পূর্ব সিদ্ধান্ত মতো পরের দিন সকালবেলা স্বপন কাকা রওয়ানা দেয় শহরের উদ্দেশ্যে। সেদিন সকালে কাকার চলে যাওয়ার সময়টা যতই এগিয়ে আসতে থাকে ততোই আমার মনজগৎকে অন্ধকারের করালছায়া আচ্ছন্ন করে ফেলে। অস্বীকার করবো না যে একটানা বেশ কিছু দিন থেকে স্থানটির প্রতি আমার কিছুটা বিতৃষ্ণা বা একপ্রকার একঘেয়েমি তৈরি হয়েছিল। আগের রাতে আমাকে সঙ্গে নেওয়ার সম্ভাবনা নির্মূল হলেও তবুও আশায় ছিলাম যদি শেষ মুহূর্তে কারো একজনের মত পরিবর্তন হয়; কিছুটা হলেও এই একঘেয়েমির অবসান ঘটবে এই আশায়। কিন্তু নাহা! চোখের সামনে স্বপন কাকা চলে গেল কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা একজনেরও একবারের জন্যও মনে পড়লো না কিংবা হয়তো ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ তুললো না। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন। নিজের কষ্টকে আপ্রাণ অন্তরে লুকানোর চেষ্টা করে গেছি। জানিনা আমাকে সকলের বিশেষ গুরুত্ব না দেওয়ার কারণ আমার এই রোগা পটকা চেহারাটি কিনা। রোগা টিংটিংয়ে শরীরের কারণে হয়তোবা আমি বড় হয়েছি বলে কেউ মানতে চায় না। কিম্বা আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার ভালো লাগাকে যে কারণে কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না।কি আর করার। অগত্যা কাকার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া যে উপায় নেই।
কাকা চলে যাওয়ার খানিক বাদেই অন্যান্য দিনের মতো আমরাও ফুপুদের জমিতে চাষের কাজে চলে যাই। একপ্রকার বাধ্য হলেও বেশ ভালই লাগছিল হঠাৎ শহরের কাঠের কাজকর্ম ফেলে রেখে সকলের এভাবে গ্রামে চাষাবাদের কাজে নিয়োজিত হওয়া। বলাবাহুল্য নুতন পরিবেশে এটাই ছিল আমাদের নিত্য কার কর্মসূচি। দেখতে দেখতে ইতিমধ্যে প্রায় কুড়ি-বাইশ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। ফুপুদের বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে কাজ করতে করতে আমাদের দিনগুলি বয়ে যাচ্ছিলো। দিনের অন্য সময়গুলো না লাগলেও বেশ ভালোই লাগছিলো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কাজের সময়টা।বলা ভালো এখানেও আমাদের একটা নুতন জীবন শুরু হলো।
দিনের কাজকর্ম শেষ করে দলুজ ঘরে ফিরে গোসল সেরে নিয়ে আবার রান্নাবান্না করতে হতো। অন্য দিন গুলোতে কাজটা স্বপন কাকা করায় তেমন মালুম হতো না। কিন্তু আজ দাদা হাত লাগায়।স্বপন কাকার প্রত্যাগমনের খুশিতেই বোধহয় দাদাকে বেশ চনমনে লাগছিল। তাই আগ্রহভরে বাপজান, নুরুল চাচাকে না ডেকে নিজেই সামান্য খড়কুটোর ছাউনি দেওয়া রান্নার হেঁসেলে ঢুকে পড়ে। কিন্তু বয়সের বাঁধা যে কাউকে রেয়াত করেনা। তাই মন চাইলেও দাদার শ্লথ গতি যেন অদক্ষতা বা ন্যুজ ভারের সাক্ষ্য বহন করে। চোখের সামনে দাদার এমন অবস্থা দেখে মূহুর্তে ভিতরটা বিগলিত হয়। আমি ওনাকে কিছুটা শাসন করার সুরে ধমক দিয়ে পাশে স্রেফ বসে থাকতে বলে এগিয়ে যাই।অবশ্য ইতিপূর্বে বাপজানও তেমনি চোখের ইশারা করেছিল। দায়িত্ব ছাড়তে অবশ্য দাদা সামান্য আপত্তি করেছিল। আমি সে আপত্তিকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। নিজের হাতে রান্না করতে গিয়ে বুঝতে পারি স্বপন কাকা কত সহজেই না দিনের পর দিন অত্যন্ত নিপুন ভাবে কাজটি সামলে আসছে। সেদিন দুপুরে কোনক্রমে রান্নাবান্না শেষ করলেও নিজের দায়িত্বে রাতে আবার রান্নাবান্না করতে হবে ভেবে অগ্রিম আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।অথচ বিকল্প বলতে স্বপন কাকা। কাজেই আমার দিক থেকে কাকার প্রত্যাবর্তনের জোড়া তাগিদ ছিল তা অস্বীকার করতে পারিনা।
