somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দশ কিংবা দশকের গল্প

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দশ
বিশেষত্বহীন নিষ্কর্ম এক শৈশব । দশ বছর বয়সী শৈশব হতে পারে দুরন্তের, কর্দমাক্ত মাঠের কিংবা রক্তিম বিকেলের সর্বোপরি একটি ডানপিটে কৈশোরের । কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয়ে ওঠেনি । যে বয়সে অন্য সবাই দৌড় ঝাঁপ লম্পঝম্প আর ব্যাট বল নিয়ে মেতে থাকত, আমি থাকতাম চিলেকোঠার পুরানো আসবাব আর মরচে ধরা কিছু তৈজসপত্র নিয়ে; একজোড়া খড়ম, একটা পুরানো ভাঙ্গা সাইকেল আর অকেজো কিছু প্লাস্টিকের খেলনাও ছিলো । কখনো ভেন্টিলেটরের ছিটাবৃষ্টি আমাকে গা করে নি, শীতের আদরমাখা রোদ্দুর আমার শরীর জড়িয়ে ধরেনি । খুব ইচ্ছে করতো একদিন আমিও অন্য সবার সঙ্গে বই খাতা নিয়ে হেলেদুলে ইশকুলে যাবো । সেই ইচ্ছাটা প্রতিনিয়ত আমাকে দুষে যায়, প্রতারক মিথ্যাবাদী বেঈমান হিসেবে আখ্যায়িত করে আর একটু একটু করে উবে যেতে থাকে । আমার আর ইশকুলে যাওয়া হয়না, টুকুনের সাথে খেলাও হয়না ।
খুব ছোটো থাকতে টুকুন একবার হামাগুড়ি দিতে দিতে ভুলক্রমে এসে পড়ে দরজায় । সিঁড়ি ভাঙতে বেচারার খুব কষ্ট হয়েছিলো জানি আমি । টুকুন বন্ধ দরজার দেয়াল ধরে একটু একটু দাঁড়াতে চেষ্টা করে আর পড়ে যায়, আবার চেষ্টা করে আবার পড়ে যায়; এভাবে সফল হবার আগপর্যন্ত সে চেষ্টা চালিয়েই যায় । আমি ওপাশ থেকে ওর ইনফ্যান্টিভ অনুভূতিগুলো ছুঁয়ে দেখতে পারি । ওর ছোটো ছোটো দ্রুতগামী শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে আঁটকে যায় আমার স্ফীত হৃদস্পন্দন । ওর মুঠি পাকানো হাতের তালুতে জমে থাকে থাকে আমার ঘর্মাক্ত সুখ, মার্বেলের মত স্বচ্ছ দৃষ্টিকণিকায় আমি দেখতে পাই আমার ঘূর্ণিয় পৃথিবী । আমি টুকুনকে কাছে ডাকি, টু-কু-ন । কি আশ্চর্য! টুকুন শুনতে পেয়ে খিলখিলিয়ে হাঁসে । আমার প্রাণ জুড়িয়ে যায়, আমি আবারো টুকুনকে ডাকি । টুকুন চকিত দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায় কিন্তু কিছুই দেখতে পায়না । আমি প্রাণপণে চেষ্টা করি টুকুনের কাছে পৌঁছুতে, কিন্তু পারিনা । বন্ধ দরজা এবং গবাক্ষের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবার কৌশল ভালমত রপ্ত করতে পারিনি আমি । তাই সেই অদৃষ্ট দ্বারারক্ষী কারারুদ্ধ করে রাখে আমাদের; দূরত্ব স্থির করে দেয় আমার আর টুকুনের জগতে । আমি হাহাকারের মত চিৎকার করি; কিন্তু কেউ শুনতে পায়না সেই আহাজারি । কেউ জানতে চায়না চিলেকোঠার রহস্য ।
অল্পক্ষণেই কিছু ভারী পদশব্দ সিঁড়ি ভেঙ্গে ছুটে আসতে থাকে, সেই সাথে উত্তেজিত চিৎকার চেঁচামেচি । তারপর থেকে আমি আর টুকুনকে কাছে পাইনি । ওর খিলখিল শব্দে হেঁসে ওঠা, চকিত দৃষ্টি ফেরানো ইত্যাদি আমার অনুভূতির আনুসন্ধানিক দৃষ্টিতে অনুসন্ধিৎসু প্রলেপ মেখে থাকে সর্বক্ষণ । কিন্তু ওকে আমি আর খুঁজে পাইনি ।

দশ বছর আগে
টুকুন? এই টুকুন ….. কোথায় তুই?
