somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিল্লী কা লাড্ডু - পর্ব ৪

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দিল্লী কা লাড্ডু - পর্ব ৪
--------------------------- রমিত আজাদ




(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)

এ্যাম্বেসী থেকে বের হতে হতে বিকাল হয়ে গেলো। ততক্ষণে হাসানের খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ভাবলো একটু খাওয়া-দাওয়া করা যাক। সামান্য হেটে ই-ব্লক মার্কের দিকে গেলো সে। একতলা মার্কেট-টি অবিকল বনানী বা উত্তরার 'সিটি কর্পোরেশন মার্কেট'-এর মত। দোকানগুলোও অবিকল একই রকম। একটা ফটোকপি করার দরকার ছিলো। এক দোকানীকে জিজ্ঞেস করলো, সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। হাসান দোকান-টা খুঁজতে লাগলো, তারপর কোন ফটোকপির দোকান দেখতে না পয়ে আরেকটু এগিয়ে দেখলো, এখানেও করিডোরের জায়গা দখল করে বসে যাওয়ার রীতি আছে। মার্কেটের করিডোরের অর্ধেকটা দখল করে ফটোকপির মেশিন, কম্পিউটার প্রিন্টার স্ক্যানার ইত্যাদি নিয়ে বসে আছে দুই যুবক। তারাই আবার টেলিফোন কার্ড বিক্রি করছে। হাসন কয়েকটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে ফটোকপি ও স্ক্যান করতে বললো। ইমপর্টেন্ট কাজগুলো খুব মনযোগ দিয়ে করার কথা। এক যুবককে দেখে মনে হলো, ছাত্রটাত্র হবে, পার্ট টাইম এই কাজ করে হয়তো। হাসানের কাজ করার সময় একটা তরুনী এলো, পুরুষালী স্বভাবসুলভতায় যুবক দুজন গল্প জুড়ে দিলো তরুনীটির সাথে। হাসানের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো, কারণ তার কাজে তখন আর তারা মনযোগ দিতে পারছে না, দায়সারা গোছের কাজ করছে।

মার্কেটের ভিতর কোন ক্যাফে পেলো না হাসান। একটা মিষ্টির দোকান পেলো শুধু। একজনকে খাওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে মার্কেটের একটা এক্সিট দরজা দেখিয়ে দিলো। হাসান ঐদিক দিয়ে বেরিয়ে, দেখলো এটা মার্কেটের একপাশে, মার্কেট বিল্ডিং ও মেইন রাস্তার মাঝখানে কিছুটা জায়গা। হয়তো এখানে বাগান থাকার কথা, তবে এখানেও জায়গা দখল করে চুলা হাড়িপাতিল প্লেট ইত্যাদি নিয়ে বসে আছে একজন খাবার ব্যবসায়ী। সে আর তার স্ত্রী মিলে গরম গরম সিঙ্গারা ও পুরী ভাজছে। চায়ের ব্যবস্থাও আছে। সিঙ্গারা ও পুরীর সাথে দুই ধরনের সস্-ও দিচ্ছে। বসার কোন ব্যবস্থা নেই, সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। হাসানও ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটি সিঙ্গারা পুরী খেলো। খাবার স্বাদ মোটামুটি, চলে। তারপর চা খেলো, মশলা দেয়া এই মিল্ক-টী হাসানের পছন্দ হলো। দাম কম নয়, তবে বেশীও নয়! পেট-টাকে মোটামুটি শান্ত করে হাসান বের হলো অটোরিকশার সন্ধানে, একটা হোটেল খুঁজে বের করতে হবে।

