somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

পদাতিক চৌধুরি
আমি আমার নিরক্ষর কিন্তু বুদ্ধিমতী মায়ের কাছ থেকে এই শিক্ষাই পেয়েছিলাম,যথাযথ কর্তব্য পালন করেই উপযুক্ত অধিকার আদায় করা সম্ভব। - মহাত্মা গান্ধী

পদ্মভূক

২১ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


(আজ আমি তোমাদের একটা গল্প শোনাবো। লোটাস ইটার্স বা পদ্মভূকদের কথা জানোতো? গ্রিক কবি হোমারের ওডিসিতে এদের উল্লেখ আছে। প্রাচীন গ্রিসে একটা ছোট্ট দ্বীপ ছিল, সেখানকার মানুষের খাদ্য ছিল এক রকমের লোটাস। এতে এমন কিছু উপকরণ ছিল যা খেলে তারা নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়তো আর সঙ্গে খুব ঘুম পেয়ে যেত। ওদের চলনবলন বা জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত ধীর গতির। এই গল্পের প্রধান চরিত্রের মানুষটি এমনই পদ্মভূকদের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভদ্রলোকের নাম অভিলাষ দাস। তোমরা বলতেই পারো কি এমন সুপারহিরো যে অভিলাষ বাবুকে নিয়ে গল্প শোনাতে হচ্ছে। হ্যাঁ সে কথা বলতেই গল্পের অবতারণা।

আসলে আমাদের বেশির ভাগ মানুষের জীবনের চলন একই গতে বাঁধা। সেই রুটিন মেনে পড়াশোনা, কাজের জগত, সংসার ঘুরে বেড়ানো পার্টি, আত্মীয়তা, ডাক্তারবদ্যি, পিএনপিসি, লোক দেখানো সমাজসেবা ইত্যাদি করতে করতে কখনো আমরা জীবন সায়াহ্নে চলে যাই এবং একদিন হঠাৎ করে চিরঘুমের দেশে গমন করি। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে পাওয়া বলতে শুধু আফসোসকে সঙ্গী করি।ইস! যদি ওমুকের মতো হতে পারতাম, কিংবা যদি ওমুখ কাজটা করতে পারতাম বা এসবের মধ্যে যদি এমন একজনের দেখা পেতাম অথবা এটাকে নিয়ে জীবনটা যেন নিজের মত প্রচলিত ধারাকে তুড়ি মেরে জীবনকে আপন খেয়ালে চালিত করতাম - আর এমন হলেই জীবনটা যেন ষোলকলা পূর্ণ হতো আর কি।

আর এই জন্যই অভিলাষ বাবুর প্রতি আমার এত কৌতুহল। ভদ্রলোক একটু ব্যতিক্রমী চিন্তার অধিকারী। উনি একটা সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন।যদিও তার সাফল্য সম্পর্কে আগেভাগে কিছুই বলা যাবেনা।তার দীর্ঘ জীবন ইতিহাস আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে। লোকমুখে শুনেছি উনি একজন অদ্ভুত স্বভাবের মানুষ। আমি চাইছিলাম ওনার সঙ্গে পরিচয় স্থাপন করে সরাসরি ওনার মুখ থেকেই ঘটনাটা শুনতে।লোকের মুখ থেকে শুনলে কিছুতো রংচঙে থাকবেই। কাজেই মনে মনে একটু প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ভদ্রলোকের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে। আর একান্তই যদি তো সম্ভব না হয় সে ক্ষেত্রে লোকমুখে যা রটেছে তা থেকে যতটা সম্ভব সত্যতা নিশ্চিত করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে।)-অংশটি ভূমিকা স্বরূপ বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে গল্পচ্ছলে বলা।


