সন্ধ্যায় লালু ভাইয়ের দোকানে চায়ে টোস্ট বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছিলাম । সাধারণত এই সময়টায় যে প্রাইভেট টিউশনি করি সেই বাসায় চা খাই। আজ ছাত্রের ছোট বোনের জন্মদিন ; আমাকেও দাওয়াত দিয়েছিল- মাসের শেষ বলে এড়িয়ে গিয়েছি। পিছন থেকে হঠাৎ কে যেন বলে উঠল -লালু ভাই , সুমন কে এক পিস কেক দেন। শুধু শুধু শুকনো বিস্কুট খাচ্ছে।
পিছনে তাকিয়ে দেখি রফিক ভাই। রফিক ভাইয়ের হাসিমুখ শেষ কবে দেখেছি বলা মুশকিল, তবে তা প্রায় সাত বছরের বেশি হবে, কম না। রফিক ভাই ছিলেন মহল্লার ছেলেপুলেদের আইডল, আদর্শ ইয়াং ম্যান । আমরা অনেকেই সে সময় রফিক ভাইয়ের হেয়ার স্টাইল নকল করতাম।
ফুচকা খাওয়া থেকে পিকনিক- কি সাকরাইনে ঘুড়ি ওড়ানো বা ফানুস কেনা বা শবেবরাতের পটকা- সব আবদারই রফিক ভাইয়ের কাছে করতাম। দরাজ দিল রফিক ভাই সব আবদারই পুরণ করতেন , সবাইকে নিয়ে মেতে থাকতেন। মহল্লার যত খেলাধুলা , ফাংশন অরগানাইজ করা- সবকিছুতেই রফিক ভাই। আমাদের ক্রিকেট টিমের স্পনসর্শিপ, ফুটবল টিমের খাওয়া-দাওয়া জার্সি-বুট; সবকিছুতেই রফিক ভাই। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে মহল্লায় আমারা ছেলেপুলেরা রফিক ভাইয়ের নামে অজ্ঞান ছিলাম। প্রায় সাত -আট বছর আগে উনি হঠাৎ করেই কেন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিলেন। মহল্লার খেলাধূলার সেই পরিবেশটা এখন আর আগের মত সরগরম না ।
রফিক ভাই কে কোন অবস্থাতেই অসুখী লোক বলা চলে না। বাংলামোটরে চালু বনেদি ব্যবসা, মোটর পার্টসের । দুটা ৬ তলা বাড়ি মহল্লায়, একটার তিন তলায় দু ইউনিট নিয়ে ওনারা থাকেন। সুন্দরী স্ত্রী , ছেলেটাও ভালো ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ঢুকেছে। শ্বশুর বাড়ির অবস্থাও ভালো। কোথাও কোনো গ্যাঞ্জাম থাকার কথা না , বাড়ি ভাড়া থেকেই যা আসে তা থেকে সংসার খরচ চলেও কিছু রয়ে যায়। ওনার বাবাও দরাজ দিল ছিলেন। ওনার মাও কখনো আমাদের পেছনে খরচ করায় কোনো বাধা দেননি। বাবা মারা যাওয়ার পর রফিক ভাইই ব্যবসা সামলান; কিন্তু রফিক ভাইয়ের দূরে সরে যাওয়ার কারণ ব্যবসা না, কারণটা অনেক পরে জেনেছি।
শুরুটা হলো এভাবে। বিয়ের মাস চারেক পর থেকে রফিক ভাই কেমন করে যেন ধীরে ধীরে একটু একটু সরে গেলেন। মাধুরিমা ভাবীকে আমরা অনেক আগে থেকেই চিনি (সে সময় মাধুরিমা আপা বলতাম) । উনি রফিক ভাইকে চাপ দিয়ে আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন এটা ভাবাটাও কঠিন। কাজেই একটা বড় সময় আমরা একটা দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলাম রফিক ভাই দূরে সরে যাবার কারণ নিয়ে। তো জবাব টা পেয়ে গেলাম রফিক ভাইয়ের বাসায় গত বছর কাজের লোক ঢোকার পর ।
রফিক ভাইয়ের মা কাজের লোক পছন্দ করতেন না । বাসার যা কাজ , এমন খুব বেশি কিছু না । তাছাড়া আমরা নিজেরাও রফিক ভাইয়ের বাসায় বহু বার গিয়ে দেখেছি -- ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ওয়াশিং মেশিন থেকে শুরু করে ওভেন, টোস্টার- ইলেকট্রিক অ্যাপ্লায়েন্স যা যা থাকার কথা সবই আছে। কাজেই কাজের লোকের অভাবে খুব বেশি সমস্যা হবার কথা না।
যাহোক অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেল যখন রফিক ভাইয়ের মার গতবছর হঠাৎ করে হার্টের সমস্যা ধরা পড়লো। ঘরে ছোট বাচ্চা, দ্বিতীয় বাচ্চা আসার পথে। মাধুরিমা ভাবি সব সামলে উঠতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে ময়নার মাকে ঠিকে কাজের লোক হিসেবে রাখতে হলো।
ময়নার মা আরো ৩-৪ বাসায় কাজ করে, এদের মধ্যে আমার সমবয়সি হারুনদের বাসাও একটা। এই বাসাগুলোর কোন বাসায় কি রান্না হলো, কে কোন দামের চাল খায়, কার কতখানি তরকারি বেঁচে গেল বা কার বাসায় দুধ পুড়ে গেলো বা কার মোজায় ফুটো আছে সবই ময়নার মার কল্যাণে জানা যায়। যাহোক ময়নার মা আর হারুনের কল্যানে রফিক ভাইয়ের সমস্যার কারণ জানা গেল।
