somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চন্দ্রগ্রহণ

২৬ শে আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ১:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সেদিন ছিল চন্দ্র উৎসব। মহামতি আহান চন্দ্রগীত গাইছেন।তার সুমধুর কণ্ঠে পরিবেশ আলোড়িত। চাঁদের আলোর রূপালী আভা পরেছে ব্রহ্মপুত্র নদের পানিতে। আশ্চর্য কারণে এ নদীতে স্রোত নেই।কিন্তু ছোটবেলায় যে ব্রহ্মপুত্রে সাতার কেটেছি, তাতে ছিল তীব্র স্রোত।স্রোতের আঘাতে বিলীন হত ঘর বাড়ি, নদের পাড়, চাষের জমি, ভাসিয়ে নিত মৃত জীবদেহ।অবশ্য এটা মূল কম্পিউটার সিডিসি'র কেরামতি, একটা চমৎকার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।

"চাদনী পশরে কে আমার স্মরণ করে
কে আইসা দাড়াইছে গো আমার দুয়ারে......"

আবেগময় চন্দ্রগীত, কিন্তু আমাকে টানছে না।আমি বিরক্ত হচ্ছি।পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণ মূল কম্পিউটার সিডিসি নিয়ে নেবার আগে আমি আযানের শব্দে এমন বিরক্ত হতাম।কেউ আমার মস্তিষ্কের নিউরন নিয়ে টানাটানি শুরু করে দিত, প্রায় ছিড়ে ছিড়ে যাচ্ছে কিন্তু ছিড়ছে না।কি অসহ্য!

একটু আগেও আমি আর মেহরাব সিডিসি-এর সামনে বসে ছিলাম।সিডিসি দেখতে বিচ্ছিরি হবার কথা, অসংখ্য তার জড়ানো একটা কম্পিউটার। কিন্তু আমার সামনে যে ছিল তার বয়স ৮০এর কাছাকাছি, মাথার সব চুল ধবধবে সাদা, চোখে মুজিব চশমা, গালে ভাজ পরেছে।
মেহরাবই কথা বলেছে,আমি চুপ করে ছিলাম।
"আপনি সন্তান চান!কেন?"
"মানব জীবনে একটা অন্যতম উদ্দেশ্য হল নিজের বংশ বৃদ্ধি করা।আর এটা আমাদের অধিকার।"

"ভূল, তোমরা মানুষেরা অন্যান্য নিম্ন শ্রেণির জীবের মতই। তোমাদের চিন্তা খাবার আর যৌন চাহিদার বাইরে না।এই দুটা পেলেই তোমরা শান্ত।"
"ঠিক আছে, তর্কে যেতে চাই না।আমি আর আমার স্ত্রী সন্তান জন্ম দিতে চাই।আমাদের ছাড়পত্র দেয়া হোক।আর মানুষ কি চায়, আপনি কম্পিউটার হয়ে কি জানেন?"

"তুমি জানো না,আমরা প্রতিনিয়ত তোমাদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করি।কেবল খাবার আর সুন্দরী মেয়ে দেখলে তোমাদের প্রতিটি নিউরনে সাড়া পরে যায়।এমনকি ৫ম মাত্রার সুন্দরী রোবট মানবীও তোমাদের চোখের লালসা থেকে মুক্ত নয়।সারা গ্রুহ দখল করার আগে আমরা তোমাদের নিয়ে রিসার্চ করেছি।"
"আপনি বেশি কথা বলছেন।আমাদের ছাড়পত্র দিন।"

"তোমায় ছাড়পত্র দেয়া হবে না।তোমার সৃজনশীলতা নেই।"
"আমি একজন লেখক, ১০০ ছোটগল্প লিখেছি। আমার সৃজনশীলতা নেই?"

"না, নেই।তোমার সৃজনশীলতার লেভেল একটা চোরের লেভেল থেকেও কম।চোরকে নতুন নতুন পদ্ধতি ভাবতে হয়।গ্রুপে গ্রুপে রোবট তাদের ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পারছে না।আশ্চর্য সৃজনশীলতা!"
"আমি যে এত এত কল্পনা করে গল্প লিখি এটা কিছুই না!"

