আট থেকে দশ ক্লাস উঠতে উঠতে তিন ভাগের এক ভাগ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে । বাকি যারা এখনো আছে, তাদের মনে হয় কোনদিনই বিয়ে হবে না । হলে তো এত দিনে হয়ে যেত! কে এদের বিয়ে করতে আসবে! একেকটা মুখপুড়ি, বদের হাড়ি । সারাদিন ক্লাসে বসে হাহা হিহি, আর বদ পুলাপানের সাথে কাগজ ছুড়াছুড়ি । বদমাশগুলো কত্ত আজেবাজে কথা লিখে দেয় । সেগুলো পড়ে রাগ করবে কি, একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে হেসেই খুন । রাজিবও বলে, দেখিস এদের কখনো বিয়ে হবে না, বাপের বাড়িতে হাড়িপাতিল মাজাই এদের নিয়তি । আমি রাজিবের সাথে কঠিন ভাবে একমত । রাজিব আমাদের ফার্স্ট বয়, আমি সেকেন্ড । আমরা দুজনে বন্ধু । সময় নেই অসময় নেই, ঐ ডাইনি বুড়িগুলি আমাদের এক সাথে দেখলেই খেপায়, বলে 'লাড্ডুগুড্ডু' !
সোহানা নামের অতি সুন্দরী তন্বী মেয়েটা ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়ে এলে দৃশ্যপট পাল্টে যায় । ডাকাবুকা বড় অফিসারের মেয়ে, আমাদের মফস্বলে বাপের পোস্টিংয়ের সুবাদে শহরের ইংলিশ মিডিয়াম ছেড়ে এখানে ভর্তি হয়েছে । প্রথম যেদিন এলো, সারা ক্লাস সুগন্ধে মৌ মৌ করছিল । রাজিব আমাকে কানে কানে বলে, সেন্ট মেখে এসেছে! ক্লাসের ধারি বুড়িগুলো চোখ কপালে তুলে ওকে দেখছে, যেন সামনে সাক্ষাৎ পরী! পরীইতো, সোহানার স্মার্টনেসের সামনে ওরা নিতান্তই ক্ষেত !
সোহানা কি জিনিস, তা সেদিন সারা ক্লাস টের পেয়েছিল । পেছন থেকে বদপুলাপান খিস্তি ছুড়ছিল- খাসা মাইরি, এক্বেরে তাল পাকা ! তাদের খিস্তি শুনে ক্লাসের অন্য মেয়েরা চাপা হাসির ঢেউ তুলেছিল । কিন্তু কিছু সময় পরেই পুরো ক্লাসে নেমে আসে কবরের নীরবতা! সোহানা উঠে দাঁড়িয়ে বদগুলোর দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে মিসাইল ছেড়েছিল, ডিজগাস্টিং ! ইউ অল আর বুলশিট !!
আমি আর রাজিব, আমাদের সাথেই সোহানার বন্ধুত্ব হলো! এর কার্যকারণ খুঁজে শেষে দুজনে যা পেলাম, ওর বাসা থেকে হয়ত বলে দিয়েছে ফার্স্ট-সেকেন্ডদের সাথে মেশার জন্য । সেদিন অন্তত প্রথম বারের মত সেকেন্ড বয় হতে পেরে গৌরব বোধ করলাম । ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সোহানা আমাদের শোনায় পিটারপ্যান আর এলিসের ফ্যান্টাসি । আমি মাসুদ রানা, আর রাজিবের দৌড় দস্যু বনহুর! আমরা নিজেদের মাঝে নোট বিনিময় করি । সোহানার চায়ের নিমন্ত্রণে ওর বাসায় যাই । নরম সোফার গদিতে রাজিব ঝিঝি ধরা পা নিয়ে মূর্তি হয়ে বসে থাকে । হাত ছলকে চা পড়ে ভিজে যাওয়া প্যান্ট আমি কৌশলে আড়াল করি । সোহানার প্রগলভতায় সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে । এক গাঢ় বন্ধুত্বে আটকে পড়ি আমরা তিনজন ।
সোহানাকে নিয়ে আমার সারাদিন ভাবতে ভালো লাগে । তাকে ভেবে ভেবে নিদ্রাহীন রাত কাটাই । তবে কি আমি সোহানার প্রেমে পড়েছি! প্রেমে পড়লে কি করতে হয় আমি জানি না । আয়নায় অনেকক্ষণ নিজেকে দেখি, নাকের নিচে গোফের সরু রেখা । হঠাৎ ঠোঁঠের কোণে হাসি খেলে যায় । সোহানার মত করে বলে উঠি 'দি আইডিয়া'! বাবার ড্রয়ার থেকে লুকিয়ে রেজর এনে শেভ হই, বাহ আমাকে দেখতে ঠিক বড় ভাইয়ার মত লাগছে!
