'ভোজন রসিক' শব্দটির অর্থ নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি কাজ করে। অধিকাংশ মানুষ ভাবেন - খাদক বা যারা বেশি খেতে পারেন, তারাই বুঝি ভোজন রসিক। আর ভদ্রস্থ ভাষায় আপনি যদি একটু স্বাস্থ্যবান বা প্রচলিত ভাষায় 'মোটা' হয়ে থাকেন, তাহলে তো কেল্লাফতে! আর কোন সন্দেহের অবকাশই নেই। দশজনের খাবার প্লেটে ঢেলে আপনার দিকে সকৌতুক কিংবা আন্তরিকভাবে তাকিয়ে থেকে ভোজনে বাধ্য করার নাম যে শুধুই বিকৃত রসিকতা সেটা বুঝতে গৃহকর্তা বা আপ্যায়নকারীর বয়েই গেছে।
ভোজন রসিক শব্দটির মূল অর্থ হচ্ছে - যিনি খাবারকে সম্মান করেন, বিভিন্ন খাবারের বিদ্যমান স্বাদ, উপাদান এবং বৈশিষ্ট্যকে সতন্ত্রভাবে মূল্যায়ন করার পাশাপাশি উপযুক্ত আয়োজন করে খাবারটি গ্রহণ করতে পারেন। আরো সহজভাবে বললে, যে কোন সাধারন খাবারকে যিনি মজা এবং আয়েশ করে খেতে পারেন, তিনিই ভোজন রসিক।
যেমন ধরুন পান্তা ভাত! হালের অনেক মানুষকে পান্তা ভাত নিয়ে নাক ছিটকাতে দেখেছি। পান্তা যেন শুধুই পহেলা বৈশাখের জন্য সংরক্ষিত। যে কোন খাবার যে কারো ভালো না লাগতেই পারে, কিন্তু তাকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। ভার্সিটি পড়ার সময় ক্লাসে পান্তা ভাত খেয়ে এসেছি শুনে অনেকেই হাসলো। এক মেয়ে এসে আমাকে অনেকটা নাক ছিটকে জিজ্ঞেস করল, এ্যাই তুমি সত্যি কি পান্তা খেয়ে ক্লাসে আসো?
তখন অবিবাহিত ছিলাম, মেরুদন্ড আরো কিছুটা শক্ত ছিলো, মেজাজে তেজদ্বীপ্ত ভাবও বেশ উজ্জল। মিষ্টি হেসে বলেছিলাম, আমার দাদা তাঁর জীবিতকালে পান্তা খাওয়ার কোটা শেষ করে যেতে পারেন নি বিধায়, আমরা এখনও মাঝে মাঝে পান্তা খাই। তোমরা ভাগ্যবান, পান্তা খাওয়ার কোটা, তোমার দাদাই শেষ করে গেছে। তোমাদের জন্য আর কিছু নেই।
একটা সময় প্রায় পাটুরিয়া ফেরীঘাটে বেড়াতে যেতাম। রাস্তায় এত জ্যাম ছিলো না, এত গাড়িও ছিলো না। ঘাটে গিয়ে ফেরীতে উঠতাম। ফেরীতে করে ঐপাড়ে যেতাম আবার এই পাড়ে চলে আসতাম। ফেরীতে আগে ৫০ টাকায় পেট চুক্তিতে খাবার পাওয়া যেত। তরকারী কিনলে ডাল ভাত ফ্রি। সেই খাবারগুলো দেখতাম দুরদুরান্তের যাত্রীরা গোগ্রাসে খাচ্ছে। একবার গরম গরম ইলিশ মাছ দেখে আমারও বেশ খেতে ইচ্ছে হলো, মোটামুটি একটা ফাঁকা টেবিল দেখে বসে পড়লাম। আমি খাওয়া শুরু করতেই আমার সামনে একলোক এসে বসলেন। বাড়তি খাতির যত্ন এবং কথোপকথনে বুঝলাম, তিনি এই ক্যান্টিনের পাচক। আমি আমার মত করে খেয়ে যাচ্ছি আর আড় চোখে উনার কি খান সেটা দেখার চেষ্টা করছি। দেখলাম সাদা গরম ভাত তিনি লবন দিয়ে ভালো করে মাখালেন। এক চামচ ঘন ডাল নিলেন আর বাকি দুই তিন চামচ ডালের উপরের পানি। ভাত আর ডাল সুন্দর করে মাখিয়ে দুটো কাঁচা মরিচ ডলে ডলে মেশালেন। এই মেশাতে মেশাতে ক্যান্টিনের বয় একটা দুটো আস্ত দেশী পেঁয়াজ ছিলে দিয়ে গেলো।
