somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চাকুরি জীবন- বিষণ্ণ ছোলা ভাজা পর্ব

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


তখন আমার অফিস ছিল কাওরান বাজারে, ওয়াসা ভবনের দোতলায়। সেখানে ওয়াসার কর্মচারীদের একটা ক্যান্টিন আছে। ওয়াসার শ্রমিক নেতারা সেখানে সারাদিন বসে থেকে পান সিগারেট খেতেন আর শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য গভীর চিন্তা ভাবনা করতেন। তারা মাঝে মাঝে ওয়াক থু করে পানের পিক মেঝেতে বা দেয়ালে ফেলে দিয়ে, জয় বাংলা অথবা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ শ্লোগান দিয়ে শ্রমিক ও দেশের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখতেন। ক্যান্টিনের পাশেই দুটো বড় হলরুম ও হার্ডবোর্ডের পার্টিশন দিয়ে তৈরী করা কয়েকটা রুম নিয়ে ছিল আমাদের অফিস। আমাদের অফিসের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট ছিল, সেটা হল, অফিসের মধ্যে কোন টয়লেট ছিল না। ক্যান্টিনের উল্টোপাশে, সারিবাঁধা কতগুলো কমন টয়লেট ছিল ফ্লোরের সবগুলো অফিসের জন্য। এর মধ্যে একটা ছিল আমাদের অফিসের জন্য বরাদ্দ। টয়লেট গুলো ঠিক জনগনের সম্পত্তি নয় বলে সবসময় তালা মারা থাকতো। আমাদের টয়লেটের চাবি রাখা থাকত এইচ আর ম্যানেজারের রুমে। কারো ব্যাবহারের প্রয়োজন হলে ম্যানেজারের রুম থেকে চাবি নিয়ে যেতে হত। তবে এজন্য এইচ আর ম্যানেজার কে উদ্দেশ্য করে কোন দরখাস্ত লিখবার প্রয়োজন হত না।
আমাদের কোম্পানির কাজ ছিল মুরগি বিক্রয়। আক্ষরিক অর্থেই মানুষের কাছে মুরগি বিক্রি করতাম আমরা। তবে মুরগিগুলো বিয়ে বাড়ির রোস্টের জন্য উপযুক্ত ছিল না, আমরা আসলে বিক্রি করতাম এক বা দুই দিনের মুরগির বাচ্চা। খামার বা হ্যাচারিতে কৃত্রিম ভাবে ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা গুলো উৎপাদন করা হত। তারপর নবজাত বাচ্চা-মুরগি, ফুটোওয়ালা কাগজের প্যাকেটে মুড়িয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চালান দেওয়া হত। গাজীপুরের কোনাবাড়িতে জঙ্গলের ধারে অনেকখানি জায়গাজুড়ে ছিল আমাদের ডিম উৎপাদন ও বাচ্চা ফুটানো কেন্দ্র। আমার কাজ যদিও ছিল ঢাকা অফিসে, তবু সপ্তাহে এক বা দুইদিন আমাকে মুরগির খামারে কাজ করতে হত এবং পিতা-মুরগি, মাতা-মুরগি ও তাদের মুল্যবান ডিম প্রসবের খোঁজ খবর রাখতে হত।
এভাবেই একসময়ের আমি- ওয়ার্ডসওয়ার্থ, রবীন্দ্রনাথ, কান্ট, হেগেল বা সার্ত্রে পড়ুয়া আমি, নিজেকে আবিষ্কার করলাম মুরগির খামারে। মুরগির ডিম উৎপাদনের সাথে যে লিরিক্যাল ব্যালাডের কোন সম্পর্ক নেই বা সার্ত্রের নাথিংনেস যে মুরগি মোটা তাজা করার ব্যাপারে বিশেষ কোন দার্শনিক মত সমর্থন করে না, সেটা আমি অতি দ্রুত বুঝে গেলাম।
