somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প বলার রাত (মনস্তাত্ত্বিক গল্প)

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




এক
সন্ধ্যা সাতটা বাজে। অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েছি। গা ম্যাজম্যাজ করছিল। আজ শীতও পড়েছে বেশ। হালকা একটা ঘুম দিয়ে উঠে ফুটবল ম্যাচ দেখব ভেবেছিলাম। বিছানায় শুয়ে কম্বলটা নাক পর্যন্ত টেনে যেই না শুয়েছি, বেরসিকের মতো ফোন বেজে উঠল আমার।
“হ্যালো!”
“আতিকুল হক বলছেন?”
“জ্বী, কে বলছেন?”
“আমার নাম শামসুর রহমান।”
“কি চান?”
“আমি আপনাদের ব্যাংকে একটা একাউন্ট খুলতে চাচ্ছিলাম।”
আমি বুঝতে পারলাম কেউ আমার সঙ্গে ফাজলামো করছে। আমি ব্যাংকে চাকরি করি সেটা সত্য, কিন্তু এই ভর সন্ধ্যায় এভাবে ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে ফোন করে কেউ ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে চাইবে বলে মনে হয় না।
“আপনি কি ফাজলামো করছেন?”
“না, সত্যি একটা একাউন্ট খোলা দরকার আমার।”
“কাল ব্যাংকে আসুন, কথা হবে।”
“ঠিক আছে, আসব। আচ্ছা আমি কি আপনার বন্ধু হতে পারি? আপনার ভয়েসটা অনেক কিউট।”
আমি তার রসিকতায় বিরক্ত হবার বদলে সন্দিহান হয়ে উঠলাম। “আপনার নাম কি যেন বললেন?”
“শামসুর রহমান।”
“শামসুর রহমান...তুই কি শামসু?”
ফোনের ওপাশে কয়েকজনের সমস্বরে হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। তার মানে শামসু একা নয়, ওর সাথে আরও কয়েক জন আছে। সম্ভবত আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অন্যান্য বন্ধুরা।
“শালা হারামজাদা মাত্র ৩ বছরে আমাদের ভুলে গেলি, আমি তো তোর কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম যে ফোনটা তুই ধরেছিস!”
“শামসু তুই কি একা?”
“নাহ, আমার সাথে রাকিব, রবিন, সাঈদ, সাথী আর নিশিতা আছে।”
“মাই গড! ৬ জন একসাথে হলি কিভাবে?”
“অফিসের কাজে আমি, সাথী আর সাইদের চিটাগাং আসার কথা ছিল। তুই তো জানিস আমরা তিনজন একই কোম্পানিতে চাকরি করি। বিজনেস ট্রিপে চিটাগাং আসার সুযোগটা পেয়ে লুফে নিলাম। তুই আর রবিন তো চিটাগাংয়েই থাকিস। রাকিবকে ফোন করে জানাতে সেও খুলনা থেকে চলে এলো এখানে। নিশিতার পোস্টিং খাগড়াছড়িতে, কাছেই, সেও চলে এলো শুনে। চমৎকার একটা রি ইউনিয়ন মতো হলো, কি বলিস?”
“আসলেই। কোথায় তোরা?”
“মেহেদীবাগে, রবিনের বাসায়। তুইও চলে আয় জলদি! আড্ডা হবে। রাতে খিচুড়ি রাঁধবে রবিনের বউ। উই’ল হ্যাভ আ গ্রেট টাইম।”
“আসছি।”
পাঞ্জাবীর উপর শালটা জড়িয়ে নিলাম আমি। অপর্ণা বসে বসে টিভি দেখছিল। প্রেগন্যান্ট সে।অফিস থেকে ম্যাটারনিটি লিভ নিয়েছে। আমি পেছন থেকে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলাম। একবার চোখের কোণ দিয়ে আমার দিকে তাকাল সে, তারপর আবার টিভি দেখায় মন দিয়ে বলল-“বেরোচ্ছ?”
“হ্যা, একটু রবিনের বাসায় যাব।”
এবার অপর্ণা ভাল করে দেখল আমাকে। “হঠাৎ রবিনের বাসায়? জানি তোমার ইউনিভার্সিটি ফ্রেন্ড, কিন্তু খুব একটা তো যাও না ওর বাসায় তুমি।”
ঠিক বলেছে সে। গৎবাঁধা জীবন আমার; অফিস-বাসা-অফিস করে কাটিয়ে দেই। ছুটির দিনে মাঝে মধ্যে কলিগদের সাথে ঘুরতে বেরোই, কখনো অপর্ণাকে নিয়ে ভাল কোন রেস্টুরেন্টে যাই, কিছু সেলফি আপলোড করি ফেসবুকে, ব্যস! এই রুটিনেই জীবন চলছে গত তিন বছর ধরে।
অপর্ণা জানে, আমি ছাত্রজীবনের বন্ধুদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখি না। রবিনের বাসা আমাদের বাসা থেকে ১০ মিনিটের হাটা দূরত্ব। কিন্তু বছরে দু’তিন বারের বেশি ওর সাথে আমার দেখা হয় না। যখন দেখা হয়, তখনো ইচ্ছাকৃত ভাবে হয় না সেটা। দৈবাৎ দেখা হয়ে যায়, একই এলাকায় থাকি বলে। কাজেই হঠাৎ করে এই ভর সন্ধ্যায় নিয়মিত রুটিন ভেঙে রবিনের বাসায় যাবার ঘটনাটা তার কাছে অদ্ভুত মনে হতেই পারে।
“আসলে ইউনিভার্সিটিতে আমাদের গ্রুপের ৬ জনই রবিনের বাসায় এসেছে। তাই ভাবলাম, দেখা করে আসি। একটা রিইউনিয়ন হোক ছোটোখাটো।”
“তোমাদের গ্রুপ বলতে?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। প্রায় তিন বছর হয়ে গেল অপর্ণার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে আমার। অথচ আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন সম্পর্কে তেমন একটা সে জানে না। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে খুব একটা গল্প করি না আমি। এমন নয় যে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ভালো কাটেনি। বরং বলা চলে অনেকের চেয়েই উচ্ছল, প্রাণবন্ত, উল্লাসিত দিন কাটিয়েছি আমি। তবুও অপর্ণার সাথে এ নিয়ে সেভাবে আলোচনা করা হয়নি কখনো।
আমি অপর্ণাকে বললাম-“আমাদের ৭ জনের একটা গ্রুপ ছিল ইউনিভার্সিটিতে। নিজেদের মধ্যে নোট দেয়া নেয়া করতাম, গ্রুপ স্টাডি করতাম, আড্ডা দিতাম, ঘোরাফেরা করতাম...একজনকে তো চেনোই, রবিন। বাকীরা হলো শামসু, রাকিব, সাঈদ, সাথী আর নিশিতা।”
অপর্ণা আমার দিকে তাকাল অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে। কি যেন বুঝতে চাইল। তারপর বলল-“তুমি কি শুধু রিইউনিয়নের জন্যই যেতে চাও, নাকি আরও ব্যাপার আছে?”
ধরে ফেলেছে অপর্ণা। এতবছর দূরত্ব রেখে, আজ হুট করে ওদের সাথে এভাবে দেখা করতে রাজি হওয়ার পেছনে আরও একটা কারণ আছে। কিন্তু অপর্ণা কি ভাবছে আমি বুঝতে পারলাম না। যেহেতু দলে দু’জন মেয়ে আছে, অপর্ণা কি ওদের কারো জন্য আমার মনে দুর্বলতা আছে, এমন ভাবছে? যদি এমন ভাবে তাহলে যাওয়া উচিত হবে না। নাকি আসল ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছে সে?
আমি ক্রিয়েটিভ মানুষ নই। কি করে বানিয়ে বানিয়ে, ভণিতা করে মিথ্যা বলতে হয় জানি না। তাই ইতস্তত গলায় বললাম-“না, আর কি ব্যাপার থাকবে!”
আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম না। জানি আমার মিথ্যে সে ধরতে পেরেছে। চোখে চোখ মিলিয়ে বিভ্রান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে লাভ নেই।
“ঠিক আছে, যাও। রাতে কি বাসায় খাবে?”
“নাহ, খেয়েই আসব। কুলসুমকে বলো শুধু তোমাদের দু’জনের জন্য রাঁধতে।”
কুলসুম বাসার কাজের মেয়ে। আমরা পার্মানেন্ট কাজের লোক রাখি না। অপর্ণার প্রেগন্যান্সির পর কুলসুমকে রাখা হয়েছে খন্ডকালীন সময়ের জন্য।
অপর্ণা মাথা দুলিয়ে বলল-“আচ্ছা।”
আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। দরজা বন্ধ করার সময় শুনতে পেলাম, অপর্ণা কুলসুমকে বলছে-তিনজনের জন্যই রাঁধিস।

