বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব জায়গাতেই শাড়িকে মেয়েদের সুন্দর এবং আকর্ষনীয় একটা পোষাক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, শাড়ি হচ্ছে মেয়েদের সবচেয়ে সুন্দর পোষাক যেটাতে প্রায় প্রতিটা মেয়েকেই রমনীয়, কোমনীয়, হৃদয়মোহিনী এবং মাতৃত্বের অবয়বে মহিমান্বিত মনে হয়। শেষ বিকেলের কনে দেখার মিষ্টি আলোর আভা যেভাবে নদীর তীরকে রাঙিয়ে রাখে, ঠিক তেমনি শাড়িও যেকোন মেয়েকে অপরূপা আর সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলে।
শাড়ি নিয়ে বেশি কিছু বলা কিংবা লেখার আগে চলুন শাড়ি সর্ম্পকে সাধারণ কিছু তথ্য জেনে আসি। উইকিপিডিয়া / মুক্ত বিশ্বকোষে শাড়িকে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছেঃ
শাড়ি ভারত, বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের ঐতিহ্যবাহী ও নিত্য নৈমিত্তিক পরিধেয় বস্ত্র। শাড়ি লম্বা ও সেলাইবিহীন কাপড় দিয়ে তৈরি হয়। সাধারণত একটি শাড়ি ১৮ ফুট (৫.৫ মি) থেকে ২১ ফুট (৬.৪ মি) দীর্ঘ এবং ৬০ থেকে ১২০ সেন্টিমিটার (২ থেকে ৪ ফুট) চওড়া কাপড় দিয়ে তৈরি, যা বিভিন্নভাবে ভাঁজ করে পড়া হয়ে থাকে। সবচেয়ে সাধারণ ভাঁজ হচ্ছে কোমরে জড়িয়ে একপ্রান্ত কাঁধের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা, যাকে আঁচল বলা হয়। শাড়ি সাধারণত পেটিকোটের (উত্তর ভারতে লেহেঙ্গা/ঘাগরা এবং বাংলাদেশসহ পূর্ব ভারতে সায়া নামেও পরিচিত) উপরে পড়া হয়ে থাকে। শাড়ির উপরের অংশের পোশাক হিসেবে ব্লাউজ (ভারতে ছোলি নামেও পরিচিত) পড়া হয়।
শাড়ি শব্দটি সংস্কৃত শাটী शाटी śāṭī হতে উদ্ভুত, যার অর্থ 'কাপড়ের টুকরা' এবং পালি শব্দ शाडी śāḍī বা साडी sāḍī, এবং যা আধুনিক ভারতীয় ভাষায় sāṛī হিসাবে পরিণত হয়েছে। 'সাত্তিক' শব্দটি সংস্কৃত সাহিত্যে এবং জাতক নামক বৌদ্ধ সাহিত্যে প্রাচীন ভারতে মহিলাদের পোশাক বর্ণনার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। এটি আধুনিক সময়ের 'শাড়ির' সমার্থক এবং সমতুল্য হতে পারে। নারীদের উর্ধাঙ্গের পোষাকের বর্ণনায় প্রাচীন স্তনপাট্টা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যা থেকে চোলির উদ্ভব হয়েছিল। কলহনার দশম শতাব্দীর সাহিত্যকর্ম রজনাঙ্গিনী অর্থ 'রাজাদের নদী' বলে যে, কাশ্মীরে রাজকীয় আদেশ অনুসারে ডেকান (দক্ষিণাপথ) থেকে আসা চোলির প্রচলন হয়েছিল। মারাঠিতে পেটিকোটকে পার্কার (परकर) বলা হয়, তামিল ভাষায় উলপাওয়াদাই (உள்பாவாடை) (pavada in other parts of South India: মালয়ালম: പാവാട, তেলুগু: పావడ, প্রতিবর্ণী. pāvāḍai, কন্নড়: ಪಾವುಡೆ, প্রতিবর্ণী. pāvuḍe) এবং পূর্ব ভারতে বাংলায় সায়া বলা