মনের দিক থেকে প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পাড়ি দিলাম গোয়ার উদ্দেশ্যে। আগে থেকে খোঁজ খবর নিয়ে নির্দিষ্ট সী বিচের লক্ষ্যে পৌঁছে গেলাম। প্রত্যাশামতোই তার সাথে আমার দেখা হয়ে গেল গোয়ার উদ্দিষ্ট সী বিচে। তবে ওনাকে খুঁজে পাওয়াটা স্মৃতিতে আজো উজ্জ্বল হয়ে আছে। উল্লেখ্য গিয়েছিলাম কোন এক গ্রীস্মের ছুটিতে। সী বিচের নিকটে বন্ধুর বাড়িতেই উঠেছিলাম। গোয়াতে পৌঁছেই সেদিন পড়ন্ত বেলায় সময় নষ্ট না করে বন্ধুকে নিয়ে বিচ ধরে গল্প করতে করতে হাঁটতে শুরু করলাম। সময়টা ছিল সূর্যাস্তের কিছু আগে যখন সেখানকার বেশিরভাগ মানুষ ও বিদেশী পর্যটকরা মিলেমিশে বিচের পরিবেশটাকে উৎসবমুখরীত করে তুলেছিল। উল্লেখ্য এসময়টাতে সকলে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করেন আর আকণ্ঠ হৃদয়ে প্রকৃতির শোভা পান করে চোখ আর প্রাণ জুড়ান। দক্ষিণ গোয়ার পালোলেম বিচে তখন অদৃশ্য প্রকৃতির রানী শিল্পীর নিপুণ হাতে রং এর কোলাজ আঁকছেন। নীল সমুদ্রের সোনালী বালুকাবেলায় কমলা সূর্যালোক তখন ধীরে ধীরে লালিমা ছড়াচ্ছিল। দূরে দিগন্তে রেখার নিচে সূর্য ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিলো সমুদ্রের ভেতরে। এমনসময় বন্ধু,
- দেখ দেখ ঐ যে অভিলাষ বাবু!
এতক্ষণে আমার ইপ্সিত লক্ষ্য পূরণ হলো। আমি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম মানুষটার দিকে। ভদ্রলোক আমাদের দিকে পিছন ফিরে নিসর্গ প্রকৃতির শোভাপানে ব্যস্ত। উচ্চতা গড়পড়তা বাঙালির মতো। বামদিকে শীতে কাটা আচড়ানো কালো চুল ও নীল শার্ট। আলাদা করে তেমন কিছু মনে হলো না।

হঠাৎ করে কমলা সূর্য গাঢ় লাল জলে ডুবে গেল। অদূরে চার্চের বেল বাজলো। ঘন্টার শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল আকাশে বাতাসে।তার সাথে ক্লক টাওয়ার এর সিঁড়ি ব্যালকনি যে সাগরের উপর ঝুলছে তার চারিদিকে মুগ্ধ চোখে ভিড় সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে যেন সঞ্জয় লীলা বনসালির কোন ঐতিহাসিক সিনেমা সেট।

আমি এত মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছিলাম যে ভদ্রলোক কখন আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন খেয়ালই করেনি। বন্ধু তার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। তাকে একটু কফি খেতে আমন্ত্রণ করলাম, তিনি রাজি হলেন। তার সাথে হেঁটে হেঁটে এটা সেটা বলতে বলতে হাজির হলাম মর্গ্যানোয়। সেখানকার পরিবেশটা অতি মনোরম। আমাদের অর্ডার নিতে হাজির হলেন স্বয়ং হোস্ট; তিনি এতটাই আকর্ষনীয়া যে মকবুল ফিদা হুসেন যদি ওনাকে মডেল করতে পারতেন তাহলে খুবই আনন্দিত হতেন। যাক গে সে কথা।ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলে তার চেহারা পরিচ্ছদ থেকে এটা বুঝলাম যে রিটারমেন্টের পর অবসর-জীবন কাটানো যেকোনো মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী ভদ্রলোকের মতো উনিও একজন। শুধু জীবন কাটাচ্ছেন নিজের মতো করে। লোকজনের কথা অতিরঞ্জিত মনে হল। বন্ধুকে সেটা জানাতে ও বলল,
-তুই ব্যাপারটা যেভাবে ভাবার ভাবতে পারিস।

