somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লেখা এসে ভর করলেই কি তবে লেখা হয়?

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ২:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



অহরহ এমন হয় যে খুব লিখতে চাচ্ছি, কিন্তু কোনো লেখা আসছে না। কি নিয়ে লিখবো, কিভাবে শুরু করবো, ভাবতে ভাবতেই পার হয়ে যাচ্ছে প্রহর, দিনের পর দিন। এটাকেই বোধহয় রাইটার্স ব্লক বলে। আবার অনেক সময় এমন হয় যে কোনো একটা লেখা শুরু করলাম কিন্তু কিছুটা লেখার পর আর কোনোভাবেই শেষ করা হয়ে ওঠে না। তখন ‘সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে/সহজ কথা যায় না লেখা সহজে’র প্যাচ নিয়ে শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে পথ আটকে দেন। এ রকম অসংখ্য লেখার ভ্রুণ শেষ পর্যন্ত আর পূর্ণতা পায়নি। হিমঘরে থাকতে থাকতে একসময় তা অ্যাবর্শন করে ফেলে দিতে হয়েছে। কদাচিৎ এমন হয়েছে যে হিমঘর থেকে কোনো লেখার ভ্রুণ নতুন করে জন্ম নিতে পেরেছে!

এর বাইরে মাঝে মধ্যে লেখা এসে ভর করে। কোত্থেকে কি হয় বলা যাবে না কিন্তু একটা ঘোরের মত ব্যাপার হয়। তখন লেখার জন্য বিশেষ কোনো টপিকের প্রয়োজন হয় না। কি দিয়ে শুরু করবো; তা নিয়ে কালক্ষেপন হয় না। হয়তো অফিস ফিরতি রাস্তায় ড্রাইভ করছি, পেছন থেকে অনর্গল হর্নের শব্দ, পাশে রিকশার টুংটাং, পথচলতি মানুষের ক্যাওয়াজ, অবধারিত জ্যাম, কিছুই আমাকে ছুঁতে পারছে না, আমি মাথার মধ্যে লাইনের পর লাইন বুনে যাচ্ছি... অথবা রাতে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ঘুম আসছে না। কারণ ওই একই, মাথার মধ্যে লেখারা এসে ভর করে আছে। সে লেখা বের না হওয়া পর্যন্ত এই চক্র শেষ হয় না, ঘুমও আসে না। হয়তো এমনও হয়েছে যে সে অবস্থায় ঘরের আলো জ্বেলে নতুন করে কম্পিউটার অন করে সে লেখা শেষ করে তবেই ঘুমুতে পেরেছি।

কিন্তু সবার এমন হয় না, আমি নিশ্চিত। যেমন আমার একজন প্রিয় ব্লগার রাজীব নুর। তিনি শক্তিমান লেখক, চাইলেই লিখতে পারেন। যখন ইচ্ছে তখন। প্রায়ই আমি অবাক হয়ে ভাবি যে এত লেখার সময় তিনি পান কিভাবে? যেখানে সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও এক মাসে আমার পোস্ট হয় মোটে ৮টা সেখানে রাজীব নুরের গড় লেখার পরিমাণই দিনপ্রতি ১.৫টি।

আমি রাজীব নুরের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিতে চেষ্টা করি। কারণ অভিজ্ঞতা খুবই মূল্যবান। তাছাড়া সৃজনশীলতার জগতে গুরুর কাছে শিক্ষা নেবার নজীর বিরল নয়। ফরাসী লেখক গুস্তাভ ফ্লবেয়রের কাছে ছোটগল্পের রাজা মোপাসাঁর লিখতে শেখার গল্পটা সর্বজনবিদিত। সে শিক্ষা আর আপন প্রতিভাবলে মোপাসাঁ হয়ে উঠেছিলেন ফরাসী সাহিত্যের সবচেয়ে নিপুণ গদ্য লেখক।

অবশ্য আমার ক্ষেত্রে রাজীব নুরের অভিজ্ঞতা কোনো কাজে আসছে না। প্রতিভার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। অথবা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সৃজনশীল লেখালেখির বিষয়ে যা বলেছিলেন, আমার ক্ষেত্রে হয়তো সেটাই কাজ করে। ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে তিনি লিখেছিলেন- কোনো লেখক থেকে অনুপ্রেরণা পেলেও তাঁকে অনুসরণ করা যাবে না। অনুকরণ তো নয়ই। অনুসরণ কখনো মূলকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।

