ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে আবাসিক ছাত্রী ছিলাম। হলে উঠে প্রথম যে বিষয়টা নোটিশ করি, বেশির ভাগ মেয়ে ডাইনিং এর খাবার খেতে পারেন না, আর অধিকাংশ মেয়েই প্রেম নামক একটা সম্পর্কে আছেন। হলের মেয়েদের প্রেমগুলো জিওগ্রাফিক্যাল একধরনের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। তাদের প্রেম হয় ক্লাস ফেলো, ডিপার্মেন্টের সিনিয়র, কিংবা ঢাবি’র অন্য ডিসিপ্লিনের কেউ একজন। আমি মাশ-আল্লাহ যতদিন হলে ছিলাম কোনো ধরনের কড়াই-খুন্তি আমার ছিলো না। আমি বছরের পর বছর হলের ডাইনিং-এ খেয়েছি। আর দ্বিতীয়ত ভাবতাম, মেয়েরা রোজ কিভাবে হলের গেটে ৬টা- সাড়ে নয়টা পর্যন্ত বসে থাকে (প্রেমিকের সাথে)। ঠিক সাড়ে নয়টাই পিলপিল করে গেইট দিয়ে ঢোকে, শ’য়ে শ’য়ে মেয়ে!
রোকেয়া হলে আমি আবাসিক ছাত্রী থাকাকালীন ৪টা মেয়ে আত্মহত্যা করেন। ৪টা সুইসাইড-ই ছিলো প্রেমিক প্রতারনা করেছেন বলে জানি। একটা ঘটনা ছিলো এমন; প্রেমিক বাসা থেকে সম্বন্ধ করা মেয়েকে বিয়ে করেছেন। দ্বিতীয়টা স্বল্প পরিচয়ে প্রেম ডিজুস সিমকার্ডের সময়কালে তারপর ঝগড়াঝাটি-বিষণ্ণতা এবং আত্মহত্যা। তৃতীয়টা দুই ধর্মের দুইজন ছিলো, বাসায় জানানো যাবে না। চতুর্থটা ছেলেটা্র একাধিক প্রেম ছিলো এবং ঘটনাক্রমে একই রুমের দুইজনের সাথে প্রেম!
আজ ‘সুইসাইড প্রিভেনশন ডে’! বিশ্বব্যাপী পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীরা বেশি আত্মহত্যা করে বা চেষ্টা চালায়। এদেশে মেয়েদের আত্মহত্যা প্রবণতা বেশি সেটা নিয়ে অবশ্যই গবেষণা হতে পারে। প্রাথমিক ধারনা থেকে বলা যায় সম্ভবত আর্থ সামাজিক কারণে এটা হয়। এই বিশ্ব আত্মহত্যাকারীদের ব্যাপারগুলো বেশ গুরুত্ব দেয় সেটা সুনিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। পৃথিবীতে একবার মাত্র জন্ম নেয়ার দুর্লভ সুযোগকে নিজ হাতে যারা শেষ করে দিতে চায় তাদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আজ অবধি কম বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। পৃথিবীব্যাপী আত্মহত্যার বিভিন্ন 'কেস স্ট্যাডি' ঘেটে তিনটি বড় কারণ শনাক্ত করা গেছে:
ক) অসহনীয় শারীরিক পীড়া,
হ) সামাজিক অবমূল্যায়ন এবং
গ) হতাশা বা সন্দেহ।
আত্মহত্যা সম্পর্কে বেশ কিছু লোককথাও প্রচলিত শোনা যায়।
লোককথা : যেসব মানুষ আত্মহত্যার কথা বলে তারা আত্মহত্যা করে না।
বাস্তবতা : গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা আত্মহত্যা করে তাদের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষই আত্মহত্যা করার আগে এ সম্পর্কে সুপ্ত ইচ্ছা পোষণ করে।
লোককথা : বিকারগ্রস্তরাই কেবল আত্মহত্যা করে।
বাস্তবতা : বিকারগ্রস্ত বলতে আমরা তাদের বুঝি যারা নানা ধরনের মানসিক রোগে ভোগে বা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। যদিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যেকোনো জনসংখ্যার শতকরা ১ জন সিজোফ্রেনিয়া (এক ধরনের মানসিক রোগ) আক্রান্ত; কিন্তু অধিকাংশ আত্মহত্যাকারীই মানসিক রোগী নয়; বরং বিভিন্ন মনোসামাজিক প্রেক্ষাপট, যেমন_বাড়ির অশান্ত পরিবেশ, হঠাৎ কোনো ক্ষতি, সাম্প্রতিক ন্যক্কারজনক ঘটনা, প্রতিকূল পরিবেশ প্রভৃতি মানুষের আত্মহত্যার প্রবণতাকে প্রভাবিত করে।
লোককথা : আত্মহত্যা একধরনের অসুখ।
