somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ধান কাটা শুরু!

২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ সকাল ৮:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধান কাটা শুরুর গল্প বলার আগে চলুন আমরা হুমায়ুন আজাদের 'বই' কবিতাটি একবার পড়ি।

বই
হুমায়ুন আজাদ

যে-বই জুড়ে সূর্য ওঠে
পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে
সে-বই তুমি পড়বে।
যে-বই জ্বালে ভিন্ন আলো
তোমায় শেখায় বাসতে ভালো
সে-বই তুমি পড়বে।

যে-বই তোমায় দেখায় ভয়
সেগুলো কোন বই-ই নয়
সে-বই তুমি পড়বে না।
যে-বই তোমায় অন্ধ করে
যে-বই তোমায় বন্দী করে
সে-বই তুমি ছুঁবেই না।


ধান কাটা শুরু-
গ্রামে আমাদের ধান কাটা শুরু হয়েছে। এবছর ধানের ফলন ভালো হয়নি। ধানে পুষ্টি কম। সময় মত বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এবছর ধানে পুষ্টি কম হয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যে যা আসলে মরার উপর খরার ঘা! একদিকে ধানের ফলন কম অন্যদিকে মিলছে না ধানকাটা কিষাণ। সুদূর শিবগঞ্জ-চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে কিষাণ আমদানি করতে হয়েছে। একজন কিষাণ ধান কেটে মাড়াই করার পর দৈনিক পাচ্ছেন গড়ে সাড়ে সাতশো টাকা। এরসাথে তাকে দিতে হচ্ছে তিন বেলা খাবার।

অন্যভাবে হিসাব করলে দৈনিক একজন কিষাণ পাচ্ছেন এক মণ ধান আর তিন বেলা খাবার। এত চড়া মূল্যে ধান কাটার পর কৃষক সেই ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। ধান মাড়াই করার পরেই বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ অপুষ্টি ধান গোলায় ভরার চেয়ে বিক্রি করাই ভালো! কৃষি উৎপাদন ব্যয় মেটানোর আর তো কোনো বিকল্প নাই!

গ্রামে এখন ধান কাটার কিষাণ পাওয়া যায় না। দেশে তৈরি পোষাক কারখানা বৃদ্ধির কারণে আগে যারা কৃষি শ্রমিক ছিলেন তারা পেশা বদল করে এখন শহরে থাকেন আর গার্মেন্টসে চাকুরি করেন। গ্রামে গেলে তারা আর মাঠে শ্রম দিচ্ছেন না। তারা সবাই এখন বাবু। ফলে দেশে এখন চরম কৃষি শ্রমিকের সংকট চলছে। ফসলের পেছনে কৃষকের যা খরচ হচ্ছে তার চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি। কৃষি শ্রমিক সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যয় বছর বছর বেড়ে যাচ্ছে।

বিগত কয়েক দশক জুড়ে দেশে শিল্পায়নের নামে কৃষি শ্রমিককে শহুরে গার্মেন্টস শ্রমিক বানানোর যে হিরিক চলছে, তাতে আগামীতে কৃষি শ্রমিক সংকটের কারণেই কৃষকরা চাষবাস বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। কারণ উৎপাদন ব্যয় বেশি করার পর বছর বছর লোকসান গোণা কৃষকের পক্ষে সম্ভব হবে না।

দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন বলে আমরা যে ফুটানি মারাই, তা এখন পর্যন্ত বলতে গেলে আমাদের কৃষকদের দয়ায় হচ্ছে। কিন্তু কৃষি শ্রমিকের সংকট যখন আরো তীব্র হবে তখন এই ফুটানি শেষ হবে।

কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পায় না। আমরা কৃষিবান্ধব নীতির বদলে শিল্পবান্ধব নীতিকে জাতীয়ভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছি। এখনো দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ কৃষক, যে কারণে সরকারি এই নীতি খালি চোখে টের পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে দেশে সুদান বা উগাণ্ডা থেকে কৃষি শ্রমিক আমদানি করার মত দিন আসতে পারে। তখন আমাদের এই ভুল নীতির খেসারত হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাবে।

বিগত কয়েক বছর ভারতে বড় আকারে কৃষক আন্দোলন হচ্ছে। বাংলাদেশে কৃষক আন্দোলন নেই। আপোষকামী গরীব কৃষকেরা আন্দোলন না করে পেশা বদলকে নতুন উপায় হিসেবে নিচ্ছে। যদি আমাদের কৃষকরা পরপর কয়েক বছর চাষবাস বন্ধ করে দেয় তাহলে আন্দোলনের চেয়েও অটোমেটিক মহাআন্দোলন ঘটে যাবে। দেশে চরম খাদ্য সংকট তৈরি হয়ে দুর্ভিক্ষ শুরু হবে। কোনো সরকারের পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না।

বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষকদের নেতৃত্বে ধান কেটে দিচ্ছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা কর্মীদের নিয়ে কৃষকের ধান কেটে দিয়ে ভোট নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। এতে কৃষকের সাময়িক সুবিধা হচ্ছে বটে কিন্তু আমাদের কৃষি নীতির যে ভুল পদ্ধতির কারণে এই সংকট দিনদিন প্রকট হচ্ছে সেদিকে সরকার বাহাদুরের কোনো নজর নেই।