মার্কেটের সামনেই রাস্তার মোড়ে অপেক্ষমান দুটা অটোরিকশা ছিলো। সেখানে দাঁড়িয়ে হাসান এ্যাভিনিউ-এর অপর পাশে তাকালো, যেখানে আন্ডার কনন্সাট্রকশন একটা বহুতল ভবন ছিলো। এই দৃশ্যটার সাথে সে ঢাকার বসুন্ধরা এলাকার এ্যাপলো হাসপাতালের সামনের রাস্তাটির অবিকল মিল খুঁজে পেলো।
: আপ কাহা যায়েগি? (বুড়োমতন একজন অটোওয়ালা জিজ্ঞাসা করলো)
হাসান: কনাট প্লেসমে যানা চাহতা হ্যায়?
এরপর হাসানের খেয়াল হলো, এই নগরীতে সে একজন নিউ এলিয়েন। শুনেছে দিল্লীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো না। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে, হাসানের কিছুটা সাবধান থাকা প্রয়োজন।
এদিকে অপর ইয়াং অটোওয়ালাটি বারবার হাসানের স্যুটকেসটির দিকে তাকাচ্ছিলো। তাই হাসান ইয়াংটাকে বাদ দিয়ে বুড়ো অটোওয়ালাটিকে চুজ করলো। এবং তাকে হাসান বুঝতে দিতে চায়না যে, সে বহিরাগত এবং সে একটি হোটেল খুঁজছে। বুড়ো অটোওয়ালাটি বললো,
: আপ কই হোটেল ধুন্ধ রাহা হ্যায়?
হাসান: নেহি নেহি। মেরা স্রেফ কনাট প্লেস মে-ই যানা চাহিয়ে।
দরদাম ঠিক করে অটোতে উঠে পড়লো হাসান। হাসান লক্ষ্য করলো যে, দিল্লিতেও স্কুটারগুলোতে মিটার রয়েছে কিন্তু কেউই মিটার মানছে না, বরং দরদাম করেই উঠছে।
মুন্সিয়ানার সাথে অটো চালিয়ে ছুটতে শুরু করলো বৃদ্ধ চালকটি। এবার হাসান একটু দেখতে শুরু করলো অপরিচিত এই প্রাচীন নগরীটি। তবে যেই রাস্তাগুলো দিয়ে অটো ছুটছে সেগুলোকে মোটেও প্রাচীন মনে হলো না। হাসান বুঝলো এটা নিউ দিল্লীর পার্ট। এ অংশের রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, মোটামুটি চওড়া। রাস্তার মাঝে আইল্যান্ড আছে ও দুপাশে সবুজ গাছপালাও আছে। কিছু কিছু মোড়ে গোলাকৃতি আইল্যান্ড যেখানে বাগান ও রঙিন ফোয়ারাও আছে। রাস্তাগুলোতে টিপটপ করে সাইনবোর্ডে রাস্তার নাম ও নির্দেশনা দেয়া আছে। দিল্লীতে প্রচুর রাস্তার নাম মার্গ দিয়ে। পরে অবশ্য হাসান বুঝতে পেরেছিলো, মার্গ মানে পথ বা রাস্তা (সেই যে বুদ্ধের অষ্ট মার্গ!)। একটা জায়গায় চোখে পড়লো, শহীদ ভগৎ সিং মার্গ। এই সেই শিখ বিপ্লবী যিনি বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছিলেন। বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে শিখ বা পাঞ্জাবীদের তুলনায় অনেক বেশী মাত্রায় প্রাণ দিয়েছিলেন বাঙালী বিপ্লবীরা এবং সংখ্যার হিসাবে সেটা কয়েকগুন বেশী হবে, তারপরেও বাঙালী বীরদের নামে দিল্লীতে মার্গ বা রাস্তা আছে কিনা হাসান তা জানেনা। আপাতত কিছু চোখে পরছে না।

