somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিকফা কী? কেন আমরা টিকফা চুক্তির বিরোধিতা করি?

১৩ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘টিফা’ বা ‘টিকফা স্বাক্ষরিত হোল। খুব তড়িঘড়ি করে এমন সময় চুক্তিটি সাক্ষর করা হোল যখন শাসক দল নির্বাচন কালীন সর্বদলীয় সরকার গঠন করেছে বলে দাবী করেছে এবং শুধুমাত্র নির্বাচন উপলক্ষে করনীয় জরুরী কাজগুলো সম্পাদন করবে বলে প্রচার করছে। টিকফা ১৯৮৬ সালে এরশাদ আমলে অ্যামেরিকার সাথে স্বাক্ষরিত বাই ল্যাটারাল ইনভেস্টমেন্ট ট্রিটির একটি বর্ধিত রূপ। উল্লেখ্য টিকফাতেও সেই চুক্তির ধারা সমুহ কঠোর ভাবে পালনের বাধ্যবাধকতা যুক্ত হয়েছে।

টিকফা কী?

টিকফা শব্দটি নতুন। আগে এর নাম ছিল টিফা।‘টিফা’ চুক্তি হলো Trade and Investment Framework Agreements বা সংক্ষেপে TIFA, যেটিকে বাংলায় অনুবাদ করলে হয় — ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি। ‘টিফা’ চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে গত বারো বছর আগে থেকে। এই চুক্তির খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০০১ সালে। ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা সম্বলিত চুক্তিটির প্রথম খসড়া রচিত হয় ২০০২ সালে। পরে ২০০৪ সালে এবং তারও পরে আবার ২০০৫ সালে খসড়াটিকে সংশোধিত রূপ দেয়া হয়। দেশের বামপন্থি শক্তিসহ অন্যান্য নানা মহলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে চুক্তিটি স্বাক্ষর করা এতদিন বন্ধ ছিল। চুক্তির খসড়া প্রণয়নের পর সে সম্পর্কে নানা মহল থেকে উত্থাপিত সমালোচনাগুলো সামাল দেয়ার প্রয়াসের অংশ হিসেবে এর নামকরণের সাথে Co-operation বা সহযোগিতা শব্দটি যোগ করে এটিকে এখন ‘টিকফা’ তথা TICFA বা Trade and Investment Co-operamework Agreement (‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা সংক্রান্ত কাঠামোগত সমঝোতা’ চুক্তি) হিসাবে আখ্যায়িত করার হচ্ছে।

চুক্তিটি কেন?

আমেরিকার ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পলিসি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মার্কিন কর্তৃপক্ষ স্বীকার করছে তাঁদের বাণিজ্যে শ্রেষ্ঠত্ব ঝুঁকির মুখোমুখি। ২০০০-২০১১ পর্যন্ত আমেরিকার রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি অন্যান্য অগ্রসর অর্থনীতির তুলনায় থমকে গেছে। ২০০২ সাল থেকেই আমেরিকার রপ্তানি আয় কে ছারিয়ে গেছে জার্মানি। রপ্তানি ভিত্তিক ট্রেডে গড় আয় বেশী, অ্যামেরিকান চাকুরির মাত্র ৭% রপ্তানি ভিত্তিক ট্রেডে ১৯৯৯ সাল থেকে এই হার আর বাড়েনি, অথচ সারা বিশ্বে অর্থনীতিতে এই সময়টাতেই বিপুল স্ফীতি ঘটেছে। অ্যামেরিকান আভ্যন্তরীণ চাকরির বাজার মুলত নন ট্রেড এবং সরকারী সেক্টরে। এই খাতগুলো ক্রমান্বয়ে ব্যয় সংকোচনের লক্ষ্য হওয়ায় অ্যামেরিকান দের ট্রেড সেক্টরে ব্যাপক সাফল্যের মাধ্যমে নাগরিকদের আয় বৃদ্ধিই অ্যামেরিকান বাণিজ্য নীতির মুল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।