একদিন আমরা বেলাভূমিতে হাঁটছিলাম। দেখলাম অভিলাষ বাবুর ঠোঁটের সিগারেট নিয়ে বারমুডা পরে দাঁড়িয়ে আছেন। খুব গরম লাগছিল তাই ওনার সঙ্গে কথা বলার তাগিদ থাকলেও জলে নেমে পড়লাম। কিছুক্ষণ সমুদ্রে স্নান করে উঠে দেখলাম উনি বালিতে তোয়ালে বিছিয়ে উপুড় হয়ে বই পড়ছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে বললেন,
-এইযে আগন্তুক কেমন লাগছে জায়গাটা?
আমি স্মিত হেসে মাথা নেড়ে জানালাম,
-খুব ভালো। দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্নানতট কিনা...
উনিও আমার হাসির প্রতিউত্তরে মৃদু হাসি দিয়ে আবার পাঠের মধ্যে ডুবে গেলেন।
শুরুতে সৌজন্যে সূচক সামান্য কথোপকথন থেকে বুঝলাম উনি বেশ কথা বলার মেজাজে রয়েছেন। এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলাম উনার পাশেই। কথায় কথায় জানলাম ইতিহাসের প্রতি ওনার বিশেষ আগ্রহের কথা।
-আমরা সবাই ঐতিহাসিক সময়ে বাস করছি। বিশেষ করে এমন একটা জায়গায় যেখানে ইতিহাস জীবন্ত বলে মনে হয়। সময়টাও ১৯৮৪ সালে। তখনো পৃথিবীটা এতটা অশান্ত হয়নি। সন্ত্রাসবাদ আজকের মত এতটা কদর্য রূপ নেয়নি।
এবার আমি জিজ্ঞাসা করি,
-আপনি এখানে কতদিন আছেন?
-তা বছর পনেরো তো হবেই, দূরে শান্ত নীল জলরাশির দিকে চোখ রেখে উদাসভাবে বললেন। উনি আরো বললেন, আমি প্রথমবার এই জায়গায় এসে স্থানটির প্রেমে পড়ে গেছি। অদ্ভুত একটা হাসি ঠোঁটের একটা দিকে ঝুলিয়ে আবারো বললেন,
-পঁচিশ বছর হয়ে গেল যেবার জীবনের প্রথমবার এখানে এসেছিলাম। তারপরে যেন চোখের পলকে সবকিছু ঘটে গেল।
আমি ওনার জীবনের আরও কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যে অদ্বিতীয় গল্প তার সম্বন্ধে শুনেছি মনে হচ্ছে তার কাছাকাছি চলে এসেছি।এমন সময় আমার বন্ধুটি সমুদ্র স্নান শেষ করে হাত দিয়ে ভেজা চুল ও গা থেকে জল চিপতে চিপতে কাছে চলে এলো। ফলে আমাদের কথাও ঘুরে গেল অন্যদিকে।

এরপর বেশ কয়েকবার আমাদের দেখা হয়েছে গোয়ার বিভিন্ন সী বিচে।যথেষ্ট ভদ্র বিনয়ী মিষ্টভাষী এবং সীমিত কল্পনাশক্তির একজন হিসেবে তিনি প্রতিভাত হয়েছেন আমার কাছে। একদিন আমরা এক সৈকতে নৈশভোজে মশগুল ছিলাম।মাতাল চাঁদের আলোতে সুস্বাদু আহার ও পানীয়ের সহাবস্থানে আমাদের মনের লাগাম কিঞ্চিৎ আলগা হয়েছিল। চাঁদ থাকুক বা না থাকুক এখানে আমরা দেদার অবসর উপভোগ করি। গোয়ার বাতাসে কোন তাড়া নেই। অবসর! ইস মানুষ যদি উপলব্ধি করতো কি অমূল্য এই অবকাশ। সব কাজের লক্ষই হলো অবসর অর্জন করা। পেটে পানিয়ের প্রভাবে তারা এক একটা দার্শনিক সূত্রের অবতারণা করে যার কোনোটিই স্বসৃষ্ট নয়। আমি অবশ্য নিরব থেকে শুধু একটা সিগারেট ধরালাম।