বাস্তবতা : আত্মহত্যা যে শারীরিক ব্যাধি, এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। আবার আত্মহত্যাকারী যে মানসিক রোগী এটাও পুরোপুরি সত্য নয়। আসলে বেশির ভাগ মানুষ আত্মহত্যার আগে বিষাদগ্রস্ত, অসুখী, দুঃখিত বা উত্তেজিত থাকে। তবে মানসিক রোগীদের যৌক্তিকতা ও উপযোগিতা বিচারে সমস্যা থাকায় তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
লোককথা : যারা আত্মহত্যা করে তারা আত্মহত্যার জন্য গায়েবি ডাক শুনতে পায়।
বাস্তবতা : এটা ধর্মীয় বিশ্বাস। তবে এমন হতে পারে যে এ ধরনের আত্মহতাকারীরা গায়েবি আওয়াজ বা প্রতিচ্ছবি কল্পনায় বাস্তবরূপে দেখতে পায়। অনেক মানসিক রোগীরই এ ধরনের রোগলক্ষণ থাকে এবং সময়মতো চিকিৎসা করালে এ থেকে আরোগ্য লাভ সম্ভব।
গ্রিক ও রোমান সভ্যতার যুগে মাটি, বাতাস, আগুন ও পানি—এই চারটি মহাজাগতিক উপাদানের সঙ্গে তুলনা করে চার ধরনের ব্যক্তিত্বের ধরন চিহ্নিত করা হতো। ধরনগুলো হচ্ছে বিষাদময়—সর্বংসহা (মাটির মতো), প্রত্যয়ী—আশাবাদী (বাতাসের মতো), ক্রুদ্ধ—মেজাজি (আগুনের মতো) এবং উদাসীন—প্রবহমান (পানির মতো)। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ‘টাইপ’ ও ‘ট্রেইট’ অনুযায়ী ব্যক্তিত্বকে নানাভাবে ভাগ করা হয়েছে এবং ব্যক্তিত্ব নির্ণয়েরও নানা পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে। জিনতত্ত্বের গবেষণায় আবিষ্কৃত হয়েছে ব্যক্তিত্ব নির্ধারণের নানা অজানা তত্ত্ব। বংশগতি, পরিবেশ এবং আরও নানা পারিপার্শ্বিক ঘটনা মানুষের ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে, ব্যক্তিত্বের প্রকাশকে প্রভাবিত করে। একজনের সঙ্গে আরেকজনের ব্যক্তিত্বের কিছু কিছু উপাদানের মিল থাকতে পারে, কিন্তু সব রকম মিল থাকে না। সহজভাবে বলা যায়, পৃথিবীতে সাড়ে ৬০০ কোটি মানুষের ব্যক্তিত্ব সাড়ে ছয় শ রকম।
গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা ‘পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার’ রয়েছে। আর কেবল মানসিক রোগীদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যার হার প্রায় ৫০ শতাংশ। যাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সমস্যা রয়েছে, তাদের মাদকাসক্তি, হত্যা, আত্মহত্যা, অতি উদ্বিগ্নতা, আবেগজনিত রোগ, নানা ধরনের অপরাধ ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
ব্যক্তিত্বের ধরন ও সমস্যাগুলোকে মোটাদাগে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
প্যারানয়েড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: এরা সাধারণত অহেতুক সন্দেহপ্রবণ, সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না, পরশ্রীকাতর, অনুভূতিপ্রবণ, প্রায়ই বিরক্ত-অসন্তুষ্ট থাকে। এরা নিজেকে সব সময় অন্যদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে থাকে।
সিজয়েড পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: এদের আবেগ থাকে কম, একা থাকতে পছন্দ করে, আনন্দের অনুভূতি কম থাকে, তবে এদের অন্তর্দৃষ্টি অন্যদের চেয়ে বেশি থাকে।
সিজোটাইপাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: এ ধরনের ব্যক্তিত্বের মানুষ সামাজিকতা এড়িয়ে চলে, সামাজিক উদ্বিগ্নতায় ভোগে। অনেক সময় তারা মনে করে, তারা অন্যদের মনের কথা বুঝতে পারে। মাঝেমধ্যে তারা মনে করে, অন্যরা সব সময় তাকে নিয়ে সমালোচনা করছে। তাদের কথোপকথনে অসামঞ্জস্যতা থাকতে পারে এবং তারা বেশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