২০১০ সালে সিনেট অব দ্যা ইউনিয়ন স্পিচ এ আগামী পাঁচ বছরে রপ্তানি আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেন, তিনি আরো আক্রমণাত্মক ভাবে বাজার তৈরি করতে হবে যেন আমাদের মাটিতে আরো নতুন চাকরি তৈরি হয় আর নিশ্চিত করতে হবে আমাদের ট্রেডিং পার্টনাররা “প্লে বাই দ্যা রুলস”। কার রুলস? এই রুলস হচ্ছে আমেরিকার তৈরি রুলস। আর এই রুলস হচ্ছে টিকফা।

চুক্তিটি কার জন্য?

চুক্তিটি আমেরিকার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের। এই চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র করেছে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গেও। চুক্তিটির ধারা উপধারা ও আমেরিকার তৈরি। আমেরিকা চুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে নাছোড়বান্দা ছিল এবং তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে বছরের পর বছর ধরে এজন্য সে বাংলাদেশের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। এর মাঝে এদেশে ও আমেরিকায় কয়েক দফা সরকার বদল হয়েছে। কিন্তু ‘টিফা’ চুক্তির বিষয়টি সব আমলেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হয়ে থেকেছে। তারা এমনও বলেছে যে,‘টিফা’ চুক্তি স্বাক্ষর না করলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতার ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পরবে। যেহেতু বাণিজ্য ও বিনিয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ও আধিপত্য প্রশ্নাতীত এবং এই অসামঞ্জস্য পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই,তাই ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগের’ স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে করা চুক্তিটির দ্বারা প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের একতরফা সুবিধা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হবে এই সমালোচনা নিরসনের জন্য ‘বাণিজ্য ও বিনিয়োগ’-এর সাথে ‘সহযোগিতা’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে যে সব প্রস্তাবনা ও ধারা রয়েছে সেগুলোর জন্য চুক্তিটি অসম ও মার্কিন স্বার্থবাহী। উল্লেখ্য আমেরিকাও তাঁদের আভ্যন্তরীণ ডকুমেন্টে অস্বীকার করেনা যে এই চুক্তি তাঁদেরকেই উপকৃত করবে।

কোথায় কোথায় বাণিজ্যে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব আছে?

সেই বক্তৃতায়, বারাক ওবামা স্পষ্টভাবে বলেছেন এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমেরিকার স্বার্থবাহী উন্নত তৈরি পণ্য, কৃষি ও সার্ভিস সেক্টরে দৃঢ়, সুনির্দিষ্ট ট্রেড ও ইনভেস্টমেন্ট পলিসি কার্যকর করতে হবে। এর অর্থ হচ্ছে উন্নত তৈরি পণ্য, কৃষি বীজ, সার, কীটনাশক এবং সার্ভিস সেক্টর মানে যোগাযোগ, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, স্বাস্থ্য, পর্যটন, খনিজ, জুয়া, ব্যাংকিং, ইন্সুরেন্স, এফ এম সি জি ইত্যাদিতে মার্কিনিরা একক আধিপত্য তৈরি করবে। এবং এই সেক্টর গুলো থেকে মুনাফা স্থানান্তর করে অ্যামেরিকায় চাকুরি বৃদ্ধি করবে। এর সরাসরি ফলাফলে সার্ভিস সেক্টরে জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ বাধাগ্রস্থ এবং পরিশেষে বন্ধ হয়ে যাবে।

টিকফা দিয়ে কীভাবে বাণিজ্যে মার্কিন স্বার্থ রক্ষিত হবে?

