প্রিয়া সাহা ফেসবুকে আমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সম্ভবত তিনিই বন্ধুত্বের অনুরোধ পাঠিয়েছিলেন। এরপর কিছুদিন পরেই আমি তাকে বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হই। আমি সাধারণত তাদেরকেই বাদ দেই যাদের সাথে মতোবিরোধের প্রেক্ষিতে ঝামেলা সৃষ্টি হওয়ার আশংকা থাকে, বারবার চেষ্টা করেও বুঝাতে ব্যর্থ হই, অথবা যদি কেউ আক্রমণাত্মক বা ক্ষতিকারক কিছু করে। এখন আমি ফেসবুকে তার আইডিটাও পাচ্ছি না। সম্ভবত দুজনের কেউ একজন অন্যকে ব্লক দিয়েছি। তিনি এখনও হিন্দু সমাজের নেতা কিনা আমি জানি না। তার সাথে আমার কোনোদিন দেখাও হয়নি।
.
কিছুদিন আগে আমি যখন প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়েছিলাম, তখন অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন দেশে হিন্দুদের অবস্থা কী, তারা কেমন আছেন। আমি বলেছি আগের চেয়ে ভালো আছেন, হিন্দু তরুণদের মধ্যে যারা যোগ্য তারা মেধায় চাকরি পাচ্ছে, সাম্প্রদায়িক হামলাও কম হচ্ছে। তখন একজন আমাকে বললেন, তাহলে ফেসবুকে আপনাদের পত্রিকায় যেসব খবর দেখি তা কি মিথ্যা? আমি বললাম, সেগুলো সত্যি হতে পারে, আমি তো নিজে সবগুলো দেখিনি; কিন্তু আগে সংবাদপত্রে এসব সাধারণত আসতো না বা প্রকাশিত হতো না, কিন্তু এখন প্রকাশ হয় বলে আপনারা জানেন। সবাই জানে বলেই ব্যবস্থাগ্রহণও দ্রুত হয়। প্রশাসন-পুলিশও আগের চেয়ে সতর্ক বলেই আর কোনো নাসিরনগর বা রসরাজের ঘটনা ঘটেনি। হিন্দুরা যদি আগের চেয়ে ভালো না থাকতো, নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি হিন্দু-মুসলিম দেখা হতো, তাহলে আমার মতো ছেলে তো মেধায় চাকরি পেতো না। হয়তো আমি আশানরূপ পাইনি, কিন্তু পেয়েছি তো! কিছুটা নিপীড়ন থাকবেই, সব দেশেই সংখ্যায় কমেরা কমবেশি চাপে থাকে।
.
তখন একজন বললেন, আচ্ছা, আপনার ওপর যে হামলা হলো, সেটা কারা করলো? অবাক হলেও পরে উপলব্ধি করলাম, ফেসবুকের কল্যাণে দুনিয়াটা এখন অনেক ছোট। আমি বললাম সামনে তো হিন্দুরাই ছিলো। তিনি বললেন, পেছনে কেউ না থাকলে কি তারা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে? বললাম, আমি ধৈর্য ধরে আছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জানিয়ে রেখেছি। দেখি কী হয়। তারা হয়তো ভেবেছিলেন আমি তাদের কাছে সাহায্য চাইবো। এমন জবাবে দমে গেলেন। আরেক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন, দুইবার হামলার পরেও পড়ে আছেন কেন ওখানে? চলে আসতে পারেন না? (এমনকি একটা মন্দির কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে থেকে যাওয়ার প্রস্তাবও দিয়ে বসলো!) আমি বললাম, হামলা তো এখানেও হতে পারে, রিফিউজি বলে গালি দিতে পারে। তাছাড়া এখানে এসে আমি কি করে খাবো? ওই দেশ আমার জন্মভূমি, আমার বাবা ঐ দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন। ঐ দেশ ছেড়ে কেন আসবো? তাছাড়া ঐদেশে আমি এখন একটা সম্মানের চাকরিও করি। দেশের সেবা করে পেট চালানোর ব্যবস্থা হয়েছে। এখানে এসে কারো গলগ্রহ কেন হবো? যেখানে আমার পূর্বপুরুষই পালায়নি, আমি তাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে থেকে কেন পালাবো? বললাম, আমি ওখানেই থাকবো, থেকেই লড়াই করবো। হোক আমার জায়গা দখল, হোক আরও হামলা, মারাক হিন্দু গুন্ডাপান্ডা দিয়েই আবার, তবুও আমি আমার মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে চাই না। আর বললাম, সব মুসলিম কিন্তু একরকম না। কিছু কিছু মুসলিম হিন্দুদের কারো কারো চেয়েও ভালো।
.
