somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেখানে আকাশ নীল

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুপুর থেকেই কাজী অফিসে বেশ ভীড়।নাকি আমি আসলেই বিয়ের ধুম পরে যায়?জানি না। আমি যখনি আব্বার কাজী অফিসে আসি দেখি বর-কনের অভাব নেই। অথচ আব্বা সজীবকে স্কুলের পিকনিকে যাবার টাকা দিলেন না। আমার কাছেও টাকা নেই, টিউশনির টাকা পেয়েই সাথীকে দিয়েছি।ওর একটা টাচ মোবাইল কেনার শখ।আমার একমাত্র বোনটা অনেক আহ্লাদী, কিন্ত নিজের টিউশনির টাকা দিয়েই কলেজে পড়ছে।আব্বার কাছে মেয়েদের পড়াশোনা মানেই বাড়তি খরচ। সজীব মাঝরাতে আমায় ডেকে বললো,"দাদা, আমায় পিকনিকের টাকাটা দিবা?আমার সব বন্ধু যাচ্ছে।"
কি যে লজ্জা পেলাম!

ও সকাল থেকে বাসায় নেই।কোথায় বসে আছে কে জানে?ও খিদে একদম সহ্য করতে পারে না।আম্মাকে খাই খাই করে মাথা খারাপ করে দেয়।সকালে নিশ্চয়ই না খেয়েই বেড়িয়ে গেছে।ওকেও খুজতে হবে।

আব্বা রুমের সব দেখতে পাচ্ছেন অথচ আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না।যেন আমি অদৃশ্য মানব, The Hollow man. আমি অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি।আব্বার কাছে টাকা নিতে এসেছি, চাকরির আবেদন করবো। আমি বসতেও পারছি না।সব চেয়ারে জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে বসে আছে।একটা ডাবল সিটার অবশ্য খালি, একটা বোরকা পরা মেয়ে বসে আছে।তার পাশে বসা যায়, আব্বা রাগ করবেন!আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

এই বিয়েতে বেশ নাটক হচ্ছে।মেয়েটা কিছুতেই কাবিননামা সই করছে না।তার বন্ধু বান্ধবীরা জোরাজোরি করছে।মেয়েটা কান্না জুড়ে দিল,"আমার মা আমাকে গার্মেন্টসে চাকরি করে পড়াচ্ছেন। আমি তাকে কষ্ট দিতে পারবো না।আমি এ বিয়ে করবো না।তোরা আমায় যেতে দে।"
আব্বা তার বন্ধু বান্ধবীকে শান্ত করলেন।মেয়েটা দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিল, দরজায় হোচট খেয়ে পরে গেল। বোরকাপরা মেয়েটা তাকে ধরে তুললো। ওর বন্ধুরা হতবাক, শক সামলাতে সময় নিচ্ছে।

বিকালে ভীড় একদম নেই।আমি আর বোরকাপরা মেয়েটা ছাড়া কেউ নেই।আব্বা দুপুরের খাবার দেরি খান।আজ মেয়েটিকে নিয়ে খেতে বসলেন_লাউ শাক, বকফুলের বড়া আর চ্যালা মাছের ঝোল। আমাকে ধমকিয়ে বললেন,"দাঁড়িয়ে আছ কেন?যাও এক বোতল ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো।"

আমি,আব্বা আর বোরকাপরা মেয়েটি ভাত খাচ্ছি। আশ্চর্য পদ্ধতি, ভাত মেখে বোরকার মাথার যে ঝোল আছে তার ভিতরে নিয়ে নিঃশব্দে খাচ্ছে। আব্বা খাবার সময় কথা বলা পছন্দ করেন না।আজ তিনিই কথা বলছেন।
"মাগো, পোলার জাতটাই খারাপ। বেঈমানের জাত,কত দেখলাম! আমিই বিয়া পড়াই আবার আমিই তালাক করাই।ঘেন্না লাগে।এমনও হয়, মেয়েটা সারাদিন বসে আছে।নচ্ছার ছেলেটার দেখা নেই।
আম্মাগো, আপনি বাসায় ফিরে যান।আর কত বইসা থাকবেন,সকালে আসছেন।কষ্ট পাইয়েন না,আম্মা।সব ঠিক হয়ে যাবে।বাসায় গিয়ে বলবেন, বান্ধবীর বাড়ি গিয়েছিলেন।এই মিথ্যায় আল্লাহপাক নারাজ হবেন না।আল্লাহপাক সর্বদ্রষ্টা।"

