somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমারে তুমি অশেষ করেছ…

১৩ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘আমি ঘরে ফিরে এলাম। গ্লাস ভর্তি পেপসি, সাথে কিছু বরফও ভাসছে। দুধকে পেপসি বানানোর মন্ত্র তাহলে সত্যি আছে? আমি দৌড়ে বাইরে বের হলাম। দারোয়ান শুধু বলতে পারল একটা ছেলেকে সে শিষ দিতে দিতে রাস্তা দিয়ে চলে যেতে দেখেছে…’

এই লাইনগুলি কতদিন আগে পড়া? বারো বছরের বেশী তো হবেই। কিন্তু মনে হয় যেন এই সেদিন পড়েছি। আমার মস্তিস্ক এতদিন ধরে এই লাইনগুলি সযত্নে সংরক্ষণ করে চলেছে। কিন্তু কেন? এই লাইনগুলি আমাকে আমার ছেলেবেলায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে এই কি তার কারণ? এই লাইনগুলা তো শুধু গল্পের লাইন নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে ছোটবেলার ফেলে আসা মফস্বল, বাড়ির ছাদ, স্কুল, আম্মুর হাতের মার, পেছনের পুকুরে পড়ে যাওয়া টেনিস বল…আরও কত কি! আর হ্যাঁ, এবং অবশ্যই একটি ধূসর মলাটের গল্পের বই। বইটির নাম – ‘মজার ভূত’। লেখক – ‘হুমায়ূন আহমেদ’। আমাদের অতিপ্রিয় হুমায়ূন স্যার। যিনি ভূতের মত ভয়ঙ্কর একটা জিনিসের মধ্যেও মজা ছড়িয়ে দিয়ে আমার ছেলেবেলাকে কল্পনার রঙে রঙিন করে তুলেছিলেন।

একটা মেয়ে বসে আছে, চুলগুলো উড়ছে, বেশ বড় একটা ফাঁকা জায়গা। বাবা বলেন, ‘এইটা তেঁজগাও এয়ারপোর্ট’। আমি সোজা হয়ে বসি, শুরু হচ্ছে ‘বাকের ভাইয়ের নাটক’, এখন বাকের ভাইকে দেখাবে। দাঁড়িওয়ালা লোকটিকে বড় ভাল লাগে আমার। দড়ি জাতীয় কিছু হাতে পেলেই নিজেকে বাকের ভাই বলে মনে হয়। ‘হাওয়ামে উড়তা যায়ে, হাওয়ামে উড়তা যায়ে’ এমন সুর তুলতে তুলতে আমি দড়িটিকে আঙ্গুলে ধরে নিয়ে একবার ডানে একবার বামে ঘুরাতে থাকি। দিন কেটে যায়। হঠাৎ শুনি বাকের ভাইয়ের নাকি ফাঁসি হয়ে যাবে। এ আবার কেমন কথা? আমার শিশুমন মানতে চায় না। বড়রা সবাই দেখি এটা নিয়ে আলোচনা করে। মন খারাপ করে টিভির সামনে বসি। অনেক লোকজন, এর মাঝে বাকের ভাইকে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বোঝা গেল যে তার ফাঁসি হয়ে গেল। মনে হল যেন জীবন থেকে একটা আনন্দ হারিয়ে গেল।

এবার আমি কিছুটা বড় হয়েছি। শোনা গেল আবার হুমায়ূন আহমদের নাটক হবে টিভিতে। এই নাটকের নাম ‘আজ রবিবার’। মোটা চশমা পরা একটা লম্বু ছেলে প্রতিবার সিঁড়ির এক জায়গাতে হোঁচট খায়। এর ব্যাপারটা বুঝে ওঠার পর তাকে সিঁড়ির দিয়ে উঠতে দেখলেই আমি বাবা-মা’কে চমকে দিয়ে চীৎকার দিয়ে উঠি – ‘এইবার পড়ে যাবে, পড়, পড়, হা হা হা’। ন্যাকা গলায় সেই ‘তিতলী ভাইয়া কঙ্কা ভাইয়া’ ডাক এখনও যেন কান পাতলে আমি শুনতে পাই।