দুই
রবিনের বাসায় গিয়ে বেশ অবাক হলাম আমি সবাইকে দেখে। তিন বছরে বেশ বদলে গেছে ওরা। যদিও ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে ছবি দেখে আঁচ করতে পারতাম কিছুটা, কিন্তু বাস্তবে পরিবর্তনগুলো অনেক স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল চোখে।
চমৎকার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি রেখেছে শামসু। চোখে রিমলেস চশমা। একটা বিজনেস টাইকুন ভাব ফুঁটে উঠেছে ওর চেহারায়। অথচ ছাত্রজীবনে বেশ হাবাগোবা দেখাত ওকে। যদিও চেহারার সাথে কথা-কাজের মিল ছিল না কোন। ওর সেন্স অফ হিউমার ছিল অসাধারণ। চমৎকার স্যারকাজম করতে পারত।
সাঈদ ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ। পত্রপত্রিকায় কলাম লিখত ছাত্র অবস্থায়ই। আমাদের যে কোন প্রজেক্টের কাজে, প্রেজেন্টেশনের কাজে অসাধারণ সব আইডিয়া দিতে পারত। ও থাকতে প্রজেক্ট-প্রেজেন্টেশনে ভাল মার্কস তুলতে আমাদের বেগ পেতে হতো না মোটেও। আগে ক্লিন শেভ করে থাকত সব সময়। এখন বেশ চাপ দাড়ি গজিয়েছে মুখে! চুল রেখেছে ঘাড় পর্যন্ত লম্বা। মোটা ফ্রেমের চশমায় কমিউনিস্ট পার্টির উঠতি কোন বুদ্ধিজীবী নেতার মতো দেখাচ্ছে তাকে।
ফিটফাট জিমন্যাস্টিক শরীর ছিল রাকিবের। গ্রুপের একমাত্র লেডি কিলার চেহারার অধিকারীছিল সেই। চমৎকার ইংরেজি বলতে পারত, একদম রয়্যাল ব্রিটিশ একসেন্টে। আমাদের গ্রুপ প্রেজেন্টেশনগুলো উপস্থাপন করত সে-ই। এখন আর জিমন্যাস্টিক শরীর নেই যদিও, মুটিয়ে গেছে হালকা। লেডিকিলার চেহারায় গাম্ভীর্য এসে ভর করেছে।
রবিনকে মাঝে মাঝেই দেখি যেহেতু, তাই ওর পরিবর্তনগুলো তেমন ধরা পড়ল না চোখে। আগের মতোই লাগে ওকে আমার। বেঁটেখাটো পোক্ত শরীর, সরল-সোজা মানুষ, কারো সাতে-পাঁচে নেই।
সাথী বোধহয় সবচেয়ে বেশি বদলেছে। আমাদের মধ্যে ওরই সবার আগে বিয়ে হয়েছে। এতদিনে দু’ছেলের মা সে। কাজেই শরীরে মা মা ভাবটা ফুটে উঠেছে ভালোই। বান্ধবী ভাবটা নেই আগের মতো। যদিও ইউনিভার্সিটিতে ডার্লিং গার্ল টাইপের চরিত্র ছিল সে। সবার সঙ্গে ভাল বন্ধুত্ব ছিল তার। অনেক ছেলে ওর সাথে ফ্লার্টিং করত, সেও উপভোগ করত ব্যাপারটা।
নিশিতা ছিল আমাদের মধ্যে সবচেয়ে পড়ুয়া মেয়ে। নোট তৈরির কাজগুলো বেশিরভাগই সে করত। সবচেয়ে ভালো সিজিপিএ ছিল তার। স্মৃতিশক্তিও অসাধারণ ছিল, একদম ফটোগ্রাফিক মেমোরি। আমাদের মধ্যে সে একমাত্র বিসিএস ক্যাডার। তবে নিশিতা বদলায়নি মোটেও। তিন বছর আগে যেমন দেখেছি ওকে, এখনও তেমনই আছে। ওর বিয়ে হয়েছে শুনেছি, ছেলেমেয়ে আছে কিনা মনে করতে পারলাম না। ফেসবুকে খুব একটা পোস্ট দেখা যায় না ওর। চাকরী জীবনেও অনেক সিরিয়াস, বোঝা যায়।
আমাকে ঢুকতে দেখে হৈ হৈ করে উঠল সবাই। যেন কফি হাউজের ৭ জন এক হয়েছে এতদিন পর।
শামসু উঠে এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে। সাঈদও যোগ দিল। তারপর একে একে বাকী ৫ জন। আমার চোখে জল চলে এলো। কতদিন পর সবার ছোঁয়া পেলাম! কতদিন পর আমার সেই পুরনো, ইউনিভার্সিটিতে পড়া আড্ডাবাজ অস্তিত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠল! আমি দু’হাতে সবাইকে জড়িয়ে ভেজা গলায় বললাম-“আস্তে বাপ, দম বন্ধ হয়ে যাবে তো আমার।”

তিন
আহা, কত গল্প! কতদিনের জমানো গল্প!! বুকের আনাচে কানাচে জমে ছিল এত কথা, মগজের গলি ঘুপচিতে এত শত শব্দ লুকিয়ে ছিল এতদিন, কে জানত!
অনেকক্ষণ ধরে আমরা অনর্গল কথা বলে গেলাম। কার জীবন কেমন চলছে, কে কোথায় কি করছে আজকাল, এসব খোঁজ খবর নিয়ে ইউনিভার্সিটি লাইফের স্মৃতিগুলো রোমন্থন করলাম। খুব বেশিদিন হয়নি, মাত্র ৩ বছর। অথচ এরই মধ্যে সবার জীবনে কত কি ঘটে গেছে!
চুপচাপ, গম্ভীর ব্যক্তিত্ব ছেড়ে উচ্ছল তরুণ-তরুণীতে পরিণত হলাম যেন আমরা। গল্প যেন ফুঁড়োতেই চায় না। মাঝখানে রবিনের স্ত্রী, সুজাতা এসে চা-নাস্তা দিয়ে গেছে সবাইকে। সুজাতা রবিনের মতোই শান্ত-নির্বিরোধী মেয়ে। এতজন পুরনো বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে এসে শুধু শুধু আড্ডায় বাগরা দিতে চাইল না সে। অবশ্য আমরা বলেছিলাম তাকে, একা একা বসে না থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিতে, কিন্তু সবার জন্য খিচুড়ি রাঁধছে-এই চমৎকার অজুহাত দিয়ে ভেতরে চলে গেল মেয়েটা।
দেড় কি দু’ঘণ্টা পেরিয়ে গেল এভাবে। রাত হয়ে এসেছে। রাত আটটা কিংবা সারে আটটা বাজে বোধহয়। আজ রাতেই সবাই যে যার শহরে চলে যাবে। শামসু, সাঈদ আর সাথী ট্রেনের টিকেট কেটে রেখেছে। আজ রাত সারে এগারটার তূর্ণা নিশিথায় ঢাকা ফেরত যাবে ওরা। রাকিবও নাকি ওদের সাথে যাবে। ঢাকা পর্যন্ত ওদের সাথে গিয়ে তারপর খুলনার বাস ধরবে। সে টিকেট কেটে রাখেনি, তবে রেল কর্মকর্তাদের মধ্যে কে যেন আছে ওর পরিচিত। টিকেট পেতে অসুবিধে হবে না। নিশিতা এত রাতে আর খাগড়াছড়ি যাবে না। কাল সকাল সকাল গিয়ে বাস ধরবে। আজ রাতটা থেকে যাবে রবিনের বাসাতেই। কাজেই আমাদের এই সংক্ষিপ্ত রিইউনিয়ন পর্ব শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে প্রায়। রাতের খাবার খেয়েই যে যার পথে চলে যাবে। জীবন ফিরে যাবে পুরনো ট্র্যাকে। এই একদিনের স্মৃতি মাথার ভেতর ঘুরঘুর করবে বহুদিন। আরও ৫-৭ বছর পর আরেকটা রিইউনিয়ন হলেও হতে পারে।
ব্যাপারটা উপলব্ধি করতেই আমাদের উপর বিষণ্ণতা ভর করল। নিশিতা ব্যাপারটা টের পেয়ে একটা আইডিয়া দিল আমাদের।
“তোদের কি মনে হচ্ছে না, আমাদের আজকের আড্ডায় কি যেন একটা বাদ পড়ে গেছে?”
সবাই প্রথমে মুখ চাওয়া চাওয়ি করল কিছুক্ষণ। তারপর মনে পড়তেই চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল সবার। কি বাদ পড়েছে সবাই জানি আমরা।
সাঈদের গল্প!
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে যখন আমরা দূরের ট্রিপে যেতাম, তখন প্রতি রাতে সাঈদ আমাদের একটা করে গল্প বলত। সাঈদ ক্রিয়েটিভ আর লেখক মানুষ আগেই বলেছি। সে গল্পও বলতে পারত জমিয়ে। হরর গল্প, প্যারানরমাল গল্প কিংবা সাইকোলজিক্যাল গল্প বলত সাঈদ।কখনো বলতো ক্রাইম ফিকশান। মুখে মুখে গল্প বানিয়ে ফেলতে পারত। আমরা সবাই তন্ময় হয়ে শুনতাম। রাতের পরিবেশে ওর গল্প শুনে ছমছম করে উঠত গা। এতদিন পর আরেকটা রাত পেয়েছি আমরা। কাজেই সুযোগটা কাজে লাগানো উচিত।
সবাই মিলে সাঈদকে ধরলাম গল্প বলার জন্য। সাঈদ আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গীতে হাত তুলে বলল-“আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে। বলব আমি গল্প। তবে, একটা শর্ত আছে।”
সবাই সমস্বরে জানতে চাইলাম, কি শর্ত!
সাঈদ বলল-“পুরনো দিনের চেয়ে একটু আলাদা হবে আজকের গল্প বলার প্রোগ্রাম। আমি তো একটা গল্প বলবই, সবাইকেই একটা করে বলতে হবে আর সেটা হতে হবে ভয়ের গল্প, মনস্তাত্ত্বিক গল্প কিংবা অপরাধের গল্প। আর গল্পটা ইনস্ট্যান্ট বানিয়ে বলতে হবে। কোন বই কিংবা সিনেমার গল্প বানিয়ে বলা যাবে না। আমি বইপোকা আর সিনেমাখোর মানুষ, এমন কিছু করলে ধরা খেয়ে যাবি।”
এবার বিপদে পড়া গেল। সবাই এটা সেটা বানিয়ে একটা দু’টো গল্প বলতেই পারবে, কিন্তু আমার জন্য ব্যাপারটা কঠিন। আমার সৃজনশীলতা শূন্যের কোঠায়। ব্যাংকে চাকরী করি, সৃজনশীলতার তেমন দরকার হয় না। ছাত্রজীবনেও বই পড়ে, মুখস্থ পড়াশোনা দিয়ে ভাল রেজাল্ট করেছি। কখনো কোন ক্রিয়েটিভ কাজের সাথে জড়িত ছিলাম না। কাজেই ব্যাপারটা আমার জন্য অনেক কঠিন। তাই আমি প্রতিবাদ করলাম।
“উহু, আমি বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে পারব না।”
বলতে যা দেরী, অমনি তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়লাম।
“আরে বাবা, বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বললেই তো হলো। রবার্ট ব্লকের মতো ওয়ার্ল্ড ক্লাস সাইকো গল্প তো আর বলতে হবে না! আজকের আসরের জন্য ফুল-পাখি-লতা-পাতা একটা কিছু হলেই হয়।”
আমি নিমরাজি হলাম। শুরু হলো গল্পের আসর। প্রথম গল্পটা সাঈদই বলল।
“আচ্ছা, আমি গল্পটা ফার্স্ট পার্সন থেকে বলি। যেন, আমি নিজেই গল্পের একটি চরিত্র। সেই পুরনো দিনের মতো। কি বলিস?”
সবাই রাজি হলো একবাক্যে। শুরু করল সাঈদ।

