৯,
বহ্নিশিখা - ফাহমিদা বারী
আত্মকথন রীতিতে রচিত গল্পটি অত্যন্ত সুন্দর দারুন ট্যুইস্টে ভরা, যাকে বলা যায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মতো গল্প। লেখক অত্যন্ত সুন্দরভাবে গল্পের বিন্যাস করেছেন। উত্তম পুরুষে বর্ণিত গল্পে, বক্তা নতুন বিবাহিতা স্ত্রী রিনাকে নিয়ে যে ফ্ল্যাটে থাকেন তার উল্টো দিকের ফ্লাটে সদ্য আগত ব্যাঙ্ক কর্মী ও তার অপরূপা সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে গল্পের বিন্যাস। ভদ্রমহিলা এতোই সুন্দরী যে পাড়ার ছেলেরা ওনার রুপে বিমোহিত হয়ে বিকেলে খেলাধুলা ফেলে ফ্ল্যাটের ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে থাকে। আগের প্রতিবেশী চলে যাওয়াতে ওনারা কিছুটা নিঃসঙ্গ বোধ করেছিলেন। কাজেই নতুন প্রতিবেশী আসাতে কিছুটা গল্পগুজব করে নিঃসঙ্গতা কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন । যদিও ওনাদের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি । ব্যাংক কর্মী ভদ্রলোক অত্যন্ত অন্তর্মুখী স্বভাবের কিছুটা অসামাজিকও বলা যেতে পারে। আর ওনার সুন্দরী স্ত্রী বাড়িতে প্রায় সারাক্ষণ আগত অভ্যাগতদের আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকেন । ফলে ভদ্র মহিলার চরিত্র নিয়ে এনাদের সন্দেহ শুরু হয়। ধারণা বদ্ধমূল হয় যেদিন শুনতে পান ভদ্রলোক চাপা স্বরে স্ত্রীকে ধমকাচ্ছেন । আর মেয়েটা অস্পষ্ট সুরে কাঁদছে ।
ইতিমধ্যে বক্তার সঙ্গে ভদ্র মহিলার বেশ কয়েকবার কথাবার্তা হয়েছে। অত্যন্ত মার্জিত স্বভাবের কথাবার্তার মধ্যে বক্তা কোন চটুলতা খুঁজে পাননি। যদিও ওনার স্ত্রী প্রথম থেকেই ভদ্রমহিলাকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখতেন । বক্তব্যে পরিষ্কার যে বহ্নিশিখা নামের ওই মহিলা বক্তার হৃদয়ে তখন রীতিমত দুন্দুভি বাজিয়ে চলেছেন। যার জন্য সময় পেলে উনি কৌতুহলী চোখ নিয়ে উঁকি দিতেন প্রতিবেশীর বারান্দার দিকে ।
হঠাৎ একদিন বিকালে অফিস থেকে ফিরে বাসার সামনে দেখেন প্রচুর লোকের ভিড় ;সঙ্গে পুলিশের গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে । ভিড় ঠেলে ঘরে ঢুকতেই স্ত্রীর কাছে শুনলেন প্রতিবেশী ভদ্রলোক সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন । এর পরে শুরু হয় দীর্ঘ পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের পর্ব । একদম প্রতিবেশী হওয়াতে ওনাদের বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল । পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে যে বিষয়টি উঠে আসে, সুন্দরী স্ত্রীকে ভদ্রলোক অত্যন্ত সন্দেহ করতেন। ওনার রূপের মোহে নাকি লতানো-পাতানো আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিত পরিজনরা বাসাতে আসতেন । আর উনি হাসিমুখে সকলকে স্বাগত জানাতেন, যার বেশিরভাগই ঘটতো স্বামীর অনুপস্থিতিতে । এ থেকেই ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত এবং চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে আত্মহননকে বেছে নেওয়া ।