খাওয়া শেষ করে আব্বা জিজ্ঞেস করলেন,"আম্মা, আপনের কাছে রিকশাভাড়া আছে?মেয়েছেলে বাড়ি থেকে টাকা,গয়না লইয়া আসে, আপনেতো কিছুই আনেন নাই।"
আব্বা মেয়েটিকে একশ টাকার পাচটা কচকচা নোট দিলেন।মেয়েটি কোন কথা বললো না।বেড়িয়ে গেল।

আমি চাকরির আবেদন করে বাসায় ফিরবো। ভাবলাম একটু মাজারে ঘুরে আসি।ওখানে সন্ধ্যার পরেই গাজার আড্ডা বসে, পুরো পরিবেশ ধোয়াচ্ছন্ন থাকে।আমি সিগারেটও খাই না,তবু ঐখানে যাই। একটা ঘোরের মত তৈরি হয়, আমার ভালো লাগে।

আমি বরাবর যে স্থানে বসি সেখানে বোরকাপরা মেয়ে বসে আছে।আমার মতই পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে।হয়তো ঐ মেয়েটাই!
"আপনি বাড়ি যাননি?"
"না, আমি বাসায় যাবো না।"

"বাসায় যান।সব ঠিক হয়ে যাবে।"
"না, ঠিক হবে না।আমি বাসায় চিঠি লিখে এসেছি। এতক্ষণে আব্বা চিঠি পড়ে, হার্টফেল করে হাসপাতালে।নয়তো আমাকে খুজতে আসতো। আব্বা, আমাকে না দেখে থাকতে পারে না।মাঝরাতেও আমার ঘরে আমাকে দেখতে আসেন।ও বাড়ি আমি ফিরে যাবো কোন মুখে?"

"শুনুন, আপনি বাসায় যান।আমার ছোট ভাইকে খুজতে হবে।ও বাড়ি থেকে পালিয়েছে, আজ মনে হয় বাড়ি পালানো দিবস!"
মেয়েটি শব্দ করে হাসলো।
"চলুন আমিও খুজি।আপনার ভাইয়ের ছবি আপনার বাবার অফিসে দেখেছি। ও এখানেই আছে।আমি দেখেছি। আপনাকে সাহায্য করি, আপনিও আমাকে সাহায্য করবেন।"

"না না, আপনি বাসায় ফিরে যান।আমার সাহায্য লাগবে না।"
"আমার যে সাহায্য লাগবে।আমি ভীষণ বিপদে, বুঝতে পারছেন!"

সজীবকে মাজারের শাহ কবীর'র কবরের পিছনে পাওয়া গেল।আমাকে দেখেই পালিয়েছে। কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না।মেয়েটি কানেকানে কিছু বললো। সজীব আর উচ্চবাচ্য করলো না।বাসায় ফিরতে রাজি হল।মেয়েদের কথায় আল্লাহ কি যে যাদু দিয়েছেন? এই যাদুতে আমিও মোহিত হলাম, তবে কথার না।স্পর্শের যাদু।
মেয়েটি আমার হাত ধরে বললো,"শুনুন আপনি আমাকে একটা খারাপ পাড়ায় দিয়ে আসুন।এই উপকারটা করুন।না করবেন না।এখানে আমি কিছু চিনি না।"
এই প্রথম আম্মা,সাথী ছাড়া কোন মেয়েহাত আমাকে স্পর্শ করলো।

