সিমলায় যাওয়ার জন্য স্থানীয় একটি ট্রাভেলিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করি। ওদের পরামর্শের মত রেল বুকিং কাউন্টার থেকে হাওড়া টু কালকা পর্যন্ত কালকা মেলের টিকিট ও কালকা থেকে সিমলা পর্যন্ত টয় ট্রেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ইতিপূর্বে একাধিকবার দার্জিলিঙে টয় ট্রেন দেখলেও চড়ার সুযোগ হয়নি। সিমলাতে সেই সুযোগটি চলে আসায় সে কারণে আমরা আর কাল বিলম্ব না করে এজেন্সিকে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেই। উল্লেখ্য আমরা দুজনেই টয় ট্রেনের ব্যাপারে শুরু থেকে খুব আগ্রহান্বিত ছিলাম। বিবাহিত নবদম্পতির কালকা মেলের অভিজ্ঞতার কথা আর পাঁচজন সাধারণ যাত্রীর মত আলাদা করে উল্লেখ করার কারণ না থাকলেও টয় ট্রেনের যাত্রার কথা না বললেই নয়। কালকা থেকে একশো কিমির অধিক দূরত্বের সিমলায় পৌঁছানোর জন্য টয় ট্রেনে পাঁচ ঘন্টার কথা বললেও বাস্তবে তা সাত ঘন্টারও বেশি লেগেছিল। সিমলা ট্যুরে আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল টয় ট্রেন। কাজেই ট্রেন যাত্রা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত ছিলাম। অস্বীকার করব না যে সে সময়ে আমি একপ্রকার ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সবকিছুই স্বপ্নের মনের মত লাগছিল।কালকা টয় ট্রেন স্টেশনটি ঠিক আর পাঁচটা সাধারণ ট্রেন স্টেশনের মতো নয়। একদিকে স্টেশন অন্যদিকে তার গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া শহরের ব্যস্ততম রাস্তা। স্টেশনের বিপরীত দিকে সারিবদ্ধ ভাবে বড় বড় গাছ। গাছগুলোর মাথায় উচ্চতা আবার একই রকমের। ভারী সুন্দর দৃশ্য।অদ্ভুত সুন্দর একটা স্টেশন।স্টেশনে চলাচলকারী লোকজনকেও ঠিক সাধারণ বলে মনে হয়নি।কত সভ্য ভদ্র তারা। কোথাও সামান্যতম জোরে চিৎকার চেঁচামেচি নেই।নেই কোনো ধাক্কাধাক্কি হুড়োহুড়ি বা হকারদের দাপাদাপি। এমনকি চোখে পড়ে নি কোনো ভিখারিও। ছবির মতো সাজানো স্টেশনটিতে এসেই প্রথম হাল্কা শীত শীত ভাব অনুভব করি।অথচ রেল যাত্রা পথে তার আগে পর্যন্ত গ্রীষ্মের দাবদাহে নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।যে কারণে এখানে এসে প্রথম হাল্কা শীত অনুভব করায় মনের মধ্যে আলাদা অনুভূতি তৈরি হয়। এলাকাটিকে আমার পরিচিত ভারতের সঙ্গে কোনো ভাবেই মেলাতে পারলাম না। আমি বিদেশে যাইনি কখনও। কাজেই বিদেশ দেখার কোনো প্রশ্ন-ই নেই।কালকাতে এসে আমার প্রথম মনে হলো, নাহা! এটা ভারত নয়; আমি যেন বিদেশের কোনো শহরে চলে এসেছি।
সম্ভবত সকাল সাড়ে এগারোটা বা বারোটার দিকে আমাদের ট্রেনটি যাত্রা শুরু করে। আমরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। এতক্ষণে আমাদের অপেক্ষার অবসান হলো।যাত্রা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে এবার শুরু হয় আরেক নুতন উন্মাদনা। প্রথমদিকে বেশ কয়েকটি স্টেশন পর্যন্ত আমাদের এই উন্মাদনা আনন্দের ফল্গুধারা হয়ে প্রবাহিত হয়। প্রত্যেকটা স্টেশন একদম ছবির মতো মনে হচ্ছিল। কি অপূর্ব সৌন্দর্য! সাজানো-গোছানো, কোলাহল বা হই হট্টগোলের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই কোথাও। দৃশ্যপটের মধ্যে নেই সামান্যতম নোংরাও। তবে রেল স্টেশনের তুলনায় টয় ট্রেনের স্টেশনগুলো যথেষ্ট ছোট্ট।