হয়। এছাড়াও পেটিকোট-কে "ভিতরের স্কার্ট" বলা যেতে পারে। বাঙালি ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে অষ্টম শতাব্দীতেও শাড়ি ছিল প্রাচীন ভারতের প্রচলিত পোশাক। যেখানে তখনকার মেয়েরা আংটি, দুল, হার এসকল অংলকারের সঙ্গে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত শাড়ি পরিধান করত, এবং উপরে জড়ানো থাকত আধনা (আধখানা)। পাহাড়পুর থেকে প্রাপ্ত পাল আমলের কিছু ভাস্কর্য অনুমান করে এ ধারণা করা যায়। শাড়ি পড়ার প্রায় ৮০টিরও অধিক নথিভুক্ত উপায় প্রচলিত রয়েছে। কোমরের চারপাশে শাড়ি জড়ানোর সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতিটি হল শাড়ির এক প্রান্ত কোমড়ে পেচিয়ে অপর আলগা প্রান্তটি অর্থাৎ আঁচল কাঁধের উপর দিয়ে পেছনে ঝুলিয়ে পরিধান করা। তবে, শাড়ি বেশ কয়েকটি পদ্ধতিতে পেচিয়ে পড়া যেতে পারে, যদিও কিছু শৈলীর জন্য নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য বা আকারের শাড়ি প্রয়োজন। শাড়ির ইতিহাসবিদ এবং স্বীকৃত বস্ত্রশিল্প পন্ডিত আতা কাপুর চিশতী তার শাড়িস: ট্র্যাডিশন অ্যান্ড বিয়ন্ড গ্রন্থে শাড়ি পরিধানের ১০৮টি পদ্ধতি নথিভুক্ত করেছেন। এই গ্রন্থে গুজরাত, মহারাষ্ট্র, গোয়া, কর্ণাটক, কেরল, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, এবং উত্তরপ্রদেশ মোট ১৪টি রাজ্যের শাড়ি পরিধানের পদ্ধতি নথিভূক্ত হয়েছে।
শাড়ি নিয়ে উপরের অংশটুকু পড়ার পর নিশ্চয় এতটুকু বুঝা যাচ্ছে যে, শাড়ি উপমহাদেশের খুব সাধারন একটা পোষাক যেটা যুগের পর যুগ ধরে আমাদের দেশের মা বোনরা ঐতিহ্য মেনে পড়ে আসছেন। সুতরাং হুট করেই এই পোষাক শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির ভিতরে যৌন তাড়নার জোয়ার সৃষ্টি করলে সেটার দোষ আর যাই হোক শাড়ির নয়, এটা নিশ্চিত। কিন্তু সামান্য একটা নিরহ গোবেচারা শাড়িও যখন আবদুল্লাহ আবু সাইয়ীদের মত তথাকথিত একজন ব্যক্তির চোখে শুধুই যৌন চেতনা বা যৌন তাড়না যাই বলে নি কেন, তৈরি করে সেটা অবশ্যই দৃষ্টিকটু এবং সর্ম্পূণ বেমানান।
তিনি মেয়েদের নিয়মিত পড়া গ্রামবাংলার অতি সাধারন একটা পোশাকের এমন রসালো, নির্লজ্জ এবং লালায়িত বর্ণনা দিয়েছেন যে, সেটার প্রতিবাদ না করে আর পারলাম না। শুনেছি উনি একজন শিক্ষক, কিন্তু উনি যেই ভাষা এবং শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন সেটা অবশ্যই শিক্ষক হিসেবে বলতে পারেন না। প্রবাদ আছে, প্রদীপের নীচেই নাকি অন্ধকার থাকে আর উনি এই লেখার মাধ্যমে সেটাই প্রমাণ করে দিলেন। প্রচলিত আছে, মদ পুরানো হলে তাতে নেশা বেশি, চাল পুরানো হলে তাতে ভাত বেশি হয় আর পুরুষ পুরানো হলে তার প্রকাশে গোপন চরিত্রের প্রতিফলন স্পষ্ট হয়। সায়ীদ সাহেব শুরু থেকেই এইরকম, না বয়স বেড়ে যাওয়ায় সেটা সবার চোখে পড়ছে বেশি, ঠিক বুঝতে পারলাম না।