আমি, বোরকাপরা মেয়ে আর সজীব আব্বার কাজী অফিসে বসে আছি।আচ্ছা বলিনি,বোরকাওয়ালীর নাম পুতুল।
"বিয়ে করতে এসেছিস, আমার ফি আছে?"
পুতুল কচকচে একশ টাকার পাচটা নোট বের করে দিল।
"আমার ফি ১০০০ টাকা!"
এবার সজীব আরেকটা দলানো মোচড়ানো ৫০০ টাকার নোক বের করে দিল।অন্য সময় হলে আব্বা সজীবকে টাকা কোথায় পেয়েছে জিজ্ঞেস করতেন,কষে চড় দিতেন!এখন কিছু বললেন না।

প্রতিটি কাজী অফিসেই কিছু রেডিমেড সাক্ষী থাকে, আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। আব্বা গম্ভীর গলায় বললেন,"আম্মা, আপনি বড় ভুল করেছেন।
সজীইব্বা, তুই এখনি বাসায় যাবি তোর বিচার রাতে করবো। আর এই যে বড় কুপুত্র জনাব সোহাগ সাহেব, এই মেয়েটির জীবন নষ্ট করার অপরাধে তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করলাম, তুমি আর বাসায় ফিরবে না।আম্মাজি, আপনি আমায় ক্ষমা করবেন।"
আব্বাতো জানেন না, মুসলিম ধর্মে ত্যাজ্যপুত্র করা যায় না।আমি কিছু বললেই আব্বা আরও রেগে যাবেন।

সজীবের পড়াশোনা ছাড়া সব কিছুতেও অনেক আগ্রহ। সে আমার ঘরটা সাজিয়ে ফেলল।ওর দুজন বন্ধু আনন্দিত চোখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।টাকা না দিয়ে আমাদের ভেতরে যেতে দিবে না।আম্মা বাসায় নেই, বড় মামার বাসায় গিয়েছেন।সাথী চুলায় মাংস রান্না চড়িয়েছে, ও নতুন রান্না শিখেছে। তবে পোলাও রান্না করতে পারে না।তাতে কি?আম্মা এসে পোলাও রান্না করবেন!

আম্মা আব্বা একসাথে বাসায় ফিরে আমাদের গেটের বাইরে বের করে দিলেন।আমি, সজীব, পুতুল বাইরে দাঁড়িয়ে আছি।আব্বা ঘরে চেচামেচি করছেন।আশেপাশের বাসা থেকে লোকজন উঁকি দিচ্ছে।চোখে প্রশ্ন, কি হয়েছে? সোহাগ, সজীবের সাথে এই বোরকাপরা মেয়েটা কে?এরা বাইরে কেন?
সাথী চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গেটের বাইরে চলে এল, যে বাড়িতে দাদাভাই, ভাবির জায়গা নেই সে বাড়িতে সেও থাকবে না।সজীব করুণ স্বরে আম্মাকে ডাকছে,"ও আম্মা, খিদা লাগছে।ও আম্মা, নাড়িভুড়ি হজম হয়ে গেল।ও আম্মা, আম্মা....!"
পুতুল কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,"তোমরা কি শুরু করলে?তোমরা বাসায় যাও।আমি তোমাদের বিপদে ফেলে দিলাম।কি ভারী অন্যায়!আমার খুব লজ্জা লাগছে।"
সাথী, সজীব পুতুলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।

সাথী সজীবের উৎসাহের শেষ নেই।নতুন উদ্যমে সব শুরু করলো।সজীবের বন্ধু দুজন এতক্ষণ ছিল না।আমরা আন্দোলনে জেতার পরই উদয় হল। পুতুলকে কথা দিতে হল, টাকা হলেই ওদের বাসর ঘরের টাকাটা দিতে হবে।বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে, বিছানায় লাল চাদরে গাদা ফুলের পাপড়ি দিয়ে লিখেছে S+P. ফুলদানিতে একদল রজনীগন্ধা, টেবিলে আব্বার প্রিয় টেবিল ল্যাম্প রাখা।
আব্বা একবার ঘরের সাজসজ্জা দেখে গেলেন। এ নিয়ে কিছুই বললেন না।