চার
খাওয়া দাওয়া শেষ করে পকেটে হাত দিয়ে দেখি ওয়ালেটটা নেই। পেছনের পকেটে থাকার কথা ছিল, সামনের পকেট, বুক পকেটেও চেক করে দেখলাম। নেই। কি আশ্চর্য, হাওয়া হয়ে গেল আস্ত ওয়ালেট! মনে মনে হিসেব করলাম, হাজার চারেক টাকা ছিল ওয়ালেটে, আর একটা ক্রেডিট কার্ড। যাহ শালা!! এবার বিল দেবে কে আমার!
ওয়েটার বিল দিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। সারে তিনশো টাকা হয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম কোন পরিচিত মুখ দেয়া যায় কিনা। নাহ, নেই কেউ পরিচিত। ভারী ঝামেলা হলো! এই রেস্টুরেন্টে আমি প্রায়ই আসি বটে, তবে তাই বলে ম্যানেজার বাকীতে খেতে দেবে এমনটা আশা করা যায় না। অভিজাত রেস্তোরাঁগুলো পুরোমাত্রায় ব্যবসায়ী। শস্তা হোটেলের মতো মামা-চাচা বলে বন্ধু পাতিয়ে টাকা বাকী রেখে বেরিয়ে আসা বোধহয় এখানে সম্ভব না।
একটাই উপায় আছে। কোন বন্ধুকে ফোন দেয়া। আশেপাশের এলাকায় কোন বন্ধু-বান্ধব থাকে কিনা মনে করার চেষ্টা করলাম। ঠিক তখন এক অল্পবয়সী সুন্দরী মেয়ে এসে বলল-“এক্সকিউজ মি! আমি কি এখানে বসতে পারি?”
আমি ভ্রু কুঁচকে দেখলাম মেয়েটাকে। এতক্ষণ পাশের টেবিলে বসে ছিল। খেয়াল করেছি। একবার চোখাচোখিও হয়েছিল। বয়স আরেকটু কম হলে হয়তো বুকের ভেতরটা নেচে উঠত। ভাবতাম মেয়েটা প্রেমে পড়ে গেছে আমার সুদর্শন চেহারা দেখে। তাই চলে এসেছে বন্ধুত্ব পাতাতে। এখন তেমন ভাবলাম তো নাই, বরং সন্দিহান হয়ে উঠলাম। জিজ্ঞেস করলাম,“আমি কি আপনাকে চিনি?”
মেয়েটা মিষ্টি করে হাসল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল-“না, তবে আমি আপনাকে চিনি। আপনার নাম কবির চৌধুরী।”
আমি বিস্ময় চেপে রাখার কোন চেষ্টা করলাম না। “আপনি কি করে জানলেন?”
“কারণ আমি মাসুদ রানা পড়ি।” বলেই মেয়েটা হেসে উঠল। অল্পবয়সী মেয়েদের সেন্স অফ হিউমার এমনই হবার কথা। অবাক হলাম না আমি। গম্ভীর হয়েই তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা সেটা খেয়াল করল। বলল-“সরি, কিছু মনে করবেন না। আমার নাম তমা। আমি রেড’স ব্লাড ডোনেশন ক্লাবের সদস্য। আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল দু’মাস আগে। আপনি রক্ত ডোনেট করতে এসেছিলেন আমাদের ক্লাবে।”
ওহ, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি! এই ক্লাবটা আমাদের এলাকায় নতুন হয়েছে। বিভিন্ন তরুণ সংগঠনের স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি আজকাল বেশ সাহায্য করছে মানুষকে। মুহূর্তেই যে কোন গ্রুপের রক্ত পাওয়া যায় এই সব প্রতিষ্ঠানের জন্য, তাও বিনামূল্যে। বেশ ভালো উদ্যোগ।
আমি হেসে তমাকে বললাম, “ও তাই বলুন, মাফ করবেন! আজকাল কিছু মনে থাকে না। তবে আপনি আমাকে মনে রেখেছেন দেখে অবাক হলাম, থ্যাংক ইউ!”
“ইউ আর ওয়েলকাম। কেমন আছেন কবির সাহেব?”
“ভালো। আপনি?”
“আমি ভালো আছি। তবে আপনাকে দেখে আসলে অস্থির মনে হচ্ছে। কোন সমস্যা?”
“সমস্যাটা বিব্রতকর। বাদ দিন।”
“ওহ, বুঝেছি। অসুবিধে নেই আমি বিল দিয়ে দিচ্ছি আপনার।”
আমি বেশ অবাক হলাম। মেয়েটা এত সহজে বুঝে গেল! “আপনি কি করে বুঝলেন আমার ওয়ালেট হারিয়েছে?”
তমা আবারও হাসল মিষ্টি করে। “অবাক হবার কিছু নেই। আপনি যেভাবে পকেট হাতাচ্ছিলেন পাংশু মুখে, পাশের টেবিলে বসে দেখেই বুঝেছিলাম ওয়ালেট হারিয়ে ফেলেছেন আপনি।”
“ওহ, আপনি বেশ বুদ্ধিমান এবং...সুন্দরীও। বিউটি উইথ ব্রেন।”
তমা প্রশ্রয়ের হাসি হাসল। বলল-“থ্যাঙ্ক ইউ কবির।” মেয়েটা আমার চেয়ে বয়সে ছোট, কিন্তু কবির ভাই না বলে শুধু কবির বলল। বিষয়টা লক্ষ্য করলাম।
আমার বিল দিল তমা, সাথে নিজেরটাও। তারপর বাইরে বেরিয়ে এলম দু’জন। তমা জানতে চাইল-“কোথায় যাবেন আপনি এখন?”
“আমি বাসায় যাব। আপনি?”
“আমি একটু ইউনিভার্সিটিতে যাব।”
“ওহ, আচ্ছা!”
“ঠিক আছে, যাই তাহলে। একই এলাকায় থাকি যখন, দেখা হবে আবারও।” তমা হেসে চলে যেতে গিয়ে থেমে গেল। বলল-“একটা কথা, আপনাকে বেশ ভালো মানুষ বলে মনে হচ্ছে। আপনি আর কখনো রেড’স ব্লাড ডোনেশন ক্লাবে রক্ত দেবেন না। ক্লাবটা ভাল নয়।”
আমার নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগল। সে আসলে কি বুঝাতে চাইল পরিষ্কার বুঝিনি!
দু’দিন পরের কথা। এলাকায় রেড’স ব্লাড ডোনেশনের অফিসে গেলাম। ক্লাবের ছেলেরা আমাকে চেনে। আমাকে দেখে তারা কুশল জানতে চাইল। ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম-“তমা নামের মেয়েটা কোথায় থাকে বল তো?”
ছেলেটা বলল-“তমা কে ভাই?”
“কেন, চিনিস না? তোদের ক্লাবের সদস্য!”
“এই নামের তো কোন মেয়ে নেই আমাদের ক্লাবে।”
“বলিস কি!”
“কেন ভাই কি হয়েছে?”
“নাহ, কিছু না।”
আমি তাদের কিছু না বলে চলে এলাম। মেয়েটা যদি এই ক্লাবের সদস্য না হয় তাহলে কে সে! আমাকে চিনলই বা কি করে।
সেদিনের পর আমি এই ক্লাবটা সম্পর্কে খোঁজ নিতে লাগলাম এবং অবাক করা একটা তথ্য পেলাম। ক্লাবটা রক্ত নেয় বটে, তবে সেই রক্ত কোন হাসপাতালে, কোন পেশেন্টকে দেয় না। ব্যাপারটা সন্দেহজনক। রক্ত নিয়ে তারা আসলে কি করে! রহস্যময় মেয়েটাই বা কে ছিল!
সেদিন রাতে তমার ফোন এলো। ওর নাম্বার ছিল না আমার কাছে, কিন্তু গলা শুনে কি করে যেন চিনতে পারলাম। “কবির চৌধুরী বলছেন?”
“জ্বী, বলছি। তমা বলছেন?”
“কি করে চিনলেন?”
“কণ্ঠ শুনে।”
“ও, আচ্ছা। আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।”
কত প্রশ্নই আছে, তমা আসলে কে, কি করে আমাকে চেনে, রেড’স ব্লাড ডোনেশন ক্লাবের সাথে কি করে জড়িত, ক্লাব সম্পর্কে সে কি জানে...আরও কত কি! কিন্তু আমি কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না।
“না, কোন প্রশ্ন নেই।”
“ওহ। আচ্ছা আমার প্রশ্নটাই করি। রেড’স ব্লাড ডোনেশন ক্লাবের নাম রেড’স কেন? এই অংশটা কি বুঝাচ্ছে?”
“হয়তো রক্তের রঙ লাল, সেটা বুঝাচ্ছে।”
“তাহলে শুধু রেড হতে পারত, রেড’স কেন?”
“কি জানি! নামে কি যায় আসে?”
“অনেক কিছুই যায় আসে। রেড’স মানে হলো রেনফিল্ড’স সিন্ড্রম। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। এই রোগীরা মানুষের রক্ত খায়। রক্তের প্রতি তাদের এক ধরনের অবসেশন কাজ করে। রেড’স ব্লাড ডোনেশন ক্লাবের সদস্যদের প্রত্যেকেরই এই রোগটা আছে। কাজেই তারা রক্ত নিয়ে কি করে বুঝতেই পারছেন!”
“মাই গড! কি বলছেন!! সোশ্যাল ওয়ার্কের নামে এ ধরনের জঘণ্য কাজ করতে পারে মানুষ!!”
“মানুষ অনেক কিছুই করতে পারে। যাই হোক, আপনাকে আমি কিন্তু ঐ ক্লাবেই চিনেছি। আপনিও সেদিন ব্লাড ডোনেট করতে এসেছিলেন। আমিও গিয়েছিলাম। আপনার সঙ্গে তখন পরিচয় হয়েছিল, আপনি ভুলে গিয়েছিলেন। আমি মনোবিজ্ঞানের ছাত্রী। ক্লাবের মেম্বারদের আচরণ আমার কাছে অস্বাভাবিক লেগেছিল। তাই এক সাংবাদিক বন্ধুকে বলেছিলাম খোঁজ নিতে। সেই বিষয়টা জানাল আমাকে। আপনার সাথে সেদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হলে একটু রহস্য করলাম।”
“আপনার সাংবাদিক বন্ধু কি পুলিশে জানিয়েছে বিষয়টা?”
“হ্যা, আজই জানিয়েছে।”
“যাক বাঁচা গেল। কি বিচ্ছিরি বিষয় বলুন তো!”
“তা ঠিক।”
“আচ্ছা আপনি আমার ফোন নম্বর কি করে পেলেন?”
তমা হাসল। বলল- “এটা রহস্যই থাক।”