এইতো মা, ছাদে ।
কি?! টুকুনের মা অতি উত্তেজনায় সম্ভ্রব হারিয়ে ফেলেন; চিৎকার করে বাড়ি উঠিয়ে ফেলেন । যার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অবস্থানরত এক দঙ্গল কাক বিষ্ঠা ছড়ানোর পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়ে উড়াল দেয় অন্যত্র । জানালার কার্নিশের কবুতরগুলো রয়ে গেছে আগের জায়গাতেই; তারা এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে ফ্যামিলিয়ার ।
টুকুন সাবধানে নেমে আসে নিচে ।
অবশেষে জবাবদিহি করতে হয় বাবার কাছে ।
ছাদে গিয়েছিলি কেন?
বল আনতে ।
কতবার তোকে বলা হইসে ছাদে ওঠা বারণ, তা যে কারণেই হোক । আপাতত কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাক । এই বলে তিনি চলে গেলেন অফিশিয়াল কার্যক্রমে ।
টুকুন কানে ধরে এক পায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে । বেশিক্ষণ নয়, যতক্ষণ না ওর বাবা আড়াল হয় । বিকেলে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা আর সন্ধ্যায় প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে বসা এই হচ্ছে টুকুনের দৈনন্দিন স্কেজ্যুল । আজকে বেরিয়ে দেখে সবার মন খারাপ । ব্যাপার কি? জিজ্ঞাস করতেই জানা গেলো খেলার জায়গা নেই । প্রাণপ্রিয় স্কুলমাঠটি এখন সেনাবাহিনীদের অস্থায়ী ক্যাম্প । গোলাবারুদের নিচে সবুজ ঘাসের আর্তনাদ, চিরহরিৎ গাছগুলো করিৎকর্মা দক্ষ হাতে পড়ে নিঃশব্দে উনুনে কয়লা হয়ে যেতে থাকে । শ্রেণীকক্ষগুলো এখন ব্যবহারিত হয় গণ ঘর্ষণাগার হিসেবে । অডিটোরিয়ামে প্রতিধ্বনি তোলে যুবতী ও প্রসূতি বালিকাদের আর্তচিৎকার, হিংস্র কামুক পশুস্বত্বার পরিতৃপ্তিময় উত্তেজক সুখধ্বনি । বস্ত্রহরণের হুটোপুটি শব্দ এবং পরিশেষে অমানবিক যৌনাচার, ধর্ষণ হত্যা !!

টুকুন সনাতনী বর্গীদের গল্প শুনেছে, শুনেছে আধুনিক পাক স্বৈরাচারীদের গল্প । দুই গল্পের ভিন্নতা এখন সে অনুধাবন করতে পারে । ‘পাকসাদ জামিন শাদেবাদ’ নামক শব্দবহর যখন তীব্র গতিতে ওকে পিষে মারতে চায় ও দৌড়ে পালিয়ে যায় সেখান থেকে । এ কুশব্দের কুঞ্জন কুহকিনী যখন ক্রমেই ওর রোম খাড়া করিয়ে দেয় তখন সে তার হস্তাঙ্গুলি দিয়ে প্রাণপণে চেষ্টা করে এটাকে রুখে দিয়ে ভেতরটা বাঁচিয়ে রাখতে । কিন্তু বাইরেরটা বাঁচাতে গিয়ে টিরানীদের টিটকারিতে পড়ে অনেকেই বিকিয়ে দেয় তাদের মহৎ এবং বিকাশিত বোধগুলোকে । খসে পড়ে ছদ্মাবরন, উন্মোচিত হয় এক নতুন ব্যাপ্তি; চোস্ত দাঁড়ি, ধর্মীয় স্তুতি, বৈষম্যনীতি ইত্যাদি ইত্যাদি । কালান্তরে এদেরকে আবার দেখা যায় সরফরাজদের তৈলমর্দন কার্যক্রমে ।
