somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ কিম্ভূতকিমাকার

৩০ শে মে, ২০২০ দুপুর ২:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এরকম বেশভূষার লোক এর আগে কখনো দেখি নি আমি ......

প্রথম তাকে দেখলাম দোয়েল চত্বরের ওখানে। বিভিন্ন মাটির জিনিস, সুন্দর সুন্দর ফুলদানী যে জায়গাটাতে বিক্রি করে দোকানীরা- ঐ দোকানগুলোর সামনে। মানুষটা অদ্ভুত সাজপোশাকে ফুটপাথের ওপর বসে ছিলো। যেনো মনে হচ্ছে- 'যেমন-খুশি-তেমন-সাজের' প্রতিযোগিতা থেকে উঠে এসেছে কেউ। আবার ভ্যাগাবন্ডও মনে হচ্ছে না ছেলেটাকে দেখে। কেমন বিদেশী বিদেশী চেহারা......

আমার বুকটা প্রথম দিন ধ্বক করে উঠেছিলো তার দৃষ্টি দেখে। ছেলেটার চোখ ছিলো আশ্চর্য নীল। অনেকেই তার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছিলো তার সাজপোশাকের কারণে, কিন্তু ছেলেটা কোমল মনযোগে তাকিয়ে ছিলো কেবল আমার দিকেই। আমি বেশ একটু বিব্রত বোধ করলাম। একটা অপরিচিত ছেলের সাথে কোন মেয়ের গোপন চোখাচোখি হয়ে গেলে যেমনটা হয়- ওরকম। দ্রুত নজর ফিরিয়ে নিয়ে ভাব করলাম যেনো কাকতালীয়ভাবে চোখ ঘোরাতে ঘোরাতে দৃষ্টি এসে থেমেছিলো তার ওপর।

আমি এর পরদিনও ছেলেটাকে ওখানে দেখলাম। একই জায়গায় একই রকমভাবে বসা। আমি বাসায় ফেরার পথে তাকিয়ে ছিলো আমারই দিকে- ঠিক সেই আগের দিনের মত। তার পরদিনও ঐ একই ঘটনা। এর পরদিনও......

আমি সাধারণত আম্মুর সাথে সবকিছু শেয়ার করতাম। কিন্তু এই ব্যাপারটা কেন জানি বলা হয়ে ওঠে নি তাকে। এর অন্যতম কারণ সম্ভবত ভাইয়ার অসুস্থতা। আমার অতিপ্রিয় বড়ভাই হুমায়ূনকে নিয়ে বাসার সবাই খুব ঝামেলায় ছিলো। তার সমস্যা নিয়েই সবাই অস্থির। তাই আমি আর নিজের কথা বলে সমস্যা বাড়াতে চাই নি। তাছাড়া ভাইয়ার সমস্যাটার তুলনায় আমার সমস্যাটা বেশ সাধারণই বলতে হবে....

আমার ভাই কিছু একটা দেখে খুব ভয় পেতো। অনেক মনরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানো হয়েছে তাকে, অনেক কবিরাজি চিকিতসা চলেছে- কিন্তু লাভের লাভ তেমন কিছু হয় নি। শেষ পর্যন্ত আর উপায় না দেখে আমরা বাসা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঠিক হলো- আগামী মঙ্গলবার আমরা মালিবাগ ছেড়ে যাত্রাবাড়ির ওদিকটায় চলে যাবো।

