বিভ্রান্তির নিরসন : কোরবানির টাকা কুরবানি না দিয়ে দান করা যাবে কি না ?
দেশে ফেতনা ফাসাদের অভাব নাই। একটা ফেতনা ঘুচায় তো আর একটা নতুন ফেতনা (বিশৃঙ্খলা) তৈরি হয়। নিত্য নতুন ফেতনার বিভ্রান্তিতে সহজ-সরল মানুষের ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায়, বিশুদ্ধ জীবনাচারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ইলমে দ্বীন শিক্ষার কোন বিকল্প নাই-অন্তত যারা সুস্থ মানবিক জীবনবোধ প্রত্যাশা করেন তাদের জন্য।
পৃথিবী ব্যাপি কভিড-19 বা করোনা ভাইরাস নামক মহামারিতে বিপর্যস্ত সর্বস্তরের মানুষ। মানব সৃষ্টির ইতিহাসে এমন পরিস্থিতির শিকার কোন মানুষ না হয়েছে, না কোন অন্তর এমন ভয়াবহতার কথা চিন্তা করেছে। এই রূপ পরিস্থিতিতে অসহায় দরিদ্র মানুষের অসহায়তা গুছাতে আসন্ন পবিত্র ঈদ-উল-আযহাকে সামনে রেখে দানশীল কতিপয় মানুষের মনে প্রশ্ন উদয় হয়েছে যে, কুরবানির টাকা দান করা যাবে কি না? উদ্ভুত প্রশ্নকে সম্মুখে রেখেই আলোচনার অবতারনা। আশা করি ভ্রান্তি ও ত্রুটি নিরাময়ে এই আলোচনা সহায়ক হবে, ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্নটির ভাববোধ 02 রকমের হতে পারে।
1) নিজের জন্য নির্ধারিত কোন সুবিধা নিজে গ্রহণ না করে তার অর্থ অভাবগ্রস্থকে দান করা যাবে কি না? (নিজে সুবিধা না নিয়ে তা অন্যকে দান করাও এক অর্থে কুরবানি)
2) কুরবানির পশুর দাম (পশু জবাই অর্থে কুরবানি) অভাবগ্রস্থকে দান করা যাবে কি না?
প্রথমোক্ত ধারণাটি অত্যন্ত সাদামাটা এবং এর উত্তরও সহজেই বোধগম্য। কেউ যদি তার মালিকানায় থাকা কোন পরিমাণের অর্থ বা কোন বস্তু হতে সুবিধা গ্রহণ না করে তা এমন কাউকে দান করেন যার দরকার, তাহলে সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। দান-খয়রাত ও পশু কুরবানি দুটি সতন্ত্র বিষয়। দান করার বিষয়ে হাদীসে তাগিদ এসেছে এবং এর বরকতও প্রকাশিত বেসুমার। রাসুল (স) বলেন- “তোমরা খোরমার একটি টুকরা দান করিয়া হইলেও তাদ্দারা দোযখের আগুন হইতে রক্ষা পাইবার চেষ্টা কর।” অপর হাদীসে বলেন, “তোমরা ছদকা খয়রাত দ্বারা আল্লাহর নিকট রুযির বরকত তালাশ কর।” অপর হাদীসে বলেন, “ নিশ্চয়ই দান খয়রাত কবরের আযাব হইতে রক্ষা করিবে। নিশ্চয় হাশরের ময়দানে দানশীল মুসলমান দান খয়রাতের ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করিবেন।”
[দান করা যায় প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে, সবাই আল্লাহ জানেন ও দেখেন]
যার অর্থ-সামর্থ্য আছে তিনি দান করবেন, দান যে কোন সময় যে কোন পরিস্থিতিতে করা যায়। এর জন্য কোন দিন-ক্ষণ-মৌসুম লাগে না। যা লাগে তা হলো দান করার মানসিকতা। পক্ষান্তরে কুরবানি (পশু কুরবানি) করা হয় আরবী জিলহজ্জ মাসের 10 তারিখ হতে 12 তারিখের সন্ধ্যার মধ্যে।
কে কুরবানি করবে?
যার উপর ছদকা ফেতর ওয়াজিব তার উপর কোরবানী করা ওয়াজিব।
কে দান করবে ? দান ছদকা যে কোন বয়সের যে কোন ব্যাক্তি যে কোন সময়ে যে কোন পরিমাণে করতে পারবেন।
কে কুরবানি করবে না ?
