শুক্রবার (৭ আগস্ট ২০২০) সকালে সুমন ভাই'র ফেসবুক পোস্টটি যখন আমার চোখে পড়লো, তখন প্রায় ৫০ মিনিট গড়িয়ে গেছে। একটি ভয়ংকর দুর্ঘটনার খবর ছিলো সেটি। রেশমা নাহার রত্না সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেকের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। আমি যখন নিউজটি দেখলাম, ততক্ষণে সুমন ভাই আর উজ্জ্বল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পৌঁছে গেছেন। আমি প্রায় কুঁড়ি মিনিট জাস্ট থ' মেড়ে বসেছিলাম। তারপর ফেসবুক থেকে রত্নার একটা ছবি নিয়ে একটা স্টাটাস দিলাম। ততক্ষণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে যারা নানাভাবে জড়িত এবং রত্নাকে যারা সরাসরি চিনতো তারা এই সংবাদ পেয়ে গেছেন।
রত্নার সাথে আমার প্রথম পরিচয় সম্ভবত ২০১৪ বা ২০১৫ সালের দিকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে। কথায় কথায় জানলাম রত্না নড়াইলের মেয়ে। পড়াশুনা করেছেন ইডেন কলেজে। একটা ইশকুলে শিক্ষকতা করেন। এর বাইরে রত্না অনেক কিছুতেই জড়িত ছিলেন। বাফা (বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস)-তে স্প্যানিশ গিটার শিখতেন। ভীষণ পড়ুয়া মেয়ে ছিলেন। ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচত্রের সদস্য। কেন্দ্রের যে কোনো ধরনের প্রোগ্রামে রত্নাকে নিয়মিত দেখা যেতো।
কিন্তু রত্নার সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার। স্বপ্ন ছিলো হিমালয়ের মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার। আর এজন্য রত্না নিজেকে সারাক্ষণ প্রস্তুতির মধ্যে রাখতেন। মেরাথন দৌঁড় থেকে শুরু করে সাইক্লিং, সাঁতার, ক্লাইম্বিং ওয়াল বানানো। নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য যত ধরনের প্রশিক্ষণ দরকার, সবগুলোই নিচ্ছিলেন রত্না।
শুরুটা ২০১৬ সালে একটি ক্লাবে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত কেওক্রাডং এর চূড়ায় আরোহণের মাধ্যমে। একই বছর ওই ক্লাবের সহযোগিতায় পর্বতারোহণের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশি যান নেহেরু ইন্সটিটিউট অব মাউন্টেইনিয়ারিং-এ প্রশিক্ষণ নিতে। পরবর্তী সময়ে নিজ উদ্যোগে পুনরায় মৌলিক প্রশিক্ষণ ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন।
২০১৮ সালে রত্না আফ্রিকার সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত মাউন্ট কেনিয়া অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। তারপর ২০১৯ সালের ২৪ আগস্ট ভারতের লাদাখে অবস্থিত স্টক কাঙ্গরি পর্বত (৬১৫৩ মিটার) এবং ৩০ আগস্ট কাং ইয়াতসে-২ পর্বত (৬২৫০ মিটার) সফলভাবে আরোহণ করেন রত্না।
করোনা মহামারীর মধ্যেও রত্না নিজের অদম্য ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তারই অংশ হিসেবে রোজ সকালে এক্সারসাইজ করতেন, হাতিরঝিলে মেরাথন দৌঁড়াতেন, আর সাইক্লিং করে মিরপুরের বাসায় যেতেন। রত্নার বন্ধুদের অনেক পোস্ট থেকে জানলাম, ৬ আগস্ট ক্রিসেন্ট লেকে দাঁড়িয়ে রত্না একটি সেলফি তুলে 'শুভ সকাল (গুড মর্নিং)' লিখে ফেসবুকে স্টাটাস দিয়েছিলেন। আর ঠিক পরদিন ৭ আগস্ট একই জায়গায় তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। কী নির্মম এই ইতিহাস!
রত্নার এই অনাকাঙ্খিত মৃত্যু বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। রত্নার যারা শুভাকাঙ্খী তারা কেউ এখন পর্যন্ত রত্নার এই মৃত্যুকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। প্রথম প্রশ্ন রত্নাকে যে গাড়িটি চাপা দিয়েছিলো, সেটি কী প্রাইভেট কার ছিলো? নাকি মাইক্রোবাস ছিলো? নাকি ভক্সওয়াগন ছিলো? এক একটি মিডিয়া এক একটির কথা উল্লেখ করেছে। একটি পত্রিকা উল্লেখ করেছে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাসের কথা!
স্বাভাবিকভাবেই তখন প্রশ্ন ওঠে, যদি কালো রঙের মাইক্রোবাস হয়ে থাকে, তাহলে কী রত্না একটি পরিকল্পিত খুনের শিকার? আর ঘাতকদল রত্নার চলাফেরার সকল রুটঘাট জেনেশুনেই, নিয়মিত রত্নাকে অনুসরণ করেই জুতসই জায়গায় ঘটনাটি ঘটিয়েছে! যদিও এসব খুঁজে বের করার দায়িত্ব এখন পুলিশের।
আমরা জানি, পুরো সংসদ এলাকা সিসিটিভি'র আওতায়। চন্দ্রিমা উদ্যানের ব্রিজ-সংলগ্ন যে জায়গাটিতে রত্না দুর্ঘটনার শিকার হন, সেই জায়গাটিও সিসিটিভি'র আওতায় থাকার কথা। তাহলে পুলিশ ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই ঘটনার জন্য দায়ী গাড়িটি সনাক্ত করতে পারার কথা।
দ্বিতীয় যে জিনিসটি খেয়াল করা দরকার- ক্রিসেন্ট লেক সড়কের উভয়মুখে সবসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি থাকে। অথচ ঘাতক গাড়িটি একজন মানুষকে হত্যা করে নির্বিঘ্নে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনে থেকেই পালিয়ে যেতে পারলো? রত্নার নিহত হবার ঘটনাটি স্রেফ দুর্ঘটনাই হোক আর পরিকল্পিত খুন হোক, যেটাই হোক না কেন, তা এখন খুঁজে বের করার দায়িত্ব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর।
কারণ, জায়গাটি খুবই সেনসেটিভ এরিয়া। খুব কাছেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী'র সরকারি বাসভবন, গণভবন। গণভবনের এত নিকটেই একেবারে দিনেবেলায় এরকম একটি ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটলো অথচ ঘাতক গাড়িটি পালিয়ে যেতে পারলো, তাহলে আরো অনেক প্রশ্নই সামনে আসে! সেসব প্রশ্ন বরং আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নিজেদের কাজের স্বার্থেই বের করবেন বলেই আমরা প্রত্যাশা করি।
এমনিতে বাংলাদেশের নারীদের উপর পুরুষ সমাজের সারাক্ষণ খবরদারি করার একটা প্রচলন চালু রয়েছে। প্রচলিত সমাজের এই ট্যাবু ভেঙে রত্নার মত মেয়েরা নিজেদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেই স্বপ্নজয়ের জন্য এগিয়ে যান। আমাদের প্রচলিত সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো যেখানে এখনো সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির হাত ধরে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় নারীকে এখনো ঘরে বন্দি করতে চায়, সেখানে রত্নার মত মেয়েদের জন্য এই প্রচল ভাঙাটাই একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। সেখানে একজন রত্নাকে কত কাঠখড় পুড়িয়ে নিজেকে তৈরি করতে হয়, সেটা হয়তো আমরা বাইরে থেকে কিছুটা অনুমান করতে পারি, কিন্তু ভেতরটা একদমই দেখতে পাই না!
এই কাঠামোর ভেতরটায় যে কত গ্লানি, কত দুঃখ, কত যন্ত্রণা, কত অসহায়ত্ব, কত বাধা, কত হাজারো সীমাবদ্ধতা নিয়ে রত্নার মত মেয়েদের মাউন্ট এভারেস্টের চেয়েও কঠিন এসব বাধাকে অতিক্রম করে স্বপ্নজয়ের নেশায় ছুটতে হয়, তা হয়তো আমরা মোটেও অনুমান করতেই পারি না। বাস্তবটা হয়তো তার চেয়েও রূঢ়, তারচেয়েও জঘন্য, তারচেয়েও ভয়ংকর কঠিন। সেই কঠিনকে ভালোবেসে রত্নারা যখন বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে, তখন আমরা কেবল হাততালি দেবার জন্য বসে থাকি! রত্নাদের কষ্টটা, ভেতরের ক্ষরণটা, তীলে তীলে নিষ্পেশিত হবার ঘটনা হয়তো আমরা কেউ আদৌ দেখতে পাই না।
তারপরেও একবুক স্বপ্ন নিয়ে, পরম যত্নে রত্নারা স্বপ্নজয়ের জন্য উদ্যোগী হয়। একটু সাপোর্ট পেলেই তারা ভেতরের অদম্য ইচ্ছাকে বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেন। মাউন্ট এভারেস্ট বিজয়ী আমাদের একজন নিশাত মজুমদার আছেন। এটা আমাদের গর্ব। মাউন্ট এভারেস্ট বিজয়ী আমাদের একজন ওয়াসফিয়া নাজনীন আছেন। এটা বাংলাদেশের অহংকার। সেই গর্ব ও অহংকারের পালকে রত্নাদের মত আরো যত ফুল ফুটতে শুরু করেছে, তাদের লালন-পালন করা সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে, এমনকি ব্যক্তিগতভাবে করাটাও বাংলাদেশের জন্য কর্তব্য জ্ঞান হওয়া উচিত।
একটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশের আরেকটি গর্ব করার মত, অহংকার করার মত, একটি সোনালী ফুল খুব অকালেই ঝড়ে গেল। বাংলাদেশ একটি রঙিন পালক হারালো। আমরা একটি সম্ভাবনাময়ী উদ্যম তরুণীর করুণ মর্মান্তিক মৃত্যু দেখলাম। এরচেয়ে বড় শোক আর কী হতে পারে!
আমরা সুস্পষ্টভাবেই বলতে চাই- রত্নাকে যে গাড়িটি চাপা দিয়ে এই শোকের স্রোতের উৎপীড়ন ঘটিয়েছে, সেই ঘাতক চালককে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে। এর আগে আমরা মহাসড়কে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের দুই প্রাণপুরুষ তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাতে দেখেছি। দিনে দিনে এই অপমৃত্যুর লাইন খুব দীর্ঘ হচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রকেই উপায় খুঁজে বের করতে হবে। রত্না'র জন্য এই শোকগাঁথা আর দীর্ঘ করতে ইচ্ছে করছে না। গতকাল থেকেই মনটা খুব ভারী হয়ে আছে। রাজধানীতে বাইসাইকেলের জন্য আলাদা লেন হোক। তাহলে হয়তো রত্নার আত্মা শান্তিতে ঘুমাতে পারবে।
----------------------------
রেজা ঘটক
কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা
৮ আগস্ট ২০২০