তখন আমি গোল্ডলিফ সিগারেট ছেড়ে নেভি সিগারেট খাওয়া আরম্ভ করেছি। তবে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুদের সাথে দেখা হলে, আমি পকেট থেকে সিগারেট বের না করে, দোকান থেকে বেনসন সিগারেট কিনে খেতাম এবং বন্ধুকেও খাওয়াতাম। আমার বন্ধুদের কেউ কেউ তখন ভাল সুযোগ পেয়েছে। তাদের কেউবা ভাল চাকুরি করে গাড়িও কিনে ফেলেছে। হঠাৎ রাস্তায় দেখা হলে এই সহৃদয় বন্ধুরা তাদের গাড়িতে করে আমাকে বাসায় পৌছে দিত। কোন ভাল সুযোগ আছে কি না, এটা নিয়ে আমরা গাড়িতে যেতে যেতে আলোচনা করতাম। আমার বন্ধুরা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে আমাকে সাহায্য করতো। চাকুরির দরখাস্তে কোন বিষয় গুলো কিভাবে লিখব, বা ইন্টারভিউ দিতে গেলে কোন পোশাকটা পড়ে যাওয়া ভাল এই সব জরুরি ব্যাপারগুলো আমি তাদের কাছে শিখেছিলাম।
মুলত আব্বা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমার জামাকাপড়গুলো ময়লা হতে শুরু করেছিল। আমার অফিসে একটা ভাল ব্যাপার ছিল, আমাদের ইস্ত্রি বিহীন জামাকাপড় বা ময়লা জুতো নিয়ে মালিক বা বড় কর্তারা মাথা ঘামাতেন না। একই পোষাক সাতদিন বা পনের দিন একটানা পড়ে গেলেও আমাদের কোন বেতন কাটা যেত না।
তখন যে কোন একটা বাজে খরচ করলে বা সাড়ে তিন টাকা দিয়ে বেনসন সিগারেট কিনলেই আমার দেশের বাড়িতে থাকা মা আর স্কুল কলেজে পড়া ছোট দুই বোনের কথা মনে পড়ত। তবে আমি যে খুব কৃচ্ছ্রতা সাধন করতাম তা নয়। প্রতি মাসে যে বেতন পেতাম তার বেশির ভাগটাই আসলে আমার খরচ হয়ে যেত। মাসে মাসে অল্প কিছু টাকাই কেবল দেশে পাঠাতে পারতাম। আমি একা আমার বেতনের বেশিরভাগ অংশ ভোগ করতাম, আর আমার মা ও বোনেরা তিনজন মিলে সামান্য টাকায় সারা মাসের খরচ চালাতেন। তারপরও প্রতিবার আমার পাঠানো টাকা হাতে পেলেই আম্মা কাঁদতেন। ঈদের ছুটিতে দেশে গেলে আমি যখন আম্মার হাতে সামান্য কিছু টাকা তুলে দিতাম, তখনও আম্মা কাঁদতেন আর বলতেন যে, " তুমি এত কষ্ট করে ঢাকায় থেকে টাকা রোজগার কর, আর আমরা শুধু বসে বসে খাই"। আম্মার ধারণা ছিল, আমি খুবই পরিশ্রমের কাজ করি।
আমার মায়ের এই ধারণাটা অবশ্য ভুল ছিল। আমি ঠিক পরিশ্রমী ছিলাম না, বা আমাকে তেমন কোন কঠিন কাজও করতে হত না। অবশ্য সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠা এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত মুরগির লালন পালনকারী লোকদের সাথে সময় কাটানো কে আপনি যদি পরিশ্রমের কাজ বলে মনে না করেন। এই কোম্পানিতে আমার জব টাইটেল ছিল, সহকারী ম্যানেজার, ফাইন্যান্স। তবে আমাকে টাকা পয়সা হিসেবের কঠিন কাজ গুলো করতে হত না। অফিসে মাদ্রাসা থেকে পাশ করা, টুপি দাড়ি ওয়ালা, সুফি চেহারার একটা ছেলে কাজ করতো। অফিস মালিকেরা টাকা পয়সা লেনদেনের