গোটা বিকেল ধরে আমরা কাকার ফেরার অপেক্ষায় থাকি। অথচ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো তবুও স্বপন কাকা আর ফিরলো না। ইতিমধ্যে রাতজাগা পাটি দলুজের সামনে জমায়েত করতে শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে স্বপন কাকার না ফেরাটা আমাদের সকলের কাছে খুবই দুশ্চিন্তার হয়ে দাঁড়ায়। শুরুতে গ্রামবাসীদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কিন্তু একটু রাত বাড়তেই পরিস্থিতি ভয়ানক হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এভাবে নিজের ছেলে বা নাতিকে না পাঠিয়ে আত্মীয় স্বজনহারা ছেলেটাকে চূড়ান্ত বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য দাদাকে সরাসরি দায়ী করে।তারা দাদাকে প্রশ্ন করে,নিজের ছেলে হলে এভাবে একাকি ছেড়ে দিতেন কিনা..।দাদা হাতজোড় করে তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু তারা কোন যুক্তি শুনতে চাইছিল না। আমার একবার মনে হচ্ছিল স্বপন কাকার আসল পরিচয় তুলে ধরি। কাকার হিন্দু পরিচয় জানলে হয়তো ওদের আক্রোশ অনেক কমতে পারে। বাপজানকে নিচু স্বরে একথা বলতেই ধমকের সুরে আমাকে থামিয়ে দেয়। আমি তোতার মুখ ভোতা করে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকি। নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আমরা সবাই তখন মুষড়ে পড়ি। মনে মনে প্রমাদ গুনি অসম্মান অপমান যাই হয় হোক। কিন্তু স্বপন কাকা যেন নিরাপদে নির্বিঘ্নে ফিরে আসে- এটাই আমাদের প্রার্থনা।
পরিস্থিতি থেকে সহজেই অনুমেয় যে সেদিন আমরা এক ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়ি।চূড়ান্ত হেনস্তার শিকার হতে হতে কোনক্রমে আমরা সে সময় রক্ষা পাই। আমাদের সকলকে যে বেঁধে ধরে পিটুনি দেয় নি এটাই যা ভাগ্যের ব্যাপার। জনরোষ কাকে বলে সেদিনই প্রথম টের পেয়েছিলাম। চূড়ান্ত হৈহট্টগোল করে অবশেষে রাতজাগা পাটি পাহারা দিতে নিজেদের গন্তব্যস্থলে চলে যায়। আমরাও ততক্ষনে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। তবে ওরা চলে গেলেও আমাদের দুর্ভাবনা দূর হয়নি। যাওয়ার আগে আগামী কাল আমাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে যায়। দাদা নিরুপায় হয়ে আরও কয়েকটি দিন থাকতে প্রার্থনা করলেও ওরা কর্ণপাত করেনি। দাদা বারবার হাতজোড় করে বলতে থাকে, আমরা চলে গেলে ছেলেটা ফিরলে আমাদের সঙ্গে চিরতরের মতো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বাবারা কটা দিন আমাদেরকে আর একটু থাকতে সুযোগ দাও। কিন্তু তখন কে শোনে কার কথা। নিজের ছোট্ট বুদ্ধিতে বুঝতে পারি,কথার গুরুত্ব থাকলেও নিজেদের দোষে সবকিছু যেন পাল্টে গেছে।ঐ রাতে আমরা আর রাত পাহারায় যাইনি। চুপচাপ বসে পরেরদিন সকালে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকি।