আমার মত আরও যারা আছেন, কম লিখতে পারেন, তাদের করণীয় সম্পর্কে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ওই লেখাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক রোনাল্ড সুকেনিক এর বরাতে লিখেছিলেন- প্রথম কথা, যদি লিখতে চাও, পড়তে হবে। দ্বিতীয় কথা, যদি লিখতে চাও, জীবনটাকে জানতে হবে। আর তৃতীয় কথা, লেখালেখির নিয়মগুলো প্রথমে নিজের মতো আয়ত্ত করে নিয়ে পরে প্রয়োজনমত ভাঙতে হবে। এরপর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম যোগ করেছিলেন, চতুর্থ একটি কথা হতে পারে, কোনো লেখক থেকে অনুপ্রেরণা পেলেও তাঁকে অনুসরণ করা যাবে না। অনুকরণ তো নয়ই। অনুসরণ কখনো মূলকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। সুকেনিক মাথা নেড়ে তাতে সম্মতি জানিয়েছিলেন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষাবসর কাটাতে যে কর্মতালিকা তৈরী করেছিলেন, তা দিয়ে লিখেছিলেন ‘বর্ষাযাপন’ কবিতা। সোনার তরী কাব্যের এ কবিতায় দেখা যায়, কবি বর্ষাবন্দী কলকাতা শহরে জানালা পথে পাশের দালানগুলোকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন, বিজলী চমক, বৃষ্টি-পতন দেখে আকাশ-পাতাল ভাবছেন, নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্য খুলে বসছেন কালিদাসের ‘মেঘদূত’, গোবিন্দদাসের পদাবলী খুলে পড়ছেন বর্ষা অভিষার- বিহব্বল হচ্ছেন একাকীনি রাধার বেদনায়, পড়ছেন গীতগোবিন্দ। তাই লেখার জন্য প্রচুর পড়ার পাশাপাশি পর্যবেক্ষণও অতীব জরুরী।

লেখা সম্পাদনাও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির মধ্যেই সম্পাদনার বহু চি‎‎হ্ন দেখা গেছে। সৈয়দ শামসুল হকও গল্পের কয়েকটি খসড়া করতেন বলে জানা যায়। তাঁর বিখ্যাত কাব্যনাটকের সবগুলোই তৃতীয়বারের লেখা। একইভাবে কবিতাও সম্পাদনা করতেন অসংখ্যবার। পৃথিবীর খ্যাতিমান সব লেখকের জীবনের ঘটনাগুলোই কমবেশি এরকম। সম্পাদনা লেখালেখিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। পাশ্চাত্যের প্রকাশকরা পেশাদার সম্পাদকদের মাধ্যমে সম্পাদনা ছাড়া কোন লেখা প্রকাশ করেন না। তা সে নোবেলজয়ী লেখকই হন না কেনো।

লেখার জন্য প্রয়োজন গবেষণাও। আপনি যদি পুরোনো প্রেক্ষাপটের কোনো গল্প লিখতে চান তাহলে সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিত, সামাজিক অবস্থা ভালোভাবে জেনে নিতে হবে। তা না হলে লেখার মেরিট কমে যায়। প্রচলিত আছে যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসটি লেখার জন্য বগুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু বছর ঘুরেছেন, লোকজনের সাথে মিশে সেখানকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছেন।

এত কিছুর পরও দেখবেন মাঝে মধ্যে লেখার মুড চলে যাবে, প্রথমেই যেটা বলেছি। এ সময় লেখা আমাদের সাথে অগণতান্ত্রিক সরকারের মত বিমাতাসুলভ ব্যবহার করতে থাকে। কোনোভাবেই আয়ত্বে আসতে চায় না। এটা নতুন কিছু নয়, পৃথিবীর তাবড় তাবড় লেখকরাও এরকম সময় পার করেছেন। শুধু লেখক কেনো, খেলোয়াড়, গায়ক, অভিনেতা, সবাইকেই এ অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এ সময় একজন সত্যিকার যোদ্ধা অবশ্যই মাঠ ছেড়ে যায় না, বরং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আবার ফর্মে ফেরত আসে। আমাদের মুশফিক এর এক সত্যিকারের উদাহরণ। গতকালও ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। এ রকম কঠিন সময়ে তাই লেখকদেরও লেখার টেবিলে ঝুলে থাকতেই হবে।

এখন লেখা এসে ভর করুক বা না করুক, লেখা চালিয়ে যেতেই হবে। আর এর মধ্য দিয়েই হয়তো আমিও রাজীব নুর হতে পারবো একদিন।

উৎসর্গ: ব্লগার রাজীব নুর
কিছুটা কৃতজ্ঞতা: মুহাম্মাদ মিনহাজ, টেক অ্যালার্মবিডি
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:৪৩
৩৪টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×