দায়িত্ব তাকে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ব্যাংকের সাথে কোম্পানির যে সব জটিল লেনদেন ছিল, সেসব দেখাশোনা করতেন, আমার বস, অর্থ্যাৎ ম্যানেজার ফাইন্যান্স। আমার এই বসের নাম ছিল মিয়া উদ্দিন। মিয়া এবং উদ্দিন, নামের এই অংশ গুলো খুব পরিচিত হলেও, শুধু মিয়া ও উদ্দিনের এই কম্বিনেশনটা আমার কাছে নতুন ছিল। পরিপাটি করে ছাটা শক্ত গোঁফের বেটে কালোমতো এই মানুষটি কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাকে অফিস এটিকেট শেখাতেন। আমার এই বসের সাথে একটা ব্যাপারে আমার মিল ছিল। তিনিও আমার মত নেভি সিগারেট খেতেন।
আমাদের অফিসে মালিকপক্ষের দুইজন লোক বসতেন। তাদের একজন কোম্পানীর চেয়ারম্যান, বয়স্ক এবং রাশভারি। আর ছিলেন একজন অল্প বয়স্ক এম,ডি, সম্পর্কে যিনি চেয়ারম্যানের ভাইয়ের ছেলে। আমাদের হলরুমের পাশেই একটা রুমে বসতেন তিনি। ফুলটাইম কোম্পানির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমাদের এম,ডি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট টাইম বিবিএ পড়তেন।
তো চাচা ভাস্তের এই কোম্পানিতে আমার কাজটা যে আসলে ঠিক কি ছিল তা আমার ভাল জানা ছিল না। চাকুরি দেবার সময় তারা আমাকে বলেছিলেন, এখানে নাকি তারা কি একটা একাউন্টিং সিস্টেম চালু করবেন, যাতে করে প্রত্যেক মুরগির পিছনে তাদের কত টাকা খরচ হয় সেটা তারা জানতে পারেন। এক দিনের বাচ্চা মুরগির পিছনে কোম্পানির ব্যয় কত, সেটা নিঁখুতভাবে বের করা নাকি হবে আমার কাজ। অফিসে অতি বয়স্ক একজন ভদ্রলোক কাজ করতেন। তিনি ছিলেন এদের মুরগি প্রজেক্টের কনসাল্ট্যান্ট। ভদ্রলোক অফিসে বসে সারাদিন ছোট ছোট কাগজে খুবই ক্ষুদ্র হরফে ইংরেজিতে কি যেন সব লিখতেন, আর মাঝে মাঝে ছবি আঁকতেন। আমার কাজ ছিল তার এইসব মুল্যবান লেখা এমএস ওয়ার্ডে টাইপ করে ফেলা, আর ছবিগুলো পাওয়ারপয়েন্ট বা এক্সেলে এঁকে ফেলা। আমি এই কোম্পানিতে দুই বছর চার মাস চাকুরি করেছি। এখানে চাকুরির পুরো সময়টাই আমি তার লেখাগুলো বিন্দুমাত্র না বুঝে টাইপ করেছি,আর ছবি গুলো- যেগুলো ছিল খুব সম্ভব প্রসেস ফ্লো ডায়াগ্রাম, তা একে গেছি। বৃদ্ধ কনসাল্ট্যান্ট মানুষ ভালো ছিলেন, তার লেখা টাইপ করে দিলেই তিনি খুশি হতেন, এসব আমি বুঝি কিনা তা নিয়ে উনি কখনো কোন প্রশ্ন করে আমাকে বিপদে ফেলতেন না।
প্রতি মঙ্গলবারে আমাকে মুরগির খামারে যেতে হত। খামারের সীমানার ভিতরে একটা অফিস ছিল। ফাইন্যান্সের দুজন লোক ওখানকার টাকাপয়সার হিসাব রাখতেন। আমার কাজ ছিল তাদের হিসেব গুলো দেখভাল করা আর তাদের সাহায্য করা। সপ্তাহের এই দিনটা ছিল আমার জন্য বিশেষ আরামের। দেরি করে ঘুম থেকে উঠে রওনা দিলেও কোন সমস্যা ছিলনা। খামারের হিসেবপত্র দেখাশুনা করতে আমার সময় লাগতো দশ মিনিট। বাকি সময়টা