যে ব্যক্তি মালদার নয় অর্থাৎ নেছাব পরিমাণ মালের মালিক নন তার উপর কোরবানী করা ওয়াজিব নয়। আর্থিক সঙ্গতিহীন ব্যক্তি জিলহজ্জ মাসের নির্দিষ্টি দিনগুলোতে শরীরের নক ইত্যদি অংশ না কেটে বরং তা ঈদুল আযহার সালাতের পরে কাটলে কুরবানির সওয়াব হাসিল করার কথা কিতাবে উল্লেখ আছে।
মহান আল্লাহ পাক অসামর্থবানকে কুরবানির হুকুম চাপিয়ে দেননি। কিন্তু কুরবানি দিতে অসামর্থবান মানুষও দান করতে পারে। কিছুদিন আগে ঢাকায় একজন ভিক্ষুককে দেখা গেছে করোনায় গরীবদেরকে ত্রান সাহায্য দিতে। এমনি ভাবে একজন গরীব-দুখি-মিসকিন যিনি দিনে এনে দিনে খান তিনিও দান করতে পারেন তার সামর্থ্য অনুযায়ী কিন্তু তিনি কুরবানি দিতে পারেন না। অর্থ-কড়ি দান করা আর পশু কুরবানি করা (পশু কুরবানির গোশতের একটা অংশও দান করা হয়- উৎসাহীরা চাইলে পূর্ণ অংশ দান করে দিতে পারেন) র তাৎপর্য ও পার্থক্য জ্ঞান না বুঝলে সিদ্ধান্তহীনতার গোলক ধাঁধায় ঘুরপাক খেতে পারেন-সন্দেহ নেই। মন দিয়ে একটু ভাবলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়।
[কুরবানির পশু যতদূর সম্ভব মোটা তাজা ও সুস্থ সবল হওয়া চাই]
যারা চাচ্ছেন এমনটি তাদের জন্য পরামর্শ :
যাদের মননে কুরবানি না করে কুরবানির টাকা দান করার চিন্তা এসেছে তাদের জন্য পরামর্শ এই- যে অর্থ কুরবানির জন্য বাজেট করবেন তা দিয়ে কুরবানি দিন এবং কুরবানির গোশত পুরোটাই গরীবদেরকে দিয়ে দিন। এতে করে আপনার কুরবানির হুকুমও আদায় হবে আর পালন করা হবে একই সাথে দানও করা হবে। এখন আবার প্রশ্ন করবেন না- তাহলেতো গরীবদেরকে টাকা দান করা হলো না। টাকাই দান করতে হবে এমন কোন নির্দিষ্টতা শরিয়তে নাই। টাকা, খেজুর, ব্যবহারর্য জিনিসপত্র যেকোন কিছুই মুক্ত হস্তে দিলে তা দান বলেই গণ্য হবে।
কুরবানিতে রয়েছে মুসলমানের জন্য শিক্ষনীয় ছবক :
সালাত, সাওম, হজ্জ, যাকাতের মতো কুরবানিও একটি নির্ধারিত সময়ের নির্ধারিত এবাদত। সালাতের পরিবর্তে যেমন রোযা রাখলে হয়না, রোযার পরিবর্তে যেমন হজ্জ করলে হয়না, যাকাতের পরিবর্তে যেমন হজ্জ বা সাওম আদায় করলে হয় না তেমনি কুরবানির টাকা দিয়ে কুরবানি না দিয়ে তা দান করলে কুরবানি আদায় হবে না। পক্ষান্তরে জিলহজ্জ মাসের কুরবানিতে রয়েছে মানবজাতির জন্য শিক্ষনীয় ছবক। ইব্রাহিম (আ) মহান আল্লাহর নির্দেশে পুত্র ইসমাইলকে জবাহ করার যে তৎপরতা তাতে শিক্ষনীয় এই যে, মহান আল্লাহর হুকুম হলে স্বীয় জান-মাল-প্রিয় বস্তু এমনকি সন্তানকেও কুরবানি দিতে হবে। এতে কোন দ্বিধা করা যাবে না। এই ধরণের কর্মতৎপরতা শুধুমাত্র ঈমানওয়ালা আল্লাহ প্রেমিকের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। সুতরাং কুরবানির যে শিক্ষা ও ফজিলত তা কুরবানির পরিবর্তে দান করাতে নয় বরং কুরবানিতেই পাওয়া সম্ভব। অপরদিকে দুনীয়ার মোহে পড়ে আমরা ইসলামের মহান শিক্ষা ভুলে যেন না যাই সেই গুরত্ব থেকেই প্রতি বছর কুরবানির নির্দিষ্ট ক্ষণ উপস্থিত হয় এবং জরুরী আমলের অনুশীলনে উৎসাহ যোগায়।
পুনশ্চ : কুরবানির অর্থ দিয়ে কুরবানির পরিবর্তে দান করলে দানের সাওয়াব পাওয়া যাবে কিন্তু কুরবানি না করায় কুরবানির ওয়াজিব আদায় হবে না, গুণাহগার হবে।
আল্লাহ সবাইকে সহিহ বুঝ দান করুন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০২০ সকাল ৯:৫৫