somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফসলের মাঠে শোনাবো তোমায় জন্মভূমির গান

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ১২:২৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমাদের দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ আজকাল আন্তর্জাতিক হয়ে গেছে । আন্তর্জাতিক ইস্যু ছাড়া তারা কথাই বলে না, আন্তর্জাতিক ঘটনার উদাহরণ ছাড়া তাদের মুখে আর কিছুই রোচে না ।

যারা দেশি পণ্য ফেলে বিদেশি পণ্যে ঘর ভরেন, কিংবা ইদে-চান্দে কাতার-সিঙ্গাপুর থেকে মার্কেট করে আসেন, তারপর বিদেশি পাজামায় বাংলাদেশি নেওর লাগিয়ে দ্যুলোক-ভূলোক-গোলক ভেদিয়া খোদার আরশ পর্যন্ত ছেদনের পাঁয়তারা করেন—তাদের কথা বলছি না । এমনকি বাংলাদেশি সাড়ে সাতান্নটা চ্যানেল ডিঙ্গিয়ে যারা এইচবিও-স্টারমুভিজে বুঁদ হয়ে থাকেন, তারাও বাদ । যারা বিদেশি বইপুস্তকের অনুবাদে সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধন করেন, তাদের প্রতিও আমার কোনো খেদ নেই—নিশ্চিত থাকেন ।


বলছি সেইসব বুদ্ধিজীবীর কথা, সারা বিশ্বের কল্যাণ ভাবনায় যারা কাতর এবং মানুষের দু:খে দু:খে অবশেষে পাথরবৎ হয়ে গেছেন—তাদের দিকে তাকান । দেখবেন, তারা সবাই এখন বেজায় আন্তর্জাতিক । তাদের লেখাজোখা, কর্মকাণ্ড, অাকার-বিকার সবই ইন্টারন্যাশনাল । দেশের কোনো সমস্যাই তাদের কাছে সমস্যা না—সব পানসে । আসল সমস্যা হলো গিয়া সিরিয়া— আরে মিয়া, কোটা দিয়া কী করবা, ট্রাম্প কেমনে রাসায়নিক হামলা দিয়া রাশিয়ার পুচ্ছে আগুন ধরায়ে দিছে, সেইটা দেখো ।

দেশের ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা তাদের হৃদয়ে রেখাপাত করে না । সাকিবের হায়দারাবাদ জয়ও তার কাছে যা, ব্রাকের স্যাটেলাইট অন্বেষার উড্ডয়নও তার কাছে তা । তার নিজ গ্রামের যে-ছেলেটা একদিন তাকে তরতর করে গাছে উঠে কচি ডাব দিয়ে আপ্যায়ন করেছে, সেই ছেলেটা যে এই বছর এইচএসি দিচ্ছে, তার কোনো খবর কোনো দিন সে রাখে নাই । আমি নিজেই দেখেছি, আম্মার কাছে লবণ চাইতে এসেছে পাশের বাসার মহিলা, কারণ তার পান্তাভাত আছে, লবণ ছাড়া কী করে খাবে । এই মহিলাকে ১০০টা টাকা কোনোদিন দেই নাই । কিন্তু ঢাকায় যেদিন প্রথম চাকরি পেলাম, সেদিন ঢাকার রিক্সাওয়ালাকে ৫০০ টাকা দিছি । তাতেও যে সওয়াব কম হয়েছে—সেই মাসলা ঝাড়ছি না মোটেই ।


আমাদের বাসার কাজের মহিলাকে আম্মা ৩০০ টাকা করে দিতেন । অথচ ৫০০ টাকায় দিনপঞ্জি লেখার দুইটা সুদৃশ্য ডায়েরি কিনে তার চোখের সামনে দিয়ে ঝুলাইতে ঝুলাইতে ঘরে ঢুকছি যেদিন, অনুভবও করি নি, তার তিনদিন আগে তার বাচ্চা হইছে এবং কাঁচা শরীর নিয়ে তিনি কাজ করতে এসেছেন । সারাদিন রাস্তার পাশে কচুর লতি কুড়িয়ে নিয়ে এসেছেন সালাউদ্দিনের মা, ঠিক আমার সামনে । ১০ টাকা দাম । কী দু:খ সেদিন আমার ! কথা দিলাম যে, চাকরি নিয়ে সবার আগে এই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে একটা সম্মানজনক ব্যবস্থা করে দেবো । আজ লেখার আগে আর মনে পড়ে নি তাকে । বেঁচে আছে সে—না বাঁচলে অন্তত খবর পেতাম ।

