পূর্বের কিস্তিগুলো পড়ুন এখানে পয়লা কিস্তি দ্বিতীয় কিস্তি: নীলাচল পর্ব তৃতীয় কিস্তি: নীলগিরি পর্ব
নীলগিরি থেকে ফেরার পথে প্রায় ২৫/৩০ মিনিট পর ‘পিক-৬৯’। গাড়ি থামলো। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েছিলাম (কারণ: ক্লান্তিতে বেঘোর ঘুমোচ্ছিলাম)। রাস্তার সাথেই বড় করে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। এটি চোখে না পড়লে আপনি বুঝতেই পারবেন না যে, আপনার অবস্থান বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে উচ্চতম রাস্তায়। ডানে বামে দাঁড়িয়ে কিছু পোজ দিলাম। ব্যাস, আবার গাড়িতে।
এরপর আরো প্রায় ২৫/৩০ মিনিট পর গাড়ি থামলো ‘চিম্বুক পাহাড়’-এ। তখন আমরা সবাই ক্লান্ত। পাহাড়ে উঠতেও কষ্ট হচ্ছিলো। কোনমতে উঠলাম। কিন্তু এদিক ওদিক যাওয়া হলো না। নেমে পড়লাম। বন্ধুদের অনেকেই আবার এপাশ ওপাশ ঘুরেছে।
গাড়ী আবার চলতে শুরু করল। প্রায় ৩০ মিনিট পর আবার ব্রেক কষলো। এবার কাঙ্খিত এক জায়গায় পৌছুলাম। শৈলপ্রপাত। নাম শুনতেই কেমন যেনো- তাই না? হ্যা, ঠিক তাই। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরত্বে এর অবস্থান। যান্ত্রিক কোলাহল নেই। আছে জলের কলতান।
গাড়ী থেকে নেমে দেখলাম এক ‘পাথুরে নদী’। স্বচ্ছ জল। পাথরের বুক চিরে বেরিয়ে আসা জলের সমারোহ। প্রবল খরস্রোতে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। সমতল ধাপটি থেকে পরবর্তী ধাপটি হঠাৎই দেবে গিয়ে প্রায় চল্লিশ ফুট নিচু। দেখতে অনেকাংশে ‘ঝরনা’র মতো। গভীরতা অনেক। ‘সুইটি’ আমাকে আগেই সতর্ক করেছিলো- ঐ নিচু খাঁদে পড়ে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু। সেইমতে আমিও সবাইকে ‘সাবধান’ করে দিলাম।
অত:পর সমস্ত ক্লান্তি ঠেলে দিলাম- জলের বুকে। ভাসিয়ে দিলাম- বিমর্ষতা। অপার জলে।
এ জল সখ্যতায় আমার আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। ১৯৯৫ সালের কথা। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। স্বপরিবারে গিয়েছিলাম ‘কক্সবাজার’ ভ্রমণে। শুধু আমাদের পরিবারই না। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ/ছয়টি পরিবার একসাথে গিয়েছিলাম। সমুদ্র দেখলাম, গোসল করলাম। নুনতা জলের স্বাদও পেলাম। অত:পর একখানি ‘সানক্যাপ’ কিনলাম খুব শখ করে। ফেরার সময় ট্রেনের জানালা দিয়ে একটুখানি বাইরে তাকিয়েছিলাম। হু হু বাতাস অমনি আমার ‘সানক্যাপ’ উড়িয়ে নিয়ে গেলো। অত:পর আমার সে কি কান্না..! ‘সানক্যাপ’ চাই-ই চাই। পুরো কর্ম্পাটমেন্টই কাঁপিয়ে দিয়েছি। হ্যাঁ হ্যাঁ..। ততক্ষণে সবাই বুঝেছে, ‘সাধন’ কি চিজ..!
আজকে এতো কিছু মনে পড়ছে কারণ- এই শৈলপ্রপাতে অনেক অনাকাংখিত কিম্বা কাংখিত অথবা অতিবিরল কিছু ঘটনা ঘটে গেলো।
প্রথমত, অয়ন ভাই আমাকে পানি ছিটকে/খোঁচা দিয়ে পালাচ্ছিল। আমিও ধরার জন্য যেই উঠে দাঁড়ালাম ওমনি ধপাস করে পড়লাম। পাথুরে নীলজলে-পাথরে। কিঞ্চিৎ ব্যাথা পেলাম। ঘড়ির কাঁচটায় চিড় চোখে পড়লো। সেই চিড় ধরা ঘড়িটা শৈলপ্রপাতের দু’ফোটা পাথুরে জলকণা নিয়ে আমার বা’হাতে এখনো সক্রিয় (ইদানিং কিছুটা নিষ্ক্রিয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে)..!
দ্বিতীয়ত, আমাদের অনেকেই এক্সট্রা প্যান্ট নিয়ে আসেনি। সো, নোটন’দা একটা গামছা হাওলাদ করে নেমে পড়লেন। সেটি সম্ভবত গাড়ীর ড্রাইভারের কাছ থেকে ধার করা। অমন খরস্রোতা জলে ‘কচি’ গামছাটি ‘পট পট’ করে উড়ছিলো যেনো বাতাসে পতাকা উড়ছে কিম্বা নিল আর্মস্ট্রংয়ের চন্দ্রাভিযানের সেই মার্কিনী ঝান্ডার মতো। বুঝুন এবার, অবস্থা কি দাঁড়ালো..!!
