১...
বিলের ঘোলা পানিতে একটা পদ্ম ফুটে আছে,শুভ্র মানবীপদ্ম!বাচ্চা মেয়েটার কেবল মুখ ভেসে আছে, সারা শরীর ভেসে থাকলে সবাই দেখতো মেয়েটি নগ্ন। সারা গায়ে আচড় কাটা, বুকে কামড়ের দাগ, নিতম্বও বাদ দেয়নি পিশাচ বা পিশাচগুলো!
কানাই ডোম চুল ধরে টেনে মেয়েটাকে পাড়ে আনলো, বিরবির করে বললো," আহারে!এই গ্যাদা মাইয়াডারেই তোরা ছিইড়া খাইলি। ফুর্তি করবি নটিবাড়ি যা, পুলাপানগুলারে ছাইড়া দে।"
মেয়েটা এই গ্রামের না। হরিশপুর গ্রামের আশেপাশে কোন গ্রাম নাই, গ্রামটা বিলের মাঝে দ্বিপের মত।
মুনশি ফজরের আযান দিতে মসজিদে যাবার পথে মেয়েটাকে দেখতে পায়।
গ্রামে দারুণ উত্তেজনা। ছেলে, বুড়ো, মেয়েরদলও চেয়ারম্যান বাড়িতে ভিড় করেছে।
নওগাঁর রানীনগর উপজেলার হরিশপুর গ্রামের চেয়ারম্যান, থানার ওসি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করছেন। ওসি শব্দ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন।চেয়ারম্যান বিরক্ত হচ্ছেন, কিছু বলছেন না।শিক্ষিত হবার এই এক যন্ত্রণা, মানুষের সাথে ইচ্ছেমতো খারাপ আচরণ করা যায় না। বিবেক বাধা দেয়।
"চেয়ারম্যান সাব, মাইয়াডার ইজ্জত নষ্ট কইরা গলা টিইপ্পা মাইরা ফেলছে। কেস মামলা হইবো। আপনের কি মতামত?"
"দেখেন যা ভালো মনে করেন।তয় আমার একটা কথা আছে।
"আপনের কাউরে সন্দেহ হয়নি?" ওসি গলা নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন।
"না, আমার কাউরে সন্দেহ হয় না।তয় শত্রু শেষ করার একটা সুযোগ যেহেতু পেয়েছি,কাজে লাগাই।মামলার কাগজে আনোয়ার হোসেনের নাম লিখে দিবেন।হারামির পোলা, ইলেকশনে ভোট দেয় নাই।আরেকজনের ক্যাম্পাস করছে, আমার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিছে।সহ্য করছি, কিছু বলি নাই।
সেদিন বিলে একটা বড় কাতলা ধরছে, বলছি আমার বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। দেয় নাই, আবার চটাংচটাং কথার উত্তর দেয়। আমি ভালো মানুষ তাই কিছু বলিনা। তবে আগাছা বাইরা গেলে কেটে দেয়া নিয়ম।
আর হ্যা,মেয়েটাকে ওর বাড়ির পাশেই পাওয়া গেছে!সমস্যা হবার কথা না।পারবেন না, ওকে ফাসিয়ে দিতে?জীবনে যাতে ছুটতে না পারে!"
ওসি কিছুই বলছে না।হাত কচলাচ্ছে।
"পুলিশ আর কুত্তা নিয়া বিরাট যন্ত্রণা!এরা মুখে কিছু বলে না। কুত্তা লেজ নাড়ায়, পুলিশের লেজ নাই তাই হাত কচলায়।"
ওসি গা দুলিয়ে হাসল।
চেয়ারম্যান একটা টাকার বাণ্ডিল ছুড়ে দিলেন।
"চেয়ারম্যান সাব, একটা কথা মনে রাখবেন। কুত্তা আর পুলিশই কিন্তু নিমক খাইয়া বিশ্বাস ভাঙে না।হেহে..…..এইবার দেখেন আমার কেরামতি।"
আছরের আযান দিচ্ছে। আনোয়ার হোসেন, পুত্র মনির আর শ্যালক রাসু বিলে ছিপ ফেলে ডিঙিতে বসে আছে। চোখের পলক পড়ছে না, একমনে পাতাকাঠির দিকে তাকিয়ে। বিলে নতুন মাছ, নতুন পানিতে এদের মাথা খারাপ। এরা বর্শি পেলেই গিলে ফেলে।
তাদের সবার মনোযোগ নষ্ট করলো লামিয়া।
"ও বাজান, ও বাজান! বাইতে চলো।পুলিশ আইছে, তুমি নাহি মাইয়াডারে ধর্ষণ কইরা মাইরা ফালাইছ। মাইনশের মাইয়ারে ধর্ষণ করার দরকার কি? আমারে করতে পারলা না।আমারে পানিত ফালাইয়া দিলেও বিপদ নাই।আমি হাতার পারি, মরতাম না।আহো, বাইতে আহো।মায় কান্দে....."