ভাই এর সমস্যা নিয়ে আমিও খুব মানসিক চাপের মধ্যে ছিলাম দীর্ঘ একটা সময়। ঝামেলাপূর্ণ জীবন সম্ভবত মানুষকে সাহসী করে তোলে। স্বাভাবিক অবস্থায় কোন একটা বিপদকে যতটা গুরুতর বলে মনে হয়, ঘাত-প্রতিঘাতে জীবন চালানো মানুষগুলোর কাছে সে একই বিপদ সহনীয় লাগে। সম্ভবত এ কারণেই আমি ষষ্ঠ দিন কার্জন হল থেকে বেরিয়ে সোজাসুজি লোকটার কাছে চলে গেলাম। তারপর ভনিতা না করে তাকে জিজ্ঞেস করে বসেছিলাম- "আপনি কি আমাকে ফলো করছেন?"
"কি পাবো আপনাকে ফলো করলে?"
আমি ছেলেটার গলার স্বর শুনে চমকে উঠি। অসম্ভব মেলোডিয়াস কন্ঠস্বর। একবার শুনলে শুধু বারবার শুনতে ইচ্ছা করে।
"কাইন্ডলি স্ট্রেইট জবাব দেবেন। আপনাকে আমি গত ছয়দিন যাবত এখানে খেয়াল করছি। বাসায় ফেরত যাবার সময় প্রতিদিন আপনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন......"
"তাকিয়ে থাকাটা নিশ্চই কোন অপরাধ না !"
"অপরাধ না হলেও সেটা অভদ্রতা।"
আমার এই কথা শুনে ছেলেটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। আমার কাছে মনে হলো- ছেলেটার হাসিও তার কন্ঠস্বরের মত, একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে হয়।

আমি সেদিন আর কথা বাড়াই নি। ওদিনই আমাদের মালিবাগ থেকে যাত্রাবাড়ি শিফট হবার কথা। আসবাবপত্র সব আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা পরিবারের চারজন- বাবা-আম্মু, ভাইয়া আর আমি যখন গাড়িতে উঠতে যাবো, তখন ভূত দেখার মত সেই অদ্ভুত পোষাকের ছেলেটাকে দেখে চমকে উঠলাম। সে কিভাবে কিভাবে আমাদের মালিবাগের বাসাটা চিনে চলে এসেছে। দেখলাম- রেলগেটের ওখানে ফুটপাথের ওপর বসে কি একটা বই যেনো পড়ছে। আশ্চর্য তো !

যাত্রাবাড়ির নতুন বাসায় উঠেও আমাদের অবশ্য লাভ তেমন হলো না । ভাইয়া সেই আগের মতই অস্বাভাবিক আচরণ করে যেতে লাগলো। ওদিকে আমিও সে কিম্ভুতকিমাকার লোকটার উপস্থিতিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। ততদিনে সে আমাদের নতুন বাসাটাও চিনে গেছে। হয় তাকে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে দেখি, নয়তো দেখি বাসার আশেপাশে। কখনো লোকটা বই হাতে নিয়ে বসে থাকে, কখনো আবার বাঁশি বাজায়। একদিন তো আমার জন্য দশটা লাল গোলাপ নিয়ে এগিয়ে এলোঃ

"আপনার জন্য!"
"চিনি না, জানি না- এমন একজনের কাছ থেকে ফুল নেবো কেন !"
"এখন হয়তো চেনেন না, কিন্তু ভবিষ্যতেও যে চিনবেন না- তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?"
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। কিন্তু তাই বলে ফুলগুলোও নিলাম না তার। থেমে থেমে বললাম- "মাফ করবেন। আপনার ফুলগুলো নিতে পারছি না আমি। অপরিচিত কারো কাছ থেকে ফুলের মত উপহার নেয়াটা শোভনীয় নয়।"
কিম্ভুতকিমাকার সুন্দর করে হাসলো। তারপর আমার চোখের সামনেই ফুলগুলোকে এডগার এলেন পো'র কবিতাসমগ্রয় পালটে দিলো নিমিষে। ম্যাজিশিয়ানরা স্টেজ ম্যাজিক দেখানোর সময় যেমন রঙ্গিন রুমালকে ফুলে পালটে ফেলেন- সেভাবে !

"পো আমার অন্যতম প্রিয় একজন কবি। আপনি বইটা নিলে খুব খুশি হবো মিস !"

