'এই বিভাগের একজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মার্ডার কেসের চার্জ আছে। অভিযুক্তের বিষয়ে কয়েকটা বিষয় জানার ছিলো। আপনার কী একটু সময় হবে ম্যাডাম...' বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি তখন আমি সহকারী প্রক্টরের দ্বায়িত্বে ছিলাম। ২০১৫ সালের ঘটনা। এটেন্ডেন্ট হানিফ এসে একটা বিজনেস কার্ড দিলো, এএসএই তারেক। আপনার সাথে দেখা করতে চায়। বেলা সাড়ে তিনটা ঘড়িতে। বললাম পাঠিয়ে দিন হানিফ। ফ্যাকাল্টি রুমে ঢুকে তারেক সাহেব লম্বা সালাম দিলেন। দুই একটা সৌজন্য আলাপের পর বিনা মেঘে বজ্রপাত। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুমন মালাকার সম্পর্কে তথ্য জানতে এসেছেন তারেক। তদন্তের সার্থে। সুমন মালাকার দিনেদুপুরে হত্যাকান্ডের সাথে যুক্ত। ঘন্টাখানেক নানান আলাপ। ১০দিন বাদে সুমন নিজে এসে হাজির। খুব স্বাভাবিক আচরণ। ফ্যাকাল্টি রুমে এসে মামা বাড়ির আবদার পেশ করলো। রেজিস্ট্রার খাতায় যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রেজেন্স রেকর্ড রাখা হয় সেখানে তাকে উপস্থিত দেখাতে হয়ে উদ্দিষ্ট ঘটনার তারিখে। কেন? কারণ হিসেবে সুমনের ব্যাখ্যা, একটা ছোট্ট মামলায় তাকে উদ্দেশ্য প্রনোদিত ভাবে আসামি করা হয়েছে। কোর্টে তাকে জামিনের জন্য এই প্রমাণ পত্র হাজির করতে এ্যাডভোকেট সাহেব পরামর্শ দিয়েছেন। তো সেই 'ছোট্ট মামলা'টা কী? সুমন হাসতে হাসতে জবাব দিলো, ম্যাডাম একটা মার্ডার কেস। কোনো একটা অদ্ভুত কারণে যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি শান্ত থাকতে পারি। খুব স্বাভাবিকভাবেই জানতে চাইলাম কাকে মার্ডার করা হয়েছে (এজ এফ ঘটনাটা আমি প্রথমবার শুনছি। সুমনের বয়ান, 'এক বন্ধু এসে বললো বাইকে ওঠ। সুমন উঠে বসলো। তারপর তারা কিছুদূর গিয়ে একটা জায়গায় দাড়িয়ে ছিল কারণ সেখানে তার বন্ধুর কাজ ছিল। পরে সে দেখলো এক মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোকের পথ আগলে দাড়ালো বন্ধু। পূর্বঘটনার জের ধরে কথোপকথনের এক পর্যায়ে বয়স্ক লোকটিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পূর্বঘটনাটি হলো ভদ্রলোকের মেয়েকে স্কুলে যাওয়া আসার পথে উত্যক্ত করতো বন্ধু ছেলেটি। মেয়েটি তার বাবাকে বিষয়টা জানানোর পর ভদ্রলোক ওদেরকে নিষেধ বারন করেছিলেন। ভদ্রলোক পেশায় স্কুল শিক্ষক ছিল। শেষ তথ্যটা আমাকে নির্বাক করে দিয়েছিল। তারপর থেকে ছাত্রটি ড্রপআউট। আমি বহু বহু দিন চেষ্টা করে সুমন মালাকারের চেহারাটা ভুলে যেতে, তার হাসিমুখে বর্ননা করা পুরো ঘটনাটা অসুস্থ নির্ভেজাল বর্তমান, যা আমরা স্বেচ্ছায় ভুলে থাকি কিংবা নিজের পাশে গড়ে তোলা কৃত্রিম নিরাপদ বেষ্টনীর ভেতর নিজেদের লুকিয়ে রাখি।
পারভেজ, আমার ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পপুলেশন সায়েন্স বিভাগে মাস্টার্স করছে। ডিপার্মেন্টটা কলা ভবনের চার তলায়, সেখানেই ওদের ক্লাস হয়। সম্ভবত ক্লাস শেষ করে ভবনের মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে সহপাঠীদের সাথে আলাপ করছিলো। রাত নয়টার মতো বাজে। আমি এবং ছোট ভাই কথা বলতে বলতে কলা ভবনের সামনের রাস্তা দিয়ে নীলক্ষেতের দিকে হাঁটছিলাম। আমাকে দেখে পারভেজ এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে কুশলাদী জানতে চাইলো। আমিও তার বর্তমান কেমন যাচ্ছে, ক্যারিয়ার নিয়ে কী ভাবছে জানতে চাই। সাথে থাকা ছোট ভাই পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। মিনিট সাতেকের মতো কথা হয় আমাদের। এবং লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে, পারভেজ একবারও তার দিকে তাকায়নি।মানুষ যে সময়ে দাঁড়িয়ে অন্যকে প্রাইভেসি দিতে ভুলে গেছে ঠিক সেই সময়ে পারভেজের এই আচরণ আমাকে মুগ্ধ করে। অনেকেই শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য সালাম দিলেও পরিচিত কেউ কেউ তো সালাম দেয় নিজের উপস্থিতি জানান দেয়ার জন্য আর কেউ কেউ বিব্রত করার জন্য। জল্পনা-কল্পনার এই স্বর্ণ-যুগে কেউ একজন অহেতুক কৌতুহলী নয় দেখে ভাল লাগে। সম্মানিত বোধ করি। ছোট ভাইকে গর্ব করে বলি ‘ওর নাম পারভেজ। আমার ছাত্র’।
