পূর্বের কিস্তিগুলো পড়ুন এখানে-
মেঘ ছোঁব বলে মেঘের দেশে : পয়লা কিস্তি
মেঘ ছোঁব বলে মেঘের দেশে : নীলাচল পর্ব
মেঘ ছোঁব বলে মেঘের দেশে : নীলগিরি পর্ব
মেঘ ছোঁব বলে মেঘের দেশে : শৈলপ্রপাত পর্ব
‘শৈলপ্রপাত’ থেকে ফেরার পথে আমি তখন গাড়িতে বেঘোর ঘুমোচ্ছিলাম। কখন যে ‘স্বর্ণমন্দির’ পৌছেঁ গেছি তার হদিস পাইনি। ছোট্ট একটি সাইনবোর্ডে টাঙানো আছে, প্রবেশ মূল্য (উন্নয়নের জন্য) ২০টাকা জনপ্রতি। টিকিট কেটে প্রবেশ করার পর বুঝাই যাচ্ছিলো না, গোটা মন্দির স্বর্ণের বৈকি স্বর্ণ রংয়ের..!
পুরো মন্দির সোনালী রংয়ের। রোদে পুড়েও চিক চিক করছে। চোখে ধান্দা লেগে যাচ্ছে। সুন্দর কারুকাজ। চোখ জুড়ানো স্থাপত্যশৈলি। সুউচ্চ পাহাড়ের ওপর স্বকীয় প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।
কত যে রঙিন গাছ চিন্তা ক’রে শুরু আমি শেষ
সীমাহরণের পর আকাশ কোরো না
যে কোনও দানেই ছায়া লাগে
আমার সীমান্তপারে ঝরে নীল দিন
শরৎ শুকায়
বন্ধু তো অনেক গেছে, বেশ।
এবার শত্রুও হাতে গোনা।
এবার মুঠোয় এসে শুয়ে পড়েছেন
স্বয়ং রঙিন
জলে ভাসে অপার সান্ত্বনা!
[রঙ # জয় গোস্বামী]
মন্দির চূড়ায় উঠতে আপনাকে কমপক্ষে ৮০-১০০টি সিড়ি উঠতে হবে। রৌদ্রতাপে সিড়িগুলো যেনো কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। আমরা পা ফেলতে পারছিলাম না। গরমে যেনো পা পুড়ে যাচ্ছে। তবে সুন্দর পরিপাটি সাজানো গোছানো সিড়িতে কোথাও কিঞ্চিৎ পরিমাণ ময়লা চোখে পড়ে নি। তাই কষ্টেসৃষ্টে উঠে পড়লাম।
সিড়ি বেয়ে উঠার পর দেখা গেলো বিভিন্ন ভঙ্গিমায় প্রার্থনারত (দাঁড়ানো অবস্থায়) গৌতম বুদ্ধের মূর্তি, চর্তুদিকে। তারও পাশে সামনে ছোট ছোট আরো কিছু মূর্তি, বসে প্রার্থনারত। কোনটা শ্বেত পাথরের আবার কোনটা বর্নিল পাথরের। মূর্তিগুলোর প্রত্যেকের গায়ে ইংরেজীতে নাম লেখা আছে। যেমন: স্যাটার্ন। তন্মধ্যে শ্বেতপাথরের মূর্তিটা কেন জানি মনে হলো সবগুলো থেকে কিঞ্চিত আলাদা (আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর)।
ভ্রমণকারীদের চোখে চোখে রাখার জন্য দুজন যুবক ঘুরাঘুরি করছে মন্দিরের উপর। ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, মন্দিরের নামকরণ কেনো ‘স্বর্ণমন্দির’ হলো? কিন্তু কেউই সঠিক করে বলতে পারলো না বা তারা যা বলেছে আমার মোটেই বিশ্বাস হয়নি। যেমন: একজন বললো চুড়োর অলংকারটি নাকি স্বর্ণের। আরেকজন বললো, স্বর্ণের মতো রঙের বলে মন্দিরটিকে স্বর্ণমন্দির বলা হয়। আমি একটু আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মাঝের যে মুর্তিটি আছে সেটি কি পুরো স্বর্ণ দিয়ে তৈরী? সোজাসাপ্টা উত্তর, জানি না (প্রশ্নোত্তরে নাখোশ মনে হলো)। আমি এ মন্দির তৈরী থেকে শুরু করে আরো বেশ কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই পাওয়া গেলো না।
