটপাতে বসতি গাড়া বস্তিবাসী জোয়ান মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি। প্রথম প্রথম এধরনের মৌজ-ফুর্তির জন্য পয়সা দিতো ওরা মেয়েগুলোকে, অথবা ওদের বাপ-স্বামীকে। ক্ষমতার স্বাদ বলে কথা। পয়সা না দিলেও কিছু করার নেই। এক সময় সেটাও বন্ধ করে দেয়। টিপু বলতো, "গতরও খাটামু, আবার পয়সাও দিমু, এইটা কোন কথা হইলো!" এটা ছিলো ওদের বন্ধুমহলে সবচেয়ে "হিট" ডায়লগ।
মাঝে মাঝে শুধু নেশা যখন খুব চুড়ায় উঠতো, টিপুর মুখে ভারী ভারী দার্শনিক কথার জোয়ার আসতো। চোখের কোণায় বালির মতো চিক চিক করতো শুষ্কপ্রায় জল। মিমির প্রসঙ্গ আসতো, টিপু বলতো, "আমি চোখ বুইঞ্জা কয়া দিবার পারি, এই মাইয়ার লাইগা ল্যাংলা-লুলা জামাইও পাওয়া যাইবোনা। কোন আবুলে এরাম জ্ঞানী বউ চায়, ক? হা হা হা।" টিপুকে খুশী করার জন্যই হোক অথবা "জ্ঞানী"দের উপর একচোট নিতে পারার কারণেই হোক, আশপাশের স্যাঙাৎরাও যোগ দিতো সেই হাসিতে।
অবশ্য মাঝে মাঝে, কদাচিৎই বলা চলে, পিজি হাসপাতালের করিডোরে কোন এক সকালের স্মৃতি মনে পড়লে হাউমাউ করে কেঁদে উঠতো টিপু, চিৎকার করে বলতো, "হারামজাদী, খাংকি, মাগী! আমি তো তরে বিয়া করনের প্রস্তাব দেইনাই। একটা থেংকসও কইতে পারলিনা! ভাবটা এমন চোদাইলি য্যান আমারে চিনবারও পারস নাই! খাংকি মাগির মায়রে বাপ্!"
২.
ক.
টিপুর ঘটনা বা আদ্যোপান্ত আর জানতে পারেনি কেউ। ওদিকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে নৃতত্ববিদ্যায় মাস্টার্স করে পিএইচডি করার জন্য ক্যানাডা চলে যায় মিমি। সদ্য বিবাহিত প্রবাসী বরের সাথে। কলোনীর লোকের মুখে মুখে প্রচন্ড ধুমধামের সাথে হওয়া সেই বিয়ের কাহিনীও ইতিহাস হয়ে ঘোরে। তবে এই ইতিহাসের সাক্ষী টিপু ছিলোনা। সে তখন কোথায় তা কেউ জানতোনা, জানার প্রয়োজনও বোধ করতোনা হয়তো। যদি না সামার ভ্যাকেশনে মিমি ঢাকায় বেড়াতে আসতো। যদি না ঠিক যে সন্ধ্যায় মিমির নানা-নানী দুর্ঘটনায় পড়েছিলেন, সেই সন্ধ্যায় মিমি নানাবাড়ীতে থাকতো।
গল্পটার শুরুটা এখানেই। খুব ছোট্ট একটা গল্প, যার জন্য টিপুকে নিয়ে এত বড় একটা ভূমিকা করতে হলো।
ছোট ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যাওয়া আফসার ভুঁইয়া যখন ফোনে শুনলেন যে তাঁর সবচেয়ে আদরের নাতনী মিমি দেখা করতে এসেছে, তখন বেশ খানিকটা হন্তদন্ত হয়েই বাসায় ফেরার জন্য রওয়ানা দেন। অনেকদিন পর আদরের নাতনীকে দেখার তাড়া। ঐ তাড়াহুড়োটাই গোলমাল বাঁধায়। বাসার গলির মুখের বড় রাস্তার অন্যপাশে রিক্সা থামিয়ে হেঁটেই এপাশে আসার চেষ্টা করেন নানা নানী। একটা প্রাইভেট কার মুহুর্তেই হুস্ করে চলে যায়। বীভৎসভাবে ধাক্কা খান বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দুজনেই, খানিকটা উড়ে গিয়ে ছিটকে পড়েন খোলা রাস্তার ওপর। দু'জন দু'দিকে।