সৈয়দ মুজতবা আলী দর্শন পড়তে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে অধ্যাপক শ্মিট তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, বক্তৃতা বুঝতে সমস্যা হয় কিনা (যেহেতু জার্মান ভাষায় বলা হয়) মুজতবা বললেন, জার্মান ভাষা কম জানার কারণে মাঝে মধ্যে সামান্য অসুবিধা হয়। অধ্যাপক বললেন, তখন হাত তুলো; আমি সব ভালো করে বুঝিয়ে বলবো। মুজতবা বললেন, আমার জার্মান জ্ঞানের অভাববশত সমস্ত ক্লাস সাফার করবে… এটা কেমন যেন…। গুরু গুরুগম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলেন, আমি একশ’জনকে পড়াবো, না একজনকে পড়াব, কাকে পড়াব কাকে পড়াব না, সেটা স্থির করি একমাত্র আমি। ( দর্শনাতীত)
অধ্যাপক দেন তথ্য
জ্ঞানী দেন ব্যাখ্যা
গুরু দেন অন্তর্দৃষ্টি
'মহাকাশে নক্ষত্রের সংখ্যা যত এই পৃথিবীতে নকল গুরু এবং মিথ্যা শিক্ষকের সংখ্যা তার চাইতেও বেশি। ক্ষমতালোভী আত্মকেন্দ্রিক লোকদের সাথে সত্যিকারের শিক্ষকদের গুলিয়ে ফেলোনা। একজন সঠিক আধ্যাত্মিক গুরু কখনোই তোমার মনোযোগকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করবেন না এবং তোমার কাছ থেকে সর্বোচ্চ আনুগত্য বা প্রশংসাও চাইবেন না। তার বদলে তোমাকে সাহায্য করবেন তোমার আত্মাকে চিনতে এবং বুঝতে। সত্যিকারের শিক্ষা গ্রহণ কাঁচের মত স্বচ্ছ আর তার মাঝ দিয়ে কোন বাধা ছাড়াই স্রষ্টার আলো প্রবাহিত হতে পারে।'
মনে পড়ছে আমার কলেজের যুক্তিবিদ্যার শিক্ষক মনিরুজ্জামান স্যারের কথা। স্যার একবার বলেছিলেন, জীবনে লেখাপড়া হল ১। আর বাকি সব গুন-দক্ষতা ০। যার এক ঠিক থাকে তার অন্য গুনগুলো আলো ছড়ায়। এক (১) ছাড়া শূন্যের (০) কোনো মূল্যমান নাই। আমার ইংরেজির শিক্ষক আব্দুল হামিদ স্যার বলেছিলেন, মানুষ সব হতে চায়, শুধু ভালো মানুষ হতে চায় না। আমার স্কুলের শিক্ষিকা মেহের নিগার ম্যাডাম সবসময় বলতেন, সব বয়সের সৌন্দর্য্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহাদুজ্জামান স্যার একজন লিভিং লিজেন্ড। আমি বড় হয়ে আপনি হতে চাই স্যার।
প্রথমসন্তানের প্রতি মায়েদের মমত্ববোধ বেশি থাকে। প্রথম মা হওয়ার উদ্বিগ্নতা সাথে নানাজনের দেয়া আদেশ-নিষেধ আর পরামর্শের তীব্র খরস্রোত। সবমিলিয়ে টালমাটাল অবস্থা। ধীরে ধীরে পরিনত হতে হতে মা তার অপরিনত ত্রুটিগুলো বুঝতে পারে। অথচ টাইমমেশিনে ফিরে গিয়ে শুধরানোর সুযোগ থাকে না। শিক্ষকরা বায়োলজিক্যাল পারেন্ট না হলেও, শিক্ষার্থীদের মনের, চিন্তার, স্বপ্নের, লক্ষ্যপূরণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে থাকেন। শিক্ষকতার শুরুর দিকে একটা কথা আমি প্রায়শই বলতাম, আপনারা আমার কাছে প্রথম সন্তানের মতো। আমার আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নাই, তবে অভিজ্ঞতা আর পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবে আমার সেরাটা আমি আপনাদের দিতে পারছি না। এই দুঃখবোধটা সারাজীবন স্মরণে রাখবো। নানা মত-পথ পাড়ি দিতে হয়। সব কিছুর উর্ধ্বে ধৈর্য-প্রজ্ঞা-একাগ্রতা সমুন্নত থাকুক শিক্ষক হিসেবে নিজের জন্য এটুকুই আমার চাওয়া।সকল শিক্ষার্থীদের সাথে চিরদিনের এই বন্ধন সুন্দর থাকুক।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১:২৬