কালপঞ্জিতে টুকুন আজ টুকে রাখে ১৩ই ডিসেম্বর, মানে বছর শেষ হতে আরও সতেরো দিন ! সতেরো দিন পরে ওর এগারো বছর পূর্ণ হবে । টুকুন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে নতুন বছরের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের । বাবা নতুন সাইকেল কিনে দেবেন; সেই সাইকেলে চড়ে দিকহীন ভট্টাচার্যের স্বর্ণতরীর মত মর্ত্য পাড়ি দেবে টুকুন । চিলেকোঠায় অবশ্য দাদার আমলের একখানা অকেজো সাইকেল আছে; কখনো আগ্রহবোধ করেনি সে । ওর চাই নতুন ঝকঝকে সাইকেল, যার ঘুরন্ত স্পোকগুলো স্পার্ক খাবে সোনালী সূর্যরশ্মিতে, টুং টাং শব্দ খাপ খেয়ে যাবে প্রকৃতির শব্দ সমারোহে । কখনো কুয়াশা কখনো বৃষ্টি ভেজা বাতাস চাইকি গ্রীষ্মের খরতাপ সবসময় সাইকেল থাকবে ওর চিরসঙ্গী, একমাত্র বাহন । এমনই একটা ইচ্ছা বহুদিন থেকে পোষণ করে আসছে টুকুন । সাইকেলের প্রতি ওর আগ্রহ জাগে বিশেষ করে ‘বাইসাইকেল থিফ’ সিনেমাটা দেখার পর থেকে । সেদিন টুকুনের বাবা দেখতে গেলেন নতুন মুভি ‘সানফ্লাওয়ার’ । টুকুনের মা এবার সঙ্গে যাননি । ছেলে বড় হইসে! তাছাড়া এলাকার মুরুব্বীরাও একটু অন্য চোখে দেখে । টুকুনের বাবা অবশ্য এসব পাত্তাই দেননি, ‘আই ডোন্ট কেয়ার’ এই এক কথায় সব ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতেন । অগত্যা গাঁইগুঁই করে টুকুনের বাবা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেরিয়ে পড়েন । আর ফিরলেন না । কতবার টুকুন বাবার হাত ধরে পাড়ার নাট্যশালায় গিয়েছে, থিয়েটারে দেখেছে ‘ক্লিওপেট্রা’, কিংবা ‘রক্তকরবী’ যাত্রাপালায় দেখেছে ‘সখী রঙমালা’ আর ‘সোহরাব-রুস্তম’ দেখতে দেখতে বার বার ঘুমিয়েও পড়েছে । ভাঁড় নারায়ণ ঘোষ এর মূকাভিনয় দেখে হাঁসতে হাঁসতে গড়িয়ে পড়েছে । সবই এখন স্মৃতির এ্যালবামের এন্টিক ।
টুকুনের ছোট চাচা আবার পলিটিক্স নিয়ে নানান গবেষণা করেন, এই রুটের সেক্টর কমান্ডার ওঁর বাল্যবন্ধু । তিনি খোঁজ লাগালেন চারিদিকে । কিন্তু টুকুনের বাবার হদিস মিলল না! নষ্ট ট্রানজিস্টর ঠিক করতে করতে আশ্বাস দেন, চিন্তার কিছু নাই ভাবী । ভাইজানরে ফিরাইয়া আনার দায়িত্ব আমার । স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একের পর এক বিজয়ের খবর ভেসে আসতে থাকে । কোণঠাসা হয়ে পড়ছে ওরা । শুনে সাময়িক শঙ্কাটা কেটে গিয়ে চঞ্চলতা বিরাজ করে সবার মাঝে ।
স্থানীয় কাঁচাবাজারটা ভেঙ্গে গেছে । কসাইখানায় পশু আর মানুষের রক্ত মিলে মিশে একাকার, আলাদা করার উপায় নেই । মাছের আড়তে দলিত মথিত মৎস্য পিণ্ড, আস্ত মাছ যা আছে তা থেকে পঁচা দুষিত গন্ধ বের হচ্ছে । বাবলা গাছের হাড়গিলা গুলো চক্কর দিয়ে মাটিতে নেমে আসে বার বার । উচ্ছিষ্ট খাদকেরা কাড়াকাড়ি করে ডাস্টবিনে । তবু নেই কোনো মানুষের হাঁক ডাক । চিরচেনা বাজারটির দুষিত ভাগাড় এখন একটা এপিটাফবিহীন ন্যাক্রপলিস । চতুর্দিকে শুধু দুর্ভিক্ষ হাহাকার, জননীর জনমভর আর্তনাদ । চারিদিকে শুধু ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, বাতাসে অনাহুত আহাজারি, পোড়া মাংসের কটু গন্ধ । দুর্বিষহ নারকীয় তাণ্ডবে বিপন্ন জন জীবন । নিস্তব্দ পরিবেশ; ‘অল কোয়াইট অন দ্যা ফরিদপুর স্পট’ ।