অ্যামেরিকান ট্রেড পলিসির লক্ষ্য হিসেবে ঘোষিত পদক্ষেপগুলোই টিকফার মুল বিষয়। অ্যামেরিকান ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে, ১/ শুল্ক বাধা দূর করা, ২/ বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সুরক্ষা ৩/ সরকারী ভর্তুকি বন্ধ করা ৪/ সরকারী ক্রয়ে অংশ নেয়া ৫/ পরিবেশ ও শ্রমের পরিবেশ উন্নত করা ৬/ মেধাসত্ত্ব কড়াকড়ি ভাবে আরোপ করা।

‘টিকফা’ চুক্তির খসড়ায় পণ্য ও পুঁজির চলাচলকে অবাধ করার কথা এবং সেই সূত্রে মুনাফার শর্তহীন স্থানাস্তরের গ্যারান্টির কথা বলা হলেও শ্রম শক্তির অবাধ যাতায়াতের সুযোগের কথা কিছুই বলা হয়নি। অথচ শ্রম শক্তিই হলো আমাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মূল্যবান সম্পদ যার রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের রয়েছে বিপুল আপেক্ষিক সুবিধা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ‘খোলাবাজার’ নীতিটি যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে রাজি নয়। তারা তা প্রয়োগ করতে প্রস্তুত কেবল পুঁজি এবং পণ্য-সেবা পণ্যের ক্ষেত্রে, যে ক্ষেত্রে তার রয়েছে বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি আপেক্ষিক সুবিধা। অন্যদিকে, টিকফাতে ‘শুল্ক বহির্ভূত বাধা’ দূর করার শর্ত চাপানো হলেও ‘শুল্ক বাধা’ দূর করার কথা বেমালুম এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাক শিল্পের পণ্যের ক্ষেত্রে, গড় আন্তর্জাতিক শুল্ক যেখানে ১২%, যুক্তরাষ্ট্রের তা ১৯%।

বিনিয়োগের সুরক্ষার নামে মুনাফার শুল্ক বিহিন স্থানান্তর, দেশীয় বিনিয়োগকারীর সম সুযোগ, বিনিয়োগ ক্ষতি গ্রস্থ হলে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকারী ক্রয় নীতিতে দেশীয় পণ্য ও দেশীয় উৎপাদক এতদিন যে প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকার পেতেন সেটা সমভাবে পাবে অ্যামেরিকান পণ্য ও উৎপাদকরা। বিশেষ করে কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহার করার চাপ সৃষ্টি করে টিকফা চুক্তির মাধ্যমে কৃষিতে জনবান্ধব রাষ্ট্র নীতিকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে।

দোহায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে গৃহীত ‘দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডার’ মূল বিষয়গুলোও ছিল—অ-কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্তকরণ, কৃষি থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার, মেধাজাত সম্পত্তি অধিকার (ট্রিপস) এবং সার্ভিস বা পরিবেশ খাতে বিনিয়োগ উদারিকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এসব বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের স্বার্থ অভিন্ন নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে মার্কিনের স্বার্থের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থের গুরুতর বিরোধ আছে।

টিকফার বর্ণিত এই সুযোগ গুলো কি আমরাও নিতে পারবো?

কথাটা ঠিক নয়। বাণিজ্যে বাংলাদেশ আর মার্কিনীদের সক্ষমতা সমপর্যায়ের নয়। টিকফাতে সুচতুর ভাবে শ্রমের মান এবং ও পরিবেশ উন্নত করার ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই ধারা গুলোর লক্ষ্য কিন্তু কোনভাবেই শ্রমজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নয় বরং এগুলোকে নন- ট্যারিফ (অশুল্ক) বাধা হিসেবে ব্যাবহার করে যুক্তরাষ্ট্র তার বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের রফতানি নিয়ন্ত্রণ করবে। এছাড়াও আছে মেধাসত্ত বাঁধা। অধিকাংশ পণ্য ও সেবার মেধাসত্ত মার্কিনীদের অথবা মার্কিনী প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকার কারণে যে দেশী শিল্পের কোন বিক্রি এবং মুনাফার একটা বড় অংশ আবার ঘুরে ফিরে মার্কিনীদের হাতেই ফিরে যাবে। মেধাসত্তর কড়াকড়ি স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার কারণে আমাদের মত দেশের জন্য ২০২১ সাল পর্যন্ত শিথিল করা থাকলেও এই টিকফার কারণে তা এখন থেকেই কড়াকড়ি ভাবে মানার বাধ্যবাধকতা তৈরি হোল।

এতো বহুপক্ষিয় বাণিজ্য চুক্তি থাকতে টিকফা চুক্তি করার প্রয়োজন পড়লো কেন?