ঘটনার পনেরো বছর পরে বক্তার পোস্টিং হয় দক্ষিণের একটি প্রত্যন্ত জেলায়। সেখানে রফিক সাহেবের সঙ্গে ওনার পরিচয় হয়। কাকতালীয়ভাবে উঠে আসে, ত্রিশের কোঠায় অপরূপা সুন্দরী ভদ্রমহিলাকে নিয়ে স্বামী ভদ্রলোক অত্যন্ত সন্দেহ করতেন-প্রসঙ্গটি । রূপের সঙ্গে ছিল মধুমক্ষিকার মত লোকজনের উৎপাত। অথচ স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ ওনার কাছে ছিল না। পরে আর চাপ সামলাতে না পেরে ভদ্রলোক একদিন বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিলেন । রফিক সাহেব অবশ্য ভদ্রমহিলার বর্তমান ঠিকানাটা বলতে পারেননি। তবে বলতে না পারলেও বক্তার কাছে বিষয়টি অজ্ঞাত নয়। আনকমন নামটি মুখে বলতে না পারলেও বক্তার হৃদয়ে বহন করা বহ্নিশিখাই বটে।
একজন পাঠক হিসেবে প্রতিক্রিয়া:-
অসম্ভব সুন্দর গল্পটি পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো বিষয় চোখে পড়লো।
১- গল্পের শুরুতে বক্তা একবার বলেছেন আমাদের নতুন বিয়ে, এখনো ছেলেপুলে হয়নি। সেখানে স্ত্রীর একাকীত্বে ভোগাটা অস্বাভাবিক লাগলো।
২- গল্পে উঠে এসেছে ব্যাঙ্ক কর্মী ভদ্রলোক ও পরিবার ওনাদের দ্বিতীয় প্রতিবেশী। প্রথমে একটি পরিবার ওই ফ্লাটে ছিল, যাদের সঙ্গে ওনাদের সখ্যতা হয়েছিল। মাঝে ফ্ল্যাটটি বেশ কিছুদিন খালি ছিল। এমতাবস্থায় বক্তার নতুন বিয়ের তত্ত্বটি অসাড় লাগলো।
৩ -পাশের ফ্লাটটি একবার বলেছেন অনেকদিন ধরে ফাঁকা ছিল। অন্যত্র বলেছেন ফ্ল্যাটটিতে দু-মাসের খরা কাটিয়ে আবার ভাড়াটিয়া এল। বিষয়টি বেশ স্ববিরোধী লাগলো।
৪-(বিয়ের পরে একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে বক্তা এবং ওনার স্ত্রী ওই ফ্ল্যাটে আছেন, যেখানে সময়টি অনুল্লেখিত )+( ব্যাঙ্ক কর্মী পরিবার দেড় বছর ছিলেন)+(ঘটনার 15 বছর পরে দ্বিতীয় সন্তান) =আনুমানিক 18/20 বছর!!!!! এক্ষেত্রে এত দীর্ঘ গ্যাপে দ্বিতীয় সন্তানের বিষয়টি অযৌক্তিক লাগলো।তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই সেক্ষেত্রেও ডাক্তারের চেষ্টা -চরিত্রের কথা গল্পে কোথাও উল্লেখ নেই।
৫- বয়স বৃদ্ধিতে নারীর রূপ সৌন্দর্য বাড়ে-এ কথা মাথায় রেখেও বলবো, ভাড়াটিয়া হিসেবে ভদ্রমহিলা যেদিন প্রথম এলেন, সেদিন বক্তার মনে হয়েছিল 20-22 বছরের তরুণী। পরে রফিক সাহেবের বর্ণনায় 30 বছরের সুন্দরীর বর্ণনাটিও বেশ বৈসাদৃশ্য লাগলো।
১০,
মানুষ এবং মানুষ- ফারিয়া রিশতা
