ঢাকার রাস্তায় বাইক চালানোর বহুত প্যারা আছে। যেমন মাঝেমধ্যেই কুত্তার পাল্লায় পড়া লাগে। বেরসিক কুত্তাগুলান আতকা বাইকের সামনে আইসা পড়ে। খুবই খতরনাক ব্যাপার হয় তখন। একবার রামপুরা রোডে এরকম দুইডা রেসিং কুত্তার সাথে বেমক্কা এক ধাক্কায় আছাড় খেয়ে পড়লাম পিচঢালা রাজপথে। মহোদয়দ্বয়ের কি হইছিলো সেইটা দেখার আগেই দেখি আমার হাত এবং পায়ের কিছু কিছু যায়গায় চামড়া অদৃশ্য হয়ে গেছে। জিন্স প্যান্ট অক্ষত থাকলো কিন্তু পায়ের চামড়া কিভাবে উধাও হলো সেইটা ভাবতে ভাবতে বুঝলাম, 'দরবেশ বাবা'র ভালোই কেরামতি আছে। কারণ প্যান্টটা কেনা হইছিলো ‘ইয়োলো’ থেকে।
তারপর থেকে রাস্তায় কুত্তার ছায়া দেখামাত্রই 'যাগায় ব্রেক'!
এই সুমতির বদৌলতে বলা যায় সেকেন্ডটাইমে ভয়াবহ এক বিপদ থেকে রক্ষা পাইছিলাম। সন্ধ্যার পরপর ভুতের গলিতে ঢুকছি, কিছুদুরে রাস্তার বামে ফ্যামিলিপ্লানিংবিহীন এক সুখী কুত্তা পরিবারের উপস্থিতি টের পেয়েই যথারীতি ব্রেকে চাপ দিলাম। মা কুকুরটা সাফল্যজনকভাবেই বাম থেকে রাস্তার ডানে চলে গেলো। কিন্তু গোল বাঁধালো ছানাপোনাদের একজন। হঠাৎ করে মাকে অনুসরণ করতে গিয়ে বাইকের সামনের চাকায় এসে গোত্তা খেয়ে তারস্বরে চিৎকার শুরু করলো। ভাইরে ভাই, এমনই তার গলা যে আশেপাশের বাড়ির জানালা খুলে সদ্যতরুণীরা ঘটনার সুলুক সন্ধান করতে লাগলো (এই বয়সের মেয়েদের হৃদয় নরম হয়, হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন)।
গোত্তা খাওয়া জুনিয়র কুত্তা এমন যায়গায় ল্যান্ড করে আছে যে আমি বাইক টান দিলেই তিনি পেছনের চাকার নিচে ভর্তা হয়ে নির্ঘাত পটল তুলবেন, আমার পেছনে বসা প্যাসেঞ্জারের ওজন ৮০ কেজির আশেপাশে। অতএব আমি ফুলস্টপ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। এবং দাঁড়ানোতেই ধরাটা খেলাম। কুত্তা পরিবারের সব ছানাপোনাসমেত কর্তা-কর্তৃ আমাদের দুজনের দিকে লাফ দিয়ে দিয়ে হুঙ্কার ছাড়তে লাগলো আর আমরা নাভির গোড়ায় ১৪ ইঞ্জেকশন নেওয়ার ভয়ে বাইক মাইকের মায়া ত্যাগ করে জীবনটা হাতে লটকে পাশের ওয়ালের উপ্রে আশ্রয় নিলাম কোনোমতে।
এরপর কুত্তা পরিবার যখন দেখলো যে জুনিয়র কুত্তা খুব একটা আহত হয়নি, তখন তাহারা 'উহাকে' মুখে করিয়া ধীরে ধীরে অন্তর্নিহিত হইলো।
ভাঙা লুকিংগ্লসসমেত বাইকটা নিয়ে আমরাও নিজ ডেরার পথ ধরলাম। মাগার সারাপথ ভাবতে লাগলাম, যদি জুনিয়রটা চাকার নিচে পড়ে মারাই যেতো অথবা ভালো রকম আহত হতো, তাইলে আমাদের দুই ভাইডির অবস্থাডা কি হইতো...