বিগত ৫০ বছরে আমরা কোনো কৃষিবান্ধব সরকার পাইনি। যা পেয়েছি সবাই শিল্পবান্ধব সরকার। প্রবাসী শ্রমিকের পাঠানো রেমিট্যান্স, আর কৃষকের এখনো মরার আগপর্যন্ত মাটিতে ফসল ফলানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টার কারণে একধরনের ভারসাম্য এখনো টিকে আছে। কিন্তু কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ভুল কৃষি নীতি প্রয়োগের কারণে বছর বছর যে সংকট আমরা তৈরি করেছি, তা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় এখনো দৃশ্যমান নয়।

'কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে' এই শ্লোগান একদিন সারাদেশে উচ্চারিত হবে। শহুরে বাবুগিড়ি একদিন শেষ হবে। বিপুল জনসংখ্যার দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই। সাড়ে সাত কোটি লোকসংখ্যার দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এখন ২১ কোটির উপরে মানুষ। সরকারি হিসেবে ১৬ কোটি বলা হলেও প্রকৃত সত্য আমরা বলি না।

আমাদের আদমশুমারি গুলো সরকারের চাওয়া পূরণ করে তথ্য প্রকাশ করে। নিয়ম অনুযায়ী এবছর জানুয়ারি মাসে আদমশুমারি হবার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে আমাদের জনসংখ্যা ব্যুরো থেকে এখন পর্যন্ত আদমশুমারি নিয়ে কোনো সরকারি ঘোষণা আমার চোখে পড়েনি।

আমরা মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ বলে গলা ফাটাচ্ছি। কিন্তু কোনো সেক্টরে আমাদের কোনো সঠিক ডাটা নেই। ফলে দেশের প্রকৃত অর্থনৈতিক চিত্র কোনো তথ্যেই সঠিকভাবে পাওয়ার উপায় নাই। সরকারের ইচ্ছায় এক ধরনের মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমরা বাজেট তৈরি করি।

এই মুহূর্তে দেশে কতজন ভিক্ষুক আমরা জানি না। কতজন নিম্ন আয়ের মানুষ আমরা জানি না। কতজন নিম্ন মধ্যবিত্ত, কতজন উচ্চ মধ্যবিত্ত, কতজন উচ্চবিত্ত আমরা জানি না। কিন্তু দেশে যে গরীব আরো গরীব হচ্ছে আর ধনী আরো ধনী হচ্ছে তা রাস্তায় বের হলেই টের পাচ্ছি।

বিগত ৫০ বছরে আমরা কৃষকের বিপক্ষে শিল্পপতিকে দাঁড় করিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মলম বিক্রি করে একটি শক্ত প্রতিপক্ষ তৈরি করেছি। দেশে মৌলবাদের উত্থান হয়েছে। দেশের সবগুলো সেক্টরে পক্ষ-প্রতিপক্ষ তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত বিচারে দেশে কোনো সংস্কৃতি চর্চা হয়নি।

দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয় এখন বোরকায় ছয়লাভ! নিজেদের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে আমরা মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি চর্চায় সবাই ধার্মিক হয়েছি। সংস্কৃতি চর্চা বলতে এখন আমরা পুলিশ পাহারায় পহেলা বৈশাখ পালন করছি। সেখানেও সান্ধ্য আইন জারি হয়েছে।
দেশে সংস্কৃতি চর্চার অভাবে সেখানে মৌলবাদ শক্ত ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। ফলে দেশের ৫০ বছরের ইতিহাস মূলত সংস্কৃতি বিসর্জনের ইতিহাস। ধর্ম নিরপেক্ষ স্বাধীন দেশ থেকে আমরা মডারেট মুসলিম দেশে রূপান্তরিত হয়েছি। বিগত ৫০ বছরে আমরা তিন ধরনের শিক্ষানীতি চালু রেখে সুস্পষ্টভাবে দেশে তিন শ্রেণির মানুষের বিভেদ তৈরি করেছি। বড়লোক ইংরেজি মাধ্যম, মিডলক্লাস বাংলা মাধ্যম, নিম্ন আয়ের মানুষ আরবি মাধ্যম।

প্রতি বছর আমরা শুধু ভারতে যে পরিমাণ টাকা চিকিৎসার নামে ব্যয় করি, সেই টাকায় দেশে উন্নতমানের কয়েক হাজার হাসপাতাল গড়ে তোলা সম্ভব ছিল। আমরা হাসপাতাল বলতে এখন কেবল কংক্রিটের দালান বুঝি!

বাসমালিকদের কারণে দেশে রেল যোগাযোগ বাড়েনি। সবখানেই আমরা রাজনীতি চর্চা করেছি আর মানুষের মধ্যে শ্রেণিবিভাগ করেছি। দেশটা আমরা কেউ গড়ে তুলতে চাইনি।

যেদিন বাংলাদেশের কৃষকরা ভারতের মত বড় ধরনের আন্দোলন করে সবকিছু অচল করে দেবে, সেদিন হয়তো আমাদের চোখে পড়বে ৫০ বছরে আমরা দেশকে উন্নয়নের মুখোশের আড়ালে আসলে কোথায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছি। বুঝবে সেদিন বুঝবে, আর ক'টা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি!

সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০২১ সকাল ৮:৩১
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×