সেদিন তিনজনে মিলে এক প্রকার ছুটতে ছুটতেই আমরা বাড়িতে চলে আসি।এসে দেখি উঠোনে প্রচুর মানুষের ভিড়।হুডখোলা গাড়িটাকে ঘিরে আশপাশের লোকজনের আগ্রহ ও কারো কারো উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে মনে মনে বেশ খুশি হই। কি সুন্দর চকচকে গাড়িটা। গাড়িটাকে অবশ্য আমি আগেও একবার দেখেছিলাম। প্রথমবার কাজে গিয়ে হালদার বাবুর বাড়িতে গাড়িটিকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। দাদার কাছ থেকে জেনেছিলাম ওনারা মাঝে মাঝে গাড়িতে করে বেড়াতে যান। কিন্তু কোথায় যান প্রশ্ন করাতে দাদা পাল্টা বলেছিল, যাওয়ার জায়গার কি অভাব আছে? আজ গাড়িটিকে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ানো দেখে দাদাকে করা সেদিনের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই। দাদা যে হেলতো ফেলতো মিস্ত্রি নন,যাকে শহরের বাবুরাও মান্য করেন। ভেতরে ভেতরে রীতিমতো গর্ব অনুভব করতে থাকি। মনে মনে কৃতজ্ঞতা মিশ্রিত ধন্যবাদ দিতে থাকি দাদাকে। দূর থেকে আমাদেরকে এভাবে হন্তদন্ত হয়ে ছুঁটে আসতে দেখে, হালদার বাবু স্মিত হাস্যে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। কাছে এসে দাঁড়াতেই দাদাকে জড়িয়ে ধরলেন। দাদা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে,
- আরে আরে বাবু মশাই! এ কি করছেন? আমি যে কাজের মধ্যে ছিলাম;গায়ে ময়লা-টয়লা আছে।
-তার চেয়ে অধিক ময়লা যে আমাদের মনেই আছে রুস্তম ভাই।
দাদা কোনো প্রতিউত্তর না দিয়ে বরং ওনাকে ভদ্রস্থ জায়গায় বসাতে শশব্যস্ত হয়ে পড়লো। মুহূর্তের জন্য এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির করে উপায়ন্তর না পেয়ে ওনার হাত ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেও আবার থেমে গেলো। কিছুটা স্বর্গোক্তি করে আপন মনে বলে উঠলো,
-বাবু মশাই মানি লোক; আমার এই ভাঙাচোরা বাড়িতে ওনাকে কোথায় যে বসতে দেই?
দাদার অস্বাভাবিকত্ব বুঝতে হালদার বাবুর বাকি রইলো না। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করতে,
- তোমাকে একদম ব্যস্ত হতে হবে না রুস্তম ভাই। আমি এখানেই ভালো আছি।
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে উনি আবারো বলতে লাগলেন,
-তোমার পড়শীরা অত্যন্ত ভালো মানুষ রুস্তম ভাই। ওদের সঙ্গে এতোক্ষণে জমিয়ে গল্প করছিলাম। পাশে দাঁড়ানো একজনের দিকে আঙুল দেখিয়ে জানালেন,
-ওই যে মকবুল।ও গাছে উঠে আমাকে ডাব পেড়ে খাওয়ালো। এত জল যে খেয়ে শেষ করতেই পারছিলাম না।
সাথে সাথে আরো জানালেন,
-এত মানুষজনের সঙ্গে কথা বলতে পেরে আমার সত্যিই খুব ভালো লাগছে। এখন বলো কেমন আছো তোমরা?
দাদা উত্তরে জানালো,
-আছি বাবু। আপনাদের আশীর্বাদে ভালো আছি। মাঝের কিছু দিন অবশ্য একটু সমস্যার মধ্যে ছিলাম। এবার দাদাও হাসতে হাসতে পাল্টা জিজ্ঞেস করলো,
- তা বাবু, আপনারা কেমন আছেন? দিদিমণি কেমন আছেন? ছোটবাবুরা দুজনেই ভালো আছে তো?