সেদিন ছিল আর এক পূর্ণিমা রাত। মাথার উপরে আলোকবর্তিকা থেকে যে স্বল্প আলো এসে পড়েছিল তার আলো-আঁধারিতে এক অনন্য মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা যেন স্মৃতির তরণী বেয়ে চলেছি অতীত পানে। মনে হচ্ছে যেন এই একমাস আগের কথা। আসলে 15 বছর অতিক্রান্ত। আমি এসেছিলাম একটু অবকাশ যাপন করতে। এখানে পাওয়া মাত্র এক আবেশ মাখা হওয়া আমার জড়িয়ে ধরল। ঢেউয়ের হাতছানি।তটরেখার নিকটবর্তী সাগর জলের ফুলে ওঠা, উঁচু উঁচু শিলা, সুনীল আকাশ, জানা-অজানা গাছ লতা ফুল সকলে হেসে এমন আপ্যায়ন করল যে এদের সঙ্গী হতে মন চাইলো প্রবল ভাবে। আর ফিরে যেতে মন চাইল না।আমার বিধাতা যদি আমাকে ব্যাংকের ম্যানেজার বানিয়ে থাকেন তবে সেই বিধাতা পুরুষের ইচ্ছে ছিল আমি যেন ভূতপূর্ব পর্তুগিজ উপনিবেশে থেকে যাই। তাহলে আমি ভুল কিছু ভাবি নি।
জিজ্ঞেস করলাম কোন ব্যাংকের,
-ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল কো-অপারেটিভ সোসাইটি। আমি বেশ স্বচ্ছন্দ ছিলাম ওখানে। সেই রাতেই ছিল সেই ছুটির শেষ রাত। পরদিন আমাকে কাজে যোগ দিতেই হত। আমি যখন জোড়া শিলাখণ্ডের দিকে তাকালাম দেখলাম জল স্নান করে তাদের মাঝে উদিত চন্দ্র ধরার দুধ স্নান করছে।দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জেলে নৌকার তিরতিরে আলো- সব মিলিয়ে এক অলৌকিক পরিবেশ। আমি নিজে নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম-কেন ফিরে যাব? কে আছে আমার? কিসের আকর্ষনে যাব? চার বছর আগে স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে ব্রংকিয়াল নিউমোনিয়ায়। ছোট্ট একমাত্র মেয়েটি তারপর তার দিদার সঙ্গে থাকতো। বুড়ি তার নাতনিকে ঠিকমতো যত্ন নেয় নি। আমার বেচারী মেয়েটির রক্তে কিছু দোষ ঘটেছিল। সঙ্গে তার বাঁ পাটা বাদ দিতে হয়েছিল। এত করেও তাকে বাঁচানো যায়নি।
-কি মর্মান্তিক! আমি বললাম।
-সে সময় আমি সংসারে থেকেও নির্লিপ্তি ছিলাম। আমার মেয়ে মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। এক পা নিয়ে বেঁচে থাকার কোন মানে হয়না। আমার স্ত্রীর জন্য খুব কষ্ট হতো।ও এমন একজন মহিলা ছিল যে সবসময় কে কী ভাববে এই ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব দিত। ঘোরাঘুরি করতে একদম ভালোবাসো না। দীঘা বা পুরীর বাইরে যাওয়ার কথা সে ভাবতেই পারত না। মানসিকতার পার্থক্য সত্ত্বেও আমাদের দাম্পত্য জীবন খারাপ ছিল না।
-আপনার অন্য কোন আত্মীয় ছিল না?
-আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আমার এক কাকা ছিল যে আমার জন্মের আগেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল বলে শুনেছি। আমার চেয়ে একা বোধহয় তখন কেউ ছিলনা। তাই আমার আপন খেয়ালে না চলার কোনো কারণ ছিল না। সে সময় আমি চৌত্রিশ। হিসাব করে দেখলাম পনেরো বছর ধরেই এই সমুদ্র শহরে আছেন তাহলে উনপঞ্চাশ।
-সেই বাইশ বছর বয়স থেকে কাজ করে চলেছি আর রিটারমেন্ট না করা পর্যন্ত কাজ করে যেতে হবে। কাজটা কি খুব মূল্যবান আমার কাছে?কি হবে যদি সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বাকি জীবনটা এখানে কাটিয়ে দেই? কিন্তু না আমার তো কাজকর্ম অসম্পূর্ণ রয়েছে। ফিরে যেতেই হবে। এসমস্ত ভাবনা নিয়ে আবার কর্মস্থলে ফিরে গেলাম। কিন্তু মন পড়ে রয়েছে এই বেলাভূমি পাহাড় নারকেল বিথীর পথে।মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর সবার মতো আমারও কি কাজ করতেই হবে?ঠিক এই সময়ে আমি একটা বই হাতে পেলাম যাতে ছিল সাইবেরিস আর ক্রোটোনা নামে দুই রাজ্যের কথা।সাইবেরিসের লোকেরা ছিল খুব আরাম প্রিয় আর ক্রোটোনার লোকেরা ছিল ঠিক উল্টোটা প্রচন্ড কর্মঠ। ক্রোটোনাবাসীরা সাইবেরিসদেরনির্মূল করেছিল আর তার কিছু বছর বাদে ওরা অন্য এক জাতির কাছে ধ্বংস হয়েছিল। কাজেই কাজ করা বা না করার ফল হয়েছিল একই। এটা জেনেই আমি মনস্থির করলাম,টাকা-পয়সার বন্দোবস্ত করতেই হচ্ছিল কারণ বেঁচে থাকতে হলে একে গুরুত্ব না দিলে চলবে না। কুড়ি বছর চাকরি না হলে ব্যাংকে পেনশন দিত না। কিন্তু স্বেচ্ছা অবসর নিলে গ্রাচুয়িটি পাওয়া যেত।বাড়ি বিক্রির টাকা, আমার জমানো অর্থ আর গ্রাচুয়িটি মিলিয়ে যেটা পেতাম তাতে আমার বাকি জীবনটা চলতো না।ভদ্রস্থ একটা থাকবার জায়গা, খাবার, আমার সব কাজকর্ম করে দেওয়ার মাইনে করা, সাহায্য করা বইপত্র কেনা আর জরুরি অবস্থার জন্য কিছু নগদ টাকার আমার প্রয়োজন ছিল। আমি জানতাম আমার কতটা দরকার। দেখলাম আগামী পঁচিশ বছরের মতো রসদ আছে।
-সেই সময় আপনি পঁয়ত্রিশ?
হ্যাঁ। ষাট বছর পর্যন্ত টানতে পারবো।
-এটা তো নিশ্চিত নয় যে আপনি ষাট বছরের মধ্যেই মারা যাবেন।আপনার জায়গায় আমি থাকলে পেনশন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত চাকরি ছাড়তাম না।
-সে পর্যন্ত অপেক্ষা করলে উপভোগের মেয়াদ কমে যেত। আমার মনে হয় ষাট বছর বয়স পর্যন্ত নির্ভেজাল আনন্দে কাটিয়ে পৃথিবীর মায়া কাটানোই যায়।
চারিদিকে চকিতে একবার চাইলাম।এমন সাধারণ চেহারার আড়ালে অসাধারণ ব্যতিক্রমী ভাবনার মস্তিষ্কের লুকিয়ে আছে ভাবা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা জীবনটা তার। নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী জীবনটা কাটানোর অধিকার আছে। তবে বন্ধুর মুখ থেকে শোনা কাহিনী নিজের কানে শুনে অন্য রকম লাগলো।যদিও মূল বক্তব্য এক তবে তার প্রয়োজনের কথা কল্পনা করে মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত প্রবাহিত হতে লাগল।