টিকফা একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। বিশ্ব বাণিজ্যের যে সমস্ত বহুপক্ষিয় প্রতিষ্ঠান এবং চুক্তি সমুহ আছে বা ছিল যেমন ডব্লিউ টি ও; জি এ টি টি, নাফটা, উরুগুয়ে রাউন্ড, টোকিয়ো রাউন্ড সেগুলোর সবচেয়ে বেশী লাভ ঘরে তুলেছিল আমেরিকা। এবং বিশ্ব বাণিজ্যে অ্যামেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব তিরিশ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু ২০০১ সালে ডব্লিউ টি ও তে চিনের অন্তর্ভুক্তি সব উলটে পাল্টে দেয়। এর পর থেকেই মার্কিন বাণিজ্য ক্ষেত্র গুলি একে একে চিনের দখলে চলে যেতে থাকে। ২০০৩ সালে প্রথম অ্যামেরিকার রপ্তানি আয় কে জার্মানি ছাড়িয়ে যায়। এর মুল কারণ ছিল চিনের কাছে অ্যামেরিকার বাজার হারানো। তখন থেকেই বহুপক্ষিয় চুক্তির বিপরীতে অ্যামেরিকা দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে নিজের স্বার্থ রক্ষার পথ বেছে নেয়। অ্যামেরিকার সরকারী নথিতে টিকফা সম্পর্কে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ আছে, “Trade policy can be an innovative tool to help grow America's economy and the world economy, while helping workers and firms here at home” তাঁরা সততার সাথে ঘোষণা করেছে নিজের অর্থনীতির বিকাশের জন্যই তাঁরা এই চুক্তিটি করছে।

ট্রেড এগ্রিমেন্ট এ নন ট্রেড এলিমেন্ট কেন?

গ্লোবাল ট্রেড ওয়াচের পরিচালক লরি অয়ালচ ট্রেড এগ্রিমেন্ট গুলো পর্যালোচনা করে বলেছেন এইসব ট্রেড এগ্রিমেন্টে নন- ট্রেড এলিমেন্ট গুলোই বেশী। যেমন, প্যাটেন্ট, বৈদেশিক বিনিয়োগ সুরক্ষা, সরকারী নীতি পরিবর্তন। এই একই ঘটনাগুলো ঘটেছে টিকফার ক্ষেত্রে। তিনি আরো বলেছেন, এই সমস্ত চুক্তির লক্ষ্য থাকে বড় বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোকে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর বিপরীতে অধিকতর সুবিধা দেওয়া। এর ফলে ধনী দেশগুলোই লাভবান হয় আর দরিদ্ররা আর ক্ষতি গ্রস্থ হয়। আর দরিদ্র মানে দরিদ্র দেশের দরিদ্র জনগন নয়, বরং ধনী দেশের দরিদ্র জনগণও সমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

মেধাসত্ত্ব বা পেটেন্ট আইন মানতে হলে সমস্যা কী?