হালদার বাবু কোনোক্রমে উত্তর দিলেন,
- হ্যাঁ তোমার ছোটবাবুরা সকলেই ভালো আছে। আমিও ভালো আছি। দিদিমণিও ভালো আছেন।
দাদা আবার কি যেন বলতে চাইছিল। এমন সময় হালদার বাবু দাদাকে একপ্রকার থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
-তুমি বলছো বটে, ভালো আছ। তবে আমি তো আর অবুঝ নই, কি ঝড়টাই না তোমার মাথার উপর দিয়ে বয়ে গেছে।যাক উপরওয়ালার ইচ্ছায় এখন যে অনেকটাই স্বাভাবিক হতে পেরেছ, এটাই আমাদের বড় পাওয়া।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদা এক্কেবারে নীরব হয়ে গেল। সংগত কারণে হালদার বাবুও চুপ হয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ দু'জনে আবার নীরব রইলেন। এবার হালদার বাবু বারদুয়েক গলা খাকারি দিয়েও পরিষ্কার না হওয়ায় কিছুটা আরষ্ট গলায় বলে উঠলেন,
-একটা কথা বলবো বলে এসেছিলাম। কিন্তু বলতে যে বড্ড সংকোচ হচ্ছে রুস্তম ভাই ...
এতক্ষণে দাদা যেন নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। মুখের কোনে এক টুকরো হাসি নিয়ে বলে উঠলো,
- বাবু আপনি নিঃসংকোচে বলতে পারেন। তবে আপনি কি বলতে চাইছেন, বিষয়টা আমার কাছে অবোধ্য নয়। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে হয়তো আপনাকে আমার খোঁজে এতদূরে আসতে হতো না। উল্লেখ্য আপনার ওখান থেকে এসে নিজের বাড়িতে কিছুতেই মন বসছিল না। আপনি বড়খোকার কাছ থেকে ইতিমধ্যে শুনেছেন কিনা জানিনা। ওর মা চলে যাওয়ার পর থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে এতটাই খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিলাম যে তা ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। অথচ আমি জানতাম আমার অনুপস্থিতিতে দোকানের কাজকর্ম সমাধা করা আপনার পক্ষে বেশ সমস্যার হতে পারে। উল্লেখ্য একটা কথা আপনাকে বলার সাহস হয়নি কোনদিন। শেষের দিকে ওর মা প্রায়ই বলতো, বয়স হয়ে গেছে এখন যেন আমি শহরের কাজটি ছেড়ে দেই। আমি অবশ্য ওর কথায় শুরুতে খুব একটা আমল দিই নি। শরীর ঠিকঠাক চলছিল বলে প্রায়ই হেসে উড়িয়ে দিতাম। তবে আমারও যে একেবারে সায় ছিল না তা নয়। সারা জীবন বাইরে থেকে কাজ করেছি। এবারে বড় খোকাকে সব বুঝিয়ে চলে যাব বলে ভিতরে ভিতরে তৈরি হচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই সবকিছু তালগোল পাকিয়ে চলে গেল। সাথে সাথে পরিস্থিতি যে দ্রুত বদলে যাবে তা কল্পনাই করতে পারিনি।
পরিবেশটা আবার থমথমে হয়ে গেল। দাদা মুখ নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে রইল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হালদার বাবু দাদার কথারই মান্যতা দিয়ে সান্ত্বনার সুরে বললেন,
-যা কপালে ছিল সেটা তো হয়েই গেছে রুস্তম ভাই। যদিও প্রসঙ্গটা উত্থাপন করাই আমারই ভুল হয়ে গেছে। শুধু শুধু পুরানো কথা মনে করিয়ে তোমার মনটা ভারাক্রান্ত করে দিলাম।
-না না এজন্য দুঃখের কি আছে, দাদা বলে উঠলো।
হালদার বাবু আবারও বললেন,
-তুমি যে জানো না তা নয়। তবুও বলছি,আমাদের সবাইকে একদিন পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হবে। কাজেই আর পিছনে ফিরে তাকানো ঠিক হবে না। তুমি বুদ্ধিমান মানুষ। ইতিমধ্যে সমস্যা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছ। কাজকর্মে মনদিয়ে আবার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা কর। বাকিটা তো উপরওয়ালার উপর ছাড়তেই হবে।
-হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন বাবুমশাই। কাজকর্মে থাকলে বরং ভালো থাকা যাবে। বাড়িতে বসে না থেকে এই কারণে গ্রামের টুকটাক বাঁশের কাজ করছিলাম।
-কাজই যখন করছ, তাহলে তোমার পুরানো জায়গায় নয় কেন রুস্তম ভাই? তুমি গুণী মানুষ; বাঁশের কাজ করা তোমার মানায় না। দয়াকরে আমাকে ফিরিয়ে দিও না। তুমি তো জানো, ব্যবসা নামেই ছিল আমার;সবই তোমার। যে কারণে তোমার অনুপস্থিতিতে ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম। তুমি আবার আগের মতো ভার নাও। অদক্ষ হাতে আমি আর ওসব দায়িত্ব সামলাতে পারছি না।
-বুঝতেই পারছি বাবু আপনার অসুবিধার কথা। তবে আমি অনেকটা বেকায়দায় পড়েছি। অস্বীকার করব না যে আমার মন আপনাদের ওখানে বাঁধা ছিল বা এখনও আছে। আপনাদের যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি তাতে আমি চীরকৃতজ্ঞ। আবারো ফিরে যাওয়ার কথা আমি যে ভাবিনি তা নয়। কিন্তু বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি। মনের শক্তি যে সব হারিয়ে ফেলেছি বাবু মশাই।
সেদিন দুজনের মধ্যে আরও অনেক আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু পরের দিকে সেসব কথা আমার আর ভাল লাগছিল না। হালদার বাবুর প্রস্তাবে শুরুতে দাদার সঙ্গে আবার কাজে যাওয়ার সুযোগ আমার কল্পনালোকে শহরে কাজে যাওয়ার স্বপ্ন চিকচিক করে ওঠে। প্রথমদিকে দাদা রাজি না হওয়াতে ভিতরে ভিতরে বেশ মুষড়ে পড়েছিলাম। দাদার উপর অসম্ভব রাগ হচ্ছিল এসময়। এমন অপ্রত্যাশিত কাজের সুযোগ নষ্ট হতে চলেছে দেখে কিছুটা বিরক্ত হয়ে আমি বাড়ির ভিতরে চলে আসি। বেশ কিছু সময় পরে আবারো ফিরে ফিরে যাই পূর্বস্থলে। গিয়ে বুঝতে পারি ওনার অনুরোধ দাদা ফেলতে পারেনি। অবশেষে শহরে কাজে যেতে রাজি হয়েছে। তখন এক অদৃশ্য যুদ্ধজয়ের অনুভূতিতে মুগ্ধ হয়ে ভিতরে ভিতরে উল্লসিত হই। কার্যত এক অনাবিল আনন্দে আমার কল্পলোকে আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায়।
বাবুর চলে যাওয়ার কয়েকদিন পর স্থানীয় কাজগুলো যতটা সম্ভব শেষ করে দাদার সঙ্গে আমিও রওয়ানা দেই। বিগত কয়েক দিন ধরে খুব শিহরিত ছিলাম দ্বিতীয়বার কাজে যাওয়ার জন্য। বারবার এ সময় দাদির কথা মনে পড়ছিল। অথচ আমাকে কাজে নিয়ে যাওয়া নিয়ে মানুষটার জীবদ্দশায় দাদার সঙ্গে শেষের একদিন কি তুমুল ঝগড়াটাই না হয়েছিল।।আজ বেঁচে থাকলে কি খুশিই না হতো মানুষটা। শহরে দ্বিতীয় বার রওনা হবার দিনে একটা ঘটনা আজও ভোলার নয়। ঠিক যে সময় বার হব,এমন সময় সামনে আসমাকে দেখে বিষণ্ণতার অঘোর ছায়ায় মনটা ভারাক্রান্ত হয়। কেমন একটা মায়াবী চাহনি নিয়ে কামরার মুখে এসে ঈষৎ কাৎ হয়ে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটি।দাদা তখন কি একটা কাজে বাইরে বের হয়েছিল। শুরুতে এমন ভঙ্গিতে ওকে দেখে আমার গলা শুকিয়ে যায়; মুখের কথা যায় আটকে। অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ি।কোন হাতামাথা না পেয়ে অসহায় ভাবে কিছু একটা বল বলার জন্যই যেন ওকে বলি,
-আসমা আমি দাদার সঙ্গে শহরে কাজে যাচ্ছি শুনেছিস?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নীরবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।ওর ওই নিরাবতাই যেন আমাকে বেশি কুঠারাঘাত করে। মনে হল যেন কিছু একটা বলবে।
-আসমা কিছু বলবি?