মন্দিরের ঠিক মধ্যিখানে যে মূর্তিটি আছে, তা দেখার সৌভাগ্য হয়নি বা দেখা যায়নি। দরজাগুলো খিল দিয়ে আটকানো। আমি কিঞ্চিত দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছিলাম, বড়সড়ো একটি মূর্তি আছে ওখানে।
মন্দিরের পেছনে একটি ‘ঘন্টা’ আছে। তার উপরে বসে আছে বিশাল আকৃতির একটি ‘ড্রাগন’। মুখ হা করে। এটি নিশ্চিত আপনার চোখে লাগবে। আমার বেশ ভালো লেগেছে। আরো একটু সামনে এগিয়ে গেলে দেখবেন, সুউচ্চ একটি ‘দন্ড’। এটি সম্ভবত একশো ফুটের উর্দ্ধে হবে। এতে একটি লম্বা পতাকা ঝুলানো, হয়তো মারমা সম্প্রদায়ের কিম্বা অখন্ড বৌদ্ধ ধর্মের কোন প্রতীকী চিহ্ন বা স্মারক..। এছাড়াও পুরো মন্দিরের চারপাশে অসংখ্য পতাকা সুতোয় টাঙানো আছে।
মন্দির ও মন্দিরের আশপাশে মোটামুটি মারমা সম্প্রদায়ের জনবসতি। ‘মারমা’ শব্দটি ‘ম্রাইমা’ শব্দটি থেকে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মারমা’রা মিয়ানমার থেকে এসেছে বলে এদেরকে প্রথমে ‘ম্রাইমা’ বলে ডাকা হতো। এই ‘ম্রাইমা’ শব্দটি থেকে ‘মারমা’ শব্দের উৎপত্তি।
মারমা’রা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মারমা সমাজ ব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক। পুরুষদের মতো মেয়েরাও পৈতৃক সম্পত্তির সমান উত্তরাধিকারী হয়। প্রধান উৎসব হচ্ছে, বৌদ্ধ পুর্ণিমা, কঠিন চীবর দান, ওয়াগ্যই, সাংগ্রাই ইত্যাদি।
২০১১ সালে পরিচালিত আদমশুমারি ও গৃহগণনা’র প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে মারমা সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যা ২,০২,৯৭৪জন (দুই লাখ দুই হাজার নয়শত চুয়াত্তর)। শিক্ষাদীক্ষায় মারমা সম্প্রদায় বেশ এগিয়ে বান্দরবান তথা চট্টগ্রামের অন্যান্য আদিবাসীদের তুলনায়।
সুইটি’র সাথে চলাফেরা অনেকদিনের। একসময় বেশ আগ্রহে মারমা ভাষায় কিছু শিক্ষা নিই। তার কাছ থেকে শেখা যে বাক্যটি এখনো জোরেশোরে মুখস্থ বলতে পারি তা হলো, ‘ঙা না’কো লরে’ । ভাবার্থ কি জানেন? আমাদের জাতীয় সংগীতের ‘দ্বিতীয় লাইন’। (বুঝছেন..?) পুরোপুরি মুখস্ত না হয়ে কাউকে বলবেন না, হিতে বিপরীত হতে পারে এবং ভাবার্থ পরিবর্তিত হয়ে অন্য কোন অর্থে চলে যেতে পারে। সো, সাবধান..।
একসময় আমিও, বহুভাষাবিদ সেজে আওড়াতাম কিঞ্চিৎ প্রয়োগও করেছি বটে।
পুনশ্চ: দায়ভার নিজ নিজ..
এইক্ষণে আমি আজকের মতো বিদায় নিলাম। আগামী পর্বটি সাংঘাতিকভাবেই স্পেশালপর্ব: ব্যাম্বো দ্যান ট্রি আফটারদ্যান মুন্ডি। ভ্রমণের সহিত রসনাবিলাসের সাংঘাতিক মিশ্রন..
রচনাকাল: ১-৪/১১/১৩, ঢাকা।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:২২