পেটেন্ট কোন প্রতিষ্ঠানকে মেধাসত্ত্ব দিয়ে দেয়। ফলে সে সেই মেধাসত্ত্বের ভিত্তিতে সেই পেটেন্টের সাথে সম্পর্কিত যে কোন বাণিজ্যে সে রয়্যালটি দাবী করতে পারে। যেমন নিমের পেটেন্ট করা আছে আমেরিকার তাই নিম গাছ থেকে উৎপাদিত যে কোন পণ্যে সে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়্যালটি দাবী করতে পারবে। বীজ এবং কৃষি পণ্যের দাম অনেকগুন বেড়ে যাবে বলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তৈরি পোশাক শিল্পকেও ব্র্যান্ড নামে ব্যবহূত এদেশের তৈরি এ্যাকসেসরিজের জন্য সংশ্লিষ্ট মার্কিন কোম্পানিকে রয়্যালটি দিতে হবে। বাসমতি চাল,চিরতার রস,নিমের দাঁতন ইত্যাদি হেন বস্তু নেই যা আগেভাগেই মার্কিনীসহ বিদেশি কোম্পানিরা পেটেন্ট করে রাখেনি। মেধাস্বত্ব অধিকারের ধারা প্রয়োগ করে তারা এসবকিছুর জন্য রয়্যালটি প্রদানে বাংলাদেশকে ‘টিকফা’ চুক্তি মাধ্যমে বাধ্য করবে। একবার নাইজেরিয়ায় একটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট কিনেছিলাম যেটা অ্যামেরিকান প্যাটেন্ট করা, সেই প্যারাসিটামল ট্যাবলেটের দাম যেখানে বাংলাদেশে এক টাকার কম সেটা নাইজেরিয়ায় বাংলাদেশী মুদ্রায় ২৭ টাকা লেগেছিল। এই অতিরিক্ত ২৬ টাকা প্যাটেন্ট বা মেধাসত্ত্বের মূল্য। মেধাসত্ত্বের মূল্য সবসময় মুল পণ্যটির চাইতে কয়েকগুন হয়ে থাকে।

বাণিজ্য ছাড়া টিকফা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আর কোন কোন লক্ষ্য অর্জিত হবে?

বাংলাদেশে অ্যামেরিকা দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদেশী বিনিয়োগকারী। তাঁদের মুল বিনিয়োগ জাতীয়ভাবে এবং পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল এলাকাতে। যেমন জ্বালানী সেক্টর। এই সেক্টরে প্রাধান্য রাখতে হলে সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও রাখতে হয়। এই অঞ্চলে মার্কিনীদের মুল বাণিজ্যিক প্রতিপক্ষ চীনের প্রভাব এবং অগ্রগতি ঠেকাতে হলে বাংলাদেশের জমির চাইতে উন্নত শন আর নেই। বাংলাদেশকে মার্কিনীদের বাণিজ্যিক এবং সামরিক প্রভাব বলয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলাটা অ্যামেরিকার জন্য সবচেয়ে লাভজনক।

এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে মার্কিনের পক্ষে এবং স্বল্পোন্নত দেশের বিপক্ষে বাংলাদেশকে দাঁড় করানোর সুযোগ পাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিপাক্ষিক চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে অবস্থান নিতে বাধ্য করতে পারবে। বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের অভিন্ন ও সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে সম্মিলিতভাবে আন্তর্জাতিক ও বহুপাক্ষিক নানা ফোরামে অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু টিফার মতো দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তা স্বাধীন মতো করতে পারবে না। শুধু তাই নয় বহুপক্ষীয়ভাবে যে কোনো বিরোধ নিরসনের সুযোগ হারাবে বাংলাদেশ। ‘টিকফা’ চুক্তির কারণে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আন্তর্জাতিক পরিসরে বহুপাক্ষিকভাবে প্রচেষ্টা চালাবার সুযোগ নিরঙ্কুশভাবে পাবে না। উপরন্তু বাণিজ্য সমস্যা বহুপক্ষীয়ভাবে সমাধানের বদলে তা মার্কিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের ফাঁদে পড়বে বাংলাদেশ। একপক্ষ প্রবল শক্তিশালী হলে দ্বিপাক্ষিক সমস্যার সমাধান স্বাভাবিক কারণেই দুর্বলের নয় বরং সবলের পক্ষেই যায়। সে কারণে বাংলাদেশকে সব সময়ই ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।

আর কোন কোন দেশের সাথে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে?