সম্প্রতি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রথম আলোতে প্রকাশিত শাড়ি নিয়ে একটি লেখায় শাড়িকে পৃথিবীর সবচেয়ে "যৌনাবেদনময়ী অথচ শালীন পোশাক" বলে মন্তব্য করেছেন। উনার এই লাইনটা পড়ার পরা ছোটবেলায় শোনা একটা কৌতুক মনে পড়ে গেল। এলাকার সবচেয়ে বড় সিঁধেল চোর মারা গেলে তার ভাই লোকজনকে বলে বেড়াত, আমার ভাইটা চোর হলে কি হবে ওর চরিত্রটা কিন্তু ভালো ছিল! যেই পোষাক যৌনাবেদনময়ী হয় সেটা আবার কিভাবে শালীন হতে পারে সেটা আমার মাথায় ঢুকল না। আমার কাছে কিন্তু সিঁধেল চোরের কাহিনীর মতোই লাগলো। শুনেছি উনি নাকি আলোকিত মানুষ, সবাই’কে গাড়িতে করে আলো বিতরন করে বেড়ান! ভাগ্যিস আলোকিত মানুষ, অন্ধকারের হলে কি যে লিখত? মাত্র কিছুদিন আগেই এক অনুষ্ঠানে দাঁড়ায়ে থাকতে পারছিলেন না, বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছিলো আপনার। আপনি নিজেই বলেছিলেন, বয়স আর আপনাকে সময় দিতে চাচ্ছে না। যে বয়স হয়েছে তাতে তো চুল-দাড়ি সাদা হয়ে যাবার কথা, এক পা কবরের উপর দিয়ে দাঁড়িয়েও আছেন! যেই বয়সে উনার মৃত্যু ভয়ে আল্লাহ খোদার নাম নেয়ার কথা, সেই বয়সে এসে উনি মেয়েদের শাড়ির ফাঁকফোকরের ভিতর দিয়ে যৌনতার গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছেন! ভালো বেশ ভালো! একদিক দিয়ে ভালোই করেছেন, এতদিনের বর্ণচোরা স্বভাবের আসল রঙটা তো চেনা গেল অবশেষে!
এইধরনের লেখা কি প্রথম আলোতে এই প্রথমবারের মতো ছাপা হয়েছে? উত্তর হলো, না। এই পত্রিকার চরিত্র ধুতরা ফুলের মতো পবিত্র। এর আগেও এই পত্রিকা সাঈদ জামিল নামে এক কবিকে ‘জীবনানন্দ দাশ সাহিত্য পুরষ্কার’ দিয়েছিল৷ সাঈদ জামিলকে কবি বলা ঠিক হবে কিনা সেটা আমি ব্লগের পাঠকদের কাছে ছেড়ে দিলাম। ‘কায়কাউসের ছেলে’ নামের বইটি প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল৷ প্রথম আলোর পক্ষ থেকে এইসব কুরূচিপূর্ণ লেখা ছাপানো নতুন কিছু নয়। এদের সাহিত্য রূচি এতই বিকৃত যে সেটা বুঝানোর জন্য সেই বই থেকে কয়েকটা লাইন নীচে দিয়ে দিচ্ছিঃ-
আমি কায়কাউসের ছেলে,
আমি বেড়াই হেসে খেলে৷
ইচ্ছে হলে হাগি মুতি,
ইচ্ছে হলে চুদি;
ইচ্ছে হলে উরুর ভাঁজেই দুই চক্ষু মুদি।
যারা এখনও আন্দাজ করতে পারেন নি তাদের জন্য আরেকটা দিলামঃ
স্ত্রীদুগ্ধ পান করতে করতে লোকটা ভাবলো,
পৃথিবীতে ইঞ্জিন আবিষ্কারের পূর্বে যেসব নিমগাছ
জন্মেছিলো সেসব নিমগাছ ইঞ্জিনের শব্দ শোনে নাই—
লোকটার ভাবনার ওপর দিয়ে তিনটে খরগোশ
দিগন্তের দিকে দৌড়ে গ্যালো।
আর, দিগন্ত থেকে খ’সে পড়লো প্রকান্ড এক পুরুষাঙ্গ!
