ইসলামাবাদ থেকে দিল্লীর ট্রেন ধরলেও রফিক ভাইয়ের কোন পরিবর্তন চোখে পড়লো না। কিছুতেই যেন স্বাভাবিক হতে পারছিল না মানুষটা। আসার সময় আফগানিস্তানের মধ্যেও যে আতঙ্ক চোখে মুখে ছিল তার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন চোখে পড়লো না। মাঝে বহুসময় আমাদেরকে ইসলামাবাদ স্টেশনে গাড়ির অপেক্ষায় থাকতে হয়েছিল কিন্তু সে সময়েও রফিক ভাইয়ের মনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরাবরই আমার থেকে বেশ কিছুটা দূরে বসেই কাটিয়ে দেয়। পাকিস্থানে এসেও ওর এই পরিবর্তন না হাওয়ায় প্রথমে অবাক হলেও পরে বেশ বিরক্ত হই। খুবই হতাশ লাগছিল ওর আচরণ দেখে। বারে বারে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল মানুষের এমন দুমুখো আচরণ হয় কী করে। এই সেই লোক যে কিনা আমাকে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে স্বামীর পরিচয় দিয়ে পুলিশের খপ্পর থেকে বাঁচিয়েছে। অথচ সেই লোকটাই যেন এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অপরিচিত দুঃসম্পর্কের কেউ। বিষয়টা স্পষ্ট যে একটা আতঙ্ক যেন সারাক্ষণ লোকটাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। অথচ কিসের ভয় বা কিসের আতঙ্কে এমন অস্বাভাবিকতা, জানতে চাইলে মুখে কিছু না বলে উল্টে আরো কিছুটা সরে যায়। বুঝতে পারি কিছু একটা সমস্যা নিশ্চয়ই ওর আছে যেটা আমার কাছে বলার নয়। তবে কারণ যা-ই হোক আমার অবশ্য খুবই অসহ্য লাগছিল। একসময় তো বলেই ফেলি,
- আচ্ছা রফিক ভাই,খালি খালি আমাকে সঙ্গ দিয়ে সময় নষ্ট না করে বরং তোমার যদি দরকারি কাজ থাকে তো ফিরে যেতে পারো। সাক্ষাৎ দোজখ থেকে থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছ, এটাই বড় উপকার করেছ। জন্ম-জন্মান্তর তোমার ঋণ শোধ করতে পারবো না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি, আপাতত আমার সামনে আর কোনো ভয় নেই। বাকি পথ আমি একাকিই যেতে পারবো। তুমি বরং এখন আফগানিস্তানে ফিরে যাও। ওখানে তোমার এখনও বহু কাজ বাকি আছে।
আমি আমার মতো কথাগুলো বললেও রফিক ভাইয়ের কানে ঢুকেছে বলে মনে হলো না।উদাস হয়ে একবার আমার দিকে আবার অন্যমনস্কের ন্যায় বাইরে তাকিয়ে থাকে। এর আগে আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের বর্ডার অতিক্রম করার সময় আমরা পারতপক্ষে নিজেদের মধ্যে যতটা সম্ভব কম কথা বলার চেষ্টা করেছি। মানলাম তখন না হয় একটা কারণ ছিল। কিন্তু ইসলামাবাদে পৌঁছেও মুখ এমন প্যাঁচার মতো হাঁড়িরতলা করে থাকা বা ওখান থেকে দিল্লির ট্রেনে একই ভাবে দূরে দূরে থাকার তো আর যাই হোক কোনো কারণ থাকতে পারে না। কেন জানিনা আত্মীয়তার সূত্রে ও যে আমার একজন আপনজন তখন এমন মনেই হচ্ছিল না। যদিও আমার দিক থেকে ওকে স্বাভাবিক করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি। বেশ কয়েকবার আগবাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু ও প্রত্যেকবারই আমার কথার উত্তর না দিয়ে নীরব থেকে গেছে। বুঝতে পারি ওর ইচ্ছা নেই আমার সঙ্গে কথা বলার।কি আর করার, উপায় না পেয়ে আপন মনে বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে সময় কাটিয়েছি। মনে মনে ভাবি এইযে আমাকে মৃত্যুপুরী থেকে উদ্ধার করেছে এটাই বা কম কিসের।তাই কথা বলতে না চাইলেও পরের দিকে বিষয়টিকে মেনেই নেই।
দিল্লিতে পৌঁছে বেশ কয়েকবার আমার দিকে তাকাতেই মনে হয় কিছু একটা বলতে চাইছে। প্রথমে অবশ্য আমি পাত্তা দেইনি।রাগ হয়েছিল বেদম ওর উপরে। কিন্তু একসময় আর না থাকতে না পেরে আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করি,
- কি হলো, কিছু বলতে চাও?
-হ্যাঁ বলতে তো চাই.... কিন্তু বলা যে খুব সহজ হচ্ছে না...
-কেন সহজ হচ্ছে না? আমি বাঘ না ভাল্লুক? আমার মতো একটা কুলহীন নষ্ট মেয়ের কাছে আবার কিসের লজ্জা তোমার?
-আসলে আমাকে এবার ফিরতেই হবে রমিসা।
-সে তো আমি অনেক আগেই বলেছি তোমাকে ফিরে যেতে। খামোখা পড়ে থেকে সময়গুলো নষ্ট করছ কেন? আর তাছাড়া আমি তো তোমাকে আটকে রাখি নি।
মনে মনে বুঝতে পারি, দিল্লিতে পৌঁছে দিয়ে রফিক ভাইয়ের দায়িত্ব শেষ। বাকি রাস্তা আমাকে আমার মতোই ফিরতে হবে। অবশ্য আমি মনের দিক থেকে আগে থেকেই তেমনই ভেবে রেখেছিলাম।
কিন্তু রফিক ভাই সে প্রসঙ্গে না গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করে,
-এখন কোথায় যাবি বলে ভেবেছিস রমিসা?