গলির মুখেই সস্তা রেস্টুরেন্ট ধরনের জায়গায় প্রায় সারাদিন ধরে আড্ডা দেয় কয়েকটা ছেলে। এক নজর দেখেই বোঝা যায় এরা সব বখে যাওয়া "ডাইলখোরে"র দল। ওদেরই দু'জন, সাথে সাথে প্রাইভেট কারটিকে তাড়া করে। বাকী তিনজন বিদ্যুতের বেগে দৌড়ে এসে ঘিরে দাঁড়ায় রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে। যাতে অন্য কোন যানবাহন তাদের ওপর দিয়ে চলে যেতে না পারে। এদেশে কোন কিছুর নিশ্চয়তা নেই। ওদের দেখাদেখি গলির পাশের ফুটপাতে দাঁড়ানো আরো কিছু লোক এসে জড়ো হয় রাস্তায়। রক্তে ভেসে গিয়েছিলো বৃদ্ধ আফসার সাহেব অর্থাৎ মিমির নানা ভাইয়ের আশপাশটা। তাঁর মাথায় ভীষন আঘাত লেগেছে। নানীরও অবস্থা আশংকাজনক। অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। এ্যাম্বুলেন্স ডাকলে আসতে যে সময় নেবে অতটা সময় এরা বাঁচবে কিনা সন্দেহ।
বখাটে ছেলেগুলোর একজন নয়ন। হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠে, "আরে ধুর! বালের এ্যাম্বুলেন্সের লাইগা বইয়া থাকলে মুরুব্বীরে বাচান যাইবোনা।"
বলেই সে দৌড়ে যায় গলির মুখের সবচেয়ে কাছের বাসাটিতে। আদেশের সুরে বলে,"গাড়ীটা বাইর করেন, উনাগোরে হাসপাতালে নেওয়া লাগবো।"
প্রতিবেশীকে সহযোগিতা করা নিয়ে বাড়ীর মালিকের অনীহা ছিলোনা, তবে ড্রাইভার ছুটিতে থাকায় ভদ্রলোক কিছুটা কাঁচুমাচু শুরু করেন। ভদ্রলোককে পাত্তা না দিয়ে অনেকটা গায়ের জোরেই নয়ন বলে, "আরে গাড়ী চালানোর লোকের অভাব নাই, আপনে খালি চাবি লইয়া আসেন, যান!"
গৃহকর্তা কাঁপতে কাঁপতে চাবি আনতে ভেতরে যান। তবে ড্রাইভার নিয়ে ঝামেলা বেঁধে যায় ঠিকই। আশপাশে এতগুলো মানুষ, কেউ গাড়ী চালাতে পারেনা।
শেষমেষ বিশাল ল্যান্ডক্রুজারে রক্তাক্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে উঠিয়ে ড্রাইভিং না জানা নয়ন নিজেই গাড়ী চালানো শুরু করে। দূর্ঘটনার ভয়ে দুয়েকজন মিন মিন করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেন, নয়নের ধমকে চুপসে যেতে হয়।
"বিসমিল্লা কইয়া স্টাট দিছি, একটা কিছু হইবোই। বইয়া থাকলে তো কিছু হইতাছেনা, তাইনা আঙ্কেল?" লোকজনকে এরকম আরো কিছু নীতিবাক্য শুনিয়ে দিয়ে গাড়ী নিয়ে দেয় ছুট। বড় রাস্তায় পাগলা হাতির মতো এলোমেলো গতিতে সেটাকে ছুটে যেতে দেখা যায়।
খ.
পরদিন একদম ভোরে যখন মিমি তার বড় মামীর সাথে স্কয়ার হাসপাতালে চলে আসে, তখন আইসিইউর বাইরে অল্প কিছু দর্শনার্থীর মধ্যে নয়ন ছেলেটি তার চোখ এড়ায়না। আগের রাতেও সে এসেছিলো, কিন্তু হাজার মানুষের ভীড়ে সবাইকে তো আর খেয়াল করা যায়না। উনিশ বিশের বেশী বয়েস হবেনা, লম্বা গড়নের,ঋজু দেহভঙ্গী। ছেলেটিকে দেখে খুব খুশী হয়ে পড়েন মামী। বড় মামাকে ফোন করে বলেন, "শোনো, বাঁচা গেলো! তুমি ফাইয়াজকে আসতে মানা করে দাও। কালকের ছেলেগুলোর একটা এখনও আছে, ওকে দিয়েই বাড়তি রক্তের ব্যবস্থা করানো যাবে।"
ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা কাছাকাছি চলে আসায় হলে চলে যাওয়া ছেলেকে মামী জানতে দেননা দুর্ঘটনার কথা। ডাক্তাররা বলে রেখেছে বাড়তি রক্তের জন্য ডোনার ঠিক করে রাখতে। ফাইয়াজের বাবা চেয়েছিলো সকালে ছেলেকে পাঠাবে। কি হবে একবেলা পড়া নষ্ট হলে, তাছাড়া দাদা-দাদী তো নাও বাঁচতে পারে। কিন্তু ছেলের মায়ের এক কথা, দুনিয়া উল্টে যাক, পড়াশোনা নষ্ট হতে দেয়া যাবেনা। এই ইয়ারের রেজাল্টের ওপরই নির্ভর করছে ছেলের ডিপার্টমেন্টে টিচার হবার ব্যাপারটি। এখন হাতের কাছে নয়নকে পাওয়ায় ভদ্রমহিলা আর কোন কথা শুনবেননা।
