somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামানের ৫১তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২০ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান। যিনি শহীদ আসাদ নামে সমাধিক পরিচিত। কোন কোন মৃত্যু ইতিহাস হয়ে যায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে জনস্রোতের উদ্বেল জোয়ার আনে। আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদের মৃত্যু তেমনি এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল ৬৯’-এর গণ-অভ্যুত্থানে। আসাদ এবং ৬৯’-এর গণ-অভ্যুত্থান এক অখন্ড সত্বা। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের আইয়ুবশাহীর পতনের দাবীতে গণ-আন্দোলনে পথিকৃৎ পুলিশের গুলিতে নিহত তিন শহীদদের একজন শহীদ আসাদ; অন্য দু'জন হচ্ছেন শহীদ রুস্তম ও শহীদ মতিউর। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি, দুপুরে ছাত্রদেরকে নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পার্শ্বে চাঁন খাঁ'র পুল এলাকায় মিছিল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন আসাদুজ্জামান। পুলিশ তাদেরকে চাঁন খাঁ'র ব্রীজে বাঁধা দেয় ও চলে যেতে বলে। কিন্তু বিক্ষোভকারী ছাত্ররা সেখানে প্রায় এক ঘন্টা অবস্থান নেয় এবং আসাদ ও তার সহযোগীরা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। ঐ অবস্থায় খুব কাছ থেকে আসাদকে লক্ষ্য করে এক পুলিশ অফিসার গুলিবর্ষণ করে। তৎক্ষণাৎ গুরুতর আহত অবস্থায় আসাদকে হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। আজ শহীদ আসাদের ৫১তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।


১৯৪২ সালের ১০ই জুন, নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার ধানুয়া গ্রামের হাতিরাদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন আমানুল্লাহ আসাদ। তার পুরো নাম আমানউল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। বাবা আলহাজ মাঃ মোহাম্মদ আবু তাহের বি এ বি টি এবং মাতা মতি জাহান খাদিজা খাতুন। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আসাদ ছিলেন চতুর্থ। আসাদের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালা ও প্রাইমারী। শৈশবকাল থেকে আসাদ পড়াশুনায় মনোযোগী ছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি খেলাধুলা, কবিতা আবৃতি, মাছধরা ও বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়া বেশ পছন্দ করতেন। প্রাইমারী পড়াশুনা শেষে ১৯৫৪ সালে তাঁর বাবা মাঃ মোহাম্মদ আবু তাহের তাঁকে শিবপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। শিবপুর হাইস্কুল থেকে ১৯৬১ সালে তিনি মেট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। মেট্রিক পাশের স্বীকৃতি অর্জন করার পর ওই বছর তিনি সিলেটের এম সি কলেজে আই এ ভর্তি হন। কলেজ জীবনে তিনি পড়াশুনার পাশাপাশি কলেজের যাবতীয় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হতে থাকেন। এ সময় তিনি তৎকালীন ঐতিহ্যবাহী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হন। এই কলেজে পড়াশুনাকালীন সময়ে তিনি ১৯৬২ সালের মহান শিক্ষা আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে তিনি ওই কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন।


আই এ পাশ করে ওই বছর আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সাথে যুক্ত হয়ে সার্বক্ষণিকভাবে রাজনীতি শুরু করেন। তূখোড় মেধাবী এই তরুণ সমাজ বদলের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি ন্যাপে কাজ শুরু করেন। এ সময় পড়াশুনা, ছাত্র আন্দোলন আর মেহনতি মানুষের মুক্তির রাজনীতি ছাড়া তাঁর কাছে অন্য কোনো কিছুর মূল্য ছিলো না। অল্পদিনের মধ্যে সাংগঠনিক দক্ষতা ও কাজের আন্তরিকতার কারণে তিনি রাজনৈতিক মহলে বেশ পরিচিতি অর্জন করেন। যার ফলে তিনি পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন ঢাকা হল শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিভাগে এম এ ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৭ সালে এম এ ডিগ্রী অর্জন করার পর তিনি ওই বছর সিটি ল’কলেজে আইনে ভর্তি হন। এম এ পাশ করার কিছু দিন পর তিনি মাওলানা ভাসানীর নির্দেশে মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করার জন্য নিজ গ্রামে চলে যান। নিজের ভবষ্যতের কথা, পরিবারে কথা না ভেবে কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুর-শ্রমজীবী-পেশাজীবীর শোষণমুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এক বছরের মধ্যে শিবপুর, মনহরদী, রায়পুরা, নরসিংদীতে শক্তিশালী কৃষক সমতি গড়ে তোলেন।


