মানুষ মরে যায়। কেন মরে কেজানে, কিন্তু মরে। মানুষের কাজ না থাকলে সে মরে। কাজ থাকলেও মরে। হয়তো নিরীহ কোনো বালক, বৃষ্টিতে ভিজে খেলছিল ফুটবল, যে হয়তো খাইয়ে না দিলে উপোস বসে থাকে, এতোটাই নিষ্পাপ। দেখা গেল সে মরে গেল বজ্রপাতে। আসলে কেন মরে মানুষ? এই ভারী প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে রাস্তা পেরোনোর সময় চাকার চাপায় মরে গেছে কতশত মানুষ। এই পরিসংখ্যানের ডেটা এন্ট্রি করল যে জালালুদ্দীন শেখ, সে মরল ক্যান্সারে। তার ছেলে একদিন বসে ছিল কোথাও একটা, ফুটপাতের পাশে রাখা একটা ভ্যানে। তার হাতে ছিল একটা চিঠি—"জুলহাসুদ্দীন, তোমার পিতার মওত হয়েছে।" জুলহাস ভাবল সে মরবে। কিন্তু তা না করে ও কিছুক্ষণ কাঁদলো, বৃষ্টিতে। হাত বেয়ে নামছে চিঠির কালো কালি।
"ভিজেন ক্যান? মজা লাগে?"
জুলহাস তাকায়। ময়লা শার্টে একটা লোক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। খাটো, শ্যামলা আর মুখে হাসি। উত্তর না পেয়ে বলতে থাকে, "শইল শক্ত থাকলে ভিজেন।"
জুলহাস তাকিয়ে থাকে। হাতে চিঠিটা লেগে আছে, চামড়ার আরেকটা স্তরের মতো। লোকটা কাছে এসে দাঁড়ায়। মনে তার আনন্দ।
"টঙে ছিলাম বইসা। ঠান্ডা হাওয়া তো, চা খাইলাম। ফোন আইল এহন। মামুর কাছে টেকা পাইতাম। হে আমার বাড়ির সামনে খাড়া, টেকা আনছে। ঘরে নাই কেউ, তালা মারা। এহন না গেলে আর পামুনা তারে।"
"আচ্ছা," জুলহাস বলে, খুব আস্তে, আর একটু হাসার চেষ্টা। আর ভাবে লোকটা এসব বলছে কেন? জায়গাটা খুব ভালোনা। লোকটা কি চায় কেজানে। বৃষ্টি পড়ছে। লোকটা নাকি এতক্ষণ বসেছিল ফুটপাথের টঙে। গায়ের কাপড় এখনও শুকনোই, ভিজতে শুরু করেছে কেবল। রাস্তায় মানুষ কম। হাঁটছেনা কেউ-ই প্রায়, মাঝে মাঝে কয়েকটা গাড়ি যায়, এইটুকুই। আজকে রাস্তাঘাট এতো নিরব কেন? বৃষ্টির জন্য না অবশ্যই। জুলহাস আবার লোকটার দিকে তাকায়, তাকিয়েই পরে অস্বস্তিতে। লোকটা এতক্ষণ তাকিয়েছিল ওর দিকে। কি চায় লোকটা। জুলহাসের সাথে টাকা বিশেষ কিছু নেই। ফোন নেই। কিছুই নেই তেমন। লোকটা চাইলেও বেশি কিছু পাবেনা। লোকটা তখনও তাকিয়ে, যেন জুলহাস কিছু বলবে, সে তা শোনার অপেক্ষায়। ঠিক তখনই দিন হঠাৎ গাঢ় অন্ধকার হয়ে যায়। বৃষ্টি কিছুটা কম। দুপুর বেলার বৃষ্টি, আলোর অভাব ছিলনা। হঠাৎ এমন অদ্ভুত অন্ধকার আর হালকা বাতাস। লোকটা তখনও চেয়ে আছে। জুলহাস দেখে, দেখে অবাক হয়। তার মনে হয় লোকটার চেহারা পালটে গেছে একটু। এমন আলোর জন্য? লোকটার কপালের উপর চুলগুলো উড়ছে, সে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে, ঠোঁটের কোণে একটা হাসির আভাস। কি হচ্ছে আসলে এখানে? লোকটা কে? সে কি চায়? দিনের আলো বাড়ছে, আবার কমছে। আর বাতাস থেমে হঠাৎ সব কিছু বন্ধ, কোনো শব্দ পর্যন্ত নেই। জুলহাসের মনে হতে থাকে সব থেমে গেছে, কোথাও কেউ নেই। আর সে আরো ভাবতে থাকে এই আলো আর বাতাস নিয়ন্ত্রণ করছে এই লোকটা, যে এখনও চেয়ে আছে তার দিকে। জুলহাস জানেনা কি চলছে। সে মনে মনে সাহস জোগায়, কিছু একটা বলা উচিৎ।
"কিছু বলবেন?"
প্রশ্নে লোকটা এক গাল হেসে নেয়, কিছুটা লজ্জাও পায় বোধহয়।
"মানে ভ্যানটা আমার..যদি একটু.."
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৯ দুপুর ১:০৬