অবশেষে দেখা হলো সেই “পদ্মাবত”। প্রায় এক বছর ধরে যে মুভি নিয়ে দুনিয়ার বিবাদ, সেটা অবশেষে মুক্তি পেয়েছে। আমি ভাবলাম সঞ্জয় লীলা ভানসালির মুভিতে কী আর হবে? একটু নাচ-গান, রং-চং ছাড়া কিছুই তো থাকে না। কিন্তু দুনিয়ার কন্ট্রোভার্সিতে পরার কারণে মুভিটি দেখার ইচ্ছা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। সাধারণত কোন মুভির প্রতি অতিরিক্ত আশা থাকলে সেটা তেমন ভালো লাগে না। কিন্তু পদ্মাবত দেখে আমি পুরাই মুগ্ধ।
কাহিনী ১৩শ সালের দিকের। ভারতের মাটির দিকে তুর্কী-আফগানদের ধীরে ধীরে দখল শুরু হয়ে গিয়েছে। বর্তমানের সুলতান, আলাউদ্দীন খিলজী (রণভীর সিং)। ভয়ংকর শয়তান এক শাসক। একটা একটা করে রাজ্য আক্রমণ করে সেই জায়গার সব নারীদের নিজস্ব হেরেমে বন্দী করে ফেলে। বাকি সারা জীবন সেই নারীদের উপর চলে অত্যাচার। আলাউদ্দীন খিলজী আবার এক্ষেত্রে একটু উদার হয়ে নিজের হেরেমে বিনোদনের জন্য পুরুষদেরকেও রাখতেন। এদিকে চিত্তরের রাজপুত রাজা রতন সিং (শহীদ কাপুর) এর রাণী পদ্মাবতী (দীপিকা পাডুকোন) এর সৌন্দর্যের কথা জানতে পারে খিলজী। তারপর শুরু হয় তার চিত্তর আক্রমণের কাহিনী।
মুভিটি মালিক মোহাম্মদ জায়াসির মহাকাব্য “পদ্মাবত” থেকে অনুপ্রাণিত। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কাহিনী তেমন কোন আহামরি নয়। তবুও চিত্রনাট্য, সংলাপ, এবং অভিনয় নৈপুণ্যের কারণে মুভিটি পুরাই ফাটাফাটি পর্যায় নিয়ে গেছেন ভানসালি। ভানসালির মুভিতে সেট ডিজাইন, লাইটিং বরাবরই ভালো হয় তবে এই মুভির তুলনায় আগের গুলি কিছুই না।
চিত্তরের দূর্গ দেখে আমি কইলাম:”ওরে আল্লাহ্! এত্ত বড়!”। এছাড়া ক্যামেরা এমনভাবে ধরা হয়েছে যেন মনে হচ্ছিল আমি নিজেই সেখানে আছি। মুভির একশান দৃশ্যগুলিও দারুণ। বিশেষ করে শেষের দিকে একটি দৃশ্য দেখেই এতটাই টাশকি খাইসি যে “ট্রয়” এর সেই দ্বৈত লড়াই এর দৃশ্যকেও চ্যালেন্জ দিবে!
অভিনয়ে অবশ্যই প্রথমে নাম আসবে রণভীর সিং এর। ওরে আল্লাহ! কী এ্যাকটিং! পুরাই ফাটাই ফেলসে। প্রতিটি দৃশ্যতে আগুন লাগায় দিসে। খিলজীর চেহারা দেখে সকল দর্শকের মনে ঘৃণা জন্মাবে। তবুও দৃশ্যগুলি বার বার দেখার মত। রণভীর সিং এর এই চরিত্রটি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বদা মনে রাখা হবে। গাব্বার সিং, মোগাম্বো, এবং এবার আলাউদ্দীন খিলজী!