এবার ও পাল্টা আমাকে জিজ্ঞেস করে,
-তুই আবার আমার মায়ের মতো একেবারে হারিয়ে যাচ্ছিস না তো মাহমুদ ভাই?
ওর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে যাই।
-আরে নারে। আমি তো কাজ করতে যাচ্ছি রে। কিছুদিন পরে আবার বাড়ি চলে আসবো।
ও আবার জিজ্ঞেস করে,
-ঠিক চলে আসবি তো মাহমুদ ভাই?
এবার আমি ওর থুতনি ধরে নাড়া দিয়ে বলি,
-হ্যারে হ্যাঁ পাগলি হ্যাঁ। ঠিক চলে আসবো।
-তাহলে একটা কথা রাখবি?
-কি কথা?
- আমার মাকে ওখানে পাওয়া যায় কিনা একটু খোঁজ নিবি?
মাতৃহীন মেয়েটার এমন আবদারে কি উত্তর দেব ভেবে বিচলিত হয়ে পড়ি। কিছুটা আমতা আমতা করে,
-আচ্ছা ঠিক আছে,দেখবোরে...
আসমার সঙ্গে কথা বলাকালীন বাইরে থেকে দাদার ডাক কানে এলো। আমি সাড়া দিয়ে বেরিয়ে এলাম। বারান্দায় উঠে দেখি ততক্ষণে মা পান্তাভাত বেড়ে বসে আছে।পাশে আরেকটি চাচাইয়ে জহরের খাওয়া মাঝপথে। আমরা দুজনে পাশাপাশি আরও দুটি চাটাইয়ে বসে পড়লাম।মা আসমাকেও খেতে বলেছিল। কিন্তু ও আমাদের চলে যাওয়ার পরে খাবে বলে জানিয়েছিল। যাইহোক পেটভরে খেয়েদেয়ে সকাল সকাল আমরা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিই।
পথে আসতে আসতে বারে বারে আসমার করুন মুখচ্ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যে আনন্দে যাত্রা করব ভেবেছিলাম, ক্রমশঃ পরের দিকে এক নিদারুণ যাতনা যেন আমাকে আবিষ্ট করে ফেলে। একদিকে ভালো যেমন লাগছিল ওর কথা ভেবে; সঙ্গে মনে মনে কিছুটা ব্যস্ত হই দ্রুত গ্রামে ফেরার কথা চিন্তা করে। কিন্তু পরক্ষণেই এক বিষণ্ণতা যেন আমাকে গ্রাস করে। অসহায় বোধ করি,গ্রামে ফিরলে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলে কিইবা উত্তর দেবো মেয়েটার। দ্বিতীয়বার শহরে ফিরে শত ব্যস্ততার মধ্যেও এই যাতনা দোটানা ছায়ার মতো সমানে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে।
হালদার বাবুর দোকানটা দোকান হলেও অনেকটা কাঠগোলার মতই ছিল। আবার কাঠগোলা হলেও ছিল অনেকটা দোকানেরই মত। হরেক কিসিমের কাঠ চারিদিকে ডাই করে সাজানো থাকতো। কাঠের সম্ভার প্রচুর হলেও বিভিন্ন রকম আসবাবপত্রও তৈরি করে বিক্রি করা হতো। সেদিক থেকে একে আবার দোকানও বলা যায়। এলাকার লোকেরা অবশ্য কাঠগোলা বলেই জানত। আমার ব্যক্তিগত অভিমত ব্যাপ্তির দিক থেকে এবং কাঠের প্রাচুর্যের কারণে এলাকাবাসীর মতই কাঠগোলা বলাই সঙ্গত। যাইহোক দাদার অনুপস্থিতিতে বাপজানই কাঠগোলার বা দোকানের হেডমিস্ত্রিতে পরিণত হয়েছিল। যদিও বাপজান কখনোই দাদার বিকল্প হতে পারেনি। অন্তত হালদার বাবুর কথাতেই সেরকম ইঙ্গিত ফুটে উঠেছিল। দাদা ফিরে আসায় সকলে মিলে আবার নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু করে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে আর একজনের নাম উল্লেখ না করলেই নয় সে হল স্বপন কাকা। দাদার অনুপস্থিতিতে হালদার বাবু হয়তো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন কিন্তু মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এই স্বপন কাকা। দাদার জন্য প্রায়ই নাকি বাপজানের কাছে হা-হুতাশ করে বিষন্নতা প্রকাশ করত। সম্ভবত সে কারণেই দাদাকে ফিরে পেয়ে স্বপন কাকার উচ্ছ্বাস ছিল সর্বাধিক, চোখে পড়ার মতো।