দিগন্ত থেকে খ’সে পড়া পুরুষাঙ্গের রঙ ঘন ও সুরেলা।
সুতরাং এই চরিত্রের পত্রিকা যে এই ধরনের কুরূচিপূর্ণ লেখা ছাপাবে তাতে অবাক হবার কি আছে? বরং এই নিদারুন লেখার জন্য সায়ীদ সাহেব’কে বড় কোন সাহিত্য পুরষ্কারে ভূষিত করলেও অবাক হবো না!
যারা এখনও এই লেখাটা পড়েন নি তাদের জন্য এর সারমর্ম নীচে তুলে দিচ্ছিঃ
-শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক।
-শাড়ি তার রূপের শরীরে বইয়ে দেয় এক অলৌকিক বিদ্যুৎ হিল্লোল।
-আধুনিক শাড়ি পরায় নারীর উঁচু-নিচু ঢেউগুলো এমন অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে, যা নারীকে করে তোলে একই সঙ্গে রমণীয় ও অপরূপ।
-সত্যি কথা বলতে কি, অধিকাংশ বাঙালি মেয়েকে শাড়ি ছাড়া আর হয়তো কিছুতেই মানায় না।
-শাড়ি সুকুমার ও নমনীয় শরীরের জন্যই কেবল সত্যিকার অর্থে মধুর।
-তবে মাঝে মাঝে এ দেশেও যে এক–আধজন সুন্দর মুখের দেখা পাওয়া যায় না, তা–ও নয়। তবে একটিমাত্র কারণেই কেবল তা হতে পারে; যদি তারা তাদের কমনীয় শাড়িগুলোকে নান্দনিক বা সুরুচিসম্মতভাবে পরতে পারে।
-বাঙালি সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা: আমার ধারণা ‘উচ্চতা’।
-দৈহিক সৌন্দর্য ছেলেদের বড় ব্যাপার নয় বলে এ নিয়েও তারা কোনোমতে পার পেয়ে যায়।
-আমার ধারণা, একটা মেয়ের উচ্চতা অন্তত ৫ ফুট ৪–এর কম হলে তার শরীরে নারীজনিত গীতিময় ভঙ্গি পুরোপুরি ফুটে ওঠে না।
-শাড়ি একটা রহস্যময় পোশাক। নারী দেহকে কতটা প্রদর্শন করলে আর কতটা অপ্রকাশিত রাখলে তা শারীরিক মোহ বজায় রেখেও দর্শকের চোখে অনিন্দ্য হয়ে উঠবে, তা পোশাকটি যেন সহজাতভাবেই জানে।
-সালোয়ার-কামিজ, টাইট জিনস, মিনি স্কার্ট কি এর সমকক্ষ? শেষেরগুলো তো প্রায় পোশাক না থাকারই শামিল।
-শাড়ির মধ্যে আছে এই দুইয়ের মিলিত জাদু। এ সৌন্দর্যের লালসাকেও বাদ দেয় না আবার আলোয়–ছায়ায়, মেঘে-রৌদ্রে শরীরকে যেন স্বপ্নরাজ্য বানিয়ে দেয়।
-তাদের শরীরের অসম অংশগুলোকে লুকিয়ে ও সুষম অংশগুলোকে বিবৃত করে শাড়ি এই দুর্লভ কাজটি করে।
-শাড়িও তেমনি নারীর শরীরে সৌন্দর্যের প্রতিটি ঢেউ আর সরণিকে আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু ভঙ্গিতে বিন্যস্ত করে আঁচলের কাছে এসে একঝাঁক সাদা পায়রার মতো নীল আকাশে উড়তে থাকে।
-যেকোনো অসমতাকে আড়ালে রেখে মানসম্মত দেহসৌষ্ঠব নিয়ে দাঁড়ানোর পথ একটাই, ইংরেজিতে যাকে বলে মেকআপ, যার গভীরতর মানে মেকআপ দ্য লস।
আবার খেয়াল করুন। নারীদের প্রতি উনার সুশীলীয় কায়দার দৃষ্টিভঙ্গি দেখুন! উনি খুব সুক্ষ্ম ভাবে কি বুঝাতে চেয়েছেন-
* তিনি লেখার শুরুটাই করেছেন এভাবে, “শাড়ি পৃথিবীর সবচেয়ে যৌনাবেদনপূর্ণ অথচ শালীন পোশাক।“ অর্থাৎ শাড়ীর মাঝে তিনি সর্বপ্রথম যৌন আবেদনটাই খুঁজে পান। সুযোগ পেলে তার কাছে আমি অবশ্যই জানতে চাইতাম, শালীনতার মানদণ্ড ঠিক কোনটা? এই শেষ বয়সে এসে মেয়েদের কি কি দেখলে উনার হরমোন আনব্যালান্সেড হয়ে পড়ে?