ভদ্রলোক লোকমা ভরে ভাত মুছে দিচ্ছেন আর পেঁয়াজে একটা কামড় দিচ্ছেন। চাবানোর সময় পেঁয়াজের কচকচ আওয়াজ যেন তার তৃপ্তির কথা বার বার জানান দিচ্ছিলো। এই পর্যায়ে, ক্যান্টিনের ছেলেটা এক পিস ভাজা ইলিশ তার সামনে এনে রাখলো। তিনি আরো কিছু ভাত নিলেন প্লেটে। আবারও সামান্য ডালের পানি নিলেন। খুব ভালো করে মাছের কাঁটা বেছে তিনি প্লেটের ভাতের সাথে প্রায় পিষে ফেললেন। আবার শুরু করলেন খাওয়া। তিনি খাচ্ছেন আর মাঝে মাঝে তর্জনী দিয়ে তর্জনী দিয়ে লবনের বাটি থেকে একটু লবন নিয়ে ভাতের সাথে ভালো করে মাখিয়ে নিচ্ছেন।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর খাওয়া দেখতে লাগলাম। আহা! কি সাধারন মেন্যু অথচ কি আয়েস করেই না তিনি খাচ্ছেন!! প্রতিটা ভাতকে যেন তিনি যত্ন করে মুখে চালান দিচ্ছেন। খাবার প্রায় শেষ দিকে। প্লেট উচু করে ছোট ছোট চুমুক আর হালকা শব্দে তিনি খাওয়া শেষ করলেন।
ফেরী তখন ঠিক মাঝ নদীতে। খোলা জানালা দিয়ে চমৎকার বাতাস আসছে। আমার সাথে উনার চোখাচোখি হলো। একটা মৃদ্যু হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু নিবেন? একপিস মাছ দিমু?
আমার খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। অল্প দুই এক লোকমা বাকি। আমারও ভদ্রলোকের মত খেতে ইচ্ছা হলো। ডাল দিয়ে ভালো করে ভাত মাখালাম, লবন নিলাম, বাকি থাকা ইলিশ মাছটা ভাতের সাথে ভালো করে মাখাতে মাখাতে পালটা হাসি দিয়ে বললাম, না ভাই, কিছু লাগবে না ধন্যবাদ।
আমার চোখে, এটাই ভোজন রসিকতা, ফেরীর ঐ সামান্য পাচকই হয়ত সেরা ভোজন রসিক। বেশি খেতে পারা মানেই ভোজন রসিক না
যাইহোক, মুল ঘটনায় আসি। মাঝে মাঝে আমার খুব অদ্ভুত খাবার খেতে ইচ্ছা করে। যা না খাওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি হয় না। যেমন আজকে মাঝরাতে প্রচন্ড ইচ্ছে করলো কাচকি মাছের শুঁটকি দিয়ে আলু কুঁচি আর কয়েক পিস বেগুন দিয়ে মাখামাখা একটা তরকারী দিয়ে গরম ধোঁয়া উঠা ভাত খাই। সাথে থাকবে পাতলা মসুরের ডাল, লেবু, কাঁচা মরিচ আর দেশী পেঁয়াজ।
এটা খাওয়ার সিস্টেম হচ্ছে, গরম ভাতে শুঁটকি মাখিয়ে কয়েক নলা ভাত গোগ্রাসে খাবার পর, দ্বিতীয় বার গরম ভাত নিয়ে তাতে ডাল, আর লেবু চিপে প্রতিবার খাওয়ার সময় কাঁচা মরিচে কামড় দিতে হবে। দুই একবার পেঁয়াজে কামড় দেয়ার পর মনে হবে- আহ!! বেহেস্তে আছি।
বলাবাহুল্য, আম্মাকে ভয়ানক ভালোবাসি। ভদ্রমহিলা, আমাকে মাঝ রাত্রিতেই খাবারটি তৈরী করে দিয়েছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:৫৯