যাত্রী সংখ্যাও তুলনায় খুবই কম। জনবসতির ঘনত্বও সমতলের তুলনায় যথেষ্ট কম হওয়ার কারণে কিনা জানি না পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এতটা সম্ভবপর হয়েছে। যাইহোক সুদীর্ঘ যাত্রাপথে অসংখ্য টানেলের সঙ্গে ছিল প্রচুর রেল ব্রিজ যারা মিলিতভাবে সর্পিল ভঙ্গিতে পাহাড়ের গা ঘেঁষে কোনো এক নৃত্য পটিয়সী নারীর ন্যায় কোমরের দুলকি চালে অপরূপ নৃত্যের মোহনীয় যাদুতে আমাদেরকে আবিষ্ট করে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। কাজেই সহজেই অনুমেয়, তার রূপের মাধুরী যাত্রাপথকে অনন্য সুন্দর মাত্রা দান করেছিল। প্রকৃতির সঙ্গে এখানে মনুষ্য সৃষ্ট এই রেলব্রিজের যেন এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। সঙ্গতকারণেই আলাদা করে এই রেল ব্রিজ উল্লেখের দাবি রাখে। উল্লেখ্য আমরা সমতলে যে রেল ব্রিজ দেখি তার সঙ্গে হিমাচল প্রদেশের রেল ব্রিজের যথেষ্ট পার্থক্য আছে। ছবির মতো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে অসংখ্য খাদ উপখাদকে যুক্ত করেছে সিমলাযাত্রা পথের এই রেল ব্রিজগুলো। ব্রিজগুলোর গঠনশৈলী রীতিমতো বিস্ময়কর। দেখে মনে হবে যেন পাহাড়ের কোলে ব্রিজগুলো ঝুলে আছে। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষকে অনেক ক্ষতি করেছে ঠিকই কিন্তু দুর্গম হিমালয়ের পাদদেশে ছোট বড় অসংখ্য জনপদ বা পাহাড়কে সুতোর মতো একসূত্রে গেঁথে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নির্মিত এই রেল পথের নির্মাতা হিসাবে তাদের কৃতিত্বকে আজও অস্বীকার করা যায়না ।তারা চলে গেছে সেই কবেই। কিন্তু আজও তাদের স্মৃতি সাক্ষ্য বহন করছে শতাব্দী প্রাচীন এই ব্রিজগুলো। এতো প্রাচীন! অথচ আজও তাদের গুরুত্ব এতটুকুও কমেনি। সম্ভবত এই কারণেই ইউনেস্কো থেকে এই রেলপথকে বর্তমানে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।যেতে যেতে মনে হচ্ছিল এই রেলপথে না চড়লে মানবজীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেতো।মনে মনে ধন্যবাদ দেই শ্বেতাকে।ও এমন জেদাজেদি না করলে এ পথে হয়তো বাকি জীবনে আসাই হতো না।
ট্রেনে উঠে প্রকৃতির রূপে মোহিত হয়ে সাময়িক ভাবে ভুলে যাই পাশে বসা সুন্দরী স্ত্রী শ্বেতার কথা। জানালার পাশে বসে তাকিয়ে ছিলাম পাশ দিয়ে অবিচ্ছন্নভাবে বয়ে চলা প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের দিকে। শ্বেতাও সম্ভবত আমার মতই বাইরের অপরূপ সৌন্দর্যের মায়াবী জাদুতে আটকে গিয়েছিল।যে কারণে দুজনের কারোর মুখে কোনো কথা ছিল না সে সময়ে। বেশ কিছুক্ষণ পর আচমকা কনুই এর গুঁতো খেয়ে আমার হুঁশ ফেরে। মনে হলো এতক্ষণ স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ শ্বেতার ডাকে যেন মর্তে নেমে এলাম। শ্বেতার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক, আনন্দের বিহ্বলতা। শিশুসুলভ সরলতায় জিজ্ঞেস করে,
-কি অপূর্ব না জায়গাটা?