মূল বিষয়ে আসি। বয়স বাড়লে মানুষের মধ্যে একটা বিষয় খুব কমন হয়ে যায়, 'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম.. ..'। আইন-শৃঙ্খলা, আদব-কায়দা, সমাজ ইত্যকার বিষয়েও এই ধারার কথাটা ছোট্টবেলা থেকেই শুনে আসছি। তখনকার বয়স্করা বলতেন পাঞ্জাবিদের সময়ে সমাজের অবস্থা ভালো ছিলো, বাচ্চাদের ভেতরে আদব লেহাজ ছিলো, আর এখন যে কি দিন আসলো.. ..। এখনও বয়স্কদের মুখে ওই কথাই শুনি, 'আমাদের ছোটবেলায় আমরা বড়দের কত সম্মান করতাম, মানুষ কত ভালো ছিলো' ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়তো আমরা নিজেরাও বলি এরকমই বা বলবো। বয়সতো থেমে নেই, বাড়ছে।
কিন্তু মানবিকতার দিক দিয়ে আমরা আসলেই কি অমানুষের পর্যায়ে চলে যাচ্ছি না ক্রমান্বয়ে? সামাজিকভাবে নৃশংসতা, খুন, ধর্ষণ এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে, এগুলো এখন আর আমাদের বিবেকে আঁচড় কাটে না। কিন্তু পরিবারের একান্ত আপনজনদের রক্ষার বদলে তাঁদের প্রতি নৃশংসতার গ্রাফ যে হারে উর্ধ্বমুখী হচ্ছে দিনকেদিন, তা খুবই আতংকজনক। এক প্রথম আলোতেই গত কয়েকদিনে এ সম্পর্কিত সংবাদগুলো পড়লে গা শিউরে ওঠবে। একজন বাবা নিজের কিশোর ছেলেকে ভয়াবহভাবে পিটিয়ে মৃতপ্রায় করে দিয়েছে। একজন অসহায়, বৃদ্ধা মাকে প্রচণ্ড শীতের রাতে স্টেশনে ফেলে চলে গেছে সন্তানরা। আরেক দুর্ভাগা ছেলে বাবাকে মারতে গিয়ে মায়ের মাথায় আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেয়। মাথা থেকে ঝরে পড়া রক্ত দেখে বাবার মৃত্যু। আজকেই আবার নিউজ এসেছে চারজনকে হত্যা করে নিজেই আত্মহত্যা করেছেন এক ব্যক্তি। কি পরিমাণ নৃশংসতা আমরা ধারণ করছি! এটাতো স্যাম্পল মাত্র, পিকচার আভি বাকি হ্যায়!!
আমাদের এই মনুষত্বহীনতা এখন ওই কুকুর পরিবারের থেকেও নিচে নেমে গেছে। অথচ সেই আমরাই ‘কুকুরের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়ে জাতে উঠতে চেষ্টা করি আর সেটা দেখে কুকুরেরা নির্ঘাত বলে 'ওরে, তোরা আমাদেরকে আর নিচে নামাস না, তোরা যেখানে নেমেছিস, ওই পর্যন্ত আমরাই যেতে পারবোনা কোনোদিন।'
প্রফেসর আনু মোহাম্মদ একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন 'রাষ্ট্রের নৃশংসতা সমাজের মধ্যে পুনরুৎপাদিত হয়'। সেটা সত্য। রাষ্ট্র নৃশংসতাকে প্রণোদনা দিলে সমাজ আর সমাজ থাকে না। দুঃখজনকভাবে গত কয়েক দশক ধরে এদেশে সেটাই হয়ে আসছে। সাগর-রুনী, বদরুল-বিশ্বজিৎ বা আরো আরো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এই প্রণোদনা প্রকট হওয়ার প্রভাব পড়ছে সবখানে।
মাঝে মাঝে কোনো কোনো বাসার সামনে দেখি নোটিশ টাঙানো থাকে কুকুর হইতে সাবধান। আমার সন্দেহ হয়, ওই বাসার লোকজন নিজেদের পরিচয়টাই দিলো কি না?
ছবিসুত্র: ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১:২৬