নয়নের দিকে পাঁচশ টাকার দুটো নোট এগিয়ে দিয়ে বললেন কি কি করতে হবে। এগিয়ে দেয়া নোটদুটো দেখে ছেলেটি খানিকটা সংকোচ দেখায়, মৃদু কন্ঠে বলতে চায় যে ওসবের দরকার নেই। আবার পাশাপাশি "দিলোই যখন নিয়ে নিলে আগামী কয়েকদিন বিনা ঝামেলায় চলা যাবে", এমন চিন্তাও যে তার মাথায় খেলেনা তা না। শেষমেষ হেরে যায় বাস্তবতার কাছে, হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিয়ে রওনা দেয় সে।
কিন্তু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা মিমি স্পষ্ট দেখতে পায়, ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে এতক্ষণ ঋজু হয়ে থাকা ছেলেটির দেহভঙ্গী। কাঁধের কাছে মাথাটা যেন হঠাৎ করেই কড়াৎ করে ভেঙে ঝুলে গেছে। ধীর পায়ে লিফটের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছেলেটির প্রাণহীন হাঁটা দেখে তার মনে হয় করুণ একটা সুর বেজে উঠছে চারপাশে। সেই সুর কাঁধে বয়ে যাচ্ছে ছেলেটি, ধীরে ধীরে লিফটের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায় নয়ন।
ঠিক তখনই মিমি টের পায়, একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। এক ধরনের অস্থিরতা যে তীব্রভাবে গ্রাস করছে, বুঝতেপারে। তার মনে হয়, ছেলেটিকে আরেকটু সময় ধরে দেখার একটা অদ্ভুত সাধ হচ্ছে তার।
হঠাৎ কেন এমন মনে হচ্ছে সে যেন জানতে চায়না, তাই বিব্রত বোধ করে। তবে তীব্র ইচ্ছেটা টের পায়, বারবার। আর পারেনা মিমি। ধীরে ধীরে অস্পষ্ট কিছু স্মৃতি তাকে গ্রাস করতে থাকে। তার মনে পড়ে, পিজি হাসপাতালের করিডোরে এমনই এক সকাল, বাবার হার্ট এ্যাটাক, তাকে পাঁজাকোলে করে চারতলা থেকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা ছেলে। মিমির এখনও মনে পড়ে, লম্বাটে শুকনো গড়নের ছেলেটি চলে যাচ্ছে হাসপাতালের করিডোর ধরে বাইরের দিকে, নয়নের মতোই মাথা নিচু করে, ধীর লয়ে, করুণ অসহায় ভঙ্গিতে।
সেদিনের ছেলেটি কে ছিলো সেটা তার এখনও মনে আছে, এবং কোনদিন যে ভুলতে পারবেনা সেটাও সে ঠিকই অনুভব করে।
পিজি হাসপাতালের করিডোরে ডাক্তার টিপুকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, "উনি রোগির কি হন?"
জবাবে মিমি বলেছিলো, নির্বিকার মুখে, নিচু স্বরে, "কেউ না"।
টিপু কোন ক্ষোভ দেখায়নি সেদিন। নিরূপায় অসহায়ের মতো একটু একটু করে লিফটের দিকে সরে গিয়েছিলো।
আজ এতদিন পর ঠিক কি কারণে মিমি বুঝতে পারেনা, চোখের কোণায় জল জমে তার, স্বচ্ছ টলটলে হ্রদের জল। সে জানে একটু এদিক সেদিক হলেই এ জলের ধারা বন্ধ করা সম্ভব হবেনা। মস্তিষ্কের ভেতর হন্তদন্ত হয়ে সে খুঁজে বেড়ায় একটি পাথর, এক্ষুণি সবকিছু চাপা দিতে হবে।
তারপরও, অস্থির সেই কয়েকটা মুহূর্তে, তীব্র ইচ্ছে হয় তার, কাউকে ধরে জিজ্ঞেস করে, "টিপু ভাইয়ের কোনো খবর জানেন?"
স্কয়ারের পাঁচতলার করিডোরে টুপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে মিমি, অন্যদিকে মুখ লুকোয়।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১০ দুপুর ১:১০