মুলত মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার দরিদ্র ও সংঘাত ময় দেশগুলো, আসিয়ান দেশগুলো, সাবেক সোভিয়েত ব্লকের দেশগুলো, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান।

জি এস পি সুবিধার পাবার প্রশ্নের সাথে কি টিকফা চুক্তি যুক্ত?

টিকফার সাথে জি এস পি সুবিধার কোন সম্পর্ক নেই। দোহা নীতি অনুসারে আমেরিকা স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা যেটাকে সাধারণভাবে জি এস পি সুবিধা বলা হয়। উল্লেখ্য বাংলাদেশের জন্য সমস্ত জি এস পি সুবিধা আপাতত স্থগিত আছে। আমেরিকা ঠিকই বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দিয়েছিল তবে তাতে ঐসব পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিলো যার রপ্তানির পরিমান খুবই কম এবং বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা সামান্য। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাককে সবসময়েই এর বাইরে রাখা হয়েছে। যেই সব পণ্য জি এস পি সুবিধার আওতায় ছিল সেই সব পণ্যের জন্য জি এস পি সুবিধা থাকা আর না সমান কথা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের যে গার্মেন্টস পণ্য রফতানি হয় তার ওপর উচ্চহারে শুল্ক বসিয়ে রেখেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের গড় আমদানি শুল্ক হার শতকরা ১ ভাগের মতো। কিন্তু বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ। এই শুল্কহার আন্তর্জাতিক বিধিরও পরিপন্থী। এই শুল্ক এমনিতেই বাতিল হওয়া দরকার। এবছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্কবাবদ প্রদান করেছে প্রায় ৫৬০০ কোটি টাকা। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে আসে তার ৬ গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়,বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের যোগান দিচ্ছে।

টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরে সর্বদলীয় সমঝোতা

টিকফাতে যত দেশ বিরোধী উপাদানই থাকুক না কেন এটা স্বাক্ষরে অভূতপূর্ব সর্বদলীয় সমঝোতা হয়েছে। সরকার প্রধান আওয়ামী লীগ, বাণিজ্য মন্ত্রি জাতীয় পার্টির এবং চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রথম অভিনন্দন বার্তা প্রধান বিরোধী দলের। চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েকদিন আগে থেকেই রাজপথে বিরোধীদলের সহিংস কর্মসূচী বন্ধ ছিল যেটা ঠিক চুক্তি স্বাক্ষরের পর দিন থেকেই শুরু হয়েছে।

করনীয় কী?

জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে রচিত ‘টিকফা’ চুক্তি পুরোটাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা আরেকটি সর্বনাশের বার্তা। এই চুক্তি বাংলাদেশ থেকে মার্কিনীদের অবাধ শোষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দেশীয় শিল্পের বিকাশের সম্ভাবনাকেও ধ্বংস করে দিবে।

যে কোন চুক্তি স্বাক্ষর হওয়া মানেই সেটা সাথে সাথে বাস্তবায়িত হওয়া নয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পরে সেটা স্ব স্ব দেশে প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের মধ্য দিয়ে জেতে হয়। জাতীয়ভাবে চাপ সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশে আইন সংশোধনের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত তৈরি করা সম্ভব। টিকফার আর্টিকেল সেভেন অনুসারে ১৮০ দিনের লিখিত নোটিশ দিয়ে বাংলাদেশ এই চুক্তি বাতিল করে দিতে পারে। তবে অ্যামেরিকার সাথে হওয়া চুক্তি বাতিল করবার মতো নৈতিক অবস্থান, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং শক্ত মেরুদণ্ড নেতৃত্বের থাকতে হবে। তবে শেষ বিচারে জনমতের তীব্র উত্তাপ যে কোন গণ বিরোধী ও রাষ্ট্র বিরোধী চুক্তির প্রধান রক্ষা কবচ।

[ফুট নোটঃ মে মাসে প্রথম প্রকাশিত ব্লগটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর পুনর্লিখিত]
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:১৪
৪৬টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×