* শাড়ির কথা বলতে গিয়ে নারীর শরীর এবং সৌন্দর্যের যে রগরগে চুলচেরা বর্ণনা দিয়েছেন, সেগুলি পড়লে মাথা প্রায় ঘুরে যায়। উনার লেখা পড়ার পর মনে হবে, এই দেশের সব মেয়েদের একটাই কাজ, উনার পছন্দ মতো শাড়ি পরে যৌনাবেদনময়ী হয়ে পুরুষদের সামনে ঘুরে বেড়ানো।
* শাড়িকে যৌন আবেদনের শীর্ষে উঠাতে যেয়ে অন্যান্য দেশের নারী, তাদের পোশাককে এবং তাদের সংস্কৃতিকেও হেয় করেছেন। তিনি বলেছেন, “সালোয়ার-কামিজ, টাইট জিনস, মিনি স্কার্ট কি এর সমকক্ষ? শেষেরগুলো তো প্রায় পোশাক না থাকারই শামিল।’’ উনাকে আরেক দেশের মেয়েদের পোষাক নিয়ে এত বাজে কটাক্ষ করার পারমিশন কে দিল?
* তিনি সুস্পষ্টভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টি নিয়েও বাজে মন্তব্য করেছেন। “দৈহিক সৌন্দর্য ছেলেদের বড় ব্যাপার নয় বলে এ নিয়েও তারা কোনোমতে পার পেয়ে যায়।” তিনি সুন্দরী হওয়ার শর্ত হিসেবে নারীর উচ্চতাকেও মূখ্য মনে করেন। তাইতো তিনি হাই হিলের গোপন রহস্যে অভিভূত হন এবং শাড়িকে আখ্যা দেন ‘মেকআপ দ্য লস’ হিসেবে।
* “নারী দেহকে কতটা প্রদর্শন করলে আর কতটা অপ্রকাশিত রাখলে তা শারীরিক মোহ বজায় রেখেও দর্শকের চোখে অনিন্দ্য হয়ে উঠবে, তা পোশাকটি যেন সহজাতভাবেই জানে”। এর মধ্য দিয়ে উনি এটাই বলতে চাচ্ছেন যে মেয়েরা শাড়ি পড়ে শুধুই দেহ প্রদর্শনের জন্যই? আমাদের মা বোনরা স্ত্রীরা শাড়ি কি পড়ে এইসব আলোকিত মানুষের নামে কলংকিত চরিত্রদের চোখে শুধুই যৌন আবেদন সৃষ্টি করার জন্য?