আমার বাবার আসল নাম অ্যাডভোকেট কমল কৃষ্ণ গুহ হলেও তিনি ফরিদপুরকে ভালোবেসে বাবু ফরিদী ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। এই নামেই তিনি সারা দেশে সুপরিচিত ছিলেন। সরকারি চাকরি করেছেন, কবি লেখক সংগঠক ছিলেন, শেষে ওকালতি করেছেন। সংগ্রামের জীবন তাঁর। অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। প্রচুর পরিচিতি আর জনপ্রিয়তার কারণে তাঁর বন্ধু বেশিই ছিলো মুসলিম। বাবার রহস্যজনক মৃত্যুর পর যখন তাঁকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়, অনেকেই অবাক হয়েছিলেন; ৩০ বছর একসাথে সাহিত্যাঙ্গনে পদচারণা করা লোকটিও সেদিন জেনেছিলেন এই লোকটা জন্মগতভাবে হিন্দু। এতোটাই অসাম্প্রদায়িক ছিলেন আমার বাবা। আমাদের এলাকার মুসলিমরাও এমন, ছোট থেকেই দেখে এসেছি সহাবস্থান, একের বাড়িতে অন্যের আসা-যাওয়া, খাওয়া-আড্ডা। কোনোদিন দাঙ্গা-ফ্যাসাদ হয়নি।আওয়ামী লীগ-বিএনপি হিন্দু-মুসলিম মিলেই থাকি। পাশের শ্রীঅঙ্গন মন্দিরটি রক্ষায় মুসলিমদের অবদানও কম নয়। আমার বন্ধুদের মাঝেও মুসলিম বন্ধু অনেক। মিলেমিশেই আছি সবাই, কিছু সমস্যা তো থাকবেই। আমার এলাকার হিন্দুরাই বরং আমাদেরকে সমাজচ্যুত করার ফন্দি এটেছে। হামলা করেছে কার ইন্ধনে জানি না, কিন্তু মামলা তুলে না নিলে এলাকার কাউকে মিশতে দেয় না আমাদের সাথে, মায়ের সরকারি স্কুলটা কিছুদিন আগে মায়ের চেষ্টার কমতি না থাকলেও তুলে দিয়েছে শত্রুতা করে। মুসলিমরা এর মধ্যে আসে না, কারণ এলে যদি সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগ করে ঐসব সংঘবদ্ধ হিন্দুরা!
.