পুতুল বোরকা পরে ঘুমিয়ে পড়লো, কিছু খেলও না।আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওর বোরকার মুখের ঝুলটা নিজেই খুলে দেই।সাহস হয়নি।খুব ইচ্ছে করছিল, ওর চেহারাটা দেখি।অজানা আশঙ্কায় পারিনি।

সকালে চোখে রোদের ছাটে ঘুম ভাঙলো। দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, আব্বার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী পরনে নীল শাড়ি, হাত-অনাব্রিত পিঠের অংশ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে দেখতে সুন্দরী হবে, পা খালি, শাড়ি সামলাতে পারছে না, কোমড় থেকে খুলে খুলে যাচ্ছে, নীল শাড়ির কিছুটা চুলের পানিতে ভিজে গাঢ় নীল হয়ে আছে। আব্বা মনোযোগ দিয়ে পেপার পড়ছেন।ওর দিকে তাকাচ্ছেনও না।ও কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে কে বলতে পারে?ও নিশ্চয়ই পুতুল, সাথী এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ঊঠার কথা না।
আম্মা রান্না ঘর থেকে গজগজ করছেন,"আমার কপাল খারাপ, সোহাগ এই মেয়ের কি দেখে নিয়ে আসছে আল্লাহ মালুম।চেহারা ছাড়া আর কোন কিছুতো পারে না।সকাল না হতেই আমার একটা কাপ, দুইটা প্লেট ভেঙে ফেলছে।তোরে কে রান্না ঘরে আসতে বলছে মুখপুড়ী!"

এখন নিশ্চিত হলাম, ঐটা পুতুল।আম্মার কথায় ওর কোন ভ্রুক্ষেপ হল মনে হচ্ছে না।সে আব্বার পাশেই চা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।আব্বা বললেন,"আহা মিনি, কি বল।মেয়েটা তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছে।কাপ,প্লেট কি কেনা যাবে না নাকি?"
আব্বা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,"মাগো, মন খারাপ কইরো না।তোমার চা ভালো হয়েছে। তবে আমি চিনি বেশি খাই।একটু চিনি দিয়ে আনতো মা।"
পুতুল তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে পরে গেল।ওর কোমড় থেকে শাড়ি প্রায় খুলে গেল।ও বেশ লজ্জা পেয়েই আমার রুমে দৌড়ে চলে।এখামে এসেই লজ্জা কমলো না, আমাকে দেখে দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

সজীবের গলা শোনা গেল,"আম্মা খিদা লাগছে।খাবার দাও।"আম্মা ভাঙা কাপের দুঃখেই হয়তো সজীবকে চড় মারলেন।
পুতুল বলছে,"আপনাদের কি যন্ত্রণায় ফেললাম!আমার লজ্জা লাগছে।"
আমি কিছুই বললাম না।আমার চোখ তখন অন্যদিকে। তামাম দুনিয়ার সকল সৌন্দর্য আমার চোখের সামনে, কথা শোনার ফুরসত কই।এই সৌন্দর্য মোহ ত্যাগ করে গৌতম বুদ্ধ কিভাবে গৃহত্যাগ করতে পারলেন?
পুতুল শাড়ি শরীরে প্যাচাতে লাগলো, বললো,"বারে!আমার কি লজ্জা করে না!"
পুতুলকে পোশাক যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করলো সাথী।

পুতুল সারাদিন আম্মাকে সাহায্য করে আম্মার মন জয় করার চেষ্টা করলো।তার চেয়ে উৎসাহ বেশি সজীব আর সাথীর, পুতুল যেখানে যায় ওরাও পিছন পিছন যায়।পুতুল যে কাজ করতে যায় ওরাও ঐ কাজই করতে যায়।সারাদিন এইভাবেই চললো। সজীব স্কুলে গেল না, তিন চারবার আম্মার মার খেল। তাতেও সমস্যা হল না, ও পুতুলের পিছনে লেগেই থাকলো। আম্মা বেশি রেগে গেলেন সাথীর উপর।
"আমি সারাদিন কামলা বেটির মত কাজ করি।কই?জীবনেতো আমাকে সাহায্য করতে এলি না।আজ এই মুখপুড়ী তোর আপন হয়ে গেল।হারামজাদি দেখি এই পিড়িতি কয়দিন থাকে?অল্প পিড়িতের ঘর ছয় মাসে বছর।"
আব্বা বারান্দায় মিটি হাসছেন।আজ তিনিও কাজী অফিসে যাননি।