পাঁচ
গল্প শেষ হতেই প্রশ্নের বান ছোটালাম আমরা।
“তমা কবিরের ফোন নম্বর কি করে পেল?”
“রেনফিল্ড’স সিনড্রম নামে আসলেই কি কোন রোগ আছে?”
“বাংলাদেশে এই রোগের রোগী আছে কোন?”
এমনকি শামসু ব্যাঙ্গ করতেও ভুলল না-“রক্তদানের মতো একটা মহৎ কাজকে এভাবে তুই কলুষিত করতে পারিস না!”
সাঈদ শান্তভাবে হেসে সবার প্রশ্নের উত্তর দিল। “হ্যা, এই নামের একটা রোগ আসলেই আছে। বাংলাদেশে এমন কোন রোগী আছে কিনা আমি জানি না। দুয়েকটা সার্ভে করে দেখা যেতে পারে। গবেষণার বিষয় নিঃসন্দেহে। আর কবিরের ফোন নম্বর তমা কি করে পেল, সেটা গল্পের মুখ্য বিষয় নয়। তারপরও একটা ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। ওয়েল, এ বিষয়টা নিয়ে এখন মাথায় আসছে না কিছু। এটা ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে হবে।”
সবাই হাসলাম ওর বলার ভঙ্গী দেখে।
এবার গল্প বলার পালা রাকিবের। কারণ, সাঈদের পাশেই রাকিব বসে আছে। সবাই রাকিবের দিকে তাকালাম আমরা। রাকিব একটু মাথা চুলকে বলল, “আমরা কেউ সাঈদের মতো স্টোরি টেলার নই। কাজেই ওর মতো এত বিস্তারিতভাবে, গুছিয়ে হয়তো গল্প বলতে পারব না। শুধু মাথায় যে গল্পটা এসেছে, সেটা নিজের মতো করে বানিয়ে বানিয়ে বলব।”
তা তো বটেই! আমরা এতে কিছু মনে করলাম না। রাকিব গল্পটা শুরু করল। রাকিবের শৈশবের কিছুটা সময় কেটেছে ইংল্যান্ডে। জন্মের পর ৫-৬ বছর পর্যন্ত ওর বাবার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরীর সুবাদে ইংল্যান্ডে ছিল সে। ওর গল্পের পটভূমিও হলো ইংল্যান্ড। সে শুরু করল গল্প বলা।