টুকুনদের এই রুটে আজ আক্রমণ আসতে পারে । স্থানীয় হর্তাকর্তা পাকিস্তানীদের পা চাটা কুত্তা নজিব মোল্লার সেক্রেটারি সুরুজ আলীকে জব্দ করে সিক্রেট বের করেছে সেক্টর কমান্ডার আজগর; গোপন সূত্রে খবরটা পেলেন টুকুনের চাচা । এই খবর শুনে অনেকে রাতারাতি মালামাল নিয়ে উধাও হতে শুরু করলো । টুকুনরা রয়ে গেলো শুধু ।
গভীর রাতে বুটের ভারি শব্দ আর ইঞ্জিনের একটানা ঘ্যানর ঘ্যানরে ঘুম ভাঙ্গে টুকুনের । কারো ঘরে একটা আলোও জ্বলছে না । সুনসান নীরবতা আর অন্ধকারের মাঝে ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে হঠাৎ । একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায় টুকুন; রফিক? ও রফিক বাইর হইয়া আসো । মেহমানরা আসছেন, ওদেরকে ঘরে নিয়ে বসাও । কই গেলা তোমরা সবাই, বাইর হইয়া আসো জলদী; খান সাহেবেরা আসছেন ।
উনি তো ঘরে নাই, মহিলা একটা কণ্ঠ শুনতে পেয়ে ধুক করে ওঠে টুকুনের বুক । চুপচাপ এগোতে গেলে পেছন থেকে কেউ একজন মুখ চেপে ধরে ফেলে ওকে । ওর চাচা, ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বলছে । একটু পর পেছনের জানালায় একটা ছায়াকাঠামো দেখা যায় । টুকুনের চাচা নিঃশব্দে আলমারিটা খুলে বুলেটসহ তিনটা সাব মেশিনগান বের করে আনেন । গলিয়ে দেন জানালা দিয়ে, আর ফিসফিসিয়ে বলেন সাবধানে থাকিস আজগর । টুকুনকে নিয়ে তিনি এবার অতি সাবধানে পা ফেলেন পেছনের সিঁড়িতে । ভাঙ্গা রেলিঙের ছাদে ম্যানিপ্লান্টসের মত নানান জায়গায় জড়িয়ে রয়েছে বিপজ্জনক বৈদ্যুতিক তার । ভাঙ্গা পাইপের পানি প্রায়শই গড়িয়ে যায় সার্কিটের গোড়ার দিকে । সাবধানে চিলেকোঠার বন্ধ দরজার তালা খুলেন তিনি । ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে ঠিকই খুলে যায় দ্বার দেদার । টুকুন কিছু বুঝতে পারার আগেই দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনতে পায় । বাইরে থেকে ওর চাচা বলে যান, খবরদার আমি না ফেরা পর্যন্ত টুঁ শব্দটিও করবি না । আমি তোর মা কে নিয়ে আসছি এক্ষুনি । তারপর তালা বন্ধ হবার একটা বিদঘুটে শব্দ শুনতে পায় টুকুন ।
বদ্ধ গুমোট ঘরটাতে ছোট ছোট ভেন্টিলেটরের ছিদ্র ছাড়া আর কোনো ফাঁক নেই । চারপাশে জমে থাকা বাতিল সব যন্ত্রপাতি, ফেলনা মোড়ক ইত্যাদি ছাড়াও দেয়ালের কোণ ছাড়িয়ে সিলিঙ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে মাকড়শার আঠালো জাল । ঘুটঘুটে অন্ধকার হাতড়ে একটা ছেঁড়া কুশন পেয়ে যায় টুকুন, তা ই বিছিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে ফ্লোরে । কখন তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ঘুম চলে এসেছে আর কখনই বা তা কেটে গেছে, বোধগম্য হচ্ছে না ওর । তবে এখন রাত গড়িয়ে সকাল তা বুঝতে পারছে । শব্দহীন জগতে নিঃশব্দে উঠে গিয়ে দরজায় কান পাতে টুকুন । কিন্তু কিছুই শুনতে পায়না । আশায় থাকে চাচা আসবে মাকে নিয়ে; মা ওকে পেয়ে জড়িয়ে ধরবে, চুমু খাবে কপালে । আদর করে বলবে আর ভয় নেই টুকুন সোনা, এইতো আমি এসে গেছি । ওরা চলে