গল্পটি মাধ্যমে গল্পকার সভ্যতার চূড়ান্ত বৈপরীত্য তুলে ধরেছেন। শান্ত স্নিগ্ধ পাহাড়ি গ্রামে রিচেলের মতো পাহাড়বাসীরা কতই না সুখে দিনানিপাত করতেন। জীবন যে প্রকৃতই বৈচিত্রময় তারই অপূর্ব ব্যাখ্যা আলোচ্য গল্পে লেখক তুলে ধরেছেন । গল্পে উল্লেখিত পৌঢ় রিচেল সাহেবের সুন্দর সাজানো গোছানো সংসার ভেঙে গেছে। স্ত্রী মারা গেছেন কবেই, দুই পুত্র শহরে থাকে। বিবাহিত একমাত্র কন্যা মাঝে মাঝে আসে বাবার খোঁজ নিতে। নানান প্রতিকূলতার সত্ত্বেও মানুষটি গ্রাম ছেড়ে যাননি। সকলের সুখ -দুঃখের সাথী হয়েছেন বরাবরই। যেদিন পাহাড় ধ্বসে গ্রামটিই ধ্বংস হলো সেদিনও পড়শীরা আশি ছুঁই ছুঁই মানুষটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন এই আশাতে যে উপর মহলকে বলে যদি উনি গ্রামবাসীদের ত্রাণের কোন একটা ব্যবস্থা করতে পারেন ।
ধ্বসের ঠিক দুদিন পরে কয়েক জন গ্রামবাসীকে সঙ্গে নিয়ে রিচেল সাহেব দূরে লেকের ধারে ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন ; যেখানে অনেক তাবু, মানুষ, পুলিশ, ট্রাক ভর্তি আলু ডাল পেঁয়াজ এসেছে শহর থেকে। মাঝ পথে পুলিশ তাদের পথ আটকে দিল এই যুক্তিতে যে ওখানে শুটিং হচ্ছে। কাজেই ওখানে যাওয়া যাবে না। ক্ষুধায় বুভুক্ষ মানুষগুলো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দূরে লেকের ধারে ঐশ্বর্য বিলাসী লোকগুলির প্রতি । গল্পটি পড়ে সুকান্ত ভট্টাচার্যের বিখ্যাত লাইনটি মনে পড়লো,
"চেরাপুঞ্জি থেকে একখানা মেঘ ধার দিতে পারো গোবি -সাহারার বুকে । "
একজন পাঠক হিসেবে মতামত:-
১- গল্পটি বলার মধ্যে যথেষ্ট সাবলীলতার অভাব চোখে পড়লো। গল্পে একাধিক স্থানে অঙ্ক সংখ্যাকে ব্যবহার করাতে পাটিগণিতের অঙ্ক বলে মনে হলো। যেমন গত ২দিন, দিনগুলি আর ৫টা, ৩ সন্তানকে এক হাতে বড় করেছিল,২ দিন তো হয়েই গেল,৫০ জন মানুষ, প্রভৃতি।
২-বেশ কিছু স্থানে বিভক্তি পৃথক ভাবে বসেছে। যেমন- সবাই কে, বউ রা, বাবা কে, সবুজ কে প্রভৃতি।
৩- একাধিক টাইপো চোখে পড়লো। দীর্ঘঃশ্বাস (যদিও বর্তমান বানান বিধিতে বাক্যের মধ্যে বিসর্গ না দিলেও চলে ) বা দীর্ঘশ্বাস/ দ্বীর্ঘশ্বাস, ব্যবস্থা/ব্যাবস্থা, ঠাওর/ঠাওড়, মন্ত্রণালয়/মন্ত্রণালায়লের, খোঁজাখুঁজি/খোজাখুজি, ব্যতিব্যস্ত/ব্যতিব্যাস্ত, প্রমাণ স্বরূপ/প্রমাণস্বরূপ , পাহাড় ধ্বস/পাহাড়ধ্বস ইত্যাদি।
১১,
মৃত আত্মার কথন- আহা রুবন
জীবনের কোন সময় যৌবনের তাড়নায় কিংবা সঙ্গ দোষে আমরা এমন অনেক ভুল করি যা পরবর্তীকালে বিবেকের দংশনে আমাদেরকে তাড়িত করে। আলোচ্য গল্পে গল্পকার সুন্দরভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন।
এটাও উত্তম পুরুষে রচিত গল্প । প্রথম পক্ষের স্ত্রী মৃত্যুকালীন সময়ে একমাত্র পুত্র ননী ও বাপের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রয় থেকে প্রাপ্ত কিছু অর্থ রেখে গেছিলেন। স্ত্রী বিয়োগের পর তিনি জবা নাম্নী প্রতিবেশী একটি মেয়েকে বিয়ে করেন।