এ প্রসঙ্গে স্বপন কাকার পূর্ববর্তী জীবনের দু-চার কথা না বললেই নয়। একেবারে শৈশবেই কাকা বাবা-মাকে হারিয়েছিল। বড় বড় দাদারা থাকলেও তারা ছিল ছোট্ট ভাইটির প্রতি চূড়ান্ত উদাসীন।খাওয়া-দাওয়া না পেয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতো। এমনই চূড়ান্ত অবহেলার মধ্যে কোন এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে হালদার বাবুর দোকানে স্বপন কাকার কাজের সন্ধান হয়।বয়সে কাকা ছিল সে সময় খুবই ছোট্ট। বাপ-মা হারা ছোট্ট ছেলেটিকে এমন কচি বয়সে কাজে আসতে দেখে দাদাও নাকি খুব আবেগ তাড়িত হয়ে পড়ে। প্রথম প্রথম নাকি দাদা ওকে কাজে না লাগিয়ে সারাক্ষণ চোখে চোখে আগলে রাখতে। খাওয়ান-দাওয়াত করাত নিজের হাতে।রাতে ঘুমাতোও দাদার পাশে। বহুদিন পর্যন্ত দাদা এভাবে কাকাকে আগলে রেখেছিল।ফলে একটু বড় হতেই দাদার মধ্যে স্বপন কাকা পেয়েছিল প্রকৃত বাবার সন্ধান। একই সঙ্গে পাশে বাপজান থাকলেও দাদা স্বপন কাকাকেই নাকি বেশি ভালোবাসতো। বাপজানও এসব বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে উল্টে ছোট্ট ভাইটিকে খুব আপন করে নিয়েছিল। সম্ভবত বাপ-মা হারানোই কাকার প্রতি দাদার প্রবল অপত্যস্নেহ তৈরি হয়েছিল। অথচ এই হালদার বাবুও নাকি শুরুতে বয়সে খুব ছোট্ট হওয়াতে স্বপন কাকাকে কাজে নিতে চাননি।দাদার ছত্রচ্ছায়ায় কাকা বড় হচ্ছেন দেখে হালদার বাবু একারণে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। পরের দিকে দাদাকে প্রায়ই বলতেন,
-স্বপনকে তুমি এমন ভালোবাসা দিয়েছ যে বুড়ো বয়সে নিজের ছেলেরা ফেললেও তোমার কোনো চিন্তা নেই। স্বপন তোমাকে চিরকালই আগলে রাখবে রুস্তম ভাই।
দাদাও হাসতে হাসতে উত্তর দিত,
-স্বপন আমারই ছেলে বাবু। ছেলেবেলার হারিয়ে গেছিল, ভাগ্যগুণে ওকে আবার ফিরে পেয়েছি। একটা ভালো সম্বন্ধ দেখে সংসারী না করানো পর্যন্ত আমার শান্তি নেই বাবু।
সংসারের কথা উঠলে স্বপ্ন কাকা লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকতো বা অন্য দিকে চলে যেত।
দাদা আরও বলতো,
-স্বপনকে এমন কাজ শিখিয়ে দেবো যে শুধু একজন মিস্ত্রি নয়, প্রকৃত একজন কাষ্ঠশিল্ফী হয়ে সারা জীবন যেন সুনাম অর্জন করতে পারে।
এমনই একটা মধুর পরিবেশে কয়েক বছর পর ঘটে গেল মারাক্তক একটা অঘটন......
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-পোস্টটি সামুর নির্বাচিত পাতায় স্থান পাওয়ায় প্রেরণা বোধ করছি। কৃতজ্ঞতা জানাই কাল্পনিক ভালোবাসা ভাইকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ১০:৩৬