সন্ধ্যায় সজীব বা সাথী আমার কাছে পড়তে আসে না।পুতুলই ওদের পড়ায়।খাবারপর বসার ঘর থেকে হাসির শব্দ আসতে লাগলো। আব্বা হাসছেন, সজীব, সাথী হাসছে।কি দেখে হাসছে বোঝা যাচ্ছে না।আব্বার আজ খবর দেখার তাড়া নেই, আম্মা 'বকুল কথা', 'দেবী চৌধুরানী' দেখতে পারছেন না। এই রাগে আম্মা বাইরে হাটাহাটি করছেন।
আসলেইতো এই মেয়েটা এমন কেন?আমরা তার সম্পর্কে নাম ছাড়া কিছুই জানি না।এমনকি কাবিননামায়ও সে বাবার নাম, ঠিকানা লিখেনি।আর মেয়েটা কিনা আম্মার সব দখল করে নিল!

সেদিন পুতুল আর সাথী রান্না করলো। সজীবটাও হয়েছে ভাবী সোহাগি, আব্বাও বাসায় ফিরে আগে বলেন,"আমার পুতুল আম্মাজি কইগো!"
রান্নার সময় আম্মা মুখভার করে দূরে বসে রাগে গজগজ করছিল।সজীবটা ওদের আশেপাশেই রইলো, যদি ভাবি কোন কাজ দেয়।বেশ পদ_গরুর মাংস, রুই ভাজা, ডালের বড়া আর মাষকলাই ডাল।
আমরা একসাথে খেতে বসলাম, আম্মা খেতে বসেই ঊঠে গেলেন। এরচেয়ে নাকি গু খেতেও ভালো। সাথীও খেতে না পেরে ঊঠে গেল, আমিও চাইছি কিন্তু পারছিলাম না।পুতুল না আবার কান্না করে দেয়।
আব্বা আর সজীব খেয়ে যাচ্ছে।কোনটাতে লবণ বেশি, কোনটাতে লবণ দেয়াই হয়নি, সবগুলো অতিরিক্ত ঝাল।
আব্বা বলছেন,"আমার আম্মাজি প্রথম রান্না করেছে, আমিতো না খেয়ে উঠে যেতে পারি না।"
পুতুল ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো।

চার মাস চলে গেল।আব্বা আমাকে ডেকে বললেন,"একটা চাকরি খুজে নে।নতুন বৌয়ের কত আবদার থাকে, হয়তো তোর চাকরি নেই দেখে বলতে পারছে না।এইনে টাকাটা রাখ, ওকে ইচ্ছেমতো কিছু কিনে দিস।কপাল গুণে এমন মেয়ে মেলে।"

পুতুল সব শিখে নিয়েছে। শাড়িটাও বেশ পরে, রান্নাটাও সে করে। আলমারি থেকে আম্মার সব শাড়ি পরতে থাকল। আম্মা আব্বা সবাই মিলে এখন সিরিয়াল দেখে, আমি চাকরির পড়া পড়ি।ওদের আড্ডায় আমার জায়গা নেই।

কেবল আমার সাথেই অর অত কথা নেই।দুএকবার বিছানায় শরীরের কথা হয়েছে, এই যা!আমি কিছু জিজ্ঞেসও করিনা।যদি আবার কষ্ট পায়।মাঝে মাঝে রাত জেগে ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।কখন রাত পার হয়ে যায় টের পাইনা।অমন মুখ দেখে এক জনম কাটিয়ে দেয়া যায়, কি শান্ত মায়াবী মুখ!করুণ চোখ বন্ধ, কি যে ভালো লাগে!