-কোথায় যাবো মানে? যে করেই হোক হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে গ্রামে যাব বাপের বাড়িতে।
-না রমিসা না।তুই আর ওখানে ফিরে যাসনা।তোর গ্রামে ফেরার রাস্তা অনেকদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।ওরা তোকে মেরে ফেলবে।
-মেরে ফেলবে মানে!কে আমাকে মেরে ফেলবে?
আমার মাথায় তখন সত্যিই আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।দম বন্ধ হয়ে আসে। মূহুর্তে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।বার বার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে কথাটা, 'মেরে ফেলবে মেরে ফেলবে'।কি করবো, কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এখন আমার করণীয়ই বা কি। একেবারে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ি। খুবই অসহায় লাগতে থাকে এসময়। হতাশায় নিজের চুল নিজেই ছিঁড়তে থাকি। সম্পূর্ণ পাগলের মতো দশা হয় আমার। মনে হচ্ছিল, তখনই নিজেকে শেষ করে ফেলি। প্লাটফর্মের মেঝেতে বসে বসে এভাবে বেশ কিছু সময় পার হয়। খানিক বাদে কিছুটা নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চাই,
-আচ্ছা আমার গ্রামে ফেরার রাস্তা বন্ধ হল কেন?
উত্তরে জানায়,
-মুজাহিদ মেয়েরা বাকি জীবনে কেউ আর ঘরে ফেরে না। অথবা ফিরলেও বাবা মায়েরা তাদেরকে ঘরে তোলে না। বিষয়টা খুবই দুর্ভাগ্যের, খুবই নির্মম পরিণতি হয় তাদের।
আব্বা-মা হয়তো বা জানে না ভেবে আমি মরিয়া হয়ে আবার জিজ্ঞেস করি,
-কিন্তু আমার মুজাহিদ হওয়ার ঘটনা তুমি ছাড়া আর তো কেউ জানে না। সেক্ষেত্রে তুমি যদি গোপন করে যাও তাহলে তো আর সমস্যা দেখি না।আর তাছাড়া এর পিছনে আমার তো কোনো হাত ছিল না। এক্ষেত্রে আমার অপরাধ কোথায়? আমিতো পরিস্থিতির শিকার হয়েছি মাত্র।
রফিক ভাইকে দেখলাম মুখ ভার করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কোনো কথা নেই দেখে আমার রাগ সপ্তমে চড়ে যায়। এমনিতেই এতোক্ষণ কান্নায় চোখ বুঁজে আসছিল। যে কারণে কথাগুলো বলার সময় বারে বারে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল।তার উপর ওর নীরবতা আমাকে ক্ষিপ্ত বাঘিনীতে পরিণত করে। হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ি ওর উপর। গায়ের শক্তি ভর হাত ধরে তীব্র ঝাঁকুনী দিতে থাকি। জানতে চাই,
-তোকে বলতেই হবে বাড়িতে আমার জায়গা হবে না কেন?
বারতিনেক ঝাঁকুনির পর রফিক ভাই মুখ খোলে।জানায়,
-রমিসা তোর মুজাহিদ হবার খবরটি আমি সর্বপ্রথম আমার মায়ের কাছ থেকেই শুনেছিলাম। বেশ কিছুদিন আগের কথা, সেবার দেশে গিয়ে শুনি তুই আফগানিস্তানে গিয়ে মুজাহিদ হয়েছিস। তবে তার আগে মা তোর পালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছিল।মা আরো জানিয়েছিল তোর স্বামী তোদের বাড়িতে গিয়ে তোর আব্বা মাকে নালিশ করে আসে,তুই নাকি আফগানিস্তানে গিয়ে অন্য পুরুষের সাথে পালিয়ে গিয়েছিস। মুজাহিদ নাকি গোটা আফগানিস্তান জুড়ে তোকে খোঁজ করে না পেয়ে বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে আব্বা-মায়ের শরণাপন্ন হয়। তুলে ধরে নিজের অসহায়ত্বের কথা।বৌ হারিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা হয় নাকি ওনার। এখানে পর পুরুষের নাম করলে গ্রাম শুদ্ধ সবাই ছি ছি করবে; লজ্জায় মাথা কাটা যাবে ভেবে তোর আব্বা মা বিকল্প সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নিজেদের মান-সম্মানকে অটুট রাখতে কিম্বা তোর কেচ্ছাকে আড়াল করতেই জামাইয়ের পরামর্শে মুজাহিদের গল্প কথাতে আশ্রয় নেয় যে তুই ধর্মযুদ্ধের জন্য নিজেকে মুজাহিদ হয়েছিস। তবে ঘটনা যাই হোক, নিজেদের সম্মান বাঁচাতে আরো আশাব্যক্ত করে,এমন সন্তানকে হাতের কাছে পেলে কেটে দুটুকরো না করা পর্যন্ত নাকি ওদের শান্তি নেই।আর এই কাজে তোর আব্বা-মা যদি অপারগ হয় তাহলে তোর মুজাহিদ স্বামীই নিজ হাতে আব্বা মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করবে বলে তখনই ঘোষণা করেছিল।
রফিক ভাইয়ের মুখ থেকে এসব কথা শুনে আমার চোখ মুখ শুকিয়ে যায়। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠি,
-হায় আল্লাহ! একি শুনলাম! তাহলে এখন কোথায় যাব? এত বড় দুনিয়াটা! অথচ আমার কাছে সব বন্ধ? মনে হয় আমি এখন দুঃখের অতল সাগরে ডুবে আছি।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০২২ রাত ১১:৪৫