মেয়েটা একটা কথা বলে এখন দম নিচ্ছে।
এরা কেউ বাড়িতে গেল না। গেলে দেখতে পেত, একজনের বৌ, আরেকজনে মা অথবা আরেকজনের বোন ঘরের বাশে ঝুলছে! ২০১২ সালে এই খবর মোটেই ভাইরাল হয়নি।কেন হবে? এতে ছাত্রলীগ, সুশীল, শিক্ষিত বা অন্য ধর্মের কেউ কোনভাবেই জড়িত নেই যে।
২...
বাবু শেখ, তার শ্যালক আর পুত্র মিলে জাল পার্টি করছে।
আয়োজন অতি সামান্য; ধোয়া উঠা ভাত, আস্ত কাল-বাউশ মাছ ভাজি, কাগজি লেবু, কাচা মরিচ। কাগজি লেবু ওসমান গণির বাড়ি থেকে চুরি করে আনা।
বাড়ির পাশে কাগজি লেবুর জঙ্গল। লেবু আনার সময় বাবু শুনেছে ওসমান গণি বৌকে পেটাচ্ছেন, তার টাকা চাই। বৌ এনে দিচ্ছে না।
ওসমান গণি রেগে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছে।
মধ্যরাত। ডিঙিতে মনির বেঘোর ঘুমে। বাবু শেখ, শ্যালক পা টিপে টিপে ওসমানের দরজায় এল।টোকা দিতেই রোকেয়া দরজা খুলে দিলো। সে ভেবেছে ওসমান ফিরেছে।
বাবু শেখ রোকেয়ার মুখ চেপে ধরলো। ঘরের মেঝেতে ফেলে দিয়েও কিছুতেই কাবু করতে পারছে না।
"ওই রাসু, তুই দুই ঠেং ধর।"
"আমি ঠেং ধরমু না।আমি ধরমু বুনি।"
পরদিন রোকেয়ার মৃত দেহ পাওয়া গেল।নাটোরের নলডাঙা উপজেলার বাসুদেবপুর গ্রামের মানুষ অবাক, বৌ পাগল ওসমান বৌ মাইরা ফেলছে!
রোকেয়ার ভাই মামলা করলো, ওসমান যৌতুকের জন্য রোকেয়াকে খুন করেছে।ওসমানকে যাবৎজীবন কারাদণ্ড দেয়া হল।
২০১৩ সালের ২১ শে আগষ্টের এই ঘটনাও অত গুরুত্ব পায়নি। বৌপাগল স্বামীও যৌতুকের জন্য বৌকে মেরে ফেলে, এটা এদেশে অস্বাভাবিক নয়!
৩...
জালপার্টি এখনো চলে। তবে গ্রাম বদলেছে, খাজুরা মোল্লাপাড়া গ্রাম। তাদের ডিঙি একেবারে রাস্তার পাশে। এই জলপার্টিতে আছে কালু, তার ছেলে আর শ্যালক।
রাস্তায় দিতে বাড়ি ফিরছে লাবনী। ওর পেছনে আসছে, দুইজন তরুণ। ওদের মোবাইলে গান চলছে,
"এই পথে যখন আমি যাই
মাঝে মাঝে একটা মেয়ে দেখতে পাই।
আলতা রাঙা পায় আবার নুপুর পরেছে
একটা বুরকা পরা মেয়ে পাগল করেছে....."
গানটা মানানসই, লাবনী বোরকা পরে আছে।দুইতালা বোরকা। কালুর শ্যালক এগিয়ে গেল,বললো,"মাইয়াডারে জ্বালাইতাছস কেন?" ছেলে দুটা কিছু বোঝার আগেই চড় খেয়ে ফেললো। ভয়ে দিল দৌড়!