নতুন বিবাহিত স্ত্রীর প্রেমে যখন উনি হাবুডুবু খাচ্ছেন, তখন ননী বড় হতে থাকে চূড়ান্ত অযত্নে বা অবহেলার মধ্য দিয়ে । একদিন প্রবল জ্বরে আক্রান্ত ননী মাঝ রাতে জল খাব বলে ডাকাডাকি করতে থাকলে, সৎ মা গিয়ে তার গলা টিপে মেরে পথের কাঁটা বিদায় দেয় । পরে স্বামী -স্ত্রী মিলে নাটুকে কান্না করে গ্রামবাসীদের বোঝাতে থাকেন যে প্রবল জ্বরে ননীর মৃত্যু ঘটেছে। এমন আকস্মিক মৃত্যুতে তারা প্রচন্ড শোকাহত। প্রিয় সন্তানের মৃত্যুতে তাই বাড়ির উঠোনেই ননীকে কবরস্থ করেন। কবরের উপর ছড়িয়ে দেন বকুল গাছের দানা। একদিন সেই গাছ বড় হয়ে তিনটি ফল দেয়। যার একটির খোসা ছাড়াতেই বেরিয়ে আসে ননীর মুখ, চোখ, নাক। ঘটনার আকস্মিকতায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন জবা। যিনি ইতিমধ্যে তিনটি সন্তানের জন্ম দিলেও একটিও বাঁচেনি। ডাক্তার জবার মাথার চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দেন । এদিকে বক্তাও প্রচণ্ড অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকেন। পড়শীরা অবশ্য তাদেরকে পাবনা মেন্টাল হসপিটালে পাঠানোর কথা বলে হাসাহাসি করতে থাকে।
একজন পাঠক হিসাবে প্রতিক্রিয়া ;-আজন্ম কাল ধরে চলে আসা সাংসারিক অবক্ষয়ের এক নিদারুন চিত্র গল্পকার অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে গল্পে কয়েকটি স্থানে কিছু শব্দ ও বাক্য দুর্বোধ্য লাগলো।
১-আমার পিঠ হাতলে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল তারা। এখানে হাতলে মানেটি স্পষ্ট হলো না।
২-ওর শরীরের উত্তাপ আমাকে বির্বত করল। বির্বত মানেটিও আমার কাছে দুর্বোধ্য।
৩-"কথাগুলো সাত বছর আগে সত্য ছিল । অবশ্য ওর কাছে সব সাত বৎসর পূর্বের মতোই অপরিবর্তিত ছিল বলে আমার ধারণা। এছাড়া আর কিছু করারও তেমন ছিল না ওর।" - এখানে একটি ধারণা পেলাম যে ওনাদের সম্পর্ক ও বিয়ে মিলে সাত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু কেন উনি মৃত্যুপথযাত্রী সে বিষয়টি স্পষ্ট করলেন না। পাশাপাশি একজন মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীর উদ্দেশ্যে পতি দেবতার," এছাড়া আর কিছু করারও তেমন ছিল না ওর।"- গোছের মনোভাব ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে গল্পের বিন্যাসে বেশ ঘাটতি লাগলো।
৪-"কবরস্থানে নিলাম না কেননা নতুন স্ত্রীর প্রেমে বিভোর ছিলাম আমি।" এই বাক্যটিও ঠিকঠাক লাগলো না।
৫-কি করেছ তুমি!? বা জবা তুমি এটা কি করলে!?
দুটি চিহ্নের স্থান আলাদা। সেক্ষেত্রে বক্তার বিস্ময়ে হতবাক হয়ে, সংলাপের শেষে কোশ্চেন মার্ক রাখাটাই বিধেয় ছিল ।
১২,
ওরাল সাসপেনশন ৪২-মিরাশদার ১০
ব্যক্তিগতভাবে গল্পটি আমার ভালো লাগেনি। রিভিউ লেখার জন্য বার তিনেক ধৈর্য নিয়ে পড়লাম। গল্পটিতে লেখক যেটা বলতে চেয়েছেন তার পরিসমাপ্তি টানতে পারেননি বলে আমার স্থির বিশ্বাস। অত্যধিক মেদযুক্ত গল্পটিতে এত বেশি অপ্রাসঙ্গিক ভাবের আধিক্য ঘটেছে যে বোরিং বা ডিসগাস্টিং না বললেও পাঠক হিসেবে মনোসংযোগ ধরে রাখতে বারে বারে ব্যর্থ হয়েছি । নয় পাতার গল্পটি কোন অবস্থাতেই তিন বা সাড়েতিন পাতার বেশি হওয়া কাম্য ছিল না।
বিশেষ দ্রষ্টব্য- আগামী 2-3 দিনের মধ্যে মরিচিকার পরবর্তী পর্ব পোস্ট করার ইচ্ছা আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ রাত ৮:৫০