আমি যন্ত্রের মতো মুখে কিছু না বলে, মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে জানালার কাঁচের ওপাশে বয়ে চলা প্রকৃতির অপরূপ শোভারাজীতে নিজেকে মগ্ন রাখি।
কালকা- সিমলা টয় ট্রেনের যাত্রাপথে অসংখ্য টানেলের কথা আগেই বলেছি। এই টানেলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় এক অসম্ভব মায়াবী পরিবেশ অন্তরকে মহোচ্ছন্নতায় ভরিয়ে দেয়। একটু দূরে বসা আমাদের ট্যুর কোম্পানির রাধুনী সহযাত্রী স্বপনকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো,
-এই লাইনে অসংখ্য টানেল আছে। টানেলের মধ্যে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় যাত্রাপথে এমন অন্ধকারের শেডগুলো মাঝে মাঝে চলে আসছে।
আগে থেকেই জানতাম কালকা-সিমলা টয় ট্রেনের বিশেষত্ব, এই লাইনে অনেকগুলো পাহাড় পড়বে ঠিকই। তাই বলে এমন পাহাড়কে এফোঁড় ওফোঁড় করে রেল চলবে! স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। যাইহোক এতক্ষণ পাহাড়ের দুপাশে অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা ও তার সঙ্গে রেল ব্রিজগুলোর মাধুরী দেখে বিমোহিত ছিলাম। এখন তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হল টানেল,যা কিনা পাহাড় ভেদ করে এগিয়ে চলেছে।স্বপনের কাছ থেকে টানেলের পরিচয় শুনে মনের আচ্ছন্নতা এক অসম্ভব প্রেমানুভূতিতে পরিনত হয়ে বিদ্যুৎ তরঙ্গের ন্যায় গোটা শরীর ও মনে প্রবাহিত হয়। টানেলের ভিতর তেমন আলোর ব্যবস্থা না থাকায় দিনের বেলায়ও এর মধ্যে একপ্রকার অন্ধকারাচ্ছন্নতা বিরাজ করে। হঠাৎ দু পায়ের উপর খুব ভারী কিছুর চাপ অনুভব করি। বুঝতে পারি শ্বেতা আমার কোলের উপর ঝুঁকে পড়েছে। আমিও ওর আবেদনে সাড়া দিয়ে ওকে পরম মমতায় দুবাহুর মধ্যে আগলে ধরি। এমন সময় আলো চলে আসতেই ও সোজা হয়ে বসে। উপস্থিত অন্যান্য যাত্রীরা মনে হয় না কেউ কিছু বুঝতে পেরেছেন। আর পারলেও তাদের বাহ্যিক আচরণে বা হাবভাবে তেমন কোন পরিবর্তন চোখে পড়লো না।
পরের দিকে এমন অন্ধকারের শেড চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে শ্বেতা চলে আসে আমার খুব কাছে। আমিও ওকে আরও কাছে টেনে নিই। ওকে এভাবে আবিষ্কার করতে পেরে আমি মনে মনে শিহরিত হই। কাজেই ট্রেনের মধ্যে আমরা অপ্রত্যাশিতভাবে কুড়িয়ে পাওয়া নুতন আনন্দে মেতে উঠি। প্রতিটি মুহূর্ত এ সময় মধুরতায় যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। পরেরদিকে এইভাবে টানেল এলে একে অপরকে জড়িয়ে হানিমুনের অগ্রিম স্বাদ উপভোগ করতে থাকি। কিন্তু হায়রে! আমাদের এই আনন্দ বেশিক্ষণ চলতে পারেনি। একটু দূরে বসা আমাদেরই ট্যুরের এক অধ্যাপক পত্নী বারেবারে আমাদের দিকে তাকিয়ে দুষ্টু দুষ্টু হাসি দিয়ে পাশে বসা ওনার প্রতি দেবতাকে কি যেন বলছিলেন।ব্যাস ওটা দেখেই শ্বেতা গেল গুটিয়ে। আমার থেকে অনেকটা তফাতে গিয়ে বসলো।দুজনেই লজ্জা পেয়ে গুটিসুটি মেরে বসে থাকি। কিন্তু সমস্যা হলো, যে প্রকৃতির দিকে চেয়ে একটু আগেও বিমোহিত হয়েছিলাম এক্ষণে নুতন আনন্দে বিঘ্ন ঘটায় আর প্রকৃতির দিকে মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়নি। ভদ্রমহিলার আগ্রহভরা চাহনিতে ওনাকে খলনায়িকার আসনে বসিয়ে আমরা দুজনেই গোমরামুখো হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে থাকি।
চলবে......
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-উপরের ছবিটি নেট থেকে নেওয়া।