পার্কের ছোট ছোট টোকাই বাচ্চাগুলোকে মিতা অনেক আদর করতো।প্রায় সকাল বেলা দেখাতাম ওদের জন্য পাউরুটি কিনে আনত।বাচ্চা দেখলেই মেয়েটা কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে উঠত।মেয়েটা পার্কে এসে বাচ্চা আর অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথেই সময় কাটিয়ে দিত।আশেপাশের পরিবেশ সমন্ধে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না।সকালের ঘণ্টাদুয়েক থাকার পর একটা লাল কারে উঠে চলে যেতো।রহস্যময়ী এই মেয়েটাকে আমি অনেক বোঝার চেষ্টা করেছি।কিন্তু মেয়েটা আগের মত দুর্বোধ্যই থেকে গেলো।ছোট্ট একটা অঘটন না ঘটলে মিতা হয়তো চিরদিনই আমার কাছে রহস্যময়ী থেকে যেতো।
সেদিন সকাল ভোরে চোখে ঘুম নিয়েই বাসা থেকে বেরিয়ে পরেছিলাম।শিশু পার্কের গেটের কাছে এসেই তীব্র চিৎকারে আমার ঘুম কেটে গেলো।দেখি মিতা একটা বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।আর ওর ওড়না রক্তে ভেসে যাচ্ছে।বাচ্চামেয়েটাকে মোটরসাইকেল চাপা দিয়ে গেছে।মিতার কান্না দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।আগে থেকে না জানলে হয়তো ভাবতাম এটা মিতারই বাচ্চা।একটা রাস্তার টোকাই মেয়ের জন্য কারো এতো মায়া থাকতে পারে আমার ধারনা ছিল না।মিতার কান্না সহ্য করার ক্ষমতা বিধাতা বোধহয় কাউকেই দেননি।আমিও তার বেতিক্রম নই।তৎক্ষণাৎ একটা সিনজি দেখে মিতাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে রওয়ানা দিলাম।৬ ঘণ্টা পর বাচ্চাটার চেতনা ফিরে এলো।এই ৬ ঘণ্টা মেয়েটা একবারও আমার দিকে ফিরে তাকালো না।এই ৬ ঘণ্টায় পুরো হাসপাতালের সব ডাক্তারকে এক করে ফেলল।ওকে দেখলে মনে হবে বাচ্চাটার কিছু হলে ও কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না।একটা সময় রাস্তার একটা টোকাইএর জন্য ওর ব্যাপারগুলো বাড়াবাড়ি মনে হল।এই ভেবেই বললাম... আসুন বাসায় পৌঁছে দেই।কিন্তু এই কথা শুনে আমাকে এমন ঝারি দিল যে আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম।৬ ঘণ্টা পর বাচ্চাটার হুঁশ ফিরলে ও যেন আমুল বদলে গেল।আমি যে ওর সাথে বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি সেটা বোধহয় ভুলেই গিয়েছিল।অগত্যা বাধ্য হয়ে আমি নিজেই যেচে পরে সবকিছু বললাম।সেদিন ওর চোখে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধটা আমার চোখে এড়ালো না।এরপর বেশ কয়েকদিন সকালে ওকে পার্কে দেখতে পেলাম না।কিছুদিন পর হাসপাতালে খোজ নিতে গিয়ে ওর দেখা পেলাম।এই কয়টাদিনে মায়াময়ী চোখদুটোর নিচে কালি পরে গেছে।হাসপাতালের ছাড়পত্র নিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে করে চলে যাবার সময় আমার দিকে একটু মুচকি হাসি দিয়ে গেল।আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম অদ্ভুত,রহস্যময়ী,মায়াবতী হেঁটে চলা পথের দিকে।