*** *** ***
ইংল্যান্ডের সাসেক্সে একটা ছোটখাটো বাংলোমতো বাড়ি রয়েছে চার্লির। বাড়িতে থাকত তার পঙ্গু স্ত্রী এবং এক গৃহ পরিচারিকা। পরিচারিকা রাখা হয়েছে তার স্ত্রীর পঙ্গুত্বের পর পরই।
চার্লির ধারণা, কোন অজানা কারণে মার্থা তাকে নিজের পঙ্গুত্বের জন্য দোষী ভাবে। অথচ সেই দুর্ঘটনায় চার্লির কোন হাত নেই। এক হ্যালোউইনের রাতে নিজের কয়েকজন বান্ধবীর সাথে মাতাল হয়ে হেডলাইট নিভিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল মার্থা। তখনই এক্সিডেন্ট হয়, একটা পা হারায় সে।
মার্থার চাকরী চালিয়ে যেতে খুব একটা কষ্ট হয়নি এক্সিডেন্টের পরও। মাহিলাদের ম্যাগাজিনে নিয়মিত গসিপ আর্টিকেল লিখত মার্থা। ঘরে বসে লেখালেখি চালিয়ে যেতে কোন অসুবিধে হয়নি তার। গৃহ পরিচারিকা রাখার পর দৈনন্দিন কাজ সারতেও তার কোন সমস্যা হতো না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মার্থার বিষণ্ণতা দিন দিন বেড়েই চলছিল। বিষয়টা চার্লিও উপলব্ধি করতে পেরেছিল ভালোভাবে। তাদের সম্পর্কে টান ধরছিল দিন দিন। তবে চার্লি কখনো কিছু বলেনি মার্থাকে। দিনের পর দিন পঙ্গুত্বের বোঝা বয়ে বেড়ালে কারই বা মন মেজাজ ভালো থাকে! সে মার্থাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবে ভাবছিল।
তখনই একদিন ব্যাপারটা চোখে পরে তার। মার্থার চেহারায় হতাশার বদলে এক ধরনের ঘোর দেখতে পায় সে। প্রায়ই মার্থা উদাস উদাস থাকত, কি যেন ভাবত আনমনে। যেন কিছু একটা পেয়েছে নতুন করে বেঁচে থাকার জন্য। ল্যাপটপে কি যেন টাইপ করত দিন রাত।
চার্লি প্রথমে ভাবল, মার্থা হয়তো নিজের উপন্যাস লেখা শুরু করেছে। একসময় সে তাকে বলেছিল যে ফিমেইল গসিপ বাদ দিয়ে নিজের একটা উপন্যাস সে পাবলিশ করতে চায়। হয়তো সেই উপন্যাস লেখায় হাত দিয়েছে এখন!
এভাবে কয়েক মাস কেটে যায়। একদিন চার্লি নিজের ল্যাপটপে ইন্টারনেট কানেকশান পাচ্ছিল না, অথচ খুব জরুরী কিছু মেইল করা দরকার তার। মার্থাকে বলে তার ল্যাপটপটা ধার নিল সে মেইলগুলো পাঠানোর জন্য। মেইল পাঠানো শেষে কি করতে গিয়ে যেন কন্ট্রোল এইচে চাপ পড়ে গেল। তারপর ব্রাউজার হিস্ট্রি সামনে আসতেই একদম তাজ্জব বনে গেল সে।
মার্থার গত দু’মাসের ব্রাউজিং হিস্ট্রিতে শুধু ফেসবুক আর কিছু কোয়েশ্চান-এনসার ফোরামের ওয়েবসাইট ছাড়া অন্য কিছু নেই। ফেসবুকে যদিও লগআউট করা, তবে ব্রাউজিং হিস্ট্রি বলছে, রিচ পানেল নামের এক ভদ্রলোকের প্রোফাইলে অনেকবার ভিজিট করেছে মার্থা। আর কোয়েশ্চান এনসার ফোরামে অনেকগুলো অদ্ভুত প্রশ্ন করেছে। যেমন-হাউ টু রান এওয়ে ফ্রম হাউজ, হাউ টু চিট অন ইওর পার্টনার, ক্যান এনি ম্যান বি ট্রাস্টেড...এ পর্যন্ত দেখেই চক্ষু চকড়গাছ হয়ে গেল চার্লির। তবে আরেকটা প্রশ্ন দেখে রীতিমতো গায়ের লোম দাড়িয়ে গেল তার-হাউ টু বি স্ট্যাবড উইদাউট ফিলিং এনি পেইন!
চার্লি কিছু ভাবতে পারল না আর। ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে বসে পড়ল দু’হাতে মাথা চেপে ধরে। অনেকগুলো প্রশ্ন তার মনে উঁকি দিল, মার্থা কি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার প্ল্যান করছে? অন্য কোন ছেলেকে ভালোবাসে সে? তার নাম কি রিচ পানেল? উহু, মিলছে না। শেষ প্রশ্নটা সব ওলোট পালট করে দিচ্ছে। কাউকে ব্যাথা না দিয়ে ছুরিকাঘাত করার উপায় জানতে চেয়েছে মার্থা, এর মানে কি? সে কি কোন অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে? নাকি একা একা ঘরে বসে থেকে নিছকই মজা করার জন্য প্রশ্নগুলো পোস্ট করেছে? যদি তাই হয়, তো ভাল। নাহলে পুলিশকে জানানো দরকার ব্যাপারটা। মার্থাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু এক্সিডেন্টের পর মার্থার মেজাজ অনেক খিটখিটে হয়ে গেছে। তার ব্রাউজিং হিস্ট্রি চেক করার কারণেই বড়সড় একটা ঝগড়া বেঁধে যাবে আজ রাতে।
চার্লি ঠিক করল পরদিন অফিসে গিয়ে নিজের এক সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুকে ব্যাপারটা জানাবে। রিচ পানেল সম্পর্কেও খোঁজ নিতে হবে। চিন্তা ভাবনা অনেক বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। সেগুলোকেও গোছাতে হবে সবার আগে।
পরদিন অফিসে গিয়ে প্রথমেই অফিসের কম্পিউটার থেকে রিচ পানেলের ফেসবুক আইডি খুঁজে বের করল সে। রহস্যময় প্রোফাইল একটি। পুরো প্রোফাইলের কোথাও কোন ব্যক্তিগত তথ্য দেয়া নেই। প্রোফাইল পিকচারের জায়গায় অদ্ভুত একটা ছবি। একটা সাদা দেয়ালে অর্থহীন শব্দ লেখা-
EPETALOPEI
এপেটালোপেই? এটা কোন ভাষার শব্দ?
গুগলে সার্চ করেও তেমন কিছু পেল না সে শব্দটা সম্পর্কে।
সারাদিন অনেক চিন্তা ভাবনা করে সে ঠিক করল, আজ বাসায় গিয়ে সরাসরি মার্থার সাথে আলোচনা করবে। ঝগড়াই বাঁধুক আর যাই হোক, বড় কোন বিপদ থেকে মার্থাকে বাঁচাতে হবে তার।
কিন্তু বিকেলে বাড়িতে গিয়ে সে দেখল, মার্থা নেই। তার ব্যাগ, জামা কাপড়, ক্রেডিট কার্ড, ল্যাপটপ, সবই বাসায়। শুধু মার্থা নেই। পরিচারিকা কিছু বলতে পারল না। সে ঘুমাচ্ছিল। চার্লি ডেকে তুলল তাকে। পরিচারিকা বলল, ঘণ্টাখানেক আগে ঘুমানোর সময়ও মার্থাকে বাড়িতে দেখেছিল সে।
তাহলে এখন কোথায় গেল মার্থা? এমনকি গাড়িও নিয়ে যায়নি। বাড়িতেই আছে গাড়িটা। পঙ্গু একটা মেয়ে কোথায় যেতে পারে এভাবে একা একা?
সে পুলিশকে জানাল। তারা বাড়িতে এলো। মার্থা সম্পর্কে সব শুনল। ব্রাউজিং হিস্ট্রির ব্যাপারটাও বলল সে তাদের। মার্থার ল্যাপটপটা নিয়ে গেল তারা।
কেটে গেল দু’টো সপ্তাহ। মার্থার কোন খোঁজ পায়নি পুলিশ। তবে আইপি এড্রেস ট্র্যাক করে, কিভাবে যেন রিচ পানেলকে খুঁজে বের করেছে তারা। চার্লি খবর পেয়ে পুলিশ স্টেশনে গেল। দেখল রিচ পানেলকে। অল্পবয়সী ছোকরার মতো দেখায় তাকে, দাড়ি ওঠেনি বলেই বোধহয়। তবে বয়স হয়েছে। গোঁফ রেখেছে হালকা। ড্রাগ এডিক্টের মতো চোখ। সে স্বীকার করল যে মার্থাকে চেনে সে। কিন্তু মার্থার নিখোঁজ হবার ব্যাপারে কোন তথ্য দিতে পারল না। তবে অদ্ভুত ব্যাপার, মার্থার সঙ্গে ফেসবুকের সব চ্যাট হিস্ট্রি সে মুছে দিয়েছে। পুলিশ জানাল, আরও বিস্তারিত ইন্টোরোগেশন করবে তারা।
বেরিয়ে আসতে যাবে চার্লি ওখান থেকে, তখনই বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা শব্দ উঁকি দিল তার মাথায়। EPETALOPEI; অক্ষরগুলোকে আগে পরে করলে একটা বাক্য পাওয়া যায়- I EAT PEOPLE!
চার্লি স্টেশনে ফিরে গিয়ে পুলিশকে জানাল ব্যাপারটা।
এর এক মাস পরে শুধু মার্থারই না, বরং আরও কিছু রহস্যময় নিখোঁজ কেসের সমাধান পেল পুলিশ। রিচ পানেল নামের এই তরুণ ক্যানিবাল ছিল, অর্থাৎ নরখাদক ছিল সে। ফেসবুকে এসে মানুষের সাথে বন্ধুত্ব করত, অবলীলায় তাদের জানাত যে সে নিজে একজন নরখাদক। যদি সম্মতি থাকে, তাহলে রিচ পানেল তাদেরকে খেতে চায়। মজার ব্যাপার, এভাবে স্বেচ্ছায় ৫ জন মানুষ নিজেরা রিচ পানেলের খাদ্য হতে রাজি হয়েছিল। মার্থা তাদেরই একজন।


ছয়
রাকিব গল্প বলা শেষ করতেই সাথী প্রশ্নটা করল-“শুনেও তো আমার গা গোলাচ্ছে। এমন একটা গল্প মাথায় এলো কেন তোর?”
রাকিব কাঁধ ঝাকাল। বলল-“গল্পটা কিন্তু বানানো নয়। পত্রিকায় পড়েছিলাম আমি এই ঘটনাটি। অবশ্য সেটা অনেক আগে। ২০০৮-০৯ সালের দিলে। তখনো ফেসবুক এত বেশি জনপ্রিয় ছিল না। তাই গল্পটা নিয়ে তেমন মাতামাতি হয়নি। আবার এমনও হতে পারে গল্পটা বানানো। পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্যই ছেপেছে তারা। তবে রিচ পানেল, সাসেক্স, এপিটালোপে, এই বিষয়গুলো আমি নিজেরমতো করে বানিয়ে বলেছি। তবে ফ্যাক্ট হলো, এই কাহিনী আমার মাথায় উৎপত্তি হয়নি। আমি শুধু নিজের মতো করে গল্প বলেছি।”
শামসু প্রতিবাদ করল-“কথা ছিল নিজে নিজে বানাতে হবে গল্প। তুই একটা সত্য ঘটনাকে ভিত্তি করে বলেছিস, এটা কিন্তু নিয়মভঙ্গ করা হলো।”
সাঈদ বলল-“অসুবিধে নেই। বাস্তবের উপর ভিত্তি করে হলেও রাকিব চমৎকার ভাবে কল্পনার রঙ মিশিয়ে বলেছে গল্পটা। এমন গল্পও গ্রহণযোগ্য। যাই হোক, এবার নিশিতার পালা।”
নিশিতা পড়ুয়া মেয়ে। আমার মতো তারও ক্রিয়েটিভিটি এত ভাল নয়। তবে তাই বলে আমার মতো এতটা খারাপও নয়। সে কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর হাতে তুড়ি মেরে বলল-“ইউরেকা, পেয়েছি!”
“শুরু কর! শুরু কর!!” সাঈদ উৎসাহ দিল তাকে।
একটা লম্বা দম নিয়ে শুরু করল নিশিতা।