গেছে, আমাদের কিচ্ছু করতে পারেনি । প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা প্রহর টুকুনের কেটে যায় উদ্বিগ্নতায়, অজানা আশঙ্কায় কিংবা উত্তেজনায়, এই মনে হয় এলো । কিন্তু পরক্ষনেই সে অনুধাবন করে সবকিছু, মেনে নেয় চিলেকোঠার বন্দীত্ব । এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যায়, মাসও শেষ হয়, সময় এখানে নিষ্ক্রিয় । সময় পারেনি ওকে এগারো বছর বয়সে উন্নীত করতে কিংবা ওর জীবনের স্থিরচিত্র গুলোকে ক্রমান্বয়ে চলমান গতিশীল করে দিতে । টুকুন এখন যাবতীয় ক্ষুদা তৃষ্ণা, ঘুম ক্লান্তি, প্রাকৃতিক আবশ্যম্ভাবলী ইত্যাদি জৈবিক প্রয়োজনীয়তার ঊর্ধ্বে । এখানে থাকতে থাকতে গা সওয়ার হয়ে গেছে সব । ভেন্টিলেটরের আলো বাতাসই ওর অনুভূতি, বেঁচে থাকার একমাত্র উপাদান । এই একটুকরো ছিদ্র দিয়ে গলে আসা ফিকে আলোর সলতেতে প্রজ্বলন ঘটে ওর নিষ্প্রভ জীবনের । কখনো হলুদাভাব, কখনো তেজস্বী, কখনো বা নিস্তেজ আলোয় স্নান করে টুকুন । আলোকস্নান শেষে সে অনুসন্ধান করে বেড়ায় এর ফোটন গুলোয় । বুঝতে পারে এ আলো নিয়ে এসেছে কোনো রূপসী তরুণীর দৈহিক উষ্ণতা, মুমূর্ষু বাতাস বহন করছে ওরই সমবয়সী আরেকটি প্রাণের প্রশ্বাস । ও ধরতে পারে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত শব্দ চলাচল, বায়ুস্তরে কম্পিত ফ্রিকোয়েন্সি, টিউনিং করতে করতে একসময় পেয়ে যায় ফলাফল । বাড়িতে নতুন বাসিন্দা এসেছে ! তাদের ছয়মাসের ছোট্ট একটা বাবু আছে । বাবুকে তার মা আদর করে টুকুন সোনা বলে ডাকে ।
টুকুন তার হারানো জগত ফিরে পায় আবার । নিজের অস্তিত্বকে নতুন করে অনুভব করে । নিজেকে অন্যের ভেতর বিলীন করে দিয়ে হারানো শৈশবে পুনুরুদ্ধার করার ব্যর্থ প্রয়াস । তারপরও টুকুন আঁকড়ে থাকে ।

দশ বছর পর
মলিন পলেস্তরা খসা দেয়ালে আজ চুনকাম শুরু হয়ে যায়, ফাটলগুলো ঢাকা পড়ে যায় কংক্রিটে । রঙ বেরঙের বেলুন আর কাগজের ফুলে সুসজ্জিত চারপাশ । টুকুনের আজ ১১তম জন্মদিন । বাসার সবাই শশব্যস্ত মোমবাতি, কেক পেস্ট্রি আর রেপিং পেপারে মোড়ানো দ্রব্যাদি নিয়ে । উৎসব শেষে টুকুনের বাবা ওকে নিয়ে গ্যারেজের দিকে যান । সারপ্রাইজ! একটা নতুন ঝকঝকে মাউন্টেইন বাইক । টুকুন বিশ্বাস করতে পারছেনা যেন । খুশিতে ওর ইচ্ছা হয় তৎক্ষণাৎ সাইকেলটাতে চেপে বসতে । খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে সাইকেলের বডি, প্যাডেল, স্টিকার ইত্যাদি পরখ করে । উত্তেজনায় টুকুন ঠিকমত ডিনারও করে না । রাত্রে শুয়ে শুয়ে পরিকল্পনা করতে লাগলো কাল কখন কোন জায়গায় যাওয়া যায় । ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে ।
সকালে টুকুন সাইকেল নিয়ে বের হতে যাবে এমন সময় আকস্মিক হট্টগোল আর চেঁচামেচিতে থমকে দাঁড়ায় সে । দারোয়ান দৌড়ে এসে বলে, স্যার পুলিশ আসছে; ঢুকতে দেইনাই, আপনারে ডাকে । টুকুনের বাবা পরিস্থিতি সামাল দিতে ওদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেন তৎক্ষণাৎ ।