অভিলাষ বাবু তার কুটিরে আমন্ত্রণ জানালে গেলাম তার বাড়ি।সামান্য পাহাড়ি পথে নারকেল আর পাম গাছের ছায়া ছড়ানো পথ পেরিয়ে হরেক রঙের ফুলের ঝোপকে সামনে রেখে তার দু কামরার ছোট্ট কুটির। সাধারণ কিন্তু পরিচ্ছন্ন এবং সর্বত্র নান্দনিকতার উপস্থিতি।ঘরে দেখলাম একটা টেপরেকর্ডার, হাওয়াইয়ান গিটার, বইয়ে ভর্তি আলমারি, আর একগোছা তাস। গিটার দেখে প্রশ্ন করে জানলাম দক্ষতা নেই তবুও সুর তুলতে ভালোবাসেন। গান শোনেন। বইয়ের প্রতি টান তো আগেই জানতাম আর সময় পেলেই তাস খেলেন।এসব দেখে বেশ আন্দাজ করতে পারছিলাম তার পনেরো বছরের ফেলে আসা জীবনটা কেমন ছিল। এক্কেবারে নিরীহ বা হার্মলেস লাইফস্টাইল বলা যায়।সমুদ্রস্নান, প্রচুর হাঁটা, গিটার বাজানো এবং তাস খেলা এসবের সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে লোকদের সঙ্গে মিশলেও একটা দূরত্ব রেখে চলছেন।মিতব্যায়িতার সত্বেও স্বাচ্ছন্দ্য ছিল এবং সর্বোপরি ছিল সৌন্দর্যপ্রিয়তা যা তার একমাত্র কামনার বস্তু এবং তিনি খুব সাধারণ উপাদান থেকে থেকে খুঁজে নিতেন।