সোহানার সামনে গেলে চুপসে যাই । মেরুদন্ড বেয়ে একটা শীতল শিহরণ নেমে আসে । খুব অস্থির লাগে, ব্যাপারটা রাজিবের সাথে শেয়ার করা দরকার । সোহানাকে কিভাবে প্রস্তাব করা যায়, রাজিব নিঃসন্দেহে ভালো কোন পরামর্শ দিবে । রাজিবকে নিয়ে হাটতে হাটতে নদীর ধারে যাই । ভনিতা না করে সব কিছু তাকে খুলে বলি । রাজিব কোন কথা না বলে চুপ করে শুনে যায় । হঠাৎ আমাকে বিদ্যুৎপষ্ট করে দিয়ে রাজিব শোনায়, সেও নাকি সোহানাকে ভালোবাসে! আমি বলি অসম্ভব, সোহানা আমার! রাজিব বলে, হতেই পারে না! আমি তাকে বলি বেঈমান, সে আমাকে বলে প্রতারক । অতঃপর পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে আমরা দুজনে বিপরীত দিকে হাটতে থাকি ।
সারারাত কেটে যায় নির্ঘুম । সকালে মা আমাকে দেখে অবাক হয় । গালে কপালে হাত দিয়ে বলে, জ্বর আসবে মনে হয় । স্কুলে না গিয়ে বাড়িতেই থাকি । মনটা বিষাদে ভারি হয়ে আসে । রাজিবকে খুন করতে ইচ্ছে হয় । ভাইয়ার শেলফ খুঁজে একটা পুরনো ফিতা ক্যাসেট বের করি । ট্যুইনওয়ান ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজে গান শুনি । মনের পর্দায় কেবলই সোহানার ছবি ভাসে । ক্যাসেটের সাথে গুনগুনিয়ে গাই, 'সুনি আজ কত দুরে.. সুনি আজ কত দুরে.. ! জগন্ময় মিত্রের কাঁপা কাঁপা ধীরলয়ের সুর আমার বুকে জমাট পাথরের মত বসে যায় ।
প্রবল আক্রোশে আবার মুখোমুখি হই রাজিবের, সেই নদীর পাড়ে । শেষে রাজিবই প্রস্তাব দেয়, 'দোস্ত নিজেদের মাঝে মনোমালিন্যের দরকার নাই । চল, দুজনে গিয়ে সোহানাকে বলি । সোহানা যাকেই পছন্দ করবে, আমরা তা মেনে নেব এবং আগের মতোই বন্ধু হয়ে থাকব' । আমি সাথে সাথেই রাজি হয়ে যাই । রাজিব শর্ত দেয়, 'আমরা এক সাথে দুজনে সোহানাকে প্রস্তাব দিব, তবে দুজন দুই ভাবে ।' আমি বললাম, 'তুই কিভাবে প্রস্তাব দিবি!' রাজিব জানায় সে সরাসরি ভালোবাসার কথা জানাবে । আমি বললাম, 'ঠিক আছে, আমি চিঠি দিয়ে প্রেম নিবেদন করব' ।
ঝুড়িটা দুমড়ানো কাগজে ভরে যায়, তবু আমার চিঠি লেখা হয়ে উঠে না । মনে কত ভাষা আসে, লিখতে বসলেই সব হাওয়া । উপায়ন্ত হয়ে বড় ভাই কাম দোস্ত হাকিম ভাইকে ধরলাম । হাকিম ভাই এ ব্যাপারে উস্তাদ শ্রেণীর, চিঠি লিখে লিখেই শিউলি আপাকে ঘায়েল করেছে । হাকিম ভাই সব শুনে বলে, 'ধুর, এটা কোন ব্যাপার হলো! আমি কালকেই লিখে দিচ্ছি ।' দুদিন পার হয়ে গেলেও হাকিম ভাইয়ের কোন পাত্তা নাই । শেষে টাইট দিয়ে ধরতেই বলে, কবি আসাদকে ধরে ছিলাম, ঐ ব্যাটা মুখের উপর না করে দিলো ।' আমি হাহাকার করে উঠি, ওকে কেন বলেছেন! হাকিম ভাই মাথা চুলকিয়ে বলে, 'ঐ ব্যাটাই তোর শিউলি আপাকে চিঠি লিখত, আমি জাস্ট মিডিয়া হয়ে ওগুলো পৌছে দিতাম । চিঠিতে কোন নাম থাকতো না, তাই শিউলি ভেবে নিয়েছে..' আমি বলি এসব কথা থাক, এখন উপায় কি বলো! 