তদন্ত বিভাগের সাবইন্সপেক্টর বলেন, আমরা এখানে এসেছি একটি গোপন সূত্র ধরে । ইসলামী কট্টরপন্থী নেতা সাইদুর রহমান ও তাঁর সহযোগী সংশ্লিষ্টদের গ্রেপ্তার করার ওয়ারেন্ট আছে আমাদের কাছে । সাইদুর ইতোমধ্যে সারেন্ডার করে ফেলেছেন । আমরা এখানে এসেছি নজিবুল হকের খোঁজে । সাইদুর রহমানের সাথে তাঁর লিংক আছে বলে যতদূর মনে হয় এবং আমাদের কাছে সমস্ত ইনফরমেশনও আছে ।
তিনি আমার পিতা । আপনার যা কিছু বলার আমাকে বলতে পারেন ; টুকুনের বাবা বলেন ।
তাহলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশে যুদ্ধ অপরাধী সংশ্লিষ্ট আইন নতুন করে পাশ করেছে; নিশ্চয় জানেন? এবং যুদ্ধ অপরাধীদের তালিকায় আপনার পিতা নজিবুল হকের নামও আছে । তাই তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ।
টুকুনের বাবা যখন কিছুতেই তাদেরকে সার্চ করতে দিচ্ছিলনা । তখন খবর পেয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছুটে আসেন । তিনি দাবী করেন এ বাড়িটাও অবৈধ ভাবে দখল করা হয়েছে । এবং এর অরিজিনাল দলিল ডকুমেন্টও ওদের কাছে আছে । নজিবুল হোক ওরফে নজিব মোল্লার যুদ্ধপরাধের সাক্ষী, প্রমাণ ঘটনা সবই ওদের কাছে আছে । এখন শুধু ওনাকে কোর্টে চালান করে দেয়া হবে । আপনি ইচ্ছে করলে লইয়ার ঠিক করে মামলা লড়তে পারেন । মনে হয় না পারবেন, গভমেন্ট কেইস ।
সুতরাং নজিব মোল্লাকে সসম্মানে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুরো বাড়িটা ভালো করে সার্চ করা হয় । চিলেকোঠার মরচে ধরা পুরানো তালা ভেঙ্গে ফেলা হয় । গুমোট বদ্ধ ঘর থেকে অনেকদিনের জমে থাকা দুর্গন্ধ বের হয় । ভেতরে একটা পঁচা বীভৎস কংকাল খুঁজে পাওয়া যায় । সাইজ দেখে অনায়াসেই বলে দেয়া যায় দশ এগারো বছরের একটা শিশুর কংকাল এটা । চিলেকোঠার রহস্য উন্মোচিত হয় অবশেষে ।

পরিশিষ্ট
সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রায় কিছুই জানেনা টুকুন । ও সারাদিন ব্যস্ত থাকে সাইকেল চালনায় । স্কুল ছুটির পর মেইটদের সাথে প্রতিযোগিতা দেয় । ঝির ঝির বৃষ্টি আর সাইকেলের ছুটন্ত গতি, স্বর্গীয় এক অনুভূতি যেন! গভীর রাতে টুকুনের ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রায়ই । চারিদিক অন্ধকার, বদ্ধ একটা রুমে টুকুন একা, শুয়ে আছে মেঝেতে বিছানো একটা মাত্র কুশনে, একমাত্র ভেন্টিলেটরের ফাঁকা ছিদ্র দিয়ে একটুকরো আলো চুইয়ে আসছে সেই সাথে হালকা একটা সুবাস । টুকুন সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকে সেই আলোক উৎসের দিকে, হারিয়ে যেতে থাকে আলোকগর্ভে । তারপর সব শূন্যে উবে যায়, টুকুন নিজেকে আগের অবস্থানে ফিরে পায় আবার । সাময়িক এই ঘোরগ্রস্ততায় লেপ্টে থাকে অন্যভুবনের এক ব্যথাতুর চিত্র ।
অন্যরকম অনুভূতি !

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১২:০৯
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×