তৃতীয়ত, সাইফুল ভাই। সে এক বিশাল কান্ড। লিখবো কি লিখবো না- সেইটাই ভাবছি। যাক্, লিখেই ফেলি- ওনার আন্ডারওয়্যার, সাইজে একটু বেশী। যেহেতু এক্সট্রা প্যান্ট আনে নি, সেইটাকে লতিয়েপেঁচিয়ে কোনোমতে নেমে পড়লেন। খরস্রোতা পাথুরে জল কি আর সেইটা বোঝে..?
জলস্রোতে ভেসে যখন ঝাঁপিয়ে পড়লেন মধ্যিখানের গর্তে (পানি গড়াতে গড়াতে এই জায়গাটি বেশ চওড়াকারে গভীর এক গর্তের সৃষ্টি করেছে যেনবা একটি কুয়ো/কুয়া) আমরা যারা বসে ছিলাম সেই গর্তের পাশে, সবাই হাত বাড়ালাম তাকে তোলার জন্য। দেখি সাইফুল ভাই শুধু হাতরাচ্ছেন আর কিছু একটা খুঁজছেন। পরক্ষণেই বুঝা গেলো- আন্ডারওয়্যার বাইপাস হয়ে গেছে...!!!
চতুর্থত, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সার্জারি ডির্পাটমেন্টের কিছু ইয়াং পোলাপানও আমাদের পেছনের সারিতে গোসল করছে। অয়ন ভাই হয়তো নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আর মনের অজান্তেই এমন এক ডিগবাজি খেলেন- গড়াতে গড়াতে শেষমেশ ‘সার্জারি’র মহিলিদের ‘পা’ ধরে রক্ষা মানে নিজেকে ঠেকালেন..!!!! হয়তোবা কানে কানে এও বলে এসেছেন যে, ‘ফুলটাইম ভ্যাকেন্সি, চাইলেই আসতে পারো..’
পঞ্চমত, জিনিয়াস প্রদীপ’কে এত্ত করে বললাম, ঝাঁপ দিন। কিন্তু গর্তের ভয়ে (হয়তোবা সাঁতার জানেন না কিম্বা দূর্ঘটনার ভয়) ঝাঁপ না দিয়ে উল্টো পালালেন আর এমন একজায়গায় ‘উষ্টা’ খেলেন যে, ১টন হরলিক্সের সেই স্ট্যামিনাতেও কাজ হলো না। কথায় আছে না, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়’। হাতটাও ফুলে গেলো তরতর করে..!!!!!
ষষ্ঠত, আমাদের দলের সবাই পরস্পরের প্রতি এমনভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম যে, যারা প্যান্ট আনে নি পরবর্তীতে আমাদের অনেকেই গোসল শেষে প্যান্ট সার্ভিস দিয়েছে তাদেরকে। অত:পর তারাও জম্পেশ গোসল করেছে।
এতোসব কিছুর বাইরেও আরো বিস্তর ঘটনা ঘটেছে। বিবরণ যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ এবং কিঞ্চিত বিব্রতকরও। বিধায়, বয়কট করলাম।
‘শৈলপ্রপাত’কে কেন্দ্র করে ছোটখাটো একটি ‘হাঁট’ গড়ে উঠেছে। দেখলাম বেশ জমজমাট। বিক্রেতাদের অধিকাংশই ‘বম’ সম্প্রদায়ের। বর্মিজ চন্দন ঠাসা গাল তথা ধবধবে সাদা মুখমন্ডলের বম তরুণী’রা বেশ সেজেগুজে হাসিমুখে আপনাকে স্বাগত জানাবে। শীতকাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন আদিবাসী পণ্য, ফলমুলসহ হস্তশিল্পের পাশাপাশি কারুশিল্পও আছে। ‘কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনব’ চিন্তা করতে করতে কিঞ্চিৎ দ্বিধাদ্বন্দে পড়বেন। একজনের সাথে কথা বলে জানলাম, শৈলপ্রপাতের একটু পরেই লাইমী পাড়া, মুন পাড়া। এগুলো বম বসতি।
বান্দরবানে বম অধ্যুষিত প্রায় ৫৪টি পাড়া আছে। ১৯৯১ সালের জরিপ মতে, জনসংখ্যায় প্রায় ৬৯৭৮ জন। তবে, বর্তমানে অধিকাংশ বম মনে করেন, সংখ্যাটি ১৫ হাজারের উর্দ্ধে হবে।
বম সমাজে ‘থলাইথার’ (নবান্ন উৎসব) অন্যতম। জুমের ধান কাটার পর সেই নতুন ধান দিয়ে রান্না করে আদি ধর্মীয় রীতি নীতিতে কলাপাতায় ভাঁত পেড়ে ভোজের আয়োজন হয়। এতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশ গ্রহণ করে। এই উৎসবই নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। এ মহাউৎসব আয়োজন ও উদযাপনে কোনরকম কমতি রাখেনা বম সমাজ। আগস্ট মাসের শেষ দিকে জুমের ধান কাটা শুরু হয় এবং শেষ হয় সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যেই। জুমের অন্যান্য ফসলাদি সংগ্রহও চলতে থাকে ক্রমান্বয়ে। বর্তমানে বম’দের অধিকাংশই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। তারা ঈশ্বরকে ‘লাল পা’ বলে সম্বোধন করেন।
পরবর্তী লক্ষ্য : স্বর্ণমন্দির।
স্পেশাল পর্ব : ‘ব্যাম্বো’ দ্যান ‘ট্রি’ আফটারদ্যাট ‘মুন্ডি’।
রচনাকাল: ২৮শে অক্টোবর, ২০১৩। ঢাকা।
চলবে....