এরপর মিতাকে আর কখনো পার্কে দেখিনি।মেয়েটি আমার কাছে পুরোপুরিই রহস্যময়ী থেকে গেল।অবশ্য দেখা হবার তেমন সুযোগও ছিল না।১৫ দিন পর আমি চাকরীর স্বার্থে ২ বছরের প্রশিক্ষণে চলে গেলাম।তবে মেয়েটিকে কখনও ভুলতে পারিনি।মাঝে মাঝে মনে মনে ভাবতাম...এটাই কি তাহলে প্রেম?কিন্তু আমার মনে হতো এটা প্রেম না...বরং মেয়েটার জন্য আমার কোনে জমে উঠা চেপে থাকা পূজনীয় ভক্তি।আমার ট্রেনিং এর ছুটির দিনগুলোতে সকালের ঘুম জলাঞ্জলি দিয়ে সেই পার্কটায় মেয়েটাকে অনেক খুঁজেছি।কিন্তু তাকে আর খুজে পাইনি।কিন্তু আমার কেন যেন মনে হতো ওর সাথে একদিন আমার দেখা হবেই।
আমার মন আসলেই আমাকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়নি।আপুর চাকরীর জন্য মৌনতাকে সকাল বেলা ৩ ঘণ্টার জন্য একটা ডে-কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করানো হল।আমি বোনের বাসায় গেলে মৌনতাকে আমি ডে-কেয়ারে দিয়ে আসতাম।ওখানে গিয়েই মিতার দেখা পেলাম।ও আমাকে দেখে দৌড়ে এলো।জানতে চাইল এতদিন কোথায় ছিলাম আমি।ও জানালো রাস্তার আহত হওয়া সেই মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ধন্যবাদ দেবার জন্যই আমাকে এতদিন খুঁজে বেরিয়েছিল।মেয়েটা এই ২ বছরে আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। এরপর মাঝে মাঝে ডে কেয়ার সেন্টারে ওর সাথে কথা হতো।মাত্র ১৫ দিনেই মেয়েটা আমাকে আপন করে নিল।ওর সাথে দেখা না হলে হাসিহাসি,মায়াময়ী মুখটার আড়ালে যে অনেক গুলো দুঃখ লুকানো আছে তা হয়তো কোনদিনই জানা হতো না।ওর মা যখন ৩ মাসের গর্ভবতী তখন সার কারখানায় ইলেকট্রিক শকে ওর বাবা মারা যায়।আর ওর ৫ মাস বয়সে ওর মা শ্বাসকষ্ট রোগে হঠাৎ করেই মারা যান। এরপরের জীবনটা শুধু বৃদ্ধ দাদীর সাথেই কেটেছে।দাদীর সাথে প্রতিদিন সকালে পার্কে গিয়ে টোকাই ছেলেদের সাথেই কেটে যেতো তার সময়।
জানতে পারলাম ৬ মাস পর একেবারে এই দেশ ছেড়ে আমেরিকায় ফুফুদের ওখানে পারি জমাবে ও।ওর সাথে আমার হয়তো কোন সম্পর্ক নেই,তারপরও ওর জন্য আমার বুকে কেমন যেন শূন্যতার সৃষ্টি হল।একদিন বিকালে ও আমাকে বিএফসিতে ডাকল।আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাতদুটো ধরে বলল,আগামী ৬ মাস তাকে সবচেয়ে কাছের বন্ধুর মতো সময় দিতে পারব কিনা।ওকে ফিরিয়ে দেবার মত শক্তি আমার ছিল না।পরের ৬টা মাস আমরা রীতিমতো ডেটিং করে বেড়িয়েছি ঢাকা,গাজীপুর আর নারায়নগঞ্জের বস্তি আর এতিম খানাগুলোতে।প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত লাগলেও মেয়েটার বাচ্চাদের প্রতি ভালবাসা দেখে আমারও ভাল লাগা শুরু হল।প্রতিটাদিন অবাক চোখে ওর দিকে আবার নতুন করে মুগ্ধ হতাম।ওর বাবার রেখে যাওয়া টাকার অনেকটাই ওখানে খরচ করে ফেলল এইভাবে।বস্তির মাঝে যখন ঘুরে বেড়াতাম তখন মানুষ আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতো আমাদের দুজনকে।সাদা হিজাব পরা মিতাকে যেন মনে হতো সত্যিকারের মাদার তেরেসা।কমলাপুরের কোন একটা বস্তিতে দুটো ফুটফুটে জমজ দেখে মিতা আমায় বলেছিল...ওরও এমন দুটা ফুটফুটে জমজ হবে।
মিতা বাচ্চাদের অসম্ভব ভালোবাসতো।কোথায় যেন পরেছিলাম,যারা বাচ্চাদের সত্যিকার ভালবাসে তাদেরকে নির্দ্বিধায় ভালবাসা যায়।এটা হয়তো মনকে বুঝানোর জন্য বলি,কিন্তু তারপরও মিতার মধ্যে কি জানি একটা আছে যা আমাকে প্রতিনিয়ত ওর কাছে তারা করতো।আমি অনেক শক্ত ছেলে।হুট করে কারো প্রেমে যাওয়া আমার ধাঁতে নেই।মিতার ক্ষেত্রেও এর বেত্তয় ঘটেনি।কিন্তু ওর মনের নিস্পাপ ভালবাসার নহর গুলো দেখে একটা সময় আমি টের পেলাম,ওর জন্য আমি রীতিমত অন্ধ হয়ে গেছি।মাঝে মাঝে ওর সাথে পার্কে গল্প করতাম,তখন কারও কোলে বাচ্চা দেখলেই তার আর হুশ থাকতো না।মাঝে মাঝে এজন্য খুব মেজাজ খারাপ হতো।২টা মাস মনের সাথে একটানা যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে হঠাৎ একদিন কথার মাঝখানে ওকে আমার ভাললাগার কথাটা বলে বসলাম।শুনে মিতা এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন ভুত দেখছে।কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল।আস্তে করে সেখান থেকে উঠে চলে এলো।আমিও আর ওকে বিরক্ত করলাম না।ওইদিন রাতের বেলা কিছুতেই ঘুম আসছিল না।২টা সেডিল খেয়ে যেই না চোখ বুঝেছি,তখনি মিতার ফোন এলো।আমার হার্টটা যেন উত্তেজনায় গলায় উঠে আসছিল।ওর সাথে পরের ৩৩ মিনিটের কথা আমাকে অদ্ভুত শান্ত করে দিল।মনে হল মিতাকে ভালোবেসে আসলেই বাচ্চা মানুষের মতো ভুল করেছি।সে আজীবনের জন্য ছাড়ছে,এই দেশে তেমন কেউ নাই।অথচ আমি যে চাকরী করি তাতে দেশ ছাড়ারও সুযোগ নেই।সত্যি বলতে কি,মিতার যুক্তি মেশানো কথা আমাকে শান্ত করে দিয়েছিল ঠিকই।কিন্তু মিতা যে তার জীবনের সত্যিকারের নায়ক আমাকে বানাতে চায় না,সেটা আমি ঠিকই টের পেয়েছিলাম।
মিতা একেবারে চলে যাবে অথচ ওকে বিদায় দেবার মত সাহস আমার ছিল না। এজন্যই আমি কাজের অজুহাত দেখিয়ে আর ঢাকা গেলাম না।রাতের ৩ টায় মিতার ফ্লাইট।১১টা বাজলেই ইন হয়ে যেতে হবে।সাড়ে ৯ টায় মিতা আমাকে ফোন দিয়ে না আসার জন্য অনেক ক্ষোভ ঝারল।আমি সবই শুনলাম কিন্তু সত্যি বলার সাহস আমার ছিল না।আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম,মেয়েটাকি একটুও আমার কথা বুঝতে পারছে না।আমাকে বলল...তোর জন্য আমার হ্যান্ডিক্যামটা দিয়ে যাচ্ছি,কাল সকালের কুরিয়ারেই পেয়ে যাবা...আমি আর মিতার সাথে কথা না বাড়িয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।
সকাল থেকে আজ অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে।একেবারে কুকুর-বিড়াল টাইপ বৃষ্টি।রাতে আমার ঘুম হয়নি।ব্যালকনিতে একা একা বসে দেখছি। যেই বৃষ্টিকে এতদিন প্রকৃতির কান্না বলে ভেবেছি,সেই প্রকৃতই আজ আমার হয়ে কেঁদে নিচ্ছে।এতো দুঃখেও আমার হাসি পেল।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে ৯ টা বেজে গেছে।মিতার তো এতক্ষনে হিথরোতে পৌঁছে যাবার কথা।ঠিক সেই মুহূর্তেই মিতা ফোন করে ঠিকমতো পৌঁছেছে বলেই কেটে দিল।এতো অল্প সময়ে মিতা ফোন রেখে দেবে ভাবিনি।তাহলে কি মিতার আমাকে ভুলে যাবার এটাই শুরু?মনটা ভারী হয়ে উঠলো।বাইরে তখন বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে গিয়েছে।ঠিক ওই সময়েই কলিং বেলটা বেজে উঠলো।মিতার কুরিয়ারটা তাহলে মোক্ষম সময়ে মন খারাপ করার জন্য হাজির হয়ে গেছে।কুরিয়ার সার্ভিস আমার জন্য এতো সুন্দর একটা ডেলিভারি পাঠাবে,তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।আমার সামনে যে মিতা দাড়িয়ে আছে তা বিশ্বাস করতে ঝারা ৪ মিনিট সময় লাগলো।আমি এতো গাধা যে গ্রামীণফোন থেকে আসা কলকে আমেরিকার কল ভেবেছি।
বৃষ্টির মাঝে দুজন পাশাপাশি হাঁটছি।মিতাকে এখনও এরকম কাণ্ড করার কারনটা জিজ্ঞেস করিনি।মিতা নিজ থেকেই বলল...তোমার কাছে থেকে কখনই বুঝিনি তুমি আমার কে...কখনো তোমাকে প্রেমিক ভাবতে বড্ড বেমানান লাগতো।যখন তোমাকে কয়েকদিন আগে তোমাকে কল করে ফোনটা রাখার পরেই বুঝতে পারি তুমি আমার কে।ভেবে খুব কান্না পাচ্ছিল,তোমার সাথে আমার আর কখনও দেখা হবে না।২২ বছরের জীবনে তেমন কারো মমতা পাইনি।এই যে বিদেশে যাবো সেখানেও একদল যান্ত্রিক লোক আমার জন্য অপেক্ষা করছে।জীবনে কারো ভালবাসা পাইনি বলে হয়তো এতো কাছে থেকেও তোমার ভালবাসাটা বুঝতে পারিনি।নিজের বাচ্চা বয়সে কখনও ভালবাসা পাইনি বলে বাচ্চাদের ভালবাসার মধ্যেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখতাম।হাসান...তুমি পারবে না আমার কোল আলো করা ফুটফুটে দুটো এঞ্জেল এনে দিতে?...
বাইরে বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে গেলো।কথায় যেন বাজও পরছে। বাজের শব্দে চমকে গিয়ে মিতা আমাকে জড়িয়ে ধরল।বাজের শব্দ থেমে গেছে কিন্তু মিতার আর আমাকে ছেড়ে দেবার নাম নেই।বৃষ্টির ঠাণ্ডা জলের মাঝেও আমি আমার বুকে গরম জলের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করেছি।আর আমি?অবাক হয়ে দেখলাম আমার চোখেও পানি?নাহ, ছেলে মানুষ কাদে নাকি...যাহ...এটা অশ্রু না ...বৃষ্টির পানি ধার করে কাদছি আমি।আবার দূরে কোথাও বাজ পরল।আমার মায়ামাখানো মায়াবতী মিতা তখন আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে...
(আগামীতে এই গল্পের পরবর্তী পর্ব' ''সুপ্ত-সুপ্তির গল্প' প্রকাশিত হবে-অচেনা বালক
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সকাল ১০:৫৬