“ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়,
পূর্নিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”
মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রথমেই আছে খাদ্য । কারন বেচে থাকার জন্য খাদ্য প্রয়োজন । আবার দেখা যায় খাদ্য নিয়েই অনেক সমস্যা । কেউ বেচে থাকার জন্য খায় আবার কেউ নিজের উদরপূর্তি করার জন্য খায় । আবার অনেকেই আছে খেতে ভালোবাসে । ভোজন রসিক লোকজন খাবারের নাম শুনলেই তাদের পেটের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয় । তবে সবার জন্য খাবার আবার মজার নয় । কারো কার জন্য প্রয়োজনেরও বেশি । ক্ষুধার কষ্ট তারাই বোঝে । তবে খাদ্য নিয়ে পুরো একটা স্যাটায়ার লিখে ফেলা কিন্তু কম কষ্ট নয় । তবে সেটাই করে দেখিয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ তার “ফুড কনফারেন্স” বইটিতে ।
“ফুড কনফারেন্স” বইটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বাংলায় যে খাদ্য সমস্যা ও তার সমাধানে নেতাদের যে গলদঘর্ম অবস্থা তার উপর ভিত্তি করেই লেখা । তার চেয়ে বড় কথা উনি কাউকেই এই লেখায় ছাড় দেননি । বলা যায় বইটিতে উনি সুন্দর ভাবে নেতাদের কর্মযজ্ঞ তুলে ধরেছেন হাস্যরসের মাধ্যমে । তাদের নিচু মানসিকতা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার সব মিলিয়ে তিনি বইটিতে খুব রসিক ভাবে উপস্থাপন করেছেন ।
মোট নয়টি গল্প আছে বইয়ে, যথাক্রমে ফুড কনফারেন্স, সায়েন্টিফিক বিযিনেস, এ.আই.সি.সি, লঙ্গরখানা, রিলিফ ওয়ার্ক, গ্রো মোর ফুড, মিছিল, জমিদারি উচ্ছেদ এবং জনসেবা য়ুনিভার্সিটি। প্রতিটি গল্প যেই তখনকার বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছে । আবুল কালাম শামসুদ্দিন এর মতে, তিনি বইতে বাংলার হিন্দু ও মুসলমানের সাধারন চারিত্রিক দিক গুলো তুলে ধরেছেন । এমনকি তিনি তাদের সরলতার কথা ভুলে যাননি । যেমন “রিলিফ ওয়ার্ক” এর হামিদ তেমন ই একটা চরিত্র ।
“ফুড কনফারেন্স” গল্পে দুর্ভিক্ষ সামলাতে ব্যর্থ নেতাদের শেরে-বাংলা, মহিষে-বাংলা, কুত্তায়ে বাংলা, বিল্লিয়ে বাংলা, চুঁহায়ে বাংলা, বেজিয়ে বাংলা, শিয়ালে বাংলা থেকে শুরু করে পোকায়ে, মাকড়ে, চিঁউটিয়ে বাংলা ইত্যাদি নানা নাম দিয়ে প্রাণির চরিত্রের সাথে বাঙালি নেতাদের তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছেন । চরিত্রগুলোর মুখে নানা সংলাপের মাধ্যমে তিনি তখনকার বাস্তব অবস্থা হাস্যরসে পরিনত করেছেন । খাদ্য সংকট কেন দেখা দিল সে নিয়ে পাঁচটি সূত্র দিয়ে সব দোষ চাষীদের উপর চাপিয়ে দেন নেতারা । সেটাও যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন “ফুড কনফারেন্স” এর একদম শেষে এসে বলেছেন সব “জানোয়ারে-বাংলা” রাই বেঁচে থাকে, “মানুষে বাংলা”রা সব মরে যায় ।
“সায়েন্টিফিক বিজিনেস” নামক গল্পে চাপরাশিগিরি আর কেরানীগিরি করে অভ্যস্ত বাঙ্গালি জাতিকে ব্যবসা, তেজারতি ইত্যাদি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় । আবুল মনসুর আহমদের কল্পনায় বাঙ্গালি তেজারতি শিখলে কি পরিমাণ অনর্থ করতে পারে তার বিস্তারিতন বর্ননা দিয়েছেন এই গল্পে । বাঙ্গালি সবকিছুতেই তেজারতি করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে যায় । এরপর রোগে ভুগে দুনিয়া থেকে সাফ হয়ে পরকালেও তেজারতি করে দুই নাম্বারি আরম্ভ করে । মানে ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে । এই গল্পটি আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের জন্য আর্দশ হতে পারে ।