অনেকেই বলবেন এটা কি রকম জীবন? এত আত্মকেন্দ্রিক! তাতে তো কারো ক্ষতি নেই। শুধু নিজের মনের মত করে তিনি জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছিলেন। খুব কম লোকই জানে শান্তির ঠিকানা। আর কমজনই তা খুঁজে পান। আমি জানিনা সে বোকা না জ্ঞানী। শুধু বুঝেছিলাম সে নিজের চাওয়াটা খুব ভালভাবেই বুঝে ছিল। একটা ব্যাপার আমাকে খোঁচা দিত-তা তো সাধাসিধে যে মানুষ সে কি করে দশ বছর পর স্বেচ্ছায় পৃথিবীকে, যাকে সে ভালোবাসে তার কাছ থেকে বিদায় নিতে পারবে? যদি না কোনো অসুস্থতা তার জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে দেয়। সেই ভবিষ্যতের আশঙ্কা নিশ্চয়ই তার মনে উঁকি দিত আর তাই সে জীবনের প্রতি মুহূর্তের আনন্দ নিংড়ে নিত।

আমার ছুটি শেষ হয়ে এসেছিল তাই চলে আসি। কিন্তু মনে ছিল চিত্রনাট্যের পরবর্তী ঘটনাটি দেখার। তেরো বছর বাদে গেলাম আবার সেই বন্ধুর কাছে। হোটেলে উঠেছিলাম। আগাম অনুমান করেছিলাম যে এখন যেখানে সে থাকে সেখানে আর একটা লোকের থাকার মত জায়গা হবে না।বন্ধু দেখা করতে এলে জানতে পারলাম যে এখন সে যে বাড়িতে থাকে সেই বাড়িতে আগে অভিলাষ বাবু থাকতেন।মনে পড়ল শেষবার দেখা হওয়ার সময় তার হাতে দশ বছর ছিল, তাহলে উনি হয়তো আর নেই। প্রশ্ন করলাম,উনি কি আত্মহত্যা করেছিলেন?
-নারে সে খুব বেদনাদায়ক ঘটনা।
অভিলাষ বাবুর পরিকল্পনার ঠিকঠাক ছিল। শুধুমাত্র একটাই ত্রুটি ছিল যা তিনি আঁচ করতে পারেননি। বাধাবিঘ্ন নয় মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে ক্ষুরধার করে। পঁচিশ বছর নির্বিঘ্ন ভাবে বিশুদ্ধ আনন্দময় জীবন অতিবাহিত করতে করতে তার ইচ্ছে শক্তির ধার নষ্ট হয়েছিল। একটানা পঁচিশ বছর যা চেয়েছিলাম তাই পেয়েছিলেন।তাই যখন তার বেঁচে থাকার রসদ শেষ তখনও তিনি পরিকল্পনামতো জীবনকে শেষ করে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারেননি। ব্যাপারটা দিনের পরদিন ফেলে রেখেছিলেন।

তিনি এই স্থানে আসার পর একটা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছিলেন যে ধার দেনা করে আরো এক বছর তিনি চালাতে পেরেছিলেন। লোকে তার গল্প বিশ্বাস করেছিল। গল্পটি এরকম-তার এক আত্মীয় মারা গেছেন এবং তিনি কিছু সম্পত্তি পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। কিন্তু আইনগত কোনো কারণে এখনই নগদ টাকা হাতে পাচ্ছেন না। কিন্তু এক বছর পর লোকে ধার দেওয়া বন্ধ করলো। বাড়ির মালিক বাড়িছাড়ার দিন নির্ধারণ করে দিলেন।সেই নির্ধারিত দিনে আগের দিন সে তার ছোট্ট বেডরুমের দরজা জানালা বন্ধ করে চার্কোল জ্বালিয়ে দিয়েছিল।পরদিন সকালে অ্যাসাল্টা তার মালকিন তথা আয়া দরজা ভেঙে অচৈতন্য অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে। সারাঘর ধোঁয়ায় ভর্তি।এবার হয়তো তিনি মনস্থির করতে পারেননি। তাই মৃত্যু নিশ্চিত করতে সেরকম ব্যবস্থা নিতে পারেননি, হালকা চেষ্টা করেছিলেন মাত্র।