এরপর থেকে প্রায়ই আমি ছেলেটাকে বাসার আশেপাশে দেখা শুরু করলাম। ক্যাম্পাসে আর আগের মত তাকে দেখা যায় না। সকালেও না। বরং রাতে তাকে কখনো গলি ধরে হাটতে, অথবা পূর্বদিকের ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।ইদানিং বরং তার হাসিমুখটা না দেখলেই অস্থির লাগে আমার।

সেদিন সন্ধ্যা থেকেই ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। আমি একবার জানালায় উকি মেরে দেখে এসেছি, এই বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় কেউ কোথাও নেই। আমার মনটা খারাপ লাগছিলো ভীষণ। আবার স্বীকার করতেও মনে চাইছিলো না যে- কিম্ভুতকিমাকার ছেলেটার কারণেই এমন মন খারাপ ! তাছাড়া ভাইয়াও সারাটা দিন কেমন পাগলের মত আচরণ করেছে। আম্মু লাইট নিভিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে ছিলো, খুব নাকি মাথাব্যথা করছে তার। বাবাও আনমনা। ছেলের চিন্তায় যে বাবা আর আম্মু দু'জনেই খুব অস্থির- সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। সব মিলে, খুব বিষণ্ণ আর অন্ধকার মনে হচ্ছিলো আমার সন্ধ্যাটাকে। আমি কিম্ভূতকিমাকারের দেয়া বইটা হাতে নিয়ে ভাইয়ার মাথার কাছে বসে রইলাম। সে এখন শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো তখনো । আমি বৃষ্টির শব্দে আচ্ছন্ন মন নিয়ে বই থেকে কবিতা পড়া আরম্ভ করি। বাইরে থেকে আসা অল্প অল্প বাতাস ভাইয়ার টেবিল ল্যাম্পের উপরদিকটা কাঁপায় মোমের শিখার মত।

It was many and many a year ago,
In a kingdom by the sea,
That a maiden there lived whom you may know
By the name of Annabel Lee......

পড়তে পড়তে কখন যে বৃষ্টি থেমে গিয়ে চাঁদ উঠে গেছে, সেটা টের পাই নি। আমার ঘোর ভাঙ্গলো বাইরে থেকে কিম্ভূতকিমাকারের গলার শব্দ শুনে। সে তার ছোট্ট গিটার- ইউকেলেল বাজিয়ে বাজিয়ে গান গাইছে-

"....I see trees of green and red roses too
I'll watch them bloom for me and you
And I think to myself
What a wonderful world !"

কি সুরেলা তার গলা ! কি অপূর্ব তার কন্ঠস্বর। অদ্ভুত জোছনা হয়েছিলো সে রাতে। ঝড়বাদলায় আমাদের গলির লাইটগুলো সব ভেঙ্গে গেলো। মিউনিসিপ্যালিটির লোক না এলে আর বোধহয় ঠিক হবে না। এতে জোছনা আরো কোমল হয়ে ফুটেছিলো সেদিন। বৃষ্টির দিন দেখে মানুষজনও বোধহয় ঘর থেকে তেমন বেরোয় নি। শুধু একটা কুকুরকে দেখলাম কিম্ভূতকিমাকারের পায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে।