"না! আমরা রিসার্চ করে দেখেছি, তুমি যা লিখছো তা আগেই রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, আহমদ ছফা, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জহির রায়হান, বিভূতিভূষণ, হুমায়ুন আহমেদসহ আরও লেখকগণ আগেই লিখে ফেলেছেন। তারা কিছুই বাকি রাখেনি!আমরা সেগুলো সংগ্রহ করেছি।এককথায় তোমার লেখাগুলো আংশিক বা ৯০% intellectual property right লঙ্ঘন করে লিখা!আমরা মানুষের আজেবাজে সৃজনশীলতাকেও গুরুত্ব দেই, তাই তোমায় কিছু বলিনি!"
"কিন্তু আমি সবসময় চেয়েছি, আমার একটা পুত্র হবে।আমরা চন্দ্র উৎসবের দিন একসাথে চন্দ্রবাগানে হাটবো।জাহাঙ্গীরনগর চন্দ্র বাগানের প্রান্তিক গেট থেকে ট্রান্সপোর্ট, শহীদ মিনার চত্তর, বোটানিক্যাল গার্ডেন হয়ে ডেইরী গেট পর্যন্ত হেটে যাবো। ছেলে আমার আর তার মায়ের হাত ধরে থাকবে।আমাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করে নাজেহাল করবে।"

"অতীব সস্তা ধরনের স্বপ্ন।তুমি যদি পঞ্চম মাত্রার রোবট মানবী চাইতে, সেটা অসম্ভব হত।আর এর জন্য সন্তান উৎপাদনের কি দরকার? তুমি চাইলে আমরা অন্যভাবে ব্যবস্থা করতে পারি,তোমার স্বপ্ন পূরণ হবে কিন্তু সন্তান জন্মদেয়ার মত কঠিন-লম্বা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে না।"
আমার আলাপ শুনতে ভালো লাগছিল না। আমি মেহরাবকে নিয়ে চলে এসেছি।

আমার মন এত খারাপ যে মহামতি আহানের গানও মন ভালো করতে পারছে না।মহামতি আহান মঞ্চে হাত নেড়ে গান করছেন।মেহরাব মাটির দিকে তাকিয়ে আছে, যেকোনো সময় কেঁদে ফেলতে পারে।আমি ওকে নিয়ে বাসায় ফিরবো। মন খারাপ নিয়ে গান শোনার কোন মানে হয় না!

আমি মেহরাবের হাত ধরে হাটছি।মেহরাব সিগারেট টানছে।আশেপাশের নিরাপত্তারক্ষী রোবটগুলো তাকিয়ে দেখছে, সমস্যা নেই।মেহরাবের লেখক পাস আছে, তার দিনে দুটো সিগারেট খাবার অনুমতি আছে।
মহামতি আহান আমাদের ডাকলেন।
"আপনারা চলে যাচ্ছেন কেন?আমি নিশ্চয়ই অত খারাপ গান করি না!"

উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ, মাথার ঘনকালো চুল কাধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, টিকালো নাক আর পিঙলা চোখের আহানকে অনেকটা যিশুখ্রিষ্টের মত লাগে।এভারেজ উচ্চতার এই লোকটাকে যতবার দেখি মনে একধরনের শুণ্যতা তৈরি হয়।তিনি আবার হাসিমুখে বললেন,"চন্দ্রগীত এতই খারাপ লাগছিল?আসলে অনেকবছর ধরে একই গান করছি বিরক্ত হবারই কথা, কিন্তু এত বছরেও কেউ কনসার্ট ত্যাগ করেনি।" চাঁদের আলো আহানের মুখে পরেছে, তার উজ্জ্বল পিঙল চোখের তারায় জানার আগ্রহ চকচক করছে।

মেহরাব তার দিকে ফিরেও তাকাল না।আমি উত্তর দিলাম,"মহামতি আহান, আমরা অত্যন্ত দুঃখিত।আজ আমাদের দুঃখের দিন।আমরা অত্যন্ত বিরক্ত, আমাদের সন্তান উৎপাদনের অনুমতি দেয়া হয়নি।সিডিসি হাসিহাসি মুখে জানিয়েছে, আমাদের কোন সৃজনশীলতা নেই।"