“এ আই সি সি” এর পূর্ণরূপ “অল ইন্ডিয়া কন্ডোলেন্স কমিটি” । গল্পটি হচ্ছে সমিতি নিয়ে । এই গল্পের চরিত্র হচ্ছে শহীদ । সে একটা সমিতি খুলবেই । কিন্তু কোন ভাবেই খুলতে না পেরে একটা শোক সমিতি খুলে ফেলে । বিভিন্ন নেতাদের শোক বার্তা জানায় সভা হয় । কিন্তু বাদ স্বাদে নতুন নেতারা তারা মরতেই চায় না । পুরো গল্প জুড়েই হাস্যরস দিয়ে লিখেছেন । উঠে এসেছে দেশপ্রেম ও মানুষের চিন্তা ভাবনা ।
“লঙ্গরখানা” গল্পটি বাংলা স্যাটায়ার হিসেবে ক্লাসিকের পর্যায়ে চলে গিয়েছে । দুই বন্ধু আকবর ও শমশের কিভাবে অধ্যাপনা ও উকিলগিরি ছেড়ে ধান্ধাবাজী করতে করতে নেতার পারমিশন বাগিয়ে লঙ্গরখানার কারবার খুলে বসে তাই নিয়ে এই স্যাটায়ার । যেখানে মজুদদার, সেবক এবং মৃত মানুষ বেড়েই চলে । অপর দিকে, লঙ্গরখানার পেছনের দরজা দিয়ে চাল, ডাল, তেল, নুন এসব পাচার হয় । অভুক্তরা খাওয়ার অভাবে ধুকে ধুকে মারা যায় । তাতে কি, দিকে দিকে লঙ্গরখানা বাড়তেই থাকে ।
“রিলিফ ওয়ার্ক” গল্পটি বর্তমান সময়ে এসেও প্রযোজ্য হবে । এই গল্পের চরিত্র হামিদ । যে দেশ আর দেশের মানুষের কথা ভাবে । যার কাছে দেশ সেবা এক পরম ধর্ম । কিন্তু বন্যায় ভেসে যাওয়া লোকজনের জন্য দেয়া রিলিফ তারা পাচ্ছে না । বরং সেগুলো গিলে নিচ্ছে গ্রামের সম্ভ্রান্ত মাথারা । অনেকটাই বলা যায়, বন্যার্তরা পাচ্ছে এক অংশের ও কম বাকি সব যাচ্ছে রিলিফ দিতে আসা কর্মী ও গ্রামের বড় কর্তাদের বাসায় । এই সব কিছুই তিনি তুলে ধরেছেন হামিদের মাধ্যমে ।
“গ্রো মোর ফুড” তখনকার কৃষিব্যবস্থার অব্যবস্থাপনাকে ইঙ্গিত করে । এই গল্পটি আমার কাছে বেশি ভাল লেগেছে । বাস্তবিক অর্থে কিভাবে কৃষকদের বঞ্চিত করা হয় সেটাই বর্ননা করা হয়েছে । তাছাড়া এখানে গাজা উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে, যেখান একটা যুক্তি এমন যে “গাজা মানুষের বুদ্ধিবৃদ্ধিতে সহায়তা করে” । এভাবেই গল্প এগিয়েছে ।
“মিছিল” সাম্প্রতিক রাজনীতির পটপরিবর্তন নিয়ে লেখা হয়েছে । এখানে একদল মানুষ মিছিল নিয়ে বের হবার পর সেট কিভাবে আদলত ও কোর্ট রুমের হাস্যরসে পরিনত হয় সেটা তুলে ধরা হয়েছে । আবার আইনের ফাক কিভাবে ব্যবহার করতে হয় সেটা দেখানো হয়েছে ।
“জমিদারি উচ্ছেদ” এই বইয়ের অন্যতম সার্থক একটা গল্প । এই গল্পে সাধারণ একজন ব্যক্তি(মুনশীজি) জমিদারি উচ্ছেদের অঙ্গীকার করে নির্বাচন করেন । লোকজন রেডিমেড খানবাহাদুরকে ভোট না দিয়ে মুনশীজিকে জেতাবার পর তার ভোল পালটে যায় । তিনি নিজেই নতুন জমিদার সেজে বসেন । আর নানা কুযুক্তি দিয়ে বোকা বানাতে থাকেন গ্রামের সরল সাধারণ মানুষদের । আসলে ক্ষমতায় গেলে মানুষের পরিবর্তনটা কতটা হতে পারে সেটাই তুলে ধরা হয়েছে । আমার মনে হয় তিনি বেচে থাকলে এখনকার রাজনীতি নিয়ে আর একটা গল্প লিখে ফেলতেন । সেটাও ক্ল্যাসিক হতো আমার মনে হয় ।
“জনসেবা ইয়ুনিভার্সিটি” এই বইয়ের সব শেষ গল্প । তবে শেষ বললে ভুল হবে । এটা দিয়ে এক জন সেবকের উঠে আসা বর্ননা করেছেন । বলা যায় আজকাল রাজনীতিতে যারা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন তাদের কথাই বর্ননা করেছেন । যিনি জনসেবা করতে গিয়ে নিজের আখের গুছিয়েছেন । কিন্তু জনসেবা কতটুকু হয়েছে সেটাই দেখার বিষয় । আমাদের রাজনীতিবিদেরা এই গল্পটা পড়তে পারেন ।
সবশেষে বলব, বইটি যেভাবে তিনি রাজনীতি ও দুর্নীতি করা লোকজনের পিন্ডি চটকিয়েছেন তাতে এখানকার সময়ে বইটি নির্ঘাত নিষিদ্ধ । তবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ক্ল্যাসিক এই বইটি সবার ই পড়া উচিত । এছাড়া সংগ্রহ করার মত একটা বই । হয়ত এজন্য অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, “আয়না লিখিয়া আবুল মনসুর প্রাতঃস্মরনীয় হইইয়াছিলেন আর ‘ফুড কনফারেন্স’ লিখিয়া তিনি অমর হইয়া গেলেন” ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১০:৪৬