হসপিটালের থেকে কয়েক দিনের মধ্যে তিনি আবার সুস্থ হয়ে উঠলেন।কিন্তু চার্কোল বিষে হোক বা মানসিক আঘাতেই হোক তিনি পূর্ণ সুস্থতা ফিরে পেলেন না। পাগলা গারদে দেওয়ার মতো পাগল নন আবার স্বাভাবিক সুস্থ মানুষও নন। আমি ওকে দেখতে গিয়েছিলাম, বন্ধু বললো। তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে দেখলাম কোনো কথা বলছেন না। এবং অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আমায় দিকে।
হসপিটাল থেকে ছাড়া পেলে কে তার দায়িত্ব নেবে যখন ঠিক করা যাচ্ছিল না তখন তার বাড়ির মালিক মালকিন তার দায়িত্ব নিল। যতদিন ভদ্রলোকের কাছে টাকা ছিলো ততদিন তিনি তার দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করেছিলেন। তাই তার পঁচিশ বছরের আচরণের ফল স্বরূপ তিনি একটা আশ্রয় পেলেন অ্যাসাল্টার কুটিরে। এই দু বছর তাদের আশ্রয়েই সে আছে। অনেক ইচ্ছে অনিচ্ছে তার আর নেই।নড়বড়ে একটা সহজ জায়গা যার কোনো জানালা নেই, গরমে অগ্নিকুণ্ড ও শীতে ঠান্ডা বরফ জমে সেই জায়গায় খাবারের মান তথৈবচ। আমাকে দেখে অ্যাসাল্টা একটু কথাবার্তা বলে। ওর হাতে কিছু পয়সার দেই যাতে ওনাকে একটু ভালোভাবে দেখেন। আমার মনে হয় অ্যাসাল্টা ওকে বাচ্চাদের মত করে যত্ন নেয় যদিও ওর স্বামী অতটা দয়ালু নয়। শুধু শুধু ওকে বসিয়ে খাওয়াতে চায় না, রাগে গজগজ করে। ওকে দিয়ে জল তোলানো বাড়ির এটা সেটা পরিষ্কার করার মতো কাজও করিয়ে নেয়।বাকি সময় গুলোতে উনি পাহাড়-সমুদ্রের ধারে নির্জন জায়গা গুলোতে ঘুরে বেড়ান। কাউকে দেখতে পেলে এই খরগোশের মত ছুটে পালায়। আমার খুব খারাপ লাগছিল কিন্তু এটা ওর প্রাপ্য ছিল।

দুই তিন দিন বাদে আমি আর বন্ধু পাম নারিকেলের ছায়া ঘেরা পথ ধরে হাঁট ছিলাম। হঠাৎ তাকে দেখলাম একটা গাছের আড়াল থেকে আমাদের দেখছে। বন্ধু বলল,
- তাকাস না। ভয় পাবে।
আমরা চলতে থাকলাম কিন্তু চোখের কোন দিয়ে লক্ষ্য করছিলাম। হঠাৎ খসখস শব্দ। যেন কোনো তাড়া খাওয়া জন্তু ছুটে পালাচ্ছে। সেই ওর সাথে আমার শেষ দেখা। গতবছর অভিলাষ বাবু পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। শেষ ছয় বছর এই রকম ভাবে বেঁচে থাকার পর। ওকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল পাহাড়ের কোলে। শান্তিতে শুয়ে আছে এমন অবস্থায়। যেখান থেকে তিনি দেখতে পেতেন সাগরের জল ফুলে ওঠা এক জোড়া বড় শিলাখণ্ড। ফ্যারাগলিওনি যার নাম। সেটা ছিল পূর্ণিমা রাত। তিনি নিশ্চয় চন্দ্রধারায় সিক্ত শিলাখণ্ডের শোভা দর্শনে গিয়েছিলেন। সৌন্দর্যের অভিঘাতে হয়তো নশ্বর দেহ তিনি ত্যাগ করে চিরতরে অমৃতলোকে চলে গেছেন।

গল্পটি উইলিয়াম সমারসেট মমের 'লোটাস ইটার্স' অবলম্বনে আমার মিসেসের ভাবানুবাদ কৃত।









সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৫:৫০
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×