somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি…

১১ ই জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এবারের বাজেটটা কেমন হয়েছে জানেন, এককথায় বললে 'বাহ্ জেট'! এইযে একশ চৌত্রিশ পৃষ্ঠার বাজেট, এর কোথাও তো আমরা নাই। সংগত কারণেই এই বাজেট নিয়ে কথা বলার চেয়ে বরং একটা গল্প বলি। অবশ্য গল্প শোনার জন্য উইপোকার মতো চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তে হবে। চিৎ হয়ে শুতে হবে কেন? আরেহ এই লেখার শেষে সেটাও বলবো, তো গল্পটা বলি...

এক যে ছিলেন রাজা। তিনি যতটা না রাজ্য শাসন করতেন, তার থেকে অনেক বেশি পছন্দ করতেন সাজ ঘরে থাকতে। মস্ত শহরে দিন রাত চলে ফুর্তি আর তামাশা। রোজ লোক আসে দেশ-বিদেশ থেকে। একদিন আসলো দুই জোচ্চোর। নিজেদের পরিচয় দিলো তাঁতি বলে; মিহি সুতার কাপড় বোনে, আশ্চর্য রং- আশ্চর্য বুনোন। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হলোঃ কেউ যদি নিরেট বোকা আর নিজের পদের কাজের অযোগ্য হয় তবে তারা সে কাপড় চোখেই দেখতে পাবে না। রাজা তো বেজায় খুশি, এবারই প্রমাণ হবে তার রাজত্বে অযোগ্য কারা আর বিরেট বোকা আছেন কারা! কাপড় বোনানার কাজে রাজা আর দেরি না করে দিলেন আগাম টাকা। জোচ্চোর দু’জন খাটালো মস্ত দুটো তাঁত। সারা দিন তারা এমন ভাব দেখান যে কাজের মধ্যে ডুবে আছেন যে। তাতে সুতা না টাঙ্গিয়েই চেয়ে নিলেন সাত কাহন সোনা আর সাত বস্তা সবচেয়ে দামি রেশম, যেগুলো করা হল আত্মসাৎ। শূন্য তাঁতে সকাল থেকে রাত পর্যান্ত চলে কাজ করার ভান।

রাজা ভাবলেন দেখে আসি কাজ কতদূর এগুলো। কিন্ত ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো তার। তাই ভেবে চিন্তে পাঠালেন প্রবীণ মন্ত্রিকে কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য কেননা তার চেয়ে যোগ্য লোক ঐ রাজ্যে আরকে আছেন? মন্ত্রি গেলেন প্রকান্ড বাড়িতে যেখানে তাঁত বোনা হচ্ছে কিন্তু তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না। তবে মুখে সেটা স্বীকার করলেন না। দুই জোচ্চোর সবিনয়ে তাকে কাছে ডেকে দেখাতে লাগলেন কাপড়। ‘দেখুন রং গুলো কি ভাল নয়? বুনোন কি ঠিক হচ্ছে না?’ প্রবীণ মন্ত্রির চোখ কেবলি বড় হতে লাগলো এবং তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না, কেননা দেখবার মতো কিছুই ছিলো না তো ওখানে! মন্ত্রি তার চশমার ফাঁক দিয়ে মিটমিট করে তাকিয়ে বললেন ‘তোমাদের কাজ খুব ভালো হয়েছে। আমি ফিরে গিয়ে মহারাজকে একথাই বলবো যে, আমি দেখে খুব খুশি হয়েছি। চমৎকার রঙ, আর কী অদ্ভুত কারুকার্য!’ জোচ্চর গুলো ‘বেশ কথা, সে তো বেশ কথা’। তারপর তারা গম্ভীর মুখে রঙ গুলোর নাম বললো, বিচিত্র নকশাটা বুঝিয়ে দিলো ভালো করে। এরপর চেয়ে নিলো আরো আরো টাকা, সোনা আর রেশম। সব ঠলিতে ভরে রেখে দিলো, একটুকু সুতা উঠলো না তাঁতে। কিন্তু সেই তাঁতের সামনে বসেই তারা একটানা কাজ করে যেতে লাগলো।

এবার কাপড় দেখতে পাঠানো হলো একজন বিজ্ঞ পারিষদকে। মন্ত্রি যা দেখলেন তিনিও তা-ই দেখলেন। তাকাতে তাকাতে তার চোখ ব্যাথা হয়ে গেল, খালি তাঁত ছাড়া আর কিছুই তিনি দেখতে পেলেন না।‘সুন্দর হচ্ছে না জিনিসটা? কী বলেন?’ বলতে বলতে জোচ্চোররা নানা দিক থেকে তাকে কাল্পনিক কাপড়টা দেখালো, কাল্পনিক ছাঁদ বুঝিয়ে দিলো ভালো করে। পারিষদ ভাবলেন, ‘আমি কি নিরেট বোকা নাকি অযোগ্য, আমি কেন কাপড় দেখতে পাচ্ছি না?’ কিন্তু এ কথা তো কেউ কোনদিন বলেনি। যাই হোক এদের টের পেতে দিলে চলবে না। এই ভেবে তিনি সেই অদৃশ্য বস্ত্রের খুব প্রশংসা করলেন।