আমি পাশের জঙ্গলে গিয়ে হাঁটাহাটি করে কাটিয়ে দিতাম। জঙ্গলের ধারে খুব সাধারণ একটা টিনের বাড়ি ছিল। সেই বাড়ি থেকে প্রায়ই হারমোনিয়ামের বাজনার সাথে কোন এক লালন ভক্তের সুরেলা গলার গান শুনতে পেতাম। গানের কথায় আঞ্চলিক টান ছিল, উচ্চারণেও কিছু অশুদ্ধতা ছিল। কিন্তু সেই অদৃশ্য গায়িকার গানে একটা কোন যাদু থেকে থাকবে। মনে হত মহিলা আসলে শুধু গান গাইছেন না, গানের ভিতর দিয়ে কোন একটা বিশেষ সাধনা করছেন। জঙ্গলের প্রভাব কিনা জানিনা, এই গান গুলো ছিল আমার জীবনে শোনা শ্রেষ্ঠ লালনগীতি।
তো আমার মায়ের ধারণা ছিল, এই কাজ গুলো নিশ্চয় খুবই কঠিন আর কষ্টসাধ্য। তবে কঠিন কিছু কাজ মাঝে মাঝে আমার সামনেও এসে পরত বৈকি। আমাদের ছাত্র এম,ডি মাসে একবার বৃদ্ধ কনসালট্যান্ট, মিয়া উদ্দিন আর আমাকে সাথে নিয়ে মুরগির খামার পরিদর্শনে যেতেন। অফিসের মাইক্রোবাস আমাদের তুলে নিয়ে গুলশানে এম, ডি'র বাসায় যেতো তাকে নেবার জন্য। গুলশানে তাদের ছায়া সুশীতল গাছপালা ঘেরা বাসায় পৌঁছলে আমরা গাড়ি থেকে নেমে লাইন ধরে দাঁড়াতাম, যেমন করে আমাদের মন্ত্রীরা দাঁড়ায় বিদেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী এলে। এম, ডি ঘুম থেকে উঠে, ফ্রেশ হয়ে, ধীরে সুস্থে নাস্তা করে যখন বাইরে বের হতেন, তখন একটা হুলুস্থূল পরে যেত। কার আগে কে তাকে কিভাবে সেবা করবেন এই নিয়ে। তিনি স্যান্ডেল পড়ে গাড়িতে উঠতেন, তবে তার জুতোগুলো চাকরের হাত থেকে নিয়ে গাড়িতে তোলা হত। আর এই জুতোগুলো গাড়িতে তোলার কাজটা করতেন আমার বস মিয়া উদ্দিন। আমার তখন মনে হত, আমি যেহেতু মিয়া উদ্দিনের স্‌হকারী, আমারও বোধহয় উচিৎ অন্তত একটা জুতো হাতে নেওয়া। কিন্তু জুতো টানাটানির ব্যাপারটা মিয়া উদ্দিনই করতেন। আমাকে অর্ধেক জুতো টানার জন্য তিনি কখনো নতুন কোন এটিকেট শিক্ষা দেননি।
এম,ডি খামারে পৌঁছলে আমিও আর সবার মত অনর্থক ছোটাছুটি করে কাজের ভাণ করতাম। মিয়া উদ্দিন আমাকে মুরগির খাবার তৈরীর মিলে পাঠাতেন এ মাসে কত মণ ফিড মুরগির খোঁয়াড়ে পাঠানো হয়েছে তার হিসেব নিয়ে আসাতে। ফিডমিলটা ছিল এই খামারেরই একটা অংশ। সাত আটজন বেশ বয়স্ক শ্রমিক সারাদিনই পিঠে করে বড় বড় বস্তা মিল থেকে খোঁয়াড়ে এবং খোঁয়াড় থেকে মিলে আনা নেওয়া করতেন। এদের সুপারভাইজার ছিলেন সরু চোয়ালের অধিকারি, খুব শুঁকনো, কালোমতো একটা ছেলে। প্রথমদিন পরিচয়ে সেই ছেলেটা আমাকে জানিয়েছিল যে, সে বি, এ পাশ। এখানকার শ্রমিকদের অধিকাংশই এসেছিল উত্তরবঙ্গ থেকে, ভাগ্যের ফেরে জমিজমা হারিয়ে, নয়ত দেনার দায়ে পরে। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিলাম, একসময়ের কৃষিজীবী নিরীহ এই মানুষগুলো সহজে কাউকে স্যার বলে সম্মোধন করতে পারতেন না। আমি তাদেরকে চাচা বলে ডাকতাম, তারাও আমাকে বাজান বা বাবা বলে সম্মোধন করতেন। এরা সারাদিন পিঠে করে যেসব ভারি বোঝা টানতেন, আমি দেখেছিলাম যে এসব টানার জন্য খুব সাধারণ চাকা লাগানো একধরনের ট্রলি ব্যবহার হয়। আর ঐ ট্রলি গুলোর দামও হাজার টাকার বেশি হবার কথা নয়। ট্রলির চাকার চাইতে এই শ্রমিকদের পিঠের দাম যে আরো অনেক কম, এটা বুঝতে আমার অনেক দিন সময় লেগেছিল। ওখানে শ্রমিকদের সাথে কাজকরে আর একটা বিষয় আমি বুঝেছিলাম। আমি বুঝেছিলাম যে, এই পৃথিবীটাই একমাত্র পৃথিবী নয়। এমন আরো একটা পৃথিবী আছে যেখানে আমাদের এম,ডি আর এই শ্রমিক গুলোর মধ্যে কোন ব্যাবধান নেই। বানানো বিভেদের পৃথিবীর সময় শেষ হলে ঐ শ্রমিকদের সাথে আবার আমার একদিন দেখা হবে, অন্য কোন পৃথিবীতে। আর তখন আমাদের কারো পিঠে কোন বোঝা থাকবে না।
সপ্তাহের বাকি দিন গুলো ঢাকা অফিসে খুব নিরস ভাবে কনসালট্যান্টের লেখা টাইপ করে পার হত। ঘড়ির কাটা ছয়টা বাজতেই আমি ফাইল পত্র গোছাতে শুরু করতাম। আমার কাগজ কলমের শব্দে পাশের ডেস্কের মিয়া উদ্দিন বুঝতে পারতেন আমি এখন বের হব। উনি পাশ থেকে বলে উঠতেন:
- কবির সাহেব বের হচ্ছেন নাকি?
- জি স্যার, আজকে একটু বাসায় কাজ আছে
- প্রতিদিনই কি আপনার বাসায় কাজ থাকে? ছয়টার পরে একদিনও আপনি অফিসে থাকেন না। আপনার তো বউ বাচ্চা নাই, প্রতিদিন সন্ধ্যা হলে আপনি যান কই বলেন তো?
- বাসায় জরুরি কাজ থাকে স্যার
- এম,ডি সাহেব এখনও অফিসে করছেন, আর আপনি বাসায় যাচ্ছেন। উনি যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ অফিসে থাকেন
- উনিতো স্যার দুটার সময় অফিসে আসছেন, আর আমি আসছি নয়টায়
- এভাবে কথা বলবেন না, কবির সাহেব। এরকম করে কথা বললে কোথাও চাকরি করতে পারবেন না। কোন অফিসের লোকেরা ঠিক টাইমে অফিস থেকে বের হয় বলতে পারবেন, সরকারি অফিস ছাড়া
- স্যার, জরুরি কাজ থাকলে কি করব বলেন
- খালি বলেন জরুরি কাজ; কি জরুরি কাজ; বিয়ে শাদির ব্যাপার নাকি
- ওই রকমই স্যার, খুব জরুরি কাজ
প্রতি সন্ধ্যাতেই আমি যখন অফিস থেকে বের হতে চাইতাম, আমাদের এই ধরণের কথাবার্তা হত। মিয়া উদ্দিন যে আমার উপর খুব রাগ করতেন তা কিন্তু নয়। বরং আমার মনে হত সন্ধ্যার ওই সময়টায় তারও খুব ইচ্ছা করতো বাসায় ফিরতে। কিন্তু চাকরিজীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি শিখেছিলেন, যে ধরণের চাকুরি করে তিনি জীবন নির্বাহ করেন তাতে করে রাত নয়টা, দশটা পর্যন্ত অফিস করাটাই নিয়ম।
রাত আটটা বেজে গেলে মিয়া উদ্দিন অফিসের পিয়নকে ক্যাশ থেকে কিছু টাকা বের করে দিতেন পাশের ক্যান্টিন থেকে সবার জন্য ছোলা ভাজা কিনে আনতে। ছোলা ভাজা আর চা, এই ছিল আমাদের প্রতিদিনের নাস্তা। এ নাস্তা প্রতিদিন খেতে খেতে অতিষ্ঠ হয়ে, এক সহকর্মী একদিন বিদ্রোহ করে বসলেন। ঐ নাস্তা তিনি আর খাবেন না। ওই সহকর্মীর মত অফিসে আরো কয়জন ছিলেন যারা রাত দশটার আগে কোনদিন বের হতে পারেন না। ওভার টাইম বলে কোন ব্যাপার ঐ অফিসে ছিলনা। ছোলা ভাজার বিনিময়ে শুধু বিকেল আর সন্ধ্যাগুলো নয়, রাতের প্রহরগুলোও কিনে নিয়েছিল চাকরিদাতা অফিস মালিকেরা।