প্রথম আলোর একটা শ্লোগান হচ্ছে “চোখ খুলে দেয় প্রথম আলো”। আমার আগে ধারণা ছিল এরা এটা রূপক অর্থে ব্যবহার করে। কিন্তু এইবার বুঝলাম এরা কদাচিৎ নির্ভেজাল সত্য কথাও বলে। এই লেখাটাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ।
পুরো লেখাটাই যেন অবাধ যৌনতার এক চরম বহিঃপ্রকাশ। নারীর উচ্চতা ও দৈহিক বৈশিষ্ট্যকে কটাক্ষ করে তিনি সৌন্দর্যের যে মান নির্ধারণ করেছেন তা উগ্র বর্ণবাদী মানসিকতার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। সব মেয়েদেরকে মাপা হয়েছে শুধু মাত্রই তাদের শারীরিক আঙ্গিকে। মুক্তমনার দাবিদার এই লেখক সত্যিই নিজের কুপুরুষত্বের প্রমাণ দিলেন! মেয়েদের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান আছে এমন কোন পুরুষ এই লেখা লিখতে পারে না। উনি শুধু কুপুরুষই হয়েছেন কিন্তু মানুষ হতে পারেন নি! মেয়েদের দেখলে উনার কি আলোকিত হয় সেটা এখন দিনের আলোর মতোই সুস্পষ্ট!
এই লেখক বলেছেন, বাংলাদেশের মেয়েরা আজকাল বিভিন্ন মডার্ন পোষাক পরে হাস্যকর আত্মতৃপ্তি নেয়৷ মেয়েরা তাদের দৈনন্দিন স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কর্মোপযোগী পোষাক পড়লে কিংবা ধর্মীয় আদেশ মেনে পোষাক পড়লে সেটা আপনার কাছে হাস্যকর আত্মতৃপ্তি? বেপর্দা মেয়েদের দেখার এতই নির্লজ্জ আর বেহায়া খায়েস আপনার? উচ্চতাজনিত ত্রুটি মানে সোজা বাংলায় খাটো হওয়া পুরুষের জন্য তেমন সমস্যার না৷ তবে নারীদের কোনভাবেই খাটো হওয়া চলবে না৷ নারীকে এই ত্রুটির জন্যে ‘মেইক আপ দা লস’ করতে হবে৷ কিন্তু কিভাবে সেই মেইকআপ করবে? শাড়ির ন্যায় দীর্ঘ পোষাক পড়ে। কারণ তাতে নাকি ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি লম্বা নারীকে দেখতে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি দেখাবে৷ আর উনি তাতে যৌনতৃপ্তি পাবেন। শারীরিক উচ্চতা কোন ব্যক্তির এচিভড কোয়ালিটি নয়৷ নিজের অর্জিত গুণের বাইরে গিয়ে শারীরিক সৌন্দর্য্য নিয়ে মেতে থাকার মতো অনর্থক কাজ বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েরাই করে না। জেনে রাখুন আলোকিত সাহেব, প্রতিটা নারীই পূর্ণাঙ্গ মানুষ৷ সে কি পড়বে, কি পছন্দ করবে সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত।
শাড়ি নিয়ে এত জঘন্য একটা লেখা লিখে দেশের পার্ভাট পুরুষদের যেই রকম উৎসাহ দিলেন, অদূর ভবিষ্যতে আপনার স্ত্রী, মেয়ে, বোনের বা কোন আত্মীয়ার শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে আপনার মতো তথাকথিত এবং আলোকিত সুশীল কেউ যদি সাহিত্য আর সংস্কৃতির নামে শরীরের আঁকবাঁক খুঁজলে, বুকের উচ্চতা মাপার কথা বললে তখন মুখটা কোথায় লুকাবেন সেটা আগে ভাগেই ঠিক করে রাখুন!