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে কিছুদিন আগে এক সাক্ষাতে যারা গিয়েছিলেন তারা সবাই বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। সবাই তাকে সমস্যার কথা জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্প কিন্তু সেভাবে কাউকেই কার্যকরী আশ্বাস তেমন একটা দেননি, শুধু শুনেছেন। সেখানে প্রিয়া সাহা কীভাবে গেলেন আমি জানি না। যেভাবেই গিয়ে থাকুন, তিনি নিজের ওপর হামলার কথা বলেছেন, যা সম্ভবত সত্যি, যারাই হামলা করে থাকুক না কেন। পত্রিকায় নিউজ হয়েছে। এ নিয়ে ফেসবুকে ছবি দেখলাম হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ মানববন্ধনও করেছে। তাহলে সেটা হয়তো মিথ্যা নয়। মিথ্যা হলে সেটারও বিচার হতে হবে। নাহলে হামলাকারীদের বিচার চাই। আরেকটা তথ্য তিনি যেটা দিয়েছেন, সেই ৩৭ মিলিয়নের তথ্য তিনি কোথা থেকে পেয়েছেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। এতোদিনে সেটা বলেও দেওয়া উচিত ছিলো বিতর্ক এড়াতে। হয়তো তিনি ৪৭ এর দেশভাগের আগের আর এখনকার তুলনা করে সেই সংখ্যাটা বলেছেন, যেমনটা ইউটিউবে দেখলাম মার্কিন কংগ্রেসম্যান ডোল্ড বলেছেন ৪৯ মিলিয়ন! গোবিন্দ প্রামাণিক নামে একজন দেখলাম হিসাব করে শুধু হিন্দুই দেখিয়েছেন ৪ কোটি মিসিং!(টাইমলাইনে আছে) আবার অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত স্যার এই জনগোষ্ঠী যাদেরকে দেশে পাওয়া যাচ্ছে না, মিসিং পপুলেশন বলেছেন। প্রিয়া সাহা বলেছেন উধাউ হয়ে গেছে, 'ডিসঅ্যাপিয়ার্ড'। তার উচিত ছিলো তথ্যসূত্র উল্লেখ করা এবং এটাও বলা যে এখন সংখ্যায় কমেরা আগের চেয়ে ভালো আছে। তবে তিনি যদি নিজেই ভিক্টিম হয়ে থাকেন, তাহলে তার আবেগাক্রান্ত হয়ে উলটাপালটা বলাটাও অস্বাভাবিক নয়। সেটা নিশ্চয়ই মার্কিনিরাও বুঝবেন। বুঝেই পরবর্তী স্টেপ নিবেন। তবে আমি মনে করি তিনি আগে আমাদের মাননীয়াকে সরাসরি সমস্যার কথাগুলো বলতে পারতেন একবার। তাতে কাজ নাহলে তারপর নিজ দায়িত্বে যা খুশি করতে পারতেন। আর বাইরে কারো কাছে এর আগেও নালিশ করে বা প্রতিকার চেয়ে কেউ সফল হয়েছে কি? এই দেশ আমাদের, এই দেশটাকে আমরাই গড়বো। বাইরের কেউ এসে তো আর গড়ে দিতে পারবে না। বাইরেএ কারো হুমকিতে নত হওয়ার লোকও আমাদের মাননীয়া নন।
.
দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা যে কমবেশি হচ্ছে এটা অস্বীকার করার হয়তো উপায় নেই। এমনিতেই কেউ নিজের ভিটেমাটি আর স্মৃতি ছেড়ে পালায় না। কিন্তু সেগুলো কমাতে সরকার তৎপর আছে এটাও সত্যি। অন্তত সরকারের উচ্চ পর্যায় এসব ব্যাপারে আন্তরিক। প্রিয়া সাহা যদি মিথ্যা কোনো তথ্য দিয়ে থাকেন, তার বিচার তিনি পাবেন। ইতিমধ্যেই মামলা হয়েছে। কিন্তু আমাকে আমার মুসলিম বন্ধুরাও কথা দিক, আজকের পর থেকে আর কোনো হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান বা আদিবাসী নিজেকে সংখ্যায় কম মনে করবে না, বঞ্চিত মনে করবে না, কারো মন্দিরে হামলা হলে তারা সবাই এক হয়ে রুখে দেবে, কাউকে 'মালাউন' বলা হবে না, কারো বাড়িতে আগুন দেওয়া হবে না আর। হিন্দুদের পূজায় মুসলিমরা নারু খেতে যাবে, মুসলিমদের ঈদে হিন্দুরা জর্দা খেতে যাবে। একে অন্যকে ভাই ভাববে, বন্ধু ভাববে। কেউ কারো সম্পদ দখল করার বা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে না। তাহলেই প্রিয়া সাহার বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হবে। আমিও চাই সেটাই হোক। কারণ এই দেশ আমার, এই মাটি আমার। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাই, মনটা পড়ে থাকে এই দেশে আমার ছোট্ট ভাঙা ঘরেই। কারণ এখানে আমার মা আছে, আছে বাবার স্মৃতি। এই দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে, আমাকে গড়ে তুলেছে। এখন দেশকে আমার দেবার পালা।
.
মাগো এই দেশেতেই জনম আমার, যেন এই দেশেতেই মরি!
(Feel free to share)
লেখাঃ দেব দুলাল গুহ (দেবু ফরিদী)