অ্যান্টিসোশ্যাল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: এদের আচরণ হয় নির্মম। অন্যের প্রতি এদের কোনো অনুভূতি থাকে না। এরা দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়, হঠাত্ করে রেগে যায়, মেজাজ হয় খিটখিটে। অপরাধ করলেও এদের মধ্যে কোনো অপরাধবোধ বা অনুতাপ থাকে না এবং তারা পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে। ছোট থেকে বড় নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়ে যেতে পারে।
বর্ডারলাইন পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: এরা অস্তিত্বের সংকটে ভোগে, কারও সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে না। এদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ কেমন হবে, তা আগে থেকে ধারণা করা যায় না। এরা হঠকারী আচরণ করে, নিজের ক্ষতি নিজে করে ফেলতে পারে এবং হাত-পা ধারালো অস্ত্র বা ব্লেড দিয়ে কাটে, দেয়ালে মাথা ঠুকে ইত্যাদি।
হিস্ট্রিয়োনিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: এরা নাটুকেপনা করতে পছন্দ করে, অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা এদের আছে। তবে এ ধরনের মানুষের অনুভূতিগুলো খুব একটা গভীর নয়। শারীরিক সৌন্দর্যকে এরা বেশি গুরুত্ব দেয়। অন্যের মনোযোগ পেতে এরা ভালোবাসে।
নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, গ্রিক দেবী নার্সিসিসের মতো এরা নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। নিজেকে এরা অনেক বড় মনে করে এবং অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবে। নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে এরা অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করে। এরা অন্যের প্রশংসা চায়। কিছুটা স্বার্থপর ও হিংসুটে স্বভাবের হয়ে থাকে। অন্যের মতামতের মূল্য এদের কাছে কম।
এভয়ডেন্ট পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: এরা সব সময় টেনশনে ভোগে। সমাজের অন্যদের চেয়ে এরা নিজেকে ছোট মনে করে। হীনম্মন্যতা থাকে এদের মধ্যে। সব সময় ভাবে, অন্যরা তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। সামাজিক কর্মকাণ্ডে এরা সাধারণত নিজেকে যুক্ত করে না এবং ঝুঁকি নিতে ভয় পায়।
ডিপেনডেন্ট পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: এ ধরনের ব্যক্তিত্বের সমস্যায় আক্রান্তরা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে। নিজে নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, এমনকি নিজের চাহিদা বা প্রয়োজনের কথাও প্রকাশ করতে পারে না। নিজের ঘাড়ে কোনো দায়িত্ব এসে পড়তে পারে, এটা নিয়ে এরা সন্ত্রস্ত থাকে।
অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার: নিয়মনীতি কঠোরভাবে মেনে চলতে চায় এ ধরনের ব্যক্তিত্বের সমস্যায় আক্রান্তরা। সবকিছুর মধ্যে পারফেকশন খুঁজে বেড়ায় এরা এবং স্বভাবটা হয়ে যায় খুঁতখুঁতে। এরা অপেক্ষাকৃত দৃঢ়চেতা হয়, বেশি কাজ করতে পছন্দ করে। সতর্ক থাকা অন্যকে সন্দেহ করা এদের আরেক বৈশিষ্ট্য। সে চায় অন্যরা তার মত অনুযায়ী চলুক।
মনের স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগী হউন। নিজের এবং প্রিয়জনদের!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ৯:২৯