নিজের যৌন চাহিদার কথা বলতে যেয়ে উনি মৃত খোদ রবী ঠাকুর’কে ছেড়ে দেন নি। উনি লিখেছেনঃ “ইংল্যান্ডের কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: এখানে রাস্তায় বেরোনোর বড় সুবিধা যে থেকে থেকেই সুন্দর মুখ দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি জাতির বেলায় কথাটা হয়তো ওভাবে খাটবে না। তবে মাঝে মাঝে এ দেশেও যে এক–আধজন সুন্দর মুখের দেখা পাওয়া যায় না, তা–ও নয়।” তার মানে কি সেটা আপনি নিজেই চিন্তা করুন! উনার মনে সুতীব্র আফসোস, এই দেশে মাত্র অল্প কিছু সুন্দরী রমনীর শাড়ি পড়া কামনা মদির দেহের দেখা তিনি পান, যাদের দেখে তার মনে ও শরীরে অতৃপ্ত কামনার আগুন জ্বলে। সংখ্যাটি অত্যন্ত কম, এটি নিঃসন্দেহে চরম কষ্টের কথা! আলোকিত এই লেখকের কথা মতো মেয়েদের একমাত্র কাজ এই সব কুপুরুষের শরীর ও মনের ক্ষুদা/চাহিদা নিবারন করা। সুতরাং এই দেশের প্রতিটা মেয়ের সায়ীদ সাহেব উপদেশ মতো সেই ভাবে শাড়ি পড়া উচিত, যাতে নারীদেহের প্রতিটা ভাঁজ কিংবা আঁকবাঁক আরও গাঢ় ভাবে ফুটে উঠবে, পশ্চাতদেশের খাদ সুস্পষ্ট হবে, বুকের উচ্চতা স্পষ্টভাবে বুঝা যেয়ে উনার মতো আলোকিত কুপুরুষদের বহুদিনের ধব্জভঙ্গ নিম্নাংঙ্গে উত্তেজনার সুনামী তুলবে।
উনার লেখা পড়ার পর সিনিয়র সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘আবহমান কালজুড়ে বাঙালি নারীর প্রিয় সুন্দর সম্মান ও ব্যক্তিত্বের পোশাক হলো শাড়ি। শাড়ি আমার মা পরেছেন, আমার বোনেরা পরেন। শাড়ি আমাদের শিশুকন্যারাও পরে। শাড়িতে নারী আমার কাছে অনেক বেশি সম্মান ও শ্রদ্ধার।’ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তার শাড়ি লেখাটির কিছু কিছু বর্ণনায় নারীকে পণ্যের শামিল করেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। ‘তার জীবনের পড়ন্ত বেলায় ভেতরে বাস করা যৌনবিকৃত পুরুষের চেহারাই উন্মোচিত হয়েছে।’
চরম সেক্সিস্ট (যৌন বৈষম্যমূলক) ও রেসিস্ট (বর্ণবাদী) এই লেখায় উনি শাড়িকে উত্তেজক পোশাক উল্লেখ করে মূলত নারীকেই পণ্য হিসেবেই মূল্যায়ন করেছেন। সারা দেশে সবাই যখন নারী বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলছে সেখানে উনার এই অবেবেচক কথাগুলি সমাজে ধর্ষকামী আচরণকে উৎসাহিত করবে।
যেকোন দেশে সুশীল শ্রেণীর কথাবার্তা এবং আচরন দেখলেই নাকি সেই দেশের মানুষের রূচি সর্ম্পকে স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়। কারন এদের কথাবার্তা পরবর্তি প্রজন্মকে দারুন ভাবে প্রভাবিত করে। আর তাই সুশীল এই শ্রেনীর সবাই’কে হতে হয় সতর্ক, রুচিশীল, সংযমী মনোভাবের। অথচ, এখন আমাদের দেশে এই তথাকথিত সুশীল শ্রেনীরা নারীবাদীদের সমর্থনের নামে যা ইচ্ছে বলে এবং করে বেড়াচ্ছে। এদের কুৎসিত রূচি কিংবা আচরণ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই যে কেউ হয়ে যাব জঙ্গী, আল কায়েদা কিংবা আফগান! এই সমস্ত সুশীল আসলে সুশীল নয় বরং এরা ভালো মানুষের মুখোশ পড়া ভাঁড়ামি সর্বস্ব কদাচার রূচির পুরুষ। যে ভাষা ব্যবহার করে শাড়ি নিয়ে লেখা হয়েছে, যেভাবে উনি ‘উঁচু-নিচু ঢেউগুলো’র দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেই ইঙ্গিতের সঙ্গে ‘চটি’র ভাষার সাথে কি কোন পার্থক্য আছে?