এর পরের কয়েকটা দিন ভাইয়াকে নিয়ে আমাদের খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো। নতুন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হলো তাকে। একগাদা ওষুধ দিলেন ভদ্রলোক। বললেন- সম্ভবত ভাইয়ার স্কিতজোফ্রেনিয়া আছে। এই অসুখটাতে নাকি মানুষ কল্পিত অনেক কিছু দেখতে পায়, বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই। বাবা কোথা থেকে খবর আনলো- যাত্রাবাড়ি এলাকায় একজন বেশ নামকরা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার আছেন। খুব নাকি পসার। তার কাছেও নিয়ে যাওয়া হলো ভাইয়াকে। কারণ নতুন সাইকিয়াট্রিস্টের চিকিৎসায় লাভ তেমন হচ্ছিলো না। বরং দিনকে দিন ভাইয়ার অবস্থা আরো বেশি খারাপ হলো। নিয়ম করে হোমিওপ্যাথি খেয়েও অবস্থার যখন কোন পরিবর্তন দেখলাম না আমরা, তখনই একদিন কিম্ভূতকিমাকার আমার মোবাইলে ফোন দিয়ে বললো-
"আপনার ভাইয়া যেটা দেখে ভয় পায়, ওটাকে সরিয়ে নিয়ে যাবো আজ আমি।"
আমি লোকটার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। অনেক প্রশ্ন জমে ছিলো আমার মাথার মধ্যে, সেগুলোই সব আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করলাম- "আপনি আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলেন? তার চেয়েও বড় কথা- আপনি ভাইয়ার সমস্যার কথাই বা জানেন কিভাবে !! সত্যি করে বলুন তো কে আপনি ?"
"আমি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা।"
"কেন রসিকতা করছেন !"
ফোনের ওপাশে ছেলেটা মৃদু হাসলো। আমার তীব্র, অথচ ক্ষণস্থায়ী স্ফুলিঙ্গের মত একটা ইচ্ছা হলো- কিম্ভুতকিমাকারের গাল একটু ছুঁয়ে দিতে পারতাম যদি ! সাথে সাথেই আমি অসম্ভব লজ্জা পেলাম। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চুপ করে রইলাম বেশ খানিকটা সময়।
"আমি কে- সেটা গুরুত্বপূর্ণ না আসলে। গুরুত্বপূর্ণ হলো- আপনার ভাইয়ের সমস্যার সমাধান !"
"সত্যি পারবেন আপনি ?"- আমার গলা ধরে আসে হঠাত।
"পারলে কি দেবেন?!"- কিম্ভূতকিমাকার কৌতূকের ছলে জিজ্ঞাস করে।
"সামর্থ্যের মধ্যে থাকলে- যা চান, তা-ই দেবো। আপনি জানেন না- ভাইয়া আমাকে কতটা আদর করতো !"
"আমাকে একটা কবিতার বই দিতে হবে । ঠিক আছে !"
আর কিছু না বলেই ফোনের ওপাশ থেকে টুট টুট শব্দ শোনা যেতে লাগলো। লাইনটা কেটে গিয়েছে। নাকি কেটে দিলেন উনি ইচ্ছা করেই ! আসলেই, ছেলেটা তার সাজপোশাকের চেয়েও অদ্ভুত।

আমি কি সেই কিম্ভূতকিমাকারের কথা বিশ্বাস করেছিলাম? করেছিলাম বোধহয়, ঠিক জানি না। ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো আকড়ে ধরে, আমিও হয়তো লোকটার রহস্যময় বেশভূষা, অপূর্ব গলার স্বর অথবা মায়াময় চাহনি দেখে বিভ্রান্ত হয়ে গেছিলাম ঠিক। তবে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর, গোধূলির লালিমা আকাশে থাকতে থাকতে লোকটা কিন্তু সত্যি এলো। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম- উনি উনার ব্যাকপ্যাক থেকে রূপালি একটা বাঁশি টেনে বের করছেন। আমার দিকে তাকিয়ে শুধু অল্প একটু হাসলেন । তারপরই বাশিতে ঠোঁট ছুইয়ে সুর ওঠাতে লাগলেন দ্রুত। আমার কাছে মনে হলো- কিম্ভূতকিমাকারের সেই জাদুময়ী সুর বুঝি বাসার গলি ছাড়িয়ে ধাওয়া করতে শুরু করেছে গোধূলির পিছু পিছু; ধুলোমাটির বন্ধন ছেড়ে রংধনুর বাহুর মত উঠে যেতে চাইছে আকাশের গভীরে। আর সে কি অদ্ভুত সুর ! আমার শরীর পুরোটা ঝিমঝিম করতে থাকলো। আমি দেখতে পেলাম- কিম্ভূতকিমাকার ধীরে ধীরে হাটা শুরু করেছেন দক্ষিণ দিকে। প্রথমে অন্ধ গলি পেরিয়ে-বড় গলি, তারপর বড় গলি পেরিয়ে রাজপথের উদ্দেশে। ছেলেটার পেছন পেছন আলকাতরার মত কালো একটা ছায়াও নেচে নেচে যাচ্ছে। কখনো সেটাকে মনে হয় বুঝি মানুষ, আবার কখনো গাছ...... কখনো কিছুই মনে হয় না, সেটা ময়দার দলার মত আকৃতি পরিবর্তন করতে থাকে দ্রুত।

আমার ঘোর ভাংলো ভাইয়ার গলার স্বর শুনে। ভেতর থেকে ভাইয়া ডাকছে- "বাবা! মা! ঋজু কোথায়, ঋজু?? এই ঋজু এদিকে আয়......"