'শোন, কবি ব্যাটা গান শুনে শুনে চিঠি লিখত, গানের সুন্দর কথাগুলো জোড়াতালি দিয়ে চিঠিতে লিখে দিত । তুই ও তাই কর ।"
দিনরাত পড়ে পড়ে গান শুনি । বাংলা-হিন্দি-ইংলিশ কোন কিছুই বাদ দিই নি । আচ্ছা, সোহানা তো সারাক্ষণ ইংলিশে পটরপটর করে, ওরে ইংরেজিতে চিঠি লিখলে কেমন হয়! নিশ্চিত চমকে যাবে, আমার প্রস্তাবে সারা না দিয়ে পারবে না! 'ব্যাটা রাজিব, তোর একদিন কি আমার একদিন' বলে মোহাম্মদ রাফির একটা গজল ইংলিশে নিজের মত করে অনুবাদ করে নিলাম,
You may forget me,
this is your fundamental right!
But for me it is difficult,
As I am drawing in Love !!
হাকিম ভাই দেখে বললো মোটামুটি ঠিক আছে । তারপর কিছু কেটেকুটে দিয়ে বললো, 'এইবার হবেই হবে',,
You may ignore me,
this is your right!
But for me it is difficult,
As I am in Love !!!
ফুলের নকশা আঁকা 'মনে রেখো' প্যাডের পাতায় কথাগুলো লিখলাম । আমরা মফস্বলি, সেন্ট পাব কোথায়! আগরবাতি জ্বালিয়ে সুগন্ধি ধোয়া দিয়ে চিঠিটা মাখালাম । তারপর ভাজ করে বুক পকেটে রেখে রাজিবের কাছে ছুটে গেলাম । আমার প্রস্তুতি থাকলে রাজিবের কাজ পড়ে যায়, রাজিব যেতে চাইলে আমার টেনশন বেড়ে যায় । এভাবে তিন চার দিন যাওয়ার পর একদিন সাহস করে চলে গেলাম সোহানাদের বাসার সামনে । কিন্তু কারোই সোহানাকে ডাকার সাহস হলো না । ঠিক আছে আরেকদিন আসব, বলে দুজনেই পিছুটান দিলাম ।
এভাবে সপ্তাহ পার হয়ে যায় । একদিন বৃষ্টিতে চিঠি ভিজে যায়, লন্ঠনের কাঁচে রেখে চিঠিটা শুকিয়ে নেই । আরও একপ্রস্ত আগরবাতির ধোয়া দিয়ে ওটাকে তাজা করে নেই । পকেটে থেকে থেকে কাগজে কালচে দাগ পড়ে গিয়েছে । শেষে একদিন ফাইনাল করে ফেললাম । আমরা দুজন সোহানাদের বাড়ি গিয়ে ওকে ডাকালাম । বুকের ভেতর ডিবডিব করে শব্দ হচ্ছে । সোহানা এলে আমরা তিনজনে মিলে নদীর কাছে গেলাম । রাজিবের প্রথমে প্রস্তাব করার পালা । ঝিরঝির বাতাসে সোহানার চুল উড়ে যাচ্ছে, আর রাজিব ক্রমাগত ঢুঁক গিলে যাচ্ছে । আমি রাজিবকে ইশারা দিই তাড়াতাড়ি বলার জন্য । রাজিব হঠাৎ পেটের কাছে দুহাত নিয়ে মোচরাতে থাকে । সোহানা উতলা হয়ে উঠে, কি হলো কি হলো! রাজিব বলে, শরীর খারাপ লাগছে, আমি যাই । আমি সোহানাকে বলি, ছাড়ো তো, ওর এরকম প্রায়ই হয় । একবার পরীক্ষার প্রশ্ন কমন না পড়ায় রাজিব প্যান্ট ভিজিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল । শোনে সোহানা হো হো করে হেসে উঠে, সাথে সাথে আমার পালপিটিশন দ্বিগুন বেড়ে যায় ।