প্রবল দুশ্চিন্তায় ও হতাশা আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। রাতে খাওয়ার কথা কারো মাথায় আসেনি। অভুক্তের সঙ্গে জুড়ি বাঁধে অনিদ্রা। সে রাতে আমরা কেউ চোখের পাতা এক করতে পারিনি। অন্য দিনগুলোতে আমরা কোনো না কোনো দলের সঙ্গে রাত পাহারায় যেতাম। কিন্তু আজ অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ায় ওরাও কেউ বলেনি বা আমরাও পাহারা দেওয়ার আগ্রহ দেখায়নি। দলুজের বারান্দায় বসে বসে কেবল একে অপরের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ বিনিময়ের মাধ্যমে সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। শেষ রাতে দূর থেকে আবার একটা গুঞ্জন ভেসে আসে। পরিচিত শব্দ। ক্রমশ সেটা স্পষ্ট হয়। বুঝতে পারি অন্যান্য দিনের মতোই রাতজাগা একটা পার্টি বাড়ি ফিরছে। কিন্তু দলুজের সামনে এসে ওরা থেমে যায়। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ। দাদা মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
-বাবারা তোমরা কি কিছু বলবে?
এবার বেশ শান্ত গলায় একজন এগিয়ে আসে।
-হ্যাঁ বলবো বলেই এসেছি চাচা। আপনারা আজকেই চলে যাচ্ছেন তো?
-হ্যাঁ বাবারা তোমরা তো কালকে তেমনই বললে। আমরা আজ সকালেই না হয় এখান থেকে চলে যাব।
এবার লোকটি বেশ ধমকের সুরে বলে,
-চলে যাব বললেই তো চলে যাওয়া যাবে না। নাহা আপনারা এখন এখান থেকে যেতে পারবেন না। আমরা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি বয়স্ক মানুষ দলুজঘরে একাকী থাকবেন। আপনার দলের বাকি সদস্যরা ওকে খুঁজতে বের হবে।না পাওয়া পর্যন্ত আপনারা গ্রাম ছাড়তে পারবেন না।
দাদা যন্ত্রের মত মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো,
- বেশ তাই হবে। তোমরা যেটা ভালো মনে করবে সেটাই করব বাবা।
নতুন ফরমান পেয়ে সেদিন ভোররাতেই আমরা যে যার মত গন্তব্যস্থল ঠিক করে নিয়েছিলাম। কিন্তু সকাল হতেই সব গেল বিগড়ে। বুঝতেই পারছি গতকাল থেকে মাথার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। যদিও সে ঝড় এখনো শেষ হয়নি। জানিনা কাকাকে ফিরে পাওয়া না গেলে আরো কত দুর্ভোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় আমরা একরকম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। বোধহয় এসব ভাবনা চিন্তা করতে গিয়েই দাদা সামলাতে পারলো না। সকাল থেকে কেমন অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। উদাসভাবে বসে আছে।কোন দিকেই ভ্রুক্ষেপ নেই। বুঝতে পারছি না এখন আমাদের করণীয় কি? দাদাকে নিয়ে এই মূহুর্তে আমরা কি করব বলে গোল হয়ে যখন তিন জন বসে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। ঠিক তখনই আবার একটি ওই হট্টগোল স্পষ্ট হয়। আমরা আবার আতঙ্কিত হয়ে পড়ি কিজানি আবার না নুতন করে কি ব্যবস্থাপনা আমাদের উপর প্রয়োগ হয়...
বিশেষ দ্রষ্টব্য:- বহুবিধ কারনে অনেকদিন ব্লগে অনিয়মিত হয়ে পড়েছিলাম। যদিও চলমান অতিমারির সংকটে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বর্ণনার অতীত। ব্লগিং করার পক্ষে একেবারেই অনুকূল নয়। এমতাবস্থায় একান্তই মনের বিরুদ্ধে গিয়ে পোস্ট দেওয়া। অসংখ্য টাইপো থাকতে পারে । আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। একইসঙ্গে সময়ে প্রতিমন্তব্য না দিতে পারলে অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৯:৪৪