আমি দৌড়ে গেলাম ভাইয়ার ঘরে। বাবা- আম্মুও এলো। দেখলাম ভাইয়া খুব ঘামছে। আমরা ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ভাইয়া আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললো- "একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি মা। দেখলাম যেনো- জাদুকরদের মত গোল, কালো টুপি আর কালো ওভারকোট পড়া এক ছেলে ঐ জিনিসটাকে টেনে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য !"

আমি কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলাম- "তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে ভাইয়া ! আর ভয় পাবে না তুমি কোনদিন।"-বলেই আর অপেক্ষা করলাম না, ওড়নায় চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে ছুটে এলাম বারান্দায়। ব্যাকুল হয়ে, গলা উচু করে দেখার চেষ্টা করলাম - দক্ষিণ দিকটায় কিম্ভূতকিমাকার কাউকে দেখা যায় কি না ! অবশ্য দেখতে চাইলেও তখন কাউকে দেখতে পেতাম কি না সন্দেহ, কারণ একটু পরপর আমার চোখদু'টো কেবল ঝাপসা হয়ে আসছিলো। ধুরছাই!

আচ্ছা, ঐ দক্ষিণে কি আছে? কোনো অচেনা শহর, লোকালয় নাকি অরণ্য? আরো দক্ষিণে? সমুদ্র??
-------
কিম্ভূতকিমাকারের সাথে সে-ই আমার শেষ দেখা। এরপর অনেক খুজেছি তাকে, কিন্তু কোথাও পাই নি। আম্মুকে বলেছিলাম, আম্মু নরম গলায় বললো- "হয়তো সবটাই তোর কল্পনারে মা। ঐরকম ছেলে কেউ কখনো ছিলো না এই শহরে!"

আম্মুর কথা শুনে আমার বলতে ইচ্ছা করে- স্কুলে পড়া বাচ্চা একটা মেয়ের সাথে এসব ফ্যান্টাসি মানায়, কিন্তু যে আমি কি না ভার্সিটি ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী, সে কেমন করে......!! তারপরি আবার মনে হয়- থাক, তর্ক করে কি হবে। আমি জানি সে সত্যি এসেছিলো। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসেছে কত অসংখ্য বার !

এটা ঠিক- সে হাওয়া হয়ে যাওয়ার পর অনেক খুজেছি আমি তাকে। কিন্তু পাই নি কোথাও। দোয়েল চত্বরের ঐ পাশটায়- যেখানে বিভিন্ন মাটির জিনিস, সুন্দর সুন্দর ফুলদানী বিক্রি করে দোকানীরা; আমদের গলির মাথায় কিংবা ল্যাম্পপোস্টের নীচে। একদিন গুটগুট করে হাটতে হাটতে মালিবাগেও গেলাম। যদি শেষ বিকেলের আলোয় ফুটপাথে বসে কাউকে বই পড়তে দেখি। কিন্তু কিম্ভূতকিমাকারকে খুঁজে আর পাই না আমি। যেনো এই শহরের মানুষগুলোর স্বপ্নে, তাদের অতিচেতনায় লোকটা পুরোপুরি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে! আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না তাকে।

আমার চোখ ক্লান্ত হয়, কিন্তু হৃদয় ক্লান্ত হয় না। এক কিম্ভুতকিমাকারের ঋণ শোধ করার আশা, উৎসাহ আর স্বপ্ন নিয়ে আমার দিনের পর দিন কাটে। আমি নীলক্ষেত থেকে অনেক খুঁজে খুঁজে পাবলো নেরুদা আর জীবনানন্দ দাশের কবিতা সমগ্র কিনে নