somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দিল্লী কা লাড্ডু - পর্ব ৬

২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৩:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
দিল্লী কা লাড্ডু - পর্ব ৬
--------------------------- রমিত আজাদ




(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)

শাড়ী পড়া অবস্থায় আনিতা-কে দেখে অভিভূত হয়েছিলো হাসান। কেন? বাঙালী তরুণ হিসাবে শাড়ীর প্রতি পৃথক একটা দুর্বলতা বরাবরই অনুভব করেছে সে। শাড়ী মানে নারী, নারী মানেই শাড়ী, এটাই ছিলো হাসানের চিরন্তন ভাবনা। কলেজ জীবনে হাসানের সাহিত্যের শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, "নারী এক রহস্য! এই রহস্য-কে উন্মোচন করার ব্যগ্রতা পুরুষের চিরন্তন। শাড়ী নারীকে আরো বেশী রহস্যে ঘিরে ফেলে। সূদীর্ঘ প্যাঁচানো প্যাঁচানো পরিচ্ছদ যেন একটা স্তরিভূত প্রতিবন্ধক। রহস্যহীনতার নিরামিষাসিতায় আগ্রহ নেই কারো। স্তরে স্তরে প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে রহস্যেভেদ করার আনন্দই আলাদা!" হতে পারে এই বাণীটি হাসানের মনে গেঁথেছিলো! হতে পারে হাসানের অবচেতন পুরুষ মনের কোথাও এটা সুপ্ত ছিলো! হাসানের এখনো মনে আছে, আনিতার অলক্ষ্যে হাসান দূর থেকে অনেকক্ষণ শাড়ী পরিহিতা আনিতাকে দেখেছিলো। শাড়ী ছাড়া আর কোন পোষাকে নারীর এত রূপস্ফুরণ হয় না। আনিতার শাড়ীটিতে ছিলো নীল-বেগুনী অর্কিড আঁকা। শাড়ীটার প্রতি সেই মুহুর্তে হয়তো কিছুটা ঈর্ষা হচ্ছিলো হাসানের! দুস্প্রাপ্য এক তনুকে পুর্নোদ্যমে জড়িয়ে আছে সেই ভাগ্যবান শাড়ী! প্রথম যেদিন আনিতাকে হাসান দেখেছিলো সেদিন সে ছিলো জিনসের প্যান্ট ও টপস পড়া মামুলি পোষাকে। সেই পোষাকের প্রতি কোন আকর্ষণই ছিলো না হাসানের, আকর্ষণ যা কিছু অনুভব করেছিলো তা সবই ছিলো আনিতার মায়াবী মুখাবয়বে। এরপর সর্বদাই সে থাকতো পশ্চিমা পোষাকে। উপরন্তু আনিতা দীর্ঘাঙ্গীনিও নয়। যদিও হিন্দুস্তানী ললনাদের অনেকেই দীর্ঘাঙ্গীনি হয়। হালকা প্রসাধনের ছোঁয়ায় আগোগোড়া বাহারি শাড়ীতে শোভিত খর্বাকৃতি আনিতাকে সেদিন একটি প্রস্ফুটিত ক্যামেলিয়ার সাথে অনায়াসেই তুলনা করা চলে। সেই প্রস্ফুটিত পুস্প কি সেদিন হাসানের দৃষ্টিতে কোন বৈশাখী ঝড় দেখেছিলো? আর সেই ঝড়ে ক্যামেলিয়ার পাপড়িতেও কি কম্পন উঠেছিলো? মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, নারীরা পুরুষের দৃষ্টিভাষা পড়তে পারে, এই গুণ তাদের জন্মগত!




একটা ভারতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ঐ প্রথম শাড়ীতে এসেছিলো আনিতা। শুধু আনিতা নয়, আরো অনেক ভারতীয় তরুণীই সেদিন শাড়ী পড়ে এসেছিলো। হাসান লক্ষ্য করেছিলো ভারতীয়দের শাড়ী পড়ার রীতিতে স্থানভিত্তিক পার্থক্য রয়েছে। ইতিপূর্বে ভিসিআর-এর কল্যাণে হিন্দি ম্যুভিগুলোতে সে এটা সামান্য দেখেছিলো। সেদিন চোখের সামনেই দেখলো। যেমন রাজস্থানীদের শাড়ী পড়ার ঢং একরকম, হিন্দুস্তানীরা বাঙালী ঢংয়েই শাড়ী পড়ে, একেবারেই ভিন্ন ঢংয়ে শাড়ী পড়ে গুজরাটি নারীরা, সেখানে কুঁচির পরিমান খুব বেশী, আঁচলটাও কাঁধ হয়ে ভিন্ন দিক থেকে এসে বুক ঢাকে। বাংলাদেশেও গ্রামে শাড়ী পড়া আর শহরে শাড়ী পড়ার ধরন ছিলো পৃথক। শহুরে মেয়েরা কুঁচি দিয়ে শাড়ী পড়ে, গ্রামের মেয়েরা কুঁচি দিতো না। হাসান পরে জানতে পেরেছিলো যে, পৃথিবীতে শাড়ী পড়ার ১০০টিরও অধিক নথিভুক্ত উপায় প্রচলিত রয়েছে। শাড়ির ইতিহাসবিদ এবং স্বীকৃত বস্ত্রশিল্প পন্ডিত আতা কাপুর চিশতী তার 'শাড়িজ: ট্র্যাডিশন অ্যান্ড বিয়ন্ড' গ্রন্থে শাড়ি পরিধানের ১০৮টি পদ্ধতি নথিভুক্ত করেছেন। বাংলাদেশের পাহাড়পুর থেকে প্রাপ্ত পাল আমলের কিছু ভাস্কর্য দেখে অনুমান করা যায় যে, অষ্টম শতাব্দীতে শাড়ি ছিল প্রাচীন বাংলার প্রচলিত পোশাক। বস্তুত বাংলাদেশের উষ্ণ ও হিউমিড আবহাওয়ায় শাড়ী একটা কমফোর্টেবল পোষাকই বটে।

শাড়ীর সাথে নারীর নাভির একটা সম্পর্ক হয়তো আছে! ঐ কাঁচা বয়সে নারীর নাভী বা দেহের বাঁক/ঢেউ সম্পর্কে অত মাথা ঘামাতো না হাসান। তখনো সে দেহজ প্রেম ও প্লেটনিক প্রেমের পার্থক্য করতে শেখেনি। তার কাছে প্রেম ছিলো শ্বাশত ও স্বর্গীয়। প্রেমের শ্রেণিবিভাগের সাথে কোন পরিচয় ছিলো না হাসানের। তবে আনিতা নাভি ঢেকেই শাড়ী পড়েছিলো। তার শাড়ীর বাঁধনও আটসাঁট সিডাকটিভ ছিলো না। হাসান লক্ষ্য করেছিলো, দিল্লীর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া আনিতা স্মার্ট, বুদ্ধিমতি, মেধাবী কিন্তু শালীন। যদিও অনেক বাংলাদেশী ও ভারতীয় তরুনীকে হাসান সেই আমলেই পেট ও নাভি উন্মুক্ত করে শাড়ী পড়তে দেখেছে। এমনকি অনেকে এটাকে আধুনিক শাড়ী পড়ার ঢংও মনে করতো! ঢাকাই সিনেমা হলের পোস্টারগুলোতে ইচ্ছা করেই উন্মুক্ত নাভি তরুনীর সিডাকটিভ ছবি দেয়া থাকতো! মুরুব্বীরা বলতেন, "এত লম্বা কাপড়েও তাদের গা ঢাকে না!"





বৃটিশ আমলের হতদরিদ্র অবস্থায় দেশে পুরাতন শাড়ী দিয়ে তৈরী হতো শীতের কাঁথা! ইংরেজ শোষণের যাতাকলে পড়ে অসহায় সামান্য কম্বল কেনার মত অবস্থায়ও ছিলো না দেশের বেশীরভাগ মানুষ। যেই শাড়ী অনেকগুলো বছর ব্যবহৃত হতো দেহ ঢাকতে, সেই শাড়ীই আবার ব্যবহৃত হতো শীতের কষ্ট কমাতে। তবে বাড়ীর মাতা-মাতামহীদের শাড়ীতে তৈরী কাঁথায় একটা নির্ভেজাল মায়া থাকতো! সূতি কাপড়ে বানানো কাঁথা হতো মোলায়েম। বৃষ্টিভেজা বর্ষারাত্রিগুলোতে কম্বলের চাইতে কাঁথাই বেশী আরামদায়ক ছিলো!





হাসান তার ছেলেবেলায় লক্ষ্য করেছিলো যে, ঢাকা ও অন্যান্য শহরাঞ্চলে অবিবাহিত মেয়েরা শাড়ী বা সালোয়ার-কামিস যেকোনটাই পড়তো, কিন্তু বিবাহিতারা আর সালোয়ার-কামিস পড়তো না, তারা সর্বদা শাড়ীই পড়তো। তবে পরবর্তিতে এই ট্রেডিশন উঠে যায়! গ্রামগুলোতে ছোটবেলা থেকেই শাড়ী পড়তো মেয়েরা।

ইউরোপীয় এক তরুণী হাসানকে বলেছিলো, "তোমাদের দেশের মেয়েদের পরিধেয় শাড়ী-টা বোধহয় খুব আনকমফোর্টেবল পোষাক, তাই না?" অপরদিকে, হাসান ও আনিতার রুশ শিক্ষিকা বলেছিলেন, "শাড়ী এমন একটা পোষাক, যা পরিধান করলে নিজেকে সত্যিকারের রমণী-ই মনে হয়। আনিতা, তুমি আমাকে শাড়ী পড়া শিখিয়ে দেবে?" আনিতা মিষ্টি হেসে বলেছিলো, "জ্বী, শিখিয়ে দেব।"

হাসানের তীব্র পছন্দের পোশাক শাড়ি। এতটাই পছন্দ যে পরবর্তি জীবনে উপমহাদেশীয় কোন নারীর সাথে অভিসারের সুযোগ পেলেই হাসান বলতো, "শাড়ী পড়ে আসবে কিন্তু!"

এই শাড়ী নিয়ে রয়েছে অজস্র কবিতা, গান। রোমান্টিক কবি নজরুলের এমন দু'টি গান হলো, 'তার রূপ চাপেনা নীল শাড়ী', এবং 'নীলাম্বরী শাড়ী পড়ে নীল যমুনায় কে যায়?" যে প্রেমের কবি তার সমৃদ্ধ কল্পনাশক্তি দিয়ে জোছনার থেকে চন্দন এনে, আর রংধনু থেকে লাল রঙ ছেনে প্রিয়ার গায়ে-পায়ে মাখাতে চেয়েছিলেন, তার শাড়ী নির্ভর গানকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় আছে?

শাড়ী নিয়ে এত এত চিন্তা ও স্মৃতিতাড়না শেষে বিরহ কাতর হাসানের মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিলো,
কখনো শাড়ীতে কখনো পশ্চিমা পোষাকে মনোরমা আনিতা কি এখন কারো ঘরের ঘরণী? হওয়ারই তো কথা! মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না! কে মেনে নেয় চিরকালীন নিঃসঙ্গতা? আনিতাকে যে জীবনে জড়াতে পারলো কে সেই সৌভাগ্যবান? নিজের লেখা একটা কবিতা মনে পড়লো হাসানের,

যদিও তোমার পাশে তিনি,
যদিও উনার পাশে তুমি!
তবুও ক্যানভাসে আঁকি আমি,
আমার পাশে তুমি,
আর তোমার পাশে আমি।
রঙ তো আছেই,
বেদনার লাল-নীল রঙ।
আমি তুলি দিয়ে ঝিনুকে ক্ষত পুরে দেব,
পুশে রাখা যন্ত্রণাটা মুক্তো হয়ে ফলুক!

(চলবে)

রচনাতারিখ: ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সাল
সময়: রাত ১২টা ৫০ মিনিট

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
নীল শাড়ি মাধুরী
----------------- রমিত আজাদ

এই নীল শাড়ীতে, রংধনু পাড়েতে,
কতবার এসেছিলে ভরাতে হৃদয়!
ছড়ানো এ কেশেতে, বরষার মেঘেতে,
সোনা বালা গহনায়, রাঙাতে দ্বিধায়।

রঙের মাধুরী মেখে অধরে দুটি,
নয়নের অঞ্জনে, দৃষ্টির সিঞ্চনে,
কত সুধা মেখেছিলে
মায়াবী কায়ায়!!!

তুমি আজ দূরে তবু আছো মোর পাশে,
তোমার ছবিটি এঁকে রেখেছিগো কাছে।
নীলাভ শাড়ীরও ছায়া, দোলানো দুলেরও মায়া,
পটভূমি প্রকৃতির কত না আবেশ!

জেনে রেখো সুদূরিকা মহাসাগরের তীরে,
এপারে আছে এক, শত মানুষের ভীড়ে।
তোমার রূপের সুধা যার মনে দেয় দোলা,
যার মনে মধুস্মৃতি, এখনো যায়না ভোলা।
--------------------------------------

কবিতার রচনাতারিখ: ২৫শে মে, ২০১৯ সাল
সময়: ১১টা ২২ মিনিট

The Beauty of a Blue Saree


সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:০২
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×