কোন রহস্যময় কারনে লাবনী এটা মেনে নিতো পারলো না।
"আমার পিছে ওরা আইছে, আপনের সমস্যা কি?"বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে হনহন করে চলে গেল।
শ্যালক মন খারাপ করে ডিঙিতে বসে আছে। কালু তাকে স্বান্তনা দিয়ে বললো," মন খারাপ করিস না।আজ রাইতে মাইয়ার কিড়া ছুটামুনে। আইজ তুই আগে।"
নিশুতি রাত।সবাই ঘুমিয়ে পরেছে, লাবনী পড়ছে। দোতলার ঘর থেকে ওর গুনগুন করে পড়ার আওয়াজ আসছে। ওরা দুজন মঈ বেয়ে তরতর করে ঊঠে গেল।
লাবনী ছোট মেয়ে, মাত্র সেভেনে পড়ে।ওর কি আর নিজেকে বাচানোর অত শক্তি আছে?
কালু আফসোস করলেন, এই আনন্দে নিজের ছেলেকে আনলেই পারতেন। ছেলের বালেগ হয়েছে।
পুলিশ কাউকে আসামী করতে পারলো না।তবে সবাই দেখেছে দুজন তরুণ সেদিন স্কুলের গেট থেকেই লাবনীর পিছুপিছু আসছিল। কোন প্রমাণ নেই। পুলিশ দুই তরুণকে হাজতে আটকে রাখলো।
কাধের দুই ফেরেশতা সাক্ষি দিতে পারে না, কেন পারে না?
দিতে পারলে ২০১৪ সালের ৬ মে'র এই ঘটনাতেও দেশে তোলপাড় হত। বিচার পরের কথা!
৪...
আনোয়ার হোসেন, পুত্র মনির, শ্যালক রাসু ঢাকায় বাস করেন।চায়ের দোকানে যা আয় হয়, দিন অত খারাপ চলে না। রাতে কেবল ঘুম আসে না। আল্লাহ মানুষকে সকল নিষিদ্ধ কাজ করার ক্ষমতা দিয়েই ওগুলো করতে নিষেধ করেছেন! যে একবার আনন্দে বুদ হয়ে যায়, তার কি আর অতশত মনে থাকে? উপরে একজন আছেন, সব কাজের হিসেব নিবেন।
মনির স্কুলে যায়। আনোয়ার দেখে আনন্দ পায়, আবার আগের জীবনে ফিরে যেতেও মন চায়। এই চা-ওয়ালা জীবনে কি আর আনন্দ আছে?
রাসু মন খারাপ করে ঘোরাঘুরি করে!
গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ওরা ঢাকাতেই ছিল।
২৭ ফেব্রুয়ারী ওরা গ্রামে ফিরে গেল। ১টা খুন আর ১০ টা খুন শাস্তি একই!
বিগলগলিয়া গ্রামের শেফালী খাতুনকে সকালে মৃত বিবস্ত্র অবস্থায় পাওয়া গেল। সবাই আশ্চর্য!
তার ছেলে অজ্ঞাতনামা আসামীদের নামে মামলা করলো।
এতদিনের বিরতিতে সবাই আগের ঘটনা ভুলে গিয়েছে।
৫...
নলডাঙার বাসিলা গ্রামের মাহমুদুল হাসানের স্ত্রী হালিমা ওদের নজরে পরেছে।
রাতে ওর ঘরে প্রবেশ করলে, মনির একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,"আব্বা, আমরা এখানে কেন আইছি?"
আনোয়ার দাঁত বের করে বলে,"বাজান, এইডা অন্য রহম মজা, কইলে বুঝবা না।করলে বুজবা।আগে কর, পরে কতা কইবা।"
মনির ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
আনোয়ার দুইপা, আর রাসু হাকিমার দুই হাত ধরে আছে। মনিরকে যতটা আনাড়ি ভাবা হয়েছিল সে ততটা আনাড়ি নয়।বেশ ভালোই কাজ করছে।
পাশেই হালিমার দুই বছরের পুত্র আব্দুল্লাহ তারস্বরে চিৎকার করছে। মনির বিরক্ত হয়ে ছেলেকে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়ে এল।
হালিমার বয়স কম ছিল, একপুত্র জন্ম দিয়ে এমনিতেই কাহিল।
তিন জনের অত্যাচার সে নিতে পারেনি।
হালিমার বাবা দেবর মাহাবুল আলমকে আসামী করে মামলা করলেন। দেবরের চালচলন তার কাছে ভালো লাগেনি। মেয়েও তার কাছে বিচার দিয়েছিল, দেবর তার দিকে কেমন করে তাকায়। গোসলখানায় উঁকি দেয়! তিনি জামাইকে বলবো বলবো করে বলেননি।
পুলিশ মাহাবুল আলমকে রিমান্ডে নেন।সে ফৌজদারি আইনের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।
৬...
