"রমজানের ঐ রোযার শেষে এল খুশির ঈদ " -গানটির সাথে যখন পরিচয় ঘটে তখনও জানতাম না এর গীতিকার কে? শুধু আমি কেন অনেকেই এভাবেই পরিচিত হয়েছেন জাতীর কবির সৃষ্টি কর্মের সাথে। কবির অন্য কোন সৃষ্টি কর্মের কথা যদি বাদও দেই এই একটি গানই পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত মানুষের মুখে মুখে গীত হবে।
বাংলা সাহিত্যে কবির অবস্থান মূল্যায়ন করার জন্য কবির কথাতেই দৃষ্টি দেখা যাক। তিনি বলেছেন- "বাংলা সাহিত্যে আমার স্থান সম্বন্ধে আমি কোনোদিন চিন্তা করিনি। এর জন্য লোভ নেই আমার। সময়ই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সমালোচক। যদি উপযুক্ত হই, একটা ছালা-টালা পাব হয়তো।"
ছালা-টালা নয় কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি হয়েছেন চির অমর অক্ষয় এক মহাকাব্যের নায়ক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে নিজস্ব প্রচেষ্টায় তিনি জ্ঞানের যে মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। অন্য কোন উপমা-অভিধাই তাঁকে বাঁধা সম্ভব নয়।
দুঃখের সাগরে তরী বাইতে বাইতে অনেক কষ্টই তিনি ভোগ করেছেন। স্বজাতির কাছ থেকে পেয়েছেন কাফির ফতোয়া। কবির কন্ঠে সুর পেয়েছে- " মুসলমান সমাজ আমাকে আঘাতের পর আঘাত দিয়েছে নির্মমভাবে। তবু আমি দুঃখ করিনি বা নিরাশ হইনি।"
সত্যিই তাই কবি অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নেন নি। বরং শত ফুলে প্রস্ফুটিত করেছেন কমল কানন। মুসলমান সমাজের দুর্গতি নিয়ে আক্ষেপ করে বলেছেন, " আমাদের সবচেয়ে বড়ো অভাব কথাসাহিত্যিকের। এর তো কোনো আশা ভরসাও দেখছিনে কারুর মধ্যে। অথচ কথাসাহিত্য ছাড়া শুধু কাব্যের মধ্যে আমাদের জীবন, আমাদের আদর্শকে ফুটিয়ে তুলতে কেউ পারবেন না। অনুবাদকের দিক দিয়েও আমরা সবচেয়ে পিছনে। সংগীত, চিত্রকলা, অভিনয় ইত্যাদি ফাইন আর্টের কথা না-ই বললাম।"
এরই সাথে বাঙ্গালী মুসলমানের চরিত্রের চিত্রও খুঁজে পাওয়া যায় কবির সৃষ্টিকর্মে। কবির ভাষায় "বাংলার অশিক্ষিত মুসলমানরা গোঁড়া এবং শিক্ষিত মুসলমানরা ঈর্ষাপরায়ণ। আমি একটুও বানিয়ে বলছিনে। মুসলমান সমাজ কেবলই ভুল করেছে – আমার কবিতার সঙ্গে আমার ব্যক্তিত্বকে অর্থাৎ নজরুল ইসলাম জড়িয়ে।"
কবির মনে আঘাতের তীর যারা হেনেছেন তাদের উদ্দ্যেশ্য কবি বলেছেন, "যাঁরা মনে করেন – আমি ইসলামের বিরুদ্ধবাদী বা তার সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছি, তাঁরা অনর্থক এ-ভুল করেন। ইসলামের নামে যে-সব কুসংস্কার মিথ্যা আবর্জনা স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছে – তাকে ইসলাম বলে না-মানা কি ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযান? এ-ভুল যাঁরা করেন, তাঁরা যেন আমার লেখাগুলো মন দিয়ে পড়েন দয়া করে – এ ছাড়া আমার কী বলবার থাকতে পারে?"
সত্যিই নজরুলকে অনেকে তখনও সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে নাই। এখনও যে পরিপূর্ণ মূল্যায়ন করা হয় তাও মনে হয় না। জন্মবার্ষিকী পালন ও পাঠ্য বইয়ের মাঝে নজরুলকে পাওয়া যায় ঠিকই। তবে বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিক তাদের কথা ও সৃষ্টিতে নজরুলকে প্রকাশের বেলায় কেন যেন একটা নির্লিপ্ত উদাসীনতা প্রদর্শন করেন। এর পিছনের নিগূঢ় রহস্য কি সেটাই বুঝতে পারি না।
যাই হোক নজরুল ছিলেন সাম্যের কবি, বিদ্রোহের সুর। সমাজের মানুষের দুঃখ গাথা, নিপীড়িত মানুষের মুখের ভাষা কবি যেভাবে অনুভব করতেন বর্তমান সময়ে কেউ তাঁর ধারে কাছেও যেতে পারে নাই।
কবি বলছেন " সকল ব্যথিতের ব্যথায়, সকল অসহায়ের অশ্রুজলে আমি আমাকে অনুভব করি।" কারণ বর্তমান সময়ের সৃষ্টিকর্মে প্রেম ভালবাসার সুড়সুড়ি মূলক হৃদয়গ্রাহী ভাষার ছড়াছড়ি ব্যতীত ভিন্ন কিছু যেন চোখেই পড়ে না।
কবির আরও বলছেন " ব্যথিতের অশ্রুজলের মুকুরে যেন আমি আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। কিছু করতে যদি নাই পারি, ওদের সাথে প্রাণ ভরে যেন কাঁদতে পাই!" কবি ঠিকই নিজে কেঁদেছেন, তবে আমরা সেই কান্না করতে শিখেছি কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
কবি বলেছিলেন -
"যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!"
বাংলার আলো বাতাসের মাঝে তাই আমি কবিকেই খুঁজে ফিরি প্রতিক্ষণ। কবির জন্মবার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। প্রত্যাশা করি কবির মত আর একজন নজরুল এই বাংলার ধরায় নেমে আসুক, লিখতে থাকুক রক্তলেখার দীর্ঘ উপাখ্যান।
তথ্যসূত্রঃ
১) পত্রগুচ্ছ (নজরুল)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২০ সকাল ৮:১২