নারী শরীরকে কতটুকু অনাবৃত রাখলে তা আপনার কাছে রহস্যখচিত লাগে, জনাব আলোকিত সাহেব? শাড়ি তো মেয়েরা অনেক ভাবেই পড়ে, শাড়ি কেউ নাভির নিচে পড়ে, কেউ পড়ে উপরে। আপনার কোনটা ভাল লাগে? নাভি দেখা গেলে? নাকি না দেখা গেলে? ব্লাউজের হাতার দৈর্ঘ্যও তো কম বেশি হয়। কেউ পড়ে ফুল হাতা, কেউ হাফহাতা, কেউ ম্যাগি, কেউ হাতা একদম কাটা ব্লাউজ। আপনার কোনটা বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি করে লেখায় উল্লেখ করলেন না? আবার শাড়ি পড়ার ঢংও সবার এক নয়। আপনার কাছে কোন ঢংটি সবচেয়ে যৌন আবেদন পূর্ণ?
আবু সায়ীদ সাহেব, ভালো ফলমূলও বেশিদিন খারাপ জায়গায় রেখে দিলে তাতে পঁচন ধরে। জানি না আপনার বেলায় ঠিক কি ঘটেছে? তবে আপনার রূচির যে ভয়াবহ পঁচন ধরেছে সেটা আমি নিশ্চিত।
আলোকিত মানুষের তকমা, সুশীলতার তকমা, সাদামনের মানুষের তকমা, সর্বজন গৃহীত চরিত্রের তকমা নিয়ে যা লিখেছেন তাতে সেটা পতিতালয়ের দালালদের সাথেই তুলনার যোগ্য। শুধু তুলনা নয় আরও নিকৃষ্ট বললেও কোনভাবেই ভুল হবে না, কারণ এরা তো পেটের দায়ে এসব করে, কিন্তু আপনি কিসের দায়ে এসব লিখে বেড়াচ্ছেন? বেলায় বেলায় অনেক সময় তো পার হয়ে গেছে, এবার ঝেড়ে কাসুন তো সুশীল সাহেব?
আপনার আমার জন্মদাত্রী মেয়েদেরকে যৌনতার পণ্য নয়, বরং মা, বোন, স্ত্রী কিংবা নিজের মেয়ের মতো মনে করতে শিখুন। হুমায়ূন আজাদের মতো মেয়েদের শুধুমাত্র দেহের দিকে তাকিয়ে আফসোস কিংবা হাসফাঁস করা বন্ধ করুন। উনাকে এখন এইসব কুৎসিত আচরণের পাই পাই করে হিসাব দিতে হচ্ছে। এই হিসাব দেয়া থেকে কিন্তু ইহলোকের কোন ব্যক্তিই মুক্তি পাবেন না! এই বৃদ্ধ বয়সে এসে এসব অসংলগ্ন আচরণ বন্ধ করে মেয়েদের শ্রদ্ধা আর সম্মান করতে শিখুন, মন থেকে ভালোবাসতে শিখুন, নারীত্বের হৃদয়কে বুঝতে শিখুন। তাদের উঁচু নীচু বুকের আর পেটের ভাঁজগুলির দিকে তাকিয়ে যৌন চেতনা সৃষ্টি না করে, মেয়েদের গর্ভাবস্থায় তার স্ফিত উদরকে ভালোবাসুন যেটা আপনাকে এই সুন্দর ধরণীতে নিয়ে এসেছিল, বাকি সবকিছু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র নিজের জন্মদাত্রী মায়ের কথা একবার স্মরণ করে হলেও!
আপনার শাড়ি নিয়ে লেখাটা অবশ্যই কোন সাহিত্য নয় বরং এটা দেহত্বের রগরগে বর্ণনা! আবু সায়ীদ সাহেব, আপনার এই লেখা পড়ার পর ব্যক্তিগতভাবে আপনি আমার সবধরনের শ্রদ্ধাই হারালেন।
সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইল।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত @ নীল আকাশ, অক্টোবর ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১২:২১