একটা বড় রাস্তার পাশে দেখলো বেশ কিছু বড় দূতাবাস, যেমন রুশ দূতাবাস, ফরাসী দূতাবাস আবার মোড় ঘুরলে মার্কিন দূতাবাস। এই রাস্তাটি খুব সুন্দর, মাঝখানে ও রাস্তার দুপাশে খুব চওড়া আইল্যান্ডে বাগিচা। এই জাতীয় রাস্তাকে boulevard বলা হয়। ইউরোপীয় বড় শহরগুলোতে হাসান এরকম অনেক বুলভার্ড দেখেছে। এই রাস্তাটির সাথে ঢাকাতে তুলনা করার মত কোন রাস্তা নাই। এই ভেবে হাসানের মনটা খারাপ হয়ে গেলো! দিল্লীর পথে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। স্ট্রীট লাইটগুলো জ্বলে উঠলো। বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে রাখা কিছু ফোয়ারায় রঙিন আলো জ্বলে উঠলো। আলোর ছটায় ফোয়ারাগুলো চমৎকার ফুটে উঠলো। ঢাকার রাস্তায় কিছু ফোয়ারা থাকলেও ওগুলো চালানো হয় কালেভদ্রে! আবার ঢাকার অনেক সুন্দর ফোয়ারার গায়ে সাটা উচ্চাভিলাষী রাজনীতিবিদদের ছবি সম্বলিত একের পর এক পোস্টারে কদর্য হয়ে উঠেছে ফোয়ারাগুলো! ঢাকাবাসীদের রুচীর এহেন অবস্থা দেখলে সত্যিই খারাপ লাগে!

অবশেষে কনাট প্লেসে এসে পৌঁছালো হাসানের অটোরিকশা। অটোওয়ালা আর একবার হাসান-কে বললো, "আগার আপ কো কই হোটেলকি জরুরৎ হ্যায় তো ম্যায় পৌছ দিউঙ্গা।" কিন্তু হাসান এই রিস্ক নিতে চাইলো না। বললো, "নেহি মেরা কনাট প্লেসই চাহিয়ে।" এই কথা বলে ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলো হাসান।

যেখানে হাসান দাঁড়ালো সেটা দিল্লীর সিটি সেন্টার 'কনাট প্লেস'। একটি চৌরাস্তার মোড়। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে এটা আসলে শাহজাহানাবাদ (বর্তমান নাম পুরাতন দিল্লী) ও নয়াদিল্লী-র একটি সংযোগস্থল। ইংরেজ দখলদাররা ঢাকা বা মুর্শিদাবাদ কোথাও-ই নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করতে পারেনি। তাই তারা তাদের দুর্গ শহর কলিকাতা থেকেই প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেভাবে কলিকাতা হয়ে ওঠে বৃটিশ রাজ-এর রাজধানী। ধীরে ধীরে কলিকাতা কেন্দ্রিক একটি দেশীয় দালাল শ্রেণী যেমন গড়ে ওঠে, তেমনি আবার কলিকাতা-কে ঘিরেই স্বাধীনতা আন্দোলনও কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। পরিশেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে বৃটিশ রাজ কিছুটা দুর্বল হয়ে গেলে ভারত ছাড়ো আন্দোলন কলিকাতা তথা বাংলায় জোরদার হতে থাকলে, ইংরেজরা আর কলিকাতা বা বাংলা কোথাও-ই থাকা নিরাপদ মনে করেনা। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নিলো প্রশাসনকে উত্তর ভারতে শিফ্ট করতে হবে। সেই মোতাবেক তারা মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী শাহজাহানাবাদ বা পুরাতন দিল্লী-তে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসে। ১৯১১ সালে কোলকাতা রাজধানীর মর্যাদা হারায়, আর দিল্লী রাজধানীর মর্যাদা পায়। তার মানে দাঁড়ালো নয়াদিল্লীর রাজধানী বয়স ১০৮ বছর, আর ঢাকার বর্তমান রাজধানী বয়স ৪৮ বৎসর। নয়াদিল্লী-র রাজধানী বয়স ঢাকার দ্বিগুনেরও বেশী, সেই হিসাবে দিল্লী ঢাকার চাইতে দ্বিগুন উন্নত কিনা হাসান গভীর মনযোগ দিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাহোক, সম্রাট পঞ্চম জর্জ ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর সংঘটিত দরবারে দিল্লী-কে বৃটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষণা করে। তবে পুরাতন দিল্লীটিকে তারা তেমন আরামদায়ক মনে করলো না। তাই সিদ্ধান্ত নিলো যে, পুরাতন দিল্লীর একপাশ থেকে তারা নতুন দিল্লী নির্মান করবে। দিল্লীর ঐ পাশটি ছিলো প্রচুর পরিমানে বাবলা কাঁটাগাছে পরিপূর্ণ, ছিলো একটি শ্বাপদশংকুল কাঁটাগাছের জঙ্গল। ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, দিল্লীর প্রাচীন নাম 'খাণ্ডবপ্রস্থ' যার অর্থ কাঁটা গুল্ম-এর বন। অনেকে মনে যে, এই কাঁটা বন অঞ্চলেই ছিলো মহাভারতে বর্ণিত পাণ্ডবদের রাজ্যের রাজধানী! যাহোক, বৃটিশ রাজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শাহজাহানাবাদ (বর্তমান নাম পুরাতন দিল্লী)-এর পাশ থেকেই নির্মান কাজ শুরু হয়। কন্সট্রাকশন ওয়ার্ক শুরু হয় ১৯২৯ সালে এবং শেষ হয় ১৯৩৩ সালে। রাণী ভিক্টোরিয়ার তৃতীয় পুত্র Duke of Connaught-এর নামানুসারে বিজনেস সেন্টারটির নাম দেয়া হয় Connaught Place।

হাসান কনাট প্লেসে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো, এখন সে কোথায় যাবে। আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলো সে, অত্যাধুনিক দোকানপাট রয়েছে সেখানে। ঢাকার বসুন্ধরা সিটি বা যমুনা ফিউচার পার্কের দোকানগুলোর সাথে তুলনা করা চলে। একবার ফাস্ট ফুডের দোকান 'ম্যাগডোনাল্ডস' চোখে পড়লো। অনেকদিন ম্যাগডোনাল্ডস-এ খাওয়া হয় না হাসানের, একবার ভাবলো ঢুকে কিছু খেয়ে নেয়। তারপর আবার ভাবলো, স্যুটকেস নিয়ে ভিতরে ঢোকা শোভন হবে না। পরে যাওয়া যাবে। ঘুরতে ঘুরতে হাসানের মনে হলো, এই জায়গাগুলো তার অতি চেনা! কেন এমন মনে হলো?!



এক জায়গায় লেখা দেখলো 'সাবওয়ে'। হাসান ভাবলো এটা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো স্টেশন। কাছে এগিয়ে দেখলো যে না। সিম্পলি রাস্তা পার হওয়ার আন্ডারপাস। ফুটপাথের একপাশে একজন জুতাপালিশওয়ালা ব্রাশ-কালি সাঁজিয়ে ফ্লোরে বসে ক্রেতার অপেক্ষা করছে, অবিকল ঢাকার দৃশ্য। হাসান এগিয়ে গিয়ে তার জুতাজোড়া খুলে দিলো। "কিৎনি রূপেয়া লাগে গা?" হাসান প্রশ্ন করলো। "বিস রূপেয়া" জুতাপালিশওয়ালা-র উত্তর। ঢাকাতেও জুতা পালিশ করতে বিশ টাকা লাগে, মনে মনে ভাবলো হাসান। পালিশ করা শেষ হলে, ঢাকার জুতাপালিশওয়ালাদের মতই সেও জুতার এদিক-ওদিক দেখে বলতে লাগলো যে, জুতার এখানে ওখানে সমস্যা আছে, একটা এক্সট্রা শুকতলী লাগালে ভালো হবে। তার আগ্রহ দেখে হাসান বললো, "ঠিক হ্যাঁ, করিয়ে রিপেয়ার।" সে ভালোভাবেই রিপেয়ার করে দিলো। হাসান বললো, "আভ, কিৎনি হুয়া?"
"স রূপেয়া।" জুতাপালিশওয়ালা-র সাফ সাফ উত্তর।
বিশ রুপী থেকে এক লাফে একশত উঠে গেলো চার্জ! হাসান বুঝলো, টেকনিক-টা ঢাকার মতই, যেহেতু সে এই দফা দরদাম করে নেয়নি, তাই জুতাপালিশওয়ালা তার খুশী মত দাম হেঁকে বসেছে। এবার হাসান বার্গেইন করতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত আশি রূপীতে রফা হলো। বাজারে দরদাম নিয়ে এই গ্যাম্বলিং হাসানের একদম পছন্দ হয় না। তবে অনেকেই এটাকে বেশ এনজয় করে।

চকচকে জুতা পড়ে হাসান ভাবতে লাগলো, কোথায় কোন হোটেলে যাওয়া যায়। এরপর সে কোলকাতায় তার পরিচিত এক ব্যাক্তিকে মোবাইলে ফোন করলো। লোকটির সাথে হাসানের কোন পূর্ব পরিচয় ছিলো না, এই ট্রিপেই প্রথম পরিচয়। কিন্তু পরিচয়-এর পর থেকেই সাদামাটা লোকটি হাসানকে ভীষণ সাহায্য করতে শুরু করে। এই জীবনে হাসান-এর ক্ষেত্রে এমন বহুবারই ঘটেছে, একেবারে অপরিচিত স্থানে অচেনা মানুষ যেচে এসে সাহায্য করেছে। হাসান এদেরকে বলে 'এ্যাঞ্জেলস ইন দ্যা সিটি'। ঘোষ বাবু ফোনটা ধরে সব শুনে বললেন, "স্যার আমি আসলে কখনো দিল্লী যাইনি। তাই ভালো বলতে পারবো না। তারপরেও দেখি। কিছুক্ষণ পর ফোন করছি। "
এর মধ্যে হাসান কনাট প্লেসটা আরেকটু ঘুরে দেখতে লাগলো। হু এলাকাটা সুন্দর। ইলেকট্রিক বাতির ব্যবহারও ভালো। সাজানো গোছানো। তবে এই সাঁজানো পরিবেশেও দেখলো কিছু গৃহহীন নরনারী ফুটপাতে অবস্থান করছে, ভিক্ষা করছে। ভূপেনের সেই বিখ্যাত গানটা আরেকবার মনে পড়লো, 'আমি দেখেছি অনেক গগনচুম্বী অট্টালিকার সারি, তার ছায়াতে দেখেছি অনেক গৃহহীন নরনারী।' ইতিমধ্যে ঘোষ বাবু কল ব্যাক করে দুটা হোটেলের নাম দিলেন, যা কনাট প্লেসের কাছাকাছি।



হাসান সাবওয়ের একপাশে এসে দাঁড়ালো অটোরিকশার খোঁজে। এখানে কিছু অপেক্ষমান অটোওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। হাসান এদেরকে মাফিয়া ড্রাইভার বলে। বড় নগরীগুলোতে এরা একটা সিন্ডিকেট করে থাকে। তারপর নগরীর বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে প্যাসেঞ্জারদের অবস্থার সুযোগ নেয়। ভীনদেশী প্যাসেঞ্জার হলে তো কথাই নেই! হাসান এদেরকে কোন সুযোগ নিতে দিতে চায় না। তাই তাদের কাছে গেলো না সে। এর মধ্যে সহসাই একটা অটোরিকশা এসে তার সামনে দাঁড়ালো। " আপ কাহা যায়েগা? হোটেল চাহিয়ে?" মনে হলো স্পিরিচুয়ালী কেউ যেন হাসানের কাছে তাকে পাটিয়ে দিয়েছে। হাসান চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকে মাপার চেষ্টা করলো। আর দশজন মাঝবয়সী হিন্দুস্তানী অটোওয়ালার মতই মামুলী চেহারা। অটোওয়ালার নিজেই বাইরে নেমে এসে হাসানের স্যুটকেস-টি হাতে নিয়ে অটোতে তুলে বললো, "ঘাবড়াইয়ে মাত! আপকো হোটেল চাহিয়ে, ম্যায় দেখাতি হু আচ্ছি হোটেল হ্যায়।" এই সাধারণ লোকটির কথার মধ্যে কিছু একটা ছিলো, হাসানের মত ঝানু লোকও সম্মোহিত হলো। উঠে গেলো তার অটোতে।
অটোওয়ালা: আপ কো কৌন সা হোটেল চাহিয়ে?"
হাসান: ব্রাইট হোটেল যাইয়ে।
অটোওয়ালা: উয়ো ব্রাইট হোটেল তো জরুর মাহিঙ্গি হোগা!
হাসান: মেরা ব্রাইট হোটেলহিই চাহিয়ে। (একটু জোর দিয়ে বললো)
অটোওয়ালা: ঠিক হ্যায়, আগার ব্রাইট হোটেল চাহিয়ে তো ব্রাইট হোটেল-ই দেখাউঙ্গা।
হাসান কিছুটা ঘাবড়াচ্ছিলোও। এই বিশাল নগরীতে সে একজন এলিয়েন, সাথে এই দেশীয় সঙ্গীসাথীও কেউ নেই। এদিকে বাইরে আঁধার রাত্রি বাড়ছে, লোকটা যদি ক্রিমিনাল কেউ হয়! হাসান-কে যদি এমন কোথাও নিয়ে যায়। যদি কোন অঘটন ঘটে!
অটোওয়ালা হাসানের মনের কথা বুঝতে পেরেই বললো কিনা!
অটোওয়ালা: আপ ঘাবড়াইয়ে মাত! ম্যায় ভি কোলকাত্তামে থা। উহাপে কাম করা হ্যায়।
হাসান: তাই! বাংলা বলতে পারেন? (অটোওয়ালা সম্ভবত হাসান-কে ক্যালকেশিয়ান ভাবছে!)
অটোওয়ালা: বাংলা সমঝ্তা হু। কুছ্ বলতেও পারি।
হাসান: ভালো-ই তো হলো। নিজের লোক পেলাম! তা কি করতেন ওখানে?
অটোওয়ালা: ব্যওসায়।
হাসান: কেমন হতো ব্যবসা?
অটোওয়ালা: পহেলী তো আচ্ছি থা। লেকিন ব্যওসা মে তো জোয়াড়-ভাটা হ্যাঁয়! যভ ব্যওসা পর গায়ি তো দিল্লীমে ওয়াপাস আগাই-ই।
হাসান: ও আচ্ছা। তা কতদিন ছিলেন কোলকাতা-তে?
অটোওয়ালা: ছে বরস।
হাসান ভাবলো, ছয় বছর তো অনেক সময়। অটোওয়ালা যা বলছে তাতে তো সে হাফ বাঙালী। এখন এই হাফ বাঙালী কি তাকে ঠিকঠাক মত কোন ভালো হোটেলে পৌঁছে দেবে, না কি আজ রাতে ভয়াবহ কিছু হাসানের জন্য অপেক্ষা করছে???!!! বিপদে পড়লে কি করবে হাসান? কার সাহায্যের আশা করতে পারে সে? হঠাৎ তার সুনিতা-র কথা মনে পড়লো।




------------------------------------------------

রচনাকাল: ২৯শে আগস্ট, ২০১৯ সাল
সময়: দুপুর ১টা ৫০ মিনিট
--------------------------------------

রিমঝিম রিমঝিম ঝরে শ্রাবণ
(Rimjhim Gire Sawan Sulag Sulag Jaaye Mann)

সুরকার: আর. ডি. বর্মন, গীতিকার: যোগেশ গাউর,
গায়ক: কিশোরে কুমার, গায়িকা: লতা মুঙ্গেশকর
বাংলায় অনুবাদ: রমিত আজাদ

(লতা মুঙ্গেশকরের কন্ঠে গাওয়া গানের অনুবাদ)

রিমঝিম রিমঝিম ঝরে শ্রাবণ, জ্বলে জ্বলে ওঠে মন,
বৃষ্টিভেজা এই মরসুমে, লাগলো কি করে এই আগুন?

আগেও তো বর্ষেছিলো এমন বর্ষণ,
আগেও তো ভিজেছিলো আমার বসন,
তবে আজকের বর্ষন থেকে কেন এই নির্গমন,
জ্বলে জ্বলে ওঠে মন,
বৃষ্টিভেজা এই মরসুমে, লাগলো কি করে এই আগুন?

এই বর্ষার বর্ষণ অতীব উত্তপ্ত,
এই বর্ষার বর্ষণ করেছে পথভ্রষ্ট,
মাতাল হায় এই পবন, জ্বলে জ্বলে ওঠে মন,
বৃষ্টিভেজা এই মরসুমে, লাগলো কি করে এই আগুন?



-------------------------------------------------------------------------------------
দিল্লী কা লাড্ডু - পর্ব 3

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:২৬
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×