আমি নিজে কত মেয়ের কথা জানি, যারা দিনের পর দিনের গ্রামের মোড়ল টাইপের লোকদের কাছে ধর্ষিত হয়েছে । তারপরও হাসিমুখে স্কুলে গেছে । একবার একটা ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে কত মশকরাও করলাম ফুপাতো ভাইয়ের সাথে । গ্রামে ডিভিডি ভাড়া করে ব্লু-ফিল্ম দেখা পার্টিরা কাণ্ডটা ঘটিয়েছে । মেয়েটা কিন্তু সুখে আছে, বিয়েও হয়েছে । কেউ জানে না, আমি জানি ।


আমি সেই মহাজনের কথা জানি, সিডরের সময় যিনি ত্রাণের দুধের বিরাট বিরাট কৌটা ঘরের মাচায় জমা করে রেখেছেন, কম্বলের রাশ দিয়েছেন পিছনের গোয়ালে, যেন মাফুজার মায়ের চোখে না পড়ে । তাইলে সেই মহিলা কাঁন্নাকাটি করবে, কারণ তার ঘরের শতবছরের জীর্ণ কাথায় আর শীত মানে না । একটা ছিঁচকে চোরকে আমি মারতে দেখেছি ভীষণ । মাতব্বররা চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলেছিল তার । তাকে কেউ সুপথে আনতে যায় নি । আব্বা একবার কি দুবার তাবলিগে নিলেন । তারপর ভুলে গেলেন । ছেলেটা নিয়মিত ইয়াবার ডিলার হয়ে উঠেছিল । সেদিন খবর পেলাম পুলিশে ধরেছে । সেই মতবররা হায় হায় বিলাপও করেছে, কারণ, বাড়ির একটা ছেলেকে ইয়াবা বেচার অপরাধে পুলিশে ধরার ফলে বাড়ির ইজ্জত পনেরো শতাংশ কমে গেছে ।

শুনলাম বাড়ির বেশিরভাগ ছেলে-ছোকরাই এখন ইয়াবা খায় । অথচ এখনও আশা করি, সামনের ইদে তারা দাওয়াত করবে, ইদের নামাজ পড়াতে মুরব্বিরা সামনে এগিয়ে দেবে, কারণ গ্রামের একমাত্র খারেজি টাইটেল পাশ মৌলানা আমি। নামাজের পরে সেই ছেলেরা ‘কাকু কাকু’ বলে জড়িয়ে ধরবে । কেউ ভদ্রতা দেখিয়ে চোখের সামনে বিড়ি খাবে না । বরং আবদার থাকবে, রাতে একটা পিকনিক করা যায় কি না । পিকনিকে গানা বাজবে না—প্রমিস করবে ।


এই আমার গ্রামের সমস্যার সামান্য নমুনা । এই গ্রামে এখনও পুরাতন স্কুল-গাইডের চালাচালি হয় । মনে আছে, আলিম পরীক্ষার সময় গভীর মনোযোগে পড়ছিলাম, জোলেখা এক ঘণ্টা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, লজ্জায় বলতে পারে নাই—পরীক্ষার পরে পুরাতন বই পুস্তক তাকে দেওয়া যাবে কি না । ওর মুখে শুনেছি, ওদের ঘরে কখনও রোশন কেনা হয় নাই, কারণ রোশন ছাড়াও তরকারি খাওয়া যায় । জোলেখার স্বামী বছর তিনেক হলো মারা গেছে । শ্বশুর বাড়িতে ঠাঁই হয় নাই । অথচ মেয়েটা এত সুন্দর যে, পাশে বসলে মনে হতো জায়গাটা আলো হয়ে আছে ।কুলসুমের ভাই মাইনুলের কথাও মনে পড়ছে, অসাধারণ ভালো বউটাকে দিনের পর দিন নির্যাতন করতো—তাকে শ্বশুর বাড়ি থেকে দামি মোবাইল এনে দেওয়া হয় না কেনো । কুলসুম কি ভালো আছে? আমি খবর রাখি নি । শুধু মনে আছে, ঘোমটা জড়িয়ে উঠান পেরিয়ে যাচ্ছিল, আইসক্রিমওয়ালাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম—কিরে খাবি? সোজা জবাব দিল— ৫ টা খামু, কিনে দেন ।