"কে বললো আপনার সৃজনশীলতা নেই?আপনি মানুষকে ভালোবাসার বিরল গুণ নিয়ে জন্মেছেন।অনেকদিন পর দেখছি, একজন মায়াবতী ভালোবেসে কারও হাত শক্ত করে ধরে আছে, হাত ছেড়ে দিলেই দুঃখে লোকটি কেঁদে ফেলবে।"
"তাতে কি?সিডিসি আমাদের সন্তান জন্মদানের ছাড়পত্র দেয়নি।আজ আমাদের দুঃখের দিন।আমাদের একা ছেড়ে দিন।"

"আপনি চাইলে আমি সিডিসি'র সাথে কথা বলতে পারি।নিশ্চয়ই সিডিসি আমার কথা শুনবে।"
"সিডিসি কোন মানুষের কথা শোনে না,অনুরোধ রাখে না।মানুষ আবেগ দিয়ে কাজ করে তাই।"

"আমি মানুষ আপনাকে কে বললো। মনোযোগ দিয়ে শুনুন, মঞ্চে ঠিকই গান চলছে। অথচ আমি আপনাদের সাথে হেটেহেটে গল্প করছি, হা হা।"
আমি আর মেহরাব দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।সত্যিইতো, মঞ্চ থেকে মহামতি আহানের সুমধুর গান ভেসে আসছে।কিন্তু তিনিতো আমাদের সাথে!

মাঝখানে পাঁচ বছর পেড়িয়ে গেল।আমাদের পুত্র শাবাবের বয়স তিন বছর, সে একটানা ফটফট করে কথা বলে।তাকে থামানোই কঠিন, আমি রেগে গেলেও মেহরাব রাগে না, শাবাবের সকল প্রশ্নের উত্তর দেয়।

আজ চন্দ্র উৎসব, প্রতিবছরের মত এবারও মহাসমারোহে উৎসব পালিত হচ্ছে।আমি আর মেহরাব শাবাবকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর চন্দ্রবাগানে চলে এসেছি।আজ মেহরাবের স্বপ্ন পূরণের দিন!
আমরা শাবাবের হাত ধরে প্রান্তিক গেট থেকে হাটা শুরু করেছি।

পুকুর পাড়ে এসে শাবাব থেমে গেল।সে অবাক হয়ে দেখছে পুকুরে নীল চাঁদের আলো পরেছে, তাতে দৌড়ঝাঁপ করছে একদল ধবধবে সাদা রাজহাস, একপাশে ফুটে আছে লাল পদ্ম, আকাশে পাক দিচ্ছে ঝাকেঝাকে অতিথি পাখি, চারপাশ কামিনীফুলের গন্ধে আলোড়িত।
শাবাব প্রশ্ন করলো,"বাবা, কালতো চন্দ্রগ্রহণ ছিল।আর আজই পূর্ণিমা, চাঁদের দশাতো ২৮ দিনের আগে বদলাবার কথা না!"

মেহরাব শুরু থেকেই তার স্বপ্ন পূরণের আনন্দে মোহিত কিছুটা উত্তেজিত। ওর চোখ দিয়ে টলমলিয়ে জল পরছে, আনন্দের জল!আমি ভাবছি, অতটুকু বাচ্চার নিশ্চয়ই চাঁদ নিয়ে অত জানাশোনা থাকার কথা না।আমরাও কখনো বলিনি।তবে কি.....?

আমার মন বিষিয়ে গেল, হাটতে ভালো লাগছে না।আমি শাবাবের হাত ছেড়ে দিয়ে মেহরাবের হাত ধরলাম।মেহরাব এতই আনন্দিত যে, শাবাবের জ্ঞানী জ্ঞানী প্রশ্ন ওকে বিব্রত করছে না।ও অতি উৎসাহে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।আমার খারাপ লাগছে, খুব খারাপ।তবুও একজন অতি আনন্দিত মানুষের হাত ধরে হাটতে পারাটাই কম কি?

বিঃদ্রঃচন্দ্র উৎসব আর "মহামতি আহান" চরিত্রটি হুমায়ুন আহমেদ'র কোন একটা উপন্যাস থেকে নেয়া।আমার নাম মনে নেই।তবে লেখক মহামতি আহানের শারীরিক বর্ণনা দেননি। আমি উৎসবের আমেজ কিছুটা ধার করেছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:২৩
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×