সকালে আম্মা কি নিয়ে আব্বার সাথে ঝগড়া করে মামার বাড়ি চলে গিয়েছেন।আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে এসে দেখি আম্মা বাসায় নেই। অবশ্য আমাদের অসুবিধা হচ্ছে না।পুতুল সব দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। তাই আব্বার আম্মাকে ফিরিয়ে আনার অত তাড়াও নেই।আর এটা নতুন না, আম্মা প্রায়ই রাগ করে মামার বাসায় চলে যান।মামার বাসা কাছেই কিনা,আর আব্বাকে শিক্ষাও দেয়া হয়।

রাতে বিছানায় পুতুল কাঁদছিল।আমি পৈশাচিক আনন্দের জন্য একটু জোর করলাম। যেই আমি হাফ ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পরলাম, ও বাইরে চলে গেল।ফুপিয়ে কাঁদছে; আব্বা, সাথী বেড়িয়ে এল।আব্বা হইচই জুড়ে দিল।সজীব আম্মাকে কল দিল, আম্মা রাগটাগ ভুলে ছুটে এল।
আমি লজ্জা পেলাম খুব, আম্মা নিশ্চয়ই লেপ্টানো লিপিস্টিক,কাজল দেখে সব বুঝতে পারবেন।ছিঃকি লজ্জা!

রাত বেশি হয়নি।আব্বা,আম্মা, সাথী, সজীব পুতুলকে ঘিরে বসে আছে।ও কাঁদছে।আব্বা বললেন,"কি হইছে আম্মা।আম্মাগো, আমারে বল।হারামজাদা কিছু বলছেনি?তুমি কিছু কও, আমি ওরে থাপ্পড় দিয়া আসি।অাম্মাগো, কান্দ কেন?"
পুতুল কিছু বললো না।
আম্মা কিছু বলছেন না।ওর হাত ধরে বসে আছেন।সজীবটা ওর মাথায় হায় বুলিয়ে দিচ্ছে, সাথী ওর সাথে গলা মিলিয়ে কাঁদছে।

পুতুল আস্তে করে বললো,"আম্মা আব্বা,আমার বাড়ির কথা মনে পরে।আব্বা বাসায় ফিরেই আমাকে ডাকতেন, আমার পুতলা আম্মা কইগো!আমি আম্মাকে দেখিনি, আমার জন্মের সময় মারা গেছেন।আমি আব্বার বুকে ঘুমাতাম, আব্বা আমাকে বুকে নিয়ে সারারাত জেগে থাকতেন।আর আমি আব্বাকে এত কষ্ট দিলাম!আমার আব্বা আজ মারা গিয়েছেন।আমার মুখও আব্বা দেখতে চাননি।"

রাত বাড়তে থাকলো, বাড়তে থাকলো চাঁদের আলো আর হাস্নাহেনার ঘ্রাণ। আব্বা সবাইকে তাড়া দিয়ে ঘুমাতে পাঠালেন।নিতান্ত অনিচ্ছায় সবাই যাচ্ছে।আব্বা আমাকে বলে গেলেন,"তুই একটা বলদা আক্কু।এত দূরে দাঁড়িয়ে আছস কেন?যা মেয়েটার হাত ধরে বসে থাক না।এত লজ্জা কিসের বুঝি না!"

আমি ওর পাশে বসে রইলাম। ও আমার হাত ধরে কাধে মাথা রাখলো।আমার শরীরের সাথে প্রায় ওর শরীর মিশে একাকার, চাঁদের আলো আমাদের পায়ে পরেছে।আমরা চাঁদের আলোয় পা ভিজিয়ে বসে আছি। না দেখেও বুঝতে পারছি আম্মা,আব্বা, সজীব, সাথী সবাই আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। কেউ ঘুমাতে যায়নি।

আমার বেশ লজ্জা লাগলো। ভয়, লজ্জা, রাগ লুকাতে আকাশের দিকে তাকাতে হয়।এতে ভয়,লজ্জা, রাগ কমে যায়।আমি আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশে চকচকে রুপোলী চাঁদ, আলোয় ভাসিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী। আশ্চর্য! আকাশটা ঝকঝকে নীল।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:১৩
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×