কিন্তু রাত দশটা পর্যন্ত অফিস করেও মালিকদের খুশি করা সহজ ছিল না। দিনের পর দিন জুতো টানাটানি করেও মিয়া উদ্দিন প্রায়ই এম,ডির কাছে গালি খেতেন। গালিগুলো তিনি ঠিক কি কারণে খেতেন আমি তা জানি না। মিয়া উদ্দিনের প্রধান কাজ ছিল, কোম্পানি যে প্রতিবছর লোকসান করে তার কাগজপত্র বানানো। লাভ দেখালে বিনিয়োগকারী ব্যাংককে লাভের অংশ দিতে হত, আবার আয়করও দিতে হত। আমাদের মালিকরা অন্য সব ব্যবসায়ীর মতই কষ্ট করে মুরগি বেঁচে উপার্জন করা টাকা ব্যাংক বা সরকারের কোষাগারে দেবার ঘোর বিরোধী ছিলেন। মিয়া উদ্দিনের এসব বিষয় বোঝায় কোন ঘাটতি ছিল না, তবুও মাসের একটা বা দুটো দিন তার খুবই খারাপ যেত। আমদের ছাত্র এম,ডি তাকে আক্ষরিক অর্থেই গালিগালাজ করতেন। সেই দিনগুলোতে ডেস্কে ফিরে এসে চুপচাপ বসে থাকতেন মিয়া উদ্দিন। তারপর, অনেকটা সময় পার হলে আমার সাথে ছোটখাট সব গল্প করতেন। তার ছেলেবেলার গল্প করতে ভালবাসতেন তিনি। তাদের হাওড় অঞ্চল বর্ষায় পানিতে ডুবে যেত বলে তার বাবা কি ভাবে তাকে খুব ছোটবেলায় পানিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সাতার শিখিয়েছিলেন অথবা প্রথম কবে বন্ধুদের সাথে স্কুল পালিয়ে শহরে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন, এরকম অনেক গল্প ছিল তার। সেদিন তিনি আর আমাকে কোন নতুন এটিকেট শেখাতেন না। বরং মনে হত ছেলেবেলার গল্পের ভিতর দিয়ে তিনি যে শুধু কিছুক্ষণ আগের তিক্ত অনুভুতি আর প্রতিদিনের দীনতাকে ভুলে যেতে চাচ্ছেন তা নয়। শৈশবের খোলা মাঠে দাড়িয়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও তিনি এটিকেটের ওভারকোটটা খুলে রাখতেন। তার অফিস এটিকেট তো আদতে ছিল প্রাণহীন, বৈচিত্র্যহীন, শুষ্ক চাকুরি জীবনের প্রাত্যহিকতা আর কঠোর বাস্তবতা থেকে পাওয়া কতগুলো সংস্কার মাত্র। বিশ বছর আগে শ্রেফ বেঁচে থাকার জন্য, বউ বাচ্চা নিয়ে সংসারে টিকে থাকার জন্য, ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য অসংখ্য দীনতার ছাঁচে তৈরী প্রাইভেট চাকুরির খাঁচায় তিনি ঢুকে পড়েছিলেন। এইসব রাতে চাকুরিদাতা মালিকের গালি খেলে মনের অবচেতনে যখন সংস্কারের খাঁচাটি ভেঙ্গে পড়ত, তখন শৈশবের দিনগুলো মনে করে তিনি একবার জীবনের কাছ থেকে মুক্তি প্রার্থনা করতেন।
(প্রথম পর্ব সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২২ রাত ২:১৮
৬২টি মন্তব্য ৬২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×