somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পটি আমি লিখতে পারিনি

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি একটা গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার পারিল গ্রামের একটি ছেলের গল্প। ছেলেটির জন্ম ১৯২৬ সালে। পারিল নামটা খুব সুন্দর। একটু যেন অন্যরকম। এই নামের পেছনের কোন ইতিহাস আমার জানা নাই। সব নামের পেছনেই একটা ইতিহাস থাকে। পারিল নামেরও হয়তো আছে কোন অজানা ইতিহাস। বাংলাদেশেের বেশিরভাগ গ্রামের মতই এই গ্রামের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে রূপালি জলধারা। নদী ঘেরা ছায়া সুশীতল পারিল গ্রামের সেই ছেলেটি পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিল। ছেলবেলায় নাকি সে খুব দূরন্ত ছিল। তরতর করে কাঠবিড়ালীর মত গাছ বেয়ে মগডালে চলে যেত। একদিন নাকি গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পা'টাই ভেঙে গিয়েছিল তার।

দূরন্ত সেই ছেলেটির আর কোন দূরন্তপনার গল্প আমি খুঁজে পাই না। সে কি স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঘুড়ি উড়াতে পাড়ি জমাতো সেই তেপান্তরের মাঠে? দিন গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে গোধূলি নিশ্চয়ই নামতো সেই গ্রামে। ছেলেটির ঘুড়ি হয়তো তখনও আকাশের ওপারে কোন এক শূন্যে একটি বিন্দুর আকার ধারণ করতো। ছেলেটি হয়তো প্রাণপণে নাটাইটা ঘুরাতে থাকতো। সন্ধ্যা যে হয়ে এলো। বাড়ি যে ফিরতে হবে এবার। মা কি কঞ্চি হাতে ছেলেটির প্রতিক্ষায় বসে থাকতো? বাবা কি কানমলা দিয়ে ছেলেটির কান লাল করে ফেলতো? এসব কিছুই আমি জানি না। তবু আমি ছেলেটিকে নিয়ে একটি গল্প লিখতে চেয়েছিলাম।

ছেলেটি ধীরে ধীরে বড় হয়। শুনেছি দূরন্ত সেই ছেলেটা নাকি বড় হয়ে অনেক দায়িত্ববান হয়ে ওঠে। জগন্নাথ কলেজে বানিজ্য বিভাগের ছাত্র ছিল সে। বাবার ছিল প্রেসের ব্যবসা। কিন্তু সেই ব্যবসায় ভরাডুবি হয়। বাবা চেয়েছিলেন প্রেসটা বিক্রি করে দিতে। কিন্তু বাঁধ সাধে ছেলেটি। সে কলেজে নৈশ শাখায় ভর্তি হয়। দিনের বেলা প্রেস রাতেরবেলা কলেজ। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রেসটা শেষ অবধি সাফল্যের মুখ দেখে।

শুনেছি ছেলেটি ভালোবাসতো পারিল গ্রামেরই একটি মেয়েকে। মেয়েটির নাম ছিল পানুবানু। পানুবানু দেখতে কেমন ছিল তা আমি জানতে পারিনি। সে কি শ্যামলবরণ কন্যা ছিল? তার কি মায়াবি দুটি চোখ ছিল? ছিল কি দীঘল কালো চুল? তার কিছুই আমি জানা হয় না। শুনেছি ছেলেটি খুব সুন্দর ছড়া লিখতো। কটি ছড়া সে লিখেছিল পানুবানুকে নিয়ে? ছড়ায় ছড়ায় কটি চিঠি সে লিখেছিল? সেই ছড়াগুলো পড়তে খুব সাধ হয়। ছেলেটি নাকি সুঁচিকর্মে পটু ছিল খুব। সে কি নিজের লেখা ছড়া, সাদা রুমালে সুঁই সুতায় নকশি তুলে, ফ্রেমে বাঁধিয়ে পানুবানুকে উপহার দিয়েছিল? জানা হয় না কিছুই। পানুবিবিও হয় তো সুঁই সুতায় ফোঁড় তুলে রুমালে লিখেছিল, যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে।

পানুবানুর সাথে নাকি ছেলেটির বিয়ে ঠিকঠাক ছিল। ছেলেটি নাকি ঢাকায় বিয়ের কেনাকাটাও করেছিল।

হয়তো রেডিওতে তখন বাজতো,

"ফাগুন,      হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান--

     তোমার   হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান--

আমার   আপনহারা প্রাণ   আমার   বাঁধন-ছেড়া প্রাণ॥"



গানটা শুনে পানুবিবির মনটা কি আনচান করে উঠতো? কে জানে মনটা ডানা মেলে উড়ে চলে যেতে যাইতো কিনা বহুদূরে, ঐ ঢাকা শহরে। অদূরে কোথাও তখন কোন একটা কোকিল কুহুতানে অবিরত ডেকেছিল কি? জানালার পাশে পুকুর পাড়ে শিমুল গাছটা ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল কি? সময়টা যে ছিল ফাগুন। আগুনলাগা ফাগুন। পানুবিবির হয়তো ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করতো শিমুল গাছটার নিচে। সেখানে বসে ছেলেটির কথা ভাবতে ভীষণ ভালো লাগতো হয়তো বা।



জানা হলো না ছেলেটি জরি আর চুমকির কাজ করা মেজেন্টা রঙের শাড়ি কিনেছিল কিনা পানুবিবির জন্য। টাকার অভাবে বেনারসি কিনতে পারেনি বলে আফসোস করেছিল কিনা। । শাড়ির রঙের সাথে মিলিয়ে কাচের চুড়িও কিনেছিল কিনা। সোনালী ট্রাঙ্কের ভেতরে একে একে খুব যতনে শাড়ি, চুরি, স্নো, পাউডার, আলতা, সুগন্ধি তেল, কাজল, চুলের ফিতা, ক্লিপ সব সাজিয়ে রেখেছিল কিনা। সবার উপরে হয়তো রেখেছিল সুঁই সুতোর নকশা করা ফ্রেমে বাঁধানো রুমালটা। রঙিন সুতায় ফোঁড় তোলা অক্ষরগুলো ফুলের মত ফুটে রয়েছিল হয়তো। অক্ষরগুলোর উপর হাত বুলিয়েছিল হয়তো বা সে। মনটা মমতায় ভরে উঠেছিল কি? ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছিল কি তার? তারপর হঠাৎই হাসিটা ঠোঁট থেকে মিলিয়ে গিয়েছিল কিনা কে জানে। হাসির বদলে রাগে ঠোঁটটা শক্ত হয়ে উঠেছিল কি? দাঁতে দাঁত চেপেছিল হয়তো ছেলেটি। চোখ দুটো হয়তো জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ হয়েছিল। সময় ছিল না যে আর। দ্রুত ট্রাঙ্কটা বন্ধ করে খাটের নিচে রেখেছিল হয়তো বা। তারপর শার্টটা গায়ে গলিয়ে নেমে পড়েছিল রাস্তায়। সোজা চলে গিয়েছিল মেডিক্যাল কলেজের সামনে। সেখানেই জড়ো হয়েছিল সবাই সেদিন। হাতে প্লাকার্ড নিয়ে সবার সাথে গলা মিলিয়ে তার কণ্ঠও সেদিন মুখোর হয়ে উঠেছিল "রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই" প্রতিধ্বনিতে।

আমি আসলে জানি না ঠিক এমনটাই ঘটেছিল কিনা সেদিন। শুধু জানি শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত মিছিলটা সেদিন এগিয়ে গিয়েছিল হোস্টেলের দিকে। মিছিলের সাথে সাথে ছেলেটিও গিয়েছিল সেখানে। এমন সময় শুরু হয় গুলি বর্ষণ। হঠাৎই একটা গুলি এসে লাগে ছেলেটির মাথায়। সাথে সাথে মাথার খুলি উড়ে চলে যায়। মগজটা খুলে পড়ে আশেপাশেই কোথাও। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছেলেটির নিথর দেহখানি। চোখের সামনে হয়তো ভেসে ওঠে মা, বাবা, ভাইবোন, পানু সকলের হাসিমাখা মুখগুলি। আরো ভেসে ওঠে রুমালে বোনা লাল নীল সবুজ বর্ণমালা।

আমি ভাষাশহিদ রফিকের জীবনের গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। গল্পটি আর আমার লিখা হয় না। কারণ আমি যে তার সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমি শুধু জানি ভাষা আন্দোলনে সালাম, বরকত,জব্বার শফিউরের সাথে রফিক নামেরও একজন শহিদ হয়েছিল। আমি শুধু এইটুকুই জানি। আর কিছুই জানি না।


রচনাকাল - ২০-০২-২০২০
©নিভৃতা
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৯:০৩
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×