অতঃপর আমার পালা । সোহানার সাথে কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে পকেট থেকে চিঠিটা বের করি । ওটা দেখেই সোহানা বলে উঠে, 'এটা কি? দেখি দেখি! প্রায় ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নেয় । তারপর দুহাত দিয়ে চিঠিটা মেলে ধরে চোখ বড় বড় করে পড়তে থাকে । আমার সারা শরীর দিয়ে ঘাম বের হতে থাকে । সোহানার দিকে তাকিয়ে ওর চোখের সংকোচন-প্রসারণ দেখতে থাকি । একগাল হাসি দিয়ে সোহানা বলে, 'সুমন, এটা কি? কিছুই পড়তে পারছি না..
আমি মৌনব্রত অবলম্বন করি । সোহানা আমার দিকে গোল গোল চোখ নাচিয়ে বলে, 'ও বুঝতে পেরেছি, তুমি রত্ন পাহাড়ের খোজে ট্রেজার আইল্যান্ড যাবা! আর এটা হলো 'ম্যাপ অব দ্য ট্রেজার আইল্যান্ড' !!
আমার কান দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছে । বুকের ভেতর থেকে বরফের চাঁই যেন গলা বেয়ে উপরে উঠছে । এখনি চোখ বেয়ে নামবে জলের ধারা । সোহানা হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে, 'হায় হায়! ধরো ধরো, তোমার 'ম্যাপ অব দ্য ট্রেজার আইল্যান্ড' বাতাসে উড়ে গেল..
আমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখি আমার প্রথম ভালোবাসার ছিন্নপত্র নদীর স্রোত বেয়ে এগিয়ে চলেছে নিরন্তর পথে ।
ম্যরাল অব দ্য স্টোরিঃ প্রেমের চিঠি ভালো মানের কাগজে লিখবেন এবং অবশ্যই নীল খামে পুড়ে রাখবেন


কৃতজ্ঞতাঃ 'কাল্পনিক_ভালোবাসা' । আজকে দুপুরে ফোনে আলাপ না হলে বর্ষপূর্তির কথা হয়ত মাথায় আসতো না । ছবিটাও সে সংগ্রহ করে দিয়েছে ।
গল্পের ধারণা নিয়েছি আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস রিসার্সের অধ্যাপক 'দিব্যজিৎ ভট্টাচার্য'র কাছ থেকে । আমাদের ক্যাম্পাসে তিনি বেশ কয়েকটি সেমিনার করেছেন । "Never use poor quality paper to write research questionnaire" বিষয়ক বক্তৃতায় তিনি তার নিজের বানানো একটা ছোট এনিমেশন মুভি দেখিয়েছেন । দশ মিনিটের ছোট মুভি'র উপর ভিত্তি করে আমি এই গল্প লিখেছি ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৪ রাত ১০:০৪