১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি ন্যাপের নির্দেশে ঢাকায় চলে আসেন। এসময় আরো ভালো ফলাফলের জন্যে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে এম.এ বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জনের জন্য চেষ্টা করছিলেন। পড়া লেখার পাশা পাশি এখানে তিনি স্বৈরাচারী আইয়ুব শাসন বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে ছাত্র-যুব-শ্রমজীবীকে সংগঠিত করেন।শহীদ আসাদ তৎকালীন ঢাকা হল (বতর্মান শহীদুল্লাহ হল) শাখার পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে এবং পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপসু-মেনন গ্রুপ), ঢাকা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিবেদিত প্রাণ আসাদুজ্জামান গরীব ও অসহায় ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার বিষয়ে সর্বদাই সজাগ ছিলেন। তিনি শিবপুর নৈশ বিদ্যালয় নামে একটি নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং শিবপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদেরকে সাথে নিয়ে আর্থিক তহবিল গড়ে তোলেন। স্বৈরাচারী আইয়ুব শাসন বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের সচেতন করে তুলতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানী পূর্ববাংলায় হরতাল ঘোষণা করেন। এই হরতাল সফল করার জন্য আসাদ শিবপুর, মনহরদী, রায়পুরা, নরসিংদীতে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক-ক্ষেতমজুর-শ্রমজীবীকে নিয়ে সফলভাবে হরতাল পালন করেন। ওই এলাকায় হরতাল পালনের সময় কৃষকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। এতে ওই এলাকার ৩ জন কৃষক নিহত হয়। আহত হন আসাদ। আহত আবস্থায় আসাদ ঢাকা এসে পত্রিকা অফিসে উক্ত ঘটনার বিবরণ দেন, যা পরের দিন পত্রিকায় ছাপা হয়।


এরপর তিনি ১৯৬৯ সালের সেই সংগ্রামময় উত্তাল দিনগুলিতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় স্বৈরাচারী আইয়ুব শাসন বিরোধী জনমত গড়ে তুলতে থাকেন। জানুয়ারী মাসের প্রতিটি দিনই কেটেছে তাঁর লড়াই-সংগ্রাম আর আন্দোলনে। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচারী আইয়ুব শাসন বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে আসদ শহীদ হন। মৃত্যুকালীন সময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এম.এ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। হাজারো ছাত্র-জনতা আসাদের মৃত্যুতে একত্রিত হয়ে পুণরায় মিছিল বের করে এবং শহীদ মিনারের পাদদেশে জমায়েত হয়। কেন্দ্রীয় প্রতিরোধ কমিটি তাকে শ্রদ্ধা জানাতে ২২, ২৩ ও ২৪ জানুয়ারি সারাদেশে ধর্মঘট আহ্বান করে। ধর্মঘটের শেষ দিনে পুলিশ পুণরায় গুলিবর্ষণ করে। ফলশ্রুতিস্বরূপ আসাদের মৃত্যুতে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান সরকার দু'মাসের জন্য ১৪৪-ধারা আইনপ্রয়োগ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। গণঅভ্যুত্থানের মহান জাগরণ এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র তৈরি করে এবং ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।


'৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পথিকৃৎ মহান শহীদ আসাদুজ্জামানের ৫১তম শাহাদাৎবার্ষিকী আজ। আইয়ুবী সামরিক স্বৈরশাসনের কবল থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে অকুতোভয় এ বীর সেনানীর শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

নূর মোহাম্মদ নূরু
গণমাধ্যমকর্মী
নিউজ চ্যানেল
ফেসবুক লিংক
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:৩৭
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×