রাজার খেয়াল হলো তিনি নিজে দেখে আসবেন কাপড়টা। সাড়া পড়ে ফেল শহরে। একদল লোক বাছাই করা হলো, ডেকে পাঠালেন প্রবীণ মন্ত্রি আর বিচক্ষণ পারিষদকে। জোচ্চোর’রা তখন পুরোদমে বুনছে, প্রাণপনে বুনছে। তার না আছে টানা, না পোড়েন। ‘কী সুন্দর না?’ প্রবীণ মন্ত্রি এবং বিজ্ঞ পারিষদ প্রায় একসাথে বলে উঠলেন। মহারাজ নকশা একবার দেখুন! আর রঙের-ই বা কী বাহার’। উৎসাহের ঝোঁকে খালি তাঁতটাই তারা বার বার আঙুল দিয়ে দেখাতে লাগলেন। কেননা তারা তো জানেন অন্য সবাই দেখতে পাচ্ছে চমৎকার। রাজা মনে মনে চমকে উঠলেন, কী সর্বনাশ! তাহলে বোকা নাকি আমি? না কি রাজা হবার অযোগ্য? এরচেয়ে সর্বনাশ আর কী হতে পারে আমার’। তাই সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে ভারিক্কি চালে বলবেন, ‘খুবই সুন্দর হয়েছে’। সঙ্গে থাকা দলবলও কিছু দেখলেন না। তবু সমস্বরে তারা কাপড়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেন। রাজা খুশি হয়ে জোচ্চোরদের উপাধি দিলেন ‘তন্তুবায় চন্দ্রকলা’।

ঠিক হলো সামনের মাসে রাজপ্রাসাদ থেকে যে শোভাযাত্রা বেরুবে, তাতে মহারাজ যেন এই পোশাকটিই পরেন। কাল মিছিল বের হবে তাই সন্ধ্যা থেকে খেটেখুটে খুব কাজ করতে লাগলো। রাজা এলেন ঘোড়সাওয়ার নিয়ে, তাকে দেখানো হলো সেই পোশাক। ‘এই হলো ইজের, এইটি কুর্তা, আর এটা চাপকান। মাকড়সার জালের মতো হালকা, গায়ে দিলে মনে হবে না কিছু পরেছেন। কিন্তু সেই তো এই কাপড়ের কেরামতি!’ ‘ঠিক কথা’ বললো ঘোড়সাওয়ারের দল, যদিও তারা কিছুই দেখেনি যেহেতু দেখবার মতো কিছু তো ছিল-ই না। জোচ্চোররা বললো, ‘মহারাজ যদি বস্ত্র ত্যাগ করেন তবে আয়নার সামনে পোশাকটি পরিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি। আয়নার সামনে দাড়ালে রাজাকে পোশাক পরিয়ে দেয়ার ভান করা হলো। প্রশংসা করা হলো কাপড়ের রঙ এবং কারুকাজ নিয়ে। রাজাও আয়নার দিকে তাকালেন, তাঁর নতুন পোশাক বিশদ ভাবে অনেকক্ষন ধরে দেখছেন এমন ভাব করলেন। বান্দারা নিচু হয়ে মেঝেতে হাত রাখলো, তারপর হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়াল। যেন রাজার উড়ুনির লুটিয়ে পড়া আঁচল ধরে উঠে দাঁড়িয়েছে। পাছে কেউ লক্ষ করে তারা কিছু-ই দেখছেনা এই ভয়ে তারা অস্থির হয়ে।

এমনি করে রাজা বেরোলেন মিছিল করে, পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই পোশাকের প্রশংসা করতে লাগলো।‘তুলনা হয় না রাজার পোশাকের, কেমন মানিয়েছে দেখ’- একথা কেউ জানতে দিতে চায় না যে সে নিজে কিছু দেখছে না। তাহলেই তো প্রমান হয়ে যাবে সে হয় নিরেট মূর্খ অথবা অযোগ্য। এত বাহবা রাজার আর কোনো পোশাক কখনো পায়নি।

শেষ পর্যন্ত এক শিশু চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘ওমা রাজা দেখি কিছুই পরেননি’। কানাঘুষো ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। এবার আস্তে আস্তে সবাই বলতে শুরু করলো ‘আমাদের রাজা দেখি কিছুই পড়েননি’। ক্রমে রাজার কানেও গেল কথাটা। তাঁর মনে লাগলো কথাটা, কেননা তাঁর যেন মনে হলো কথাটা ঠিক। কিন্তু মনে মনে ভাবলেন ‘মিছিল করে বেরিয়েছি যখন, যেতেই হবে মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে’। আর বান্দারা আরো বেশি শক্ত করে মুঠি চেপে ধরলো; আঁচলই নেই, অথচ আঁচল ধরে ধরে নিয়ে চলল তারা।
(‘এক যে ছিলেন রাজা’ গল্প থেকে… হান্স ক্রিস্টিয়ান এন্ডারসেনেগল্প)

লক্ষ্য করুন এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮.২। একমাত্র গোঁজামিল ছাড়া এ অর্জন সম্ভব? তাই চলুন ঘষাকাঁচের মতো অস্পষ্ট চারপাশকে এড়িয়ে যেতে চোখে টিনের চশমা পরে নিই।

এবার চিৎ হয়ে শুয়ে গল্প শোনার কারণটা বলি, উইপোকারা ঘুমানোর সময় দুই-পা উপরের দিকে রাখে ঘুমায়; যাতে ঘুমের মধ্যে আকাশ যদি ভেঙ্গে পড়ে, সে যেনো পা দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে পারে। আমাদের মাথায় এখন আকাশই তো ভেঙে পড়তে বাকি আছে, নাকি?
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ ভোর ৫:১১
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×