আমার ছোটবেলার হাউজ টিউটর জন প্রভুদানের কল্যাণে দেশী বিদেশী শিশুসাহিত্য আমি প্রচুর পড়েছি। আমার আম্মুর অভিযোগ এইজন্যই নাকি স্কুলের বই পড়ার ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই, আমি নাকি শুধু গল্পের বই পড়তে চাই। তখন বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। কোন কিছুই তেমন ভাল লাগে না, বাবা-মা’র কথাও শুনতে ইচ্ছা করে না। নিজের মত থাকতে মন চায়। নতুন বাসার বুক শেলফে অনেক বই সাজানো ছিল। সেইখানে আমি কিভাবে যেন ‘পারাপার’ নামের একটা বই আবিষ্কার করলাম। এটা যে কিভাবে আমাদের বাড়িতে এসেছিল সেটা আমি আজও জানি না। যেহেতু হুমায়ূন আহমেদের বই, ভাবলাম পড়ে দেখা যাক। পড়লাম এবং পড়ে পাগল হয়ে গেলাম। হিমু নামের একটা ছেলে, এ তো আমার স্বপ্নের চরিত্র, আমি তো এমনই হতে চাই। শেষ লাইনটা ছিল- ‘আমার মনে হল পৃথিবীর সব নারীই রূপা আর সব পুরুষই হিমু’। অসাধারণ। এরপর আর কোন কথা নেই, বাছাবাছির বালাই নেই, মলাটে হুমায়ূন আহমেদ লেখা থাকলেই গ্রোগাসে গিলতে থাকি। পরে দেখা গেল যে এই হিমু ছেলেটাকে নিয়েই আরও গল্প আছে। অনেক মান-অভিমান করে আম্মুকে রাজী করিয়ে একটা পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবী বানিয়ে নিলাম। এই হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে চড়িয়ে আমি দুপুর রোদের মধ্যে হেঁটে বেড়াই, কেমন যেন উদাস উদাস লাগে, নিজেকে হিমু বলে মনে হয়। এরপর আস্তে আস্তে মিসির আলী, শুভ্র এদের সাথেও আমার বেশ ভাল জানা পরিচয় হয়ে গেল।

হুমায়ূন স্যারের সাথে আমার একবারই দেখা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, আমার প্রথম একুশে বইমেলাতে। যতদূর মনে পড়ে সেদিন বৃহস্পতিবার, তাই বইমেলাতে বহু নামকরা ব্যাক্তিদের আনাগোনা। আমি একটা নীল রঙের ডায়েরী নিয়ে অটোগ্রাফ শিকার করে বেড়াচ্ছি। অন্যপ্রকাশের সামনে বিশাল ভিড় আর ঠেলাঠেলি। অনেকভাবে দেখেশুনে নিশ্চিত হলাম যে, স্যার অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। বহুকষ্টে লাইনের শেষ খুঁজে পেয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। বহু প্রতীক্ষা শেষে লাইনের সামনে পৌঁছে স্যারকে সামনাসামনি দেখে কেমন জানি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি নাম?’। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত আমার নাম বললাম। স্যার খসখস করে কিছু লিখলেন, আমি ডায়েরীটা ফেরত নিলাম। ভিড় ঠেলে বাইরে এসে মনে হল বিশ্বজয় করে এসেছি। ঘুরিফিরি আর বারবার ডায়েরীর পাতা উল্টিয়ে স্যারের অটোগ্রাফটা দেখি। সে এক বড়ই আশ্চর্য অনুভূতি।

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে, সাম্প্রতিককালে স্যারের লেখা পড়ার সেই প্রচন্ড আগ্রহটা হয়ত ছিল না, কিন্তু এটা খুবই সত্যি যে আমার ছেলেবেলা থেকে কিশোর-যৌবনকালকে তিনি তার লেখনী দিয়ে উপভোগ্য করে তুলেছিলেন। তার লেখা পড়ে একধরণের তৃপ্তির ঘোর নিয়ে বড় হয়েছি। বারবার তাঁর বিভিন্ন লেখায় আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি, নিজের জীবনের স্বপ্নকে দেখতে পেয়েছি তাঁর লেখা বইয়ের পাতায়।

স্যার, আপনি কি দেখছেন যে আপনার অনুপস্থিতিতেও গনগনে মধ্যদুপুরের ঢাকার রাস্তায় হিমুরা উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে বেড়ায়। কিন্তু তাদের কোন ছায়া পড়ে না। মধ্যদুপুরে কারও ছায়া পড়ে না। স্যার আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন যে ঝুম বৃষ্টিতে অসংখ্য রূপা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে হিমুদের অপেক্ষায় কেঁদে যায়। কিন্তু তাদের অশ্রু কেউ দেখতে পায় না। বৃষ্টিতে কারও অশ্রু দেখা যায় না।

স্যার, আপনার কোন একটা বইয়ের শুরুতে আপনি রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলো লিখেছিলেন। আজ আপনার জন্মদিনে সেই লাইনগুলোই আপনাকে বলতে চাইঃ

আমারে তুমি অশেষ করেছ
এমনি লীলা তব ।
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ
জীবন নব নব।

শুভ জন্মদিন হুমায়ূন স্যার।।


এই লেখাটি সাপ্তাহিক এর বর্ষ ৫ সংখ্যা ১৭ কিংবদন্তী শিল্পী হুমায়ুন আহমেদ এ প্রকাশিত। স্যারের জন্মদিনে ঈষৎ পরিবর্তন করে ব্লগে প্রকাশ করলাম।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:১১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×