‘এত তার আলো সে চলে গেলেও হয় না যে ঘর অন্ধকার,
এত তার প্রেম, সে যাবার পরেও ছড়িয়ে থাকে গন্ধ ভালোবাসার’
খুব কম ছেলেকে দেখলে আমার মনে হয়, বুক পকেটের নিচে তার একটি হৃদয় আছে। সুশান্ত সিং রাজপুতকে দেখলে আমার ঠিক এই কথাটাই প্রথম মনে হতো। ভীষণ হৃদয়বান মানুষ ছিলেন। ছিলেন! হ্যাঁ, তাঁর টুইটগুলো পড়ে আমার তাকে মানবিক, লোকহিতৈষী ব্যক্তিই মনে হতো। ধানমন্ডি ২৭ এর মীনাবাজারের উল্টোদিকে বাটার যে আউটলেট আছে ওখানে সুশান্তের খুব সুন্দর বিশাল একটা ছবি আছে। কর্মস্থলে আসতে - যেতে ছবির ছেলেটাকে আমি রোজ মনোযোগ দেখতাম। সে আর বেঁচে নেই, এই অনুভূতিটা খুব অদ্ভুত! বিষন্ন...
গত ৮৫ দিনের ঘরবন্দি জীবনে সবথেকে বেশিবার শুনেছি ‘শুদ্ধ দেশি রোমান্স’ মুভির তেরে মেরে বিচ মে ক্যায়া হে গানটা। গানের শেষ লাইনটা আমার খুব প্রিয়- তুঝে পাতা তো হে, ক্যায়া হে! অথচ আমাদের জানার মধ্যে কত ফাঁক থেকে যায়। ধোনি’র বায়োপিকে করা মুভিটিতে প্রথম নায়িকা কল করে যখন জানতে চায়, মিস করোগে মুঝে? ধোনি চরিত্রে সুশান্ত একমূহুর্তে প্রতিউত্তর দেন ‘না’। মেয়েটা দূর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পরে সুশান্ত এই ছোট্ট না টুকু বলার জন্য রিগ্রেট ফিল করেন। আর আজ আমরা সুশান্তের জন্য রিগ্রেট ফিল করছি। পিকে মুভিতে নায়িকার কাছে চেয়ে নেয়া চারকদম সময়টা এত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে কে কবে ভেবেছিল!
ভালোবেসে অভিনয়কে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়া সুশান্ত চলে গেলেন মাত্র ৩৪বছর বয়সে। তবে সেই যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। চলচ্চিত্র তাকে তারকা খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেলেও শারীরিক- মানসিক প্রশান্তির শীর্ষে নিতে পারেনি! বিপরীত প্রক্রিয়ায় দিন দিন ভেঙে যাচ্ছিলো ব্যক্তি সুশান্ত, যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন। রূপালি চরিত্রগুলো থেকে বেরিয়ে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছিলেন না। তাঁর টুইটগুলো বলে দেয়, নিজের ভাবনাগুলোর লাগাম ধরতে পারছিলেন না তিনি। কোনো অব্যক্ত কারণে তাঁর মন ছুটে চলছিলো দুর্বার গতিতে। মনের এই দুর্বার ছুটে চলার সঙ্গে গতি ধরে রাখতে গিয়েই কি হোঁচট খাচ্ছিলেন কোথাও কোথাও? তারকা সত্তার বিপরীতে সুশান্তের ব্যক্তিসত্তা। সত্তার টানাপড়েন নয়তো! হয়তো চেয়েছিলেন সাময়িক বিরতি, চেয়েছিলেন প্রশান্তিতে সব কিছু ভুলে থাকতে। ১৪জুন, ২০২০ অনন্তের পথে চলে গেলেন সুশান্ত। তবে তার স্টার সত্তা হয়তো স্টার সুশান্ত হয়েই আরো কিছুদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।
রূপালী জগৎ একজন তারকাকে প্রথমেই জানিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে, 'তুমি সাধারণের জন্য কিন্তু সাধারন থেকে আলাদা'। শুরু হয় তার বিচ্ছিন্নতার অভিযান। তারকারাও হয়ে যান ডানা থেকে খসে পড়া শাদা পালকের মতো। প্রকৃতি, ভালোবাসা, কাছের মানুষ অধিকন্তু সাধারণ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও বন্দি হয়ে যায় রঙিন বাক্সে। তারকার ব্যক্তিজীবনের আড়াল থাকে না। যে আড়াল প্রয়োজন একজন ব্যক্তি-মানুষের বেঁচে থাকার জন্য। কাছের মানুষ, পরিবার, বন্ধু-বান্ধবের সংগায়ন বদলে যায়। বিচ্ছিন্নতার ঘেরাটপে ডুবে যান একান্ত ব্যক্তিগত এক বলয়ে।
খ্যাতি একসময় সমাজ, পরিবার, ভালোবাসা, সময় সব কিছু কেড়ে নেয়। সাধারণের সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে পড়ে যান্ত্রিক। ইচ্ছে করলেই খোলা আকাশের নিচে সাধারণের মত ধীরে হাঁটতে পারেন না; লুকিয়ে রাখতে হয় নিজেকে। শরীর-মন থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তা গড়ে ওঠে। ফলে বিচ্ছিন্নতার একপর্যায়ে শ্রমিক যেমন তার নিজের কারখানায় আগুন দিতে দ্বিধাবোধ করে না, তেমনি তারকা ও যাপিত জীবনের দ্বন্দ্বে কূলকিনারা না পেয়ে হয়তো বিদায় জানান জগতকে, চলে যান চিরতরে। একটা সম্ভাবনাময় নক্ষত্র ঝরে গেলে বলেই তো তাকে নিয়ে এত কথা। অথচ কি আশ্চর্য দেখুন; আমি তাঁর কেউ নই, বাস্তবে দেখিনি পর্যন্ত কোনোদিন। তবু তাঁর জন্য আমি হৃৎপিন্ডে ব্যথা অনুভব করছি…
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০২১ রাত ১২:৩৫