নিজের কীর্তি ছড়িয়ে দিতে হয়।এটাই নিয়ম। বাবু শেখ এ জন্যই নিজের আত্মীয় বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হাতীবান্ধা গ্রামে এলেন।
বাবর আলীর স্ত্রী সমলা বেওয়াকে নির্যাতন করে হত্যা করলেন এবছরের ৯ জুলাই।
১৪ সেপ্টেম্বর রাতে মির্জাপুর উপজেলার হরতকীতলা গ্রামের কানচু খানের স্ত্রী রুপভানু বেগমকে হত্যা করে বাবু শেখ। সিঁধ কেটে ঘরে ঢুকে রুপভানুকে হত্যা করা হয়। রুপভানু হয়তো শারিরীক নির্যাতন থেকে বেচে যায়, তার বয়স বেশি।
সেখান থেকে ৪৪ হাজার টাকার জিনিসপত্র চুরি করে পালায় বাবু শেখ। স্থানীয় পুলিশ এ দুটি ঘটনার রহস্য আজও উদ্ঘাটন করতে পারেনি।
৯ অক্টোবর নাটোরের লালপুরে সাহেরা বেগমকে মেরে ফেলে বাবু শেখ ও তার গ্রুপ। চুরি করে তার এন্ড্রয়েড মোবাইল, টাকা আর কিছু গয়না।
কাজ শেষে ফিরছিলো। রাস্তার পাশ দিয়ে হাটার সময় দেখলো অমেজান বেওয়া ঘরে ঘুমাচ্ছে। কাপড়ের ঠিক নাই, দরজাও খোলা!
একদিনে দুই খুন করলে কেমন হয়? যেমন কথা তেমন কাজ।
মনির ছোট ছেলে, ওর অত দম নাই। পরে গলায় কাপড় পেচিয়ে একটু অপেক্ষা, বুড়ির অত ক্ষমতা নাই।
অমেজান বেওয়া দুনিয়া ছাড়া হলেন।এতদিনে ছেলে মনির পাকা খেলোয়াড়, সেও পৈশাচিক আনন্দ পেয়ে গেছে।
মোবাইলে গান বাজায় আর পিতা-পুত্র-মামা শিকার খোজে।
৭...
পুলিশ বাবু শেখ, কালু, আনার বা আনোয়ার হোসেনকে ধরতে পেরেছে। তাও যতটা না তাদের কৌশলে তারচেয়ে হয়তো ওর গ্রুপের বোকামিতে। ওরা চুরি করা মোবাইলটা ব্যবহার করছিল।
আনোয়ার হোসেন ওরফে কালু, বা বাবু শেখ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে। নিজের খুনের দায় স্বীকার করেছে। কেন খুন করেছে?
খুন না করেও যদি আসামি হতে হয়, খুন করলে কি সমস্যা!আর মেয়েদের খুন করা সহজ, সহজে হাতের কাছেই পাওয়া যায়। একটি বয়সী হলে কথাই নেই; একা থাকে, গায়েও অত জোর নেই।
বাবু শেখ, কালু বা আনার এবং তার দল ধরা পরেছে দেখে আনন্দিত হবার কিছু নেই। হয়তো অন্য কোন স্থানে অন্য আনোয়ার হোসেনকে তৈরি হচ্ছে, কোন কালু, বাবু শেখ বা আনার! জড়িয়ে দেয়ার দ্বায়িত্ব পুলিশের।
ওসমান গণি, মাহমুদুল হাসান, মাহাবুল আলম বা ঐ দুই তরুণ যে নতুন কালু, বাবু শেখ বা আনার হবে না, এর নিশ্চয়তা কে দিচ্ছে?তারাও নাম বদলিয়ে খুন শুরু করলো বলে!কেন করবে?
তারাওতো আনোয়ার হোসেনের মত অন্যায়ের শিকার। জিঘাংসা বেশ সংক্রামক!
"যে কোনো স্থানে অন্যায় সব স্থানে ন্যায়ের প্রতি হুমকি। Injustice anywhere is a threat to justice everywhere."
কে বলেছে ভুলে গেছি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ১:৪৭