এরাই আমার গ্রামের মানুষ । পরদাদা পর্যন্ত গেলে দেখা যাবে এদের প্রত্যেকে আমার রক্তের আত্মীয়—কেউ আমার জননীসম ফুপু, কেউ আমার খালা, কেউ আমার বড় বোন, কেউবা ছোট হয়েও আমারই চাচা । আমার স্বজন ছাড়া কেইবা আছে আমাদের বাড়িতে ! তাদের বড়রা ছোটবেলায় আমার নাছোর আবদার মেটাতে বতবার নাকাল হয়েছেন । তারা আমাকে সুন্দর একটা শৈশব উপহার দিয়েছেন, সে-ই যখন আজ মৌলানা হয়ে ঢাকার বাড়িতে বউ নিয়ে থাকছে, তার কাছে কি তাদের কোনো প্রত্যাশা থাকতে পারে?


সিরিয়া নিয়ে সরাদিন চিল্লাইলেও কী লাভ, আমার এত এত চিৎকারের একটি শব্দও কি আসাদের কানে যাবে? তার একটা বুলেটেও কি সামান্য বারুদের ঘাটতি আনবে? তার থেকে আমার গ্রামের ইউপি নির্বাচনে রামদা হাতে লাফিয়ে পড়ে যারা জাতশত্রুতার জিঘাংসা ছড়াতে চায়, যেই রামদা কেড়ে নেওয়ার অধিকার সেখানে আমার আছে । তাহলে সেখানেই কি আমার সুখ প্রথিত নয়? কাশ্মিরের আসিফাকে নিয়ে আপনি যতটুকু বললেন, তার সবটুকু অ্যানার্জি যদি বিউটির প্রতি দিতেন, আমি যদি আমার গ্রামের অবলা মেয়েদের দিকে দিতাম, তাহলে কি মনে হয়, কিছু কি কম হতো?

আপনার গরিব আত্মীয়দের হক আপনার প্রতি যতখানি, ততখানি আপনার প্রতিবেশির হক কি আছে? আবার প্রতিবেশির যতখানি পাশের গ্রামের মানুষের হক কি ততখানি? গ্রামের মানুষের হক যতটুকু, সারা দেশের মানুষের হক কি তার চেয়ে বেশি? তেমনিভাবে বিদেশিদের হক কখনো দেশের মানুষের চেয়ে বেশি নয়, হতেই পারে না ।


একটা জীবন যাদের সঙ্গে কাটিয়েছি—হোক অল্প সময়—তাদের সঙ্গে কথা বলতে, একসঙ্গে খেতে ঘুমাতে যে সুখ, ঢাকায় ২০ বছরেও তার তিলাতিতিলমাত্র পাই নি, হলফ করে বলতে পারি। এখানেও প্রতিবেশি আছে যদিও, কিন্তু তারা কি আমাকে ডাকে, নাকি আমি তাদের পুছি? কেন ডাকবে তারা—সুখ তো নেই । যেখানে সুখ আছে, সেখানের কথা তো মনেই পড়ে না । আমি আমার গ্রামের মাদরাসা দেখেছি, ছাত্ররা পলিটিক্সের ফাঁদে পড়ে কিভাবে গোল্লায় যাচ্ছে । স্কুলের দীনতা দেখেছি, দেখেছি কলেজের চাল বৈশাখী ঝড়ে উড়ে গিয়ে পড়েছে সিকদার বাড়ির উঠানে । বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটা ক্রমেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে, অথচ এটাই ছিল একসময় চাষবাশের ভরসা । হাঁটুরে মানুষের জন্য যদিও এখন রাস্তা হয়েছে বড়, কিন্তু এই বৃষ্টির দিনে কাঁদায় কী যে দুর্গতি হবে সবার—আমি জানি ।

বেঁচে থাকলে এই দেশে আমি আরও বড় হবো । এই দেশের মাটিতেই জন্ম নিয়েছি যেহেতু, এই দেশই হোক আমার ধ্যানের আকাশ । তার চেয়েও বড় হোক আমার বাড়ির দঙ্গল । আমি আবার আমার গ্রামে ফিরে যাবো । সহজ মানুষের কাছে থাকবো । আরেকবার গ্রামের নির্মল বাতাস মেখে মানুষ হতে চাইবো । আরেকবার ফসলের মাঠে গান গাইতে গাইতে শোনাবো তোমায় জন্মভূমির নাম ।

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৪:১৬
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×