*** *** ***
রমনা থানার ওসি আফসার উদ্দিন বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। খুনটা হয়েছে একটি অভিজাত রেঁস্তোরার ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমের বাইরে কয়েক জন ওয়েটার দাড়িয়ে গল্পও করছিল খুন হবার সময়। তারা ভেতর থেকে কোন আওয়াজ শোনেনি। ভেতর থেকে বাহিরে কাউকে যেতে দেখেনি। ভিক্টিম যাবার আগে-পরে কাউকে ঢুকতেও দেখেনি ভেতরে। অথচ কেউ একজন এসে ঘাড় মটকে খুন করেছে ইলিয়াস চৌধুরী নামক এক ব্যবসায়ীকে।
সে ভালোভাবে তল্লাশি করে দেখেছে, দরজা ছাড়া ওয়াশরুমের ভেতর থেকে বাইরে যাবার কোন পথ নেই। কাজেই ভূতে এসে ঘাড় মটকে মেরে গেছে, এটা ছাড়া আর কোন ব্যাখ্যা তার মাথায় এলো না।
সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে অবশ্য রেস্তোরাঁয়। কিন্তু সেগুলো কাজ করে না। বিদেশীদের মতো, অপরাধীদের ভয় দেখানোর জন্য নাকি লাগানো হয়েছে ওগুলো। কি আহামরি বুদ্ধি! ভাবলেও রাগে গা জ্বলে যায় আফসার উদ্দিনের।
পুলিশের আইটি বিভাগের জাকির হোসেন ছেলেটা বেশ কাজের। আফসার উদ্দিনের কেস সমাধানে সে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য দিল। এখন পুরো দুনিয়াটা সোশ্যাল মিডিয়ায় পাওয়া যায়। গত রাতে ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে যারা যারা এই রেস্টুরেন্টে চেক ইন দিয়েছে, তাদের তোলা সেলফিগুলো সে জোগাড় করল। একটা সেলফিতে পেছনে দেখা যাচ্ছে, খুব সাধারণ চেহারার এক ভদ্রলোক ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। ওয়াশরুমের আশেপাশে কয়েকজন ওয়েটার দাড়িয়ে গল্প করছিল, কিন্তু তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই লোকটার প্রতি।
কিছু কিছু মোবাইলে ছবি তোলার তারিখ আর সময় লেখা থাকে। এই ছবিটির তারিখ-সময় মিলিয়ে দেখা গেল, ইলিয়াস চৌধুরীকে খুন করার কয়েক মিনিট পরই তোলা হয়েছে ছবিটি। কাজেই এই ভদ্রলোকই বোধহয় সম্ভাব্য খুনি!
একটা ছবি থাকলে পুলিশ অনেক কিছু করতে পারে। মাসখানেকের মতো সময় লাগল খুনিকে হাজতে পুরতে। জেরা করে জানা গেল, সে পেশাদার খুনি। নাম আক্কাস উদ্দিন। ইলিয়াস চৌধুরীর এক ব্যবসায়িক পার্টনারই তাকে খুন করার কন্ট্রাক্ট দিয়েছে ওকে।
আক্কাস উদ্দিনের দীর্ঘদিনের কারাদন্ড হলো। মজার ব্যাপার, তাকে জেলে নেয়ার আগেই কিভাবে যেন পালিয়ে গেল সে। এমন ঘটনা খুব সচারচর ঘটে না।
এতগুলো পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আদালত থেকে হাজতে নেবার পথে আক্কাস কিভাবে পালাল, বিষয়টা নিয়ে অনেক ভাবল আফসার উদ্দিন। তখন আরও কিছু প্রশ্ন তার মাথায় উঁকি দিল। আক্কাস কিভাবে ওয়েটারদের চোখে ধরা পড়ল না? কিভাবে রেস্ট্রন্টের কেউ আক্কাসকে লক্ষ্য করল না?
অনেক ভাবার পর উত্তরটা পেল সে!
রহস্যটা হলো আক্কাসের চেহারা। কিছু মানুষ থাকে, যাদের চেহারা, পোশাক-আশাক এতই সাধারণ যে মানুষ একবারের বেশি দুবার তাকায় না তাদের দিকে। মানুষের মস্তিষ্কের কাজের ধরনই এমন। কারো মাথায় যদি একটা পাকা চুল থাকে, সেটা ধরা পড়ে। কিন্তু একটা সাধারণ কালো চুলকে আলাদাভাবে কেউ লক্ষ্য করে না। তেমনি একদল ইউনিফর্ম পড়া মানুষের মধ্যে আলাদাভাবে কাউকে লক্ষ্য করা মুশকিল। স্বাভাবিকত্বের প্রতি মানুষের মস্তিষ্কে এক ধরনের ডেনায়াল কাজ করে, উপেক্ষা কাজ করে। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে মস্তিষ্ক মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখে না, উপেক্ষা করে যায়।
আক্কাসের চেহারা একজন সাধারণ মানুষের তুলনায় দশগুণ বেশি সাধারণ। অতিরিক্ত সাধারণত্ব তাকে প্রায় ইনভিজিবল করে দিয়েছে মানুষের কাছে। তাই তার দিকে তাকানো আর না তাকানো প্রায় সমান। যে কোন স্বাভাবিক মস্তিষ্ক তাকে দেখলেও উপেক্ষা করে যায়। সে জন্যই রেস্ট্রন্টে কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি। সেজন্যই সে পুলিশের কাস্টডি থেকে পালাতে পেরেছে।


সাত
“চমৎকার ইন্টারেস্টিং গল্প। একটু আঁতলামোর ছোঁয়া ছিল। তবে আঁতলামো থেকে ক্রিয়েটিভ কিছু বের হলে আঁতলামোই ভাল।” সাঈদ বলল।
আমরা হাসলাম ওর কথায়।
এবার শামসুর পালা। শামসুর দিকে তাকাতেই সে দু’হাত উপরে তুলে বলল-“না না, আমি জোকার মানুষ। দুয়েকটা জোকস বলতে পারি। কিন্তু হরর-সাইকো-ক্রাইম গল্প? উহু, সেটা আমার কাজ নয়।”
অনেক জোরাজুরির পর শামসু রাজি হলো। “ঠিক আছে। আমি বরং একটা ফ্ল্যাশ ফিকশান বলি। ”
আমরা নিমরাজি হলাম। ফ্ল্যাশ ফিকশান মানে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত গল্প। কিন্তু কিছু করার নেই। শামসুর উপর জোর খাটানো সহজ নয়।
শামসু বলল গল্পটা।

*** *** ***
রাজু আজ রাতে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে। পরিচিত মানুষজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্খী, সবাইকে একটা এসএমএস পাঠিয়েছে। লিখেছে-আমি কোন ভুল টুল করে থাকলে ক্ষমা করে দিও। আর হ্যা, রাতে কখনো আয়নার সামনে দাড়িও না কেউ।
আয়নার ঘটনাটা শুরু হয়েছিল রাজু যখন খুব ছোট। তখন থেকে। একদিন রাতে আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখে, একজন বুড়ো মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে আয়নার ভেতরে। সে ভয় পেয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে। তার বাবা-মা চিৎকার শুনে এসে আয়নায় কাউকে খুঁজে পায়নি। ছোট মানুষের কল্পনা ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু বুড়ো লোকটাকে দেখা বন্ধ করেনি রাজু। প্রায়ই তাকে দেখত সে আয়নায়। মজার ব্যাপার, সে যত বড় হচ্ছিল। লোকটার বয়স কমছিল ততোই। একসময় সে বুঝতে পারে, আয়নার বুড়োটা আর কেউ নয়। সে নিজে! তার বার্ধক্যের চেহারা ওটা।
রাজু এখন ২৭ বছরের তরুণ। আয়নার বুড়োটাও এখন যুবক। তার মতোই। তার মানে জীবনের ঠিক মাঝখানে পৌঁছেছে সে। এরপর কি হবে রাজু জানে না।
রাজুর মেসেজ পেয়ে পরদিন সবাই ছুটে এলো তার বাড়িতে। জানতে চাইল এই মেসেজের মানে কি। রাজু হাসল, বলল, ওটা একটা কৌতুক ছিল।
শুধু আয়নার ভেতরকার সত্যিকারের রাজু জানল, ওটা কোন কৌতুক ছিল না। তাকে বাকী জীবন নিজেরই প্রতিচ্ছবি হয়ে কাটাতে হবে।


*** *** ***
“তার মানে?”
সাথী বোধহয় বুঝতে পারেনি গল্পটা। শামসু বুঝিয়ে দিল ওকে।
“তার মানে হলো চরিত্রের অদল বদল। আয়নার ভেতর কার রাজু বাইরে এসেছে, সত্যিকারের রাজু গিয়েছে আয়নার ভেতর।”
“ইন্টারেস্টিং। আয়নার কথা থেকে আমারও একটা গল্প মনে পড়ল।”
“বলে ফেল! এমনিতেই তোর টার্ন এখন।”
সাথী বলতে লাগল।

*** *** ***
যুথী সুমনকে বলল-
"সুমন, আমার চোখের দিকে তাকাও।"

"বলো যুথী।"

"না, তুমি তাকাচ্ছ না। তাকাও আগে।"

"আচ্ছা, তাকালাম। বলো।"

"এ কি, তুমি কাঁপছ কেন?"

"কাঁপছি না।"

"কাঁপছ!"

" না তো!"

"তোমার কি হয়েছে বলো তো। ঘুম থেকে উঠে প্রায়ই দেখি তুমি গুটিসুটি মেরে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এক কোণে বসে আছো, মাঝে মাঝে প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে দিশেহারা হয়ে ছুটে বেড়াও। কেন?"