মুভিটি আমি আশা করেছিলাম দীপিকা প্রধান হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। সেকারণে দীপিকার নৈপুণ্য সেরকম দারুন বলা যাচ্ছে না। তবে দারুণ লেগেছে শহীদ কাপুরকে। রতন সিং এর চরিত্রটি অনেক দুর্বল হওয়ার কারণে কেউ এই চরিত্র করতে রাজি ছিল না। আর এদিকে শহীদ কাপুর এতটাই ভাল অভিনয় করেছে যে এটাই তার সেরা অভিনয়। রণভীর সিং এর এত দারুণ অভিনয়ের সামনে পাল্লা দেওয়া এত সহজ ছিল না।
এছাড়া দুইজনের অভিনয়ে পুরাই টাশকি খাইসি। মালিক কাফুর চরিত্রে জিম সর্ভ এবং মেহরুন্নিসা চরিতে অদিতি রাও হায়দ্রী। সহ-অভিনেতাদের চরিত্র এত ভালো হওয়ার কারণে মুভিটি অনেক উঁচু পর্যায়ে চলে গেছে। রতন সিং- পদ্মাবতীর প্রেমের চাইতে খিলজী-মালিক কাফুর এর প্রেমকাহিনী বেশি রোমাঞ্চকর ছিল।
মুভির সংগীত মোটামুটি। তবে “বিনতে দিল” গানটি আমার দারুণ লেগেছে। এছাড়া কিছু সিগনেচার ভানসালি গান আছে, যেমন ঘুমার (মার ডালা) এবং খালিবালি (মালহারি) যেগুলি দেখতে বেশ ভালোই লেগেছে।
মুভিতে বলে রাজপুতদের অনেক বীর দেখানো হয়েছে। সকল রাজপুতেরাই এই মুভি দেখে গর্বিত হবে। সেকারণে হুদা কামে এই মুভির পিছনে লাগার কারণটা কিছুই বুঝলাম না। যদি কেউ এই মুভি দেখে কেউ অসন্তুষ্ট হয় তবে মুসলমানেরা হতে পারে। তবে খিলজী আসল জীবনে আরো বড় শয়তান ছিল। তার শয়তানির কিছুই দেখানো হয়নি এবং সেগুলি একটি পারিবারিক মুভিতে দেখানোও সম্ভব না।
মুভিটির খারাপ দিক নিয়ে কিছু বলি। মুভিটি একটু বেশি বড়। শেষ দৃশ্যটিই প্রায় ১০-১৫ মিনিট ধরে চলতে থাকে। কিছু ভানসালি জাকজমকতা দেখাতে গিয়ে কাহিনী থেমে যায়। এছাড়া সবচেয়ে বড় সমস্যা হল মুভির কাহিনীর মূল বিষয় ছিলো রানী পদ্মাবতীর সৌন্দর্য। কিন্তু দীপিকাকে এত সুন্দরও লাগেনি। সেই জায়গায় অদিতি রাও হায়দ্রীকে বেশী সুন্দর লেগেছে।
এদিকে মানুষজন হুদাই কিছু কথা বলে। যেমন “আলাউদ্দীন খিলজিকে কেন এত শয়তান দেখানো হয়েছে?” আরে ব্যাটা! এই খিলজী হালার পুত এদিকে নারী-পুরুষ-শিশু সবার সাথেই তার যৌন লালসা মিটাইতো। এমনকি সে নিজেকে নবী বানায়ে নতুন ধর্মও বানাতে চেয়েছিল।
আবার অনেকে বলে “রণভীর সিং এর চরিত্রটি “গেম অব থ্রোনস” এর খাল-ড্রোগোর নকল”। কইলেই হইলো? যত্তসব! আবার এই মুভি বলে “সতীদাহ” প্রথাকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু মুভিতে “সতীদাহ” দেখানো হয়নি। যেটা দেখানো হয়েছে সেটি হলো “জওহার” যা শুধুমাত্র যুদ্ধের পরাজয়ের পর পালন করা হতো।
সব মিলিয়ে এই মুভির প্রতি দৃশ্য দারুণভাবে উপভোগ করেছি। নিঃসন্দেহে সঞ্জয় লীলা ভানসালির তৈরী সেরা মুভি।
রেটিং – ৪.৫ / ৫.০
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:০৫