রফিক ভাইয়ের মা রফিক ভাইকে বিয়ের জন্য অনেকদিন থেকেই বলছিলেন। রফিক ভাইয়ের কোন পছন্দ আছে কিনা জানতে চাইছিলেন। আমরা এমনিতেই জানি রফিক এর তেমন কোন ইয়ে ছিল না। তবে রফিক ভাই একদিন কথায় কথায় ওনার মাকে বলেছিলেন মাধুরীমা কে বেশ লাগে।
মাধুরিমা আপু এ পাড়ারই মেয়ে। ওনার বাবা ব্যবসায়ী, জিন্দাবাজারে অনেক বড় ক্রোকারিজের দোকান আছে। মাঝখানে একবার দেখেছিলাম ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার সময় রিকশায় করে ১৫-২০টা কাপ-মেডেল নিয়ে ফিরছেন। ভালো অ্যাথলেট। কাজেই রফিক ভাইয়ের সাথে মাধুরিমা আপার বিয়ে খুব সুখের হবে , এটা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ ছিল না। বিয়েতে আমরা যথেষ্ট ফুর্তি ও করেছিলাম।
সমস্যা শুরু হয়েছিল বিয়ের পর কোন এক সময় রফিক ভাইয়ের মা মাধুরী আপাকে বলেছিলেন যে ওনার ইচ্ছে ছিল ছেলের বিয়ে কোন ডাক্তারের সাথে দেবেন। এরপর থেকেই বউ-শাশুড়ির সম্পর্কের অবনতি। বাসায় আসলে রফিক ভাই দু'পক্ষেরই অভিযোগ সামলাতে যেরবার । অবশেষে রফিক ভাই দোকানে অতিরিক্ত সময় থাকা শুরু করলেন। ব্যবসার কারণে মাঝে মাঝেই বাইরে যাওয়া শুরু করলেন। যখন আমাদের সাথে কথা বলতেন মুখে হাসি থাকতো না, অবশেষে আমাদের সাথে মেলা মেশা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেলো।
এই রফিক ভাই হঠাৎ করে হাসিমুখে আমাকে আর একটা কেক দেওয়ার জন্য লালু ভাই কে বলছেন, ঘটনা মেলাতে পারছিলাম না। রফিক ভাই নিজেও লালু ভাইয়ের দোকান থেকে একটা অতিরিক্ত সর দেওয়া চা নিলেন। এটাও গত ছয়-সাত বছরে ঘটেনি। যাহোক রফিক ভাই প্রায় এক ঘন্টা ধরে আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ক্লাব এর খবরা খবর নিলেন। ব্যাডমিন্টন খেলার কী ব্যবস্থা জিজ্ঞাসা করে বললেন কালকেই বাল্ব এর সেট লাগানোর জন্য। পরশু থেকে রেগুলার খেলা চালু হয়ে যাবে ।
বাসায় যেয়ে ভাবছিলাম- ঘটনা কি করে কি হলো। যাহোক পরদিন দুপুরে শানে নুজুল জেনে গেলাম। ঘত দুমাস হলো ময়নার মা আমাদের বাসাতেও সকালবেলা কাপড় ধুয়ে দিয়ে যায়। ময়নার মার কাছ থেকে যা জানা গেল তাই তা এই যে হঠাৎ করে বউ শাশুড়ি খুব ভাব হয়ে গেছে। মাধুরিমা ভাবী এখন নিয়মিত প্রতিদিনই শাশুড়িকে নিয়ে শপিং এ যান, এটা সেটা কিনে দেন, জড়িয়ে ধরেন, দিনে কয়বার করে কোলাকুলি করেন। বউ শাশুড়ি এখন অনেক ভাব।
এটা ফেব্রুয়ারির শেষের দিকের কথা। এর পরের তিন সপ্তাহ আমি নিজেও দেখেছি মাধুরিমা ভাবি আর ওনার শাশুড়ি গাড়িতে করে শপিংয়ে যাচ্ছেন বা ফিরছেন। মাঝে মাঝে রিক্সায়ও দেখেছি, রফিক ভাই গাড়ি নিয়ে বাইরে থাকলে। কোলাকুলির ব্যাপারটা দেখিনি, তবে ভাবি যে শক্ত করে মাঝে মাঝেই শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরছেন তা চোখে পড়েছে।
এরপর লকডাউন শুরু হয়ে গেল । ময়নার মা বেতন নিয়ে চলে গিয়েছে। আবার মে মাসের ১ তারিখে এসে বেতন নিয়ে যাবে । শপিংমলগুলো বন্ধ। মাধুরিমা ভাবি আর শাশুড়ির সাথে শপিং-এ যেতে পারেন না। তবে মাঝে মাঝেই বারান্দা দিয়ে দেখি , বউ শাশুড়ি একসঙ্গে বেরিয়ে কাঁচাবাজারে যাচ্ছেন , আর বাজার সেরে একসঙ্গে হাত ধরাধরি করে বাসায় ফিরছেন। রফিক ভাইয়ের অনেক দিনের কষ্ট সম্ভবত দূর হয়েছে ।
বিবাহিতা মহিলাদের বলছি, আপনারা আপনাদের শাশুড়িকে নিয়মিত হাগ করুন, জড়িয়ে ধরুন, বউ শাশুড়ি এক সাথে সব্জির বাজার করুণ। তবে যে সমস্ত মহিলাদের নিজেদের হার্টের সমস্যা আছে বা ডায়াবেটিস আছে তারা এত শাশুড়ি সোহাগি না হলেও চলবে।
*মাধুরিমা নামটির কপিরাইট উম্মুক্ত করায় ইসিয়াক ভাইকে কৃতজ্ঞতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২০ রাত ৯:৫৯