"জানি না।"

"তুমি আমাদের শহরের বাসাটা ছেড়ে এই নির্জন এলাকায় বাসা নিয়েছ, গত কয়েক মাসে আত্মীয় স্বজন কারো বাসায় যাওনি, অফিসেও যাওনি। কেন? "

"এমনি, শরীরটটা ভালো যাচ্ছে না ক'দিন ধরে।"

"তুমি ঘরকুনো হয়ে পড়লে কেন এভাবে? আগে তো ঘুরতে অনেক পছন্দ করতে। অথচ গত সপ্তাহে নিজের আপন মামাতো বোনের বিয়েতেও যাওনি। কি হয়েছে তোমার বলো তো সত্যি করে?"

"কিছু না যুথী! বললামই তো শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ক'দিন ধরে।"

"না, আরও কিছু ব্যাপার আছে। তুমি লুকোচ্ছ!"

"কিচ্ছু লুকোচ্ছি না।"

"তাই? তাহলে বলো যে বাসা থেকে সব আয়না সরিয়ে ফেলেছ কেন? আজকাল দাড়ি কামাতেও আয়না ব্যবহার করো না। কেন? কেন তোমার আমার সেলফোন দু'টো বিক্রি করে বাসায় ল্যান্ড লাইন এনেছ?"

"এমনি।"

"এমনি? এটা কোন উত্তর হলো?"

"হুম।"

"তোমার মানসিক সমস্যা হয়েছে সুমন, তোমাকে সাইকায়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাব কাল।"

"না!!"

"না, নিয়ে যাবই।"

"প্লিজ না!"

"ঠিকাছে, নেব না। এক শর্তে,তুমি আয়নায় মুখ দেখবে আমার সামনে বসে। আমার ধারণা কোন রহস্যময় কারণে তুমি আয়না দেখতে ভয় পাচ্ছ।"

"আয়না? আয়না কই পেলে তুমি? সব আয়না তো আমি ফেলে দিয়েছি।"

"আমার পার্সে একটা ছোট আয়না ছিল।"

"সর্বনাশ, কোথায় সেটা? এক্ষুণি ফেলে দাও!"

"কেন ফেলে দেব? দেব না। তুমি আমার সামনে আয়নায় নিজের মুখ নিজে দেখবে।"

"ঠিকাছে, কিন্তু তারপরই তুমি ফেলে দেবে আয়নাটা।"

"আচ্ছা।"

সুমন নিজের চেহারা দেখল আয়নায়, ছোট্ট গোল আয়নায় তার লম্বাটে মুখটা অদ্ভুত দেখাল।

"হয়েছে, এবার ফেলে দাও যুথী।"

"না। ফেলব না। কেন ফেলব? আমি জানতে চাই, আয়না রহস্যটা কি!"

"দোহাই লাগে, ফেলে দাও ওটা।"

"না। ফেলব না। আমি জানতে...."

হঠাৎ স্থির হয়ে গেল যুথী। আয়নায় নিজের মুখটা দেখতে পেয়েছে সে। কি ভয়ংকর! তার চোখের মনির অংশটা পুরোপুরি সাদা, কোন কালো অংশ নেই। সাদা চোখের কিনারায় রক্ত জমেছে। চেহারাও কাগজের মতো সাদা,যেন রক্তশূন্য। কালো কুচকুচে ঠোটের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে দু'টো শ্বদন্ত; ঠিক যেন হিংস্র কুকুরের দাঁত। কি ভয়ংকর!

"এসব কি সুমন? আমার চেহারা..."

"ইটস ওকে যুথী। আই লাভ ইউ! তুমি ঠিক হয়ে যাবে। আমি ডাক্তারের সাথে কথা..."

"কিন্তু আমার হয়েছে কি সুমন?"

"জানি না! দু'মাস ধরে তোমার শরীরের পরিবর্তনগুলো হচ্ছে। কেন হচ্ছে জানি না। যেদিন তোমার দাঁত গজাল, তুমি রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে। যখন ফিরলে, তখন তোমার দাঁত বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সেই থেকে প্রতিরাতে তুমি একই কাজ করো। কিন্তু সকালে উঠে ঠিকঠাক আচরণ করো আবার।"

"সেজন্যই তুমি বাসা থেকে সব আয়না সরিয়ে রেখেছ? সেজন্যই এই দুর্গম এলাকায় বাসা নিয়েছ? আত্মীয় স্বজনকে এড়িয়ে চলছ এজন্যই?"

"হ্যা যুথী। কিন্তু তুমি মন খারাপ করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।"

"কেমন করে ঠিক হবে? আমি কি পিশাচে পরিণত হয়েছি সুমন?"

"যুথী,রাত হয়েছে। কাল এসব আলোচনা হবে।"

"তুমি কি ভয় পাচ্ছ সুমন? রাত হলে কি আমি আমি প্রেতাত্মা হয়ে যাব?"

"প্লীজ,এখন ঘুমোতে চলো।"

"না।"

যুথী উঠে দাড়াল। আজ তার খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। রক্ত তৃষ্ণা, অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি।


*** *** ***
সাথীর গল্পটা বেশ ভাল লাগল আমার। বললাম- “চমৎকার হয়েছে সাথী!”
রবিন বলল, “সাথীর গল্পটা ভাল হয়েছে। তবে শামসু ফ্ল্যাশ ফিকশানের কথা বললেও ফ্ল্যাশ ফিকশনের তুলনায় একটু বড় গল্প বলে ফেলেছে সে। আমি তোদের একটা সত্যিকারের ফ্ল্যাশ ফিকশান শোনাতে চাই। মাইক্রো ফিকশানও বলতে পারিস।”
গা বাঁচানোর পায়তারা করছে রবিন। বিষয়টা আমরা বুঝতে পেরে প্রতিবাদ করতে যাব, ততোক্ষণে রবিনের গল্প বলা শেষ। তার গল্পটা হলো-

“মাঝরাতে সিগারেট ধরাতে বারান্দায় গেল আরিফ। ফিরে এসে নিজের বিছানায় ঘুমোতে গিয়ে দেখে, আরিফ ঘুমিয়ে আছে সেখানে।”

সাঈদ প্রতিবাদ করল। “উহু, এটা অনেক কমন গল্প। প্লাস এক লাইনের। চিটিং হলো।”
রবিন আড়মোড়া ভেঙে বলল-“এখন বলে লাভ নেই, আমার টার্ন শেষ। প্লাস ভুলে গেলে চলবে না, আজ রাতের খিচুড়ি আমার তরফ হতে।”
আমরা হেসে উঠলাম ওর কথায়।

আট
এবার আমার পালা। সবাই চোখে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওরা জানে, আমার মধ্যে কোন ক্রিয়েটিভিটি নেই। কখনো ক্রিয়েটিভ কিছু করিনি। সেই আমি কি করে বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প বলি, সেটা জানতে চায় সবাই।
আমি ভাবার চেষ্টা করলাম কি গল্প বলা যায়। রবিন আর শামসু ফ্ল্যাশফিকশান বলেছে। আমার মধ্যে সেটা করারও ক্রিয়েটিভিটি নেই। শামসু আর সাথী চমৎকার দু’টো গল্প বানিয়ে ফেলেছে। সেটা তো আমার দ্বারা সম্ভবই নয়। নিশিতা গল্প বলেছে হিউম্যান সাইকোলজির উপর ওর জ্ঞান থেকে। আমি ব্যাংকার মানুষ, সাইকোলজি আমার সাবজেক্ট নয়।
রাকিব একটা সত্য ঘটনা থেকে গল্প বলেছে। এই পদ্ধতি আমার ক্ষেত্রে কাজে লাগলেও লাগতে পারে। আমি মনে করার চেষ্টা করলাম আমার জানামতে গায়ে কাঁটা দেয়া কোন সত্য ঘটনা আছে কিনা। অনেক ভাবলাম। তেমন কিছু মনে পড়ল না।
তারপর হঠাৎ একটা ঘটনা মনে পড়ল। সেই সাথে বিদ্যুৎ চমকের পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে। তিন বছর ধরে ওদেরকে আমার এড়িয়ে চলা, রাজস্থানের সেই ঘটনা, আজকের রিইউনিয়ন, গল্পের আসর, সব কিছু আসলে এক সূত্রে গাঁথা। আজকের গল্পের আসরই বসানো হয়েছে আমার গল্পটা জানার জন্য।
সহজ যুক্তি। একদমই ক্রিয়েটিভ নয়, এমন কাউকে বানিয়ে গল্প বলতে বললে সে কোন সত্য ঘটনার আশ্রয় নেবে। ওরা যে ক্যাটাগরির গল্প শুনতে চায়, সেই ধরনের ঘটনা আমার জীবনে একটাই ঘটেছে। ওরা সেটাই জানতে চায়। তিন বছর ধরে ওরা এই একটা গল্প শোনার জন্যই বসে বসে প্ল্যান করছিল হয়তো।
আমি ওদের সবার চোখের দিকে তাকালাম। চোখের ভাষা পরিষ্কার ওদের। ওরা গল্প নয়, গল্পের ছলে সত্য জানতে চায়। আমি বললাম ওদের। কঠিন, কুৎসিত সত্য।

*** *** ***
ধরি আমার গল্পের পাত্রের নাম...উহু নাম খুঁজে পাচ্ছি না। নিজের নামটাই ধরি, আতিক।
আতিক একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া উচ্ছল, ফুর্তিবাজ তরুণ। বন্ধুদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় সে। ইউনিভার্সিটিতেও জনপ্রিয় একটি চরিত্র।
তার হাসিখুশি, প্রাণবন্ত চরিত্রের আড়ালে যে দিকটা কেউ জানে না, তা হলো, তার মধ্যে কাজ করে এক ধরনের গভীর অবসেশন। অবসেশন নিজের প্রতি নয়, অন্যের প্রতি। কে কার সাথে মিশবে, কার সাথে কথা বলবে, কার সাথে বন্ধুত্ব করবে, এ বিষয়ে তার নিজস্ব বিচার রয়েছে। দু’জন বিপরীত চরিত্রের মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব হোক, ভাব-ভালোবাসা হোক, এটা সে মেনে নিতে পারে না কোনভাবেই। সত্যি বলতে কি, এ ধরনের মানসিকতা অনেকের মধ্যেই আছে, কিন্তু তার ভেতর যতটা তীব্র, এতটা অন্য কারো ভেতর নেই। দু’জন অসম চরিত্রের মানুষকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখলেও রাগে ব্রক্ষ্মতালু জ্বলে যায় তার। অথচ সে কিছুই করতে পারে না। চুপচাপ দেখে যেতে হয় শুধু।
নিজের ভেতরের এই কুৎসিত সত্ত্বাকে কারো কাছে সে প্রকাশ করতে পারেনি। খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছেও নয়। মনের ভেতরের দানবকে অবদমন করতে হয় তাকে প্রতিনিয়ত।
ঘটনাটা ঘটে পামেলাকে নিয়ে। পামেলা চোখ ধাধানো সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং বন্ধুবৎসল।একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে সে। পামেলার প্রেম হয় তারই আরেক বন্ধু শামীমের সঙ্গে। বিষয়টা সহ্য করতে পারত না সে মোটেও।
এমন নয় যে সে পামেলার প্রতি দুর্বল। না, পামেলার জন্য তার মনে মোটেও দুর্বলতা নেই। সে পামেলার প্রেমে পড়েনি। বরং নির্মল বন্ধুত্ব রয়েছে তাদের মধ্যে। সে শুধু নিজের ভেতরকার দানবকে সামলে রাখতে ব্যর্থ হলো পামেলার ক্ষেত্রে।
শামীম বড়লোক বাবার বখে যাওয়া ছেলে। হিরোইন, মদ, গাঁজা, কোন কিছুর প্রতি অনীহা নেই তার। রাজনৈতিক ক্ষমতা আছে। এর আগেও কয়েকটা মেয়ের সাথে দেখেছে সে শামীমকে। এমন একটা ছেলের সঙ্গে পামেলার মাখামাখি সহ্য করা মোটেও সহজ হলো না তার জন্য। সে ঠিক করল, দু’জনের কোন একজনকে শেষ করে দেবে সে। হয় শামীমকে, না হয় পামেলাকে। ভেতর ভেতর কতটা ডেস্পারেট ছিল সে, কতটুকু মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিল, তার এই কুৎসিত অভিপ্রায় থেকে বোঝা যায়। নিজেকে দমন করে রাখার সব চেষ্টা তার ব্যর্থ হলো।
সুযোগটা এসে গেল ভারতের রাজস্থানে বসে। গ্রাজুয়েশন শেষে তারা ডিপার্টমেন্টের সব বন্ধুরা মিলে ফরেন ট্রিপে ইন্ডিয়ায় গিয়েছিল, ছাত্রজীবনে ওটা তাদের শেষ ট্রিপ ছিল। দিল্লি, মানালি, শিমলা ঘুরে রাজস্থানে গেল তারা। রাজস্থানের এক পুরনো দুর্গ দেখার সময় সুযোগটা এসে গেল। দুর্গের ছাদে দাড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল শামীম। পেছন থেকে ধাক্কা মারার লোভ কোনভাবেই সংবরণ করতে পারেনি আতিক।
শামীম মারা গিয়েছিল। কেউ দেখেনি ধাক্কা দেয়ার ঘটনাটা। সবাই ভেবেছিল দুর্ঘটনা। শামীম হয়তো পা ফস্কে পড়ে গেছে। শুধু আতিকের বন্ধু রাকিব আর সাঈদ তাকে শামীমের আশেপাশে ঘুরতে দেখেছিল বলে আঁচ করেছিল কিছু। কিন্তু তারা জানত না আসলেই কি ঘটেছে। শামীম কি আসলেই দুর্ঘটনায় মারা গেছে নাকি অন্য কিছু ঘটেছে তার ভাগ্যে? যদি অন্য কিছু ঘটে থাকে তাহলে সেখানে আতিকের হাত কতটুকু? আতিকের সাথেই বা শামীমের কি ঝামেলা ছিল?
তারা পুলিশকে কিছু বলেনি এ ব্যাপারে। শত হোক, আতিক তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নিশ্চিত কিছু না জেনে তাকে পুলিশি ঝামেলায় ফেলা উচিত হবে না।
তবে এখন আর কিছু যায় আসে না। ঘটনাটা ঘটেছে অন্য দেশের টেরিটরিতে আর শামীমের মৃত্যু দুর্ঘটনায় হয়নি, তার কোন প্রমাণ নেই কোথাও।
তবে মজার ব্যাপার, সেই ঘটনার পর আতিকের ভেতরকার দানব ঘুমিয়ে গেছে। কখনো সে আর বিরক্ত করেনি আতিককে।


নয়
শীত পড়েছে বেশ। রাস্তায় ভারী কুয়াশার পর্দা দৃষ্টি আটকে দেয়। আমি ঠোঁটে সিগারেট ধরিয়ে চুপচাপ হাটছি।
মনে পড়ল, অপর্ণা বাসায় তিন জনের জন্য রাঁধতে বলেছিল। কেন বলেছিল? অপর্ণা কি জানত, আজ রাতে রবিনের ওখান থেকে খেয়ে আসার রুচি হবে না আমার? হয়তো জানত। আমার ভেতরকার দানবকে হয়তো সে চিনতে পেরেছিল। যদিও কিছু বলিনি ওকে কখনো এ ব্যাপারে।
আমার গল্প শেষে থম মেরে গিয়েছি সবাই। ওরা ভাবেনি ওদের বন্ধু একজন খুনি হতে পারে। কিংবা কে জানে, হয়তো ভেবেছে, নিশ্চিত হতে চাইছে। জানি, ওরা এই কথা কাউকে বলবে না। এত বছর পর এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি করে কোন লাভ নেই। আমি খুনি, সেটাও কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।
“বাট ইউ ডেজার্ভ টু বি পানিশড, ডোন্ট ইউ?”
কে কথা বলল?
পামেলা!
কুয়াশা ভেদ করে পামেলাকে দেখতে পেলাম আমি। একটা ওভারকোট পরে আছে সে। দস্তানা লাগানো ডান হাতে একটা পিস্তল। পিস্তলের সামনে লম্বা নল, সাইলেন্সার বোধহয়।
আমি আশেপাশে তাকালাম। দেখা যাচ্ছে না কাউকে। এই এলাকাটা এই সময় মোটামুটি নির্জন থাকে। তার উপর কুয়াশা পড়েছে বেশ।
“তুমি কি করে জানলে পামেলা?”
বাম হাতটা পকেট থেকে বের করে দেখাল সে, ফোন সে হাতে। স্ক্রিনে সাঈদের নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে। লেখা-
Yes, he did.
পামেলা কিছুক্ষণ আমার মাথার দিকে ধরে থাকল পিস্তলটা। তারপর বলল-“আমি মারব না তোমাকে। কেন জানো? অপর্ণা আমার ছোটবেলার বান্ধবী! তোমাকে খুন করে একটা ডেথ সার্কেল তৈরি করতে চাই না আমি।”
“অপর্ণা তোমার বান্ধবী, জানতাম না তো!”
“ঠিক যেভাবে অপর্ণা জানত না, তুমি তার প্রিয় বান্ধবীর প্রেমিকের খুনি!”
আমি চুপ করে রইলাম।পামেলা আবার বলল-“তোমাকে যেতে দিচ্ছি আমি। বাকী জীবন অনুশোচনা নিয়ে কাটাবে, এটাই তোমার শাস্তি।”
পামেলা পিস্তল ধরা হাতটা পকেটে ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে হাটতে লাগল হাইওয়ের দিকে। আমি কয়েক মুহূর্ত ওকে দেখলাম। তারপর হো হো করে হেসে উঠলাম। পামেলা আমার হাসির শব্দ শুনে থমকে দাড়াল, কিন্তু তাকাল না পেছন ফিরে।
আমি হাসতেই হাসতেই বললাম-“পামেলা, তুমি ভুল ভাবছ। আমি ওদের সবাইকে বলেছি যে আমার ভেতরের দানবটা শামীমের মৃত্যুর সাথে সাথে মরে গিয়েছে। কিন্তু সত্য কথা হলো, সে আজও বেঁচে আছে বহাল তবিয়তে। আজও ভেতরে ভেতরে আমি সেই পুরনো, সাইকো, খুনি আতিকই রয়ে গেছি! আর অনুশোচনা? হাহ! তোমার মনে হয় আমার মনে কোন ধরনের অনুশোচনা আছে সেই ঘটনায়? বিন্দুমাত্র নেই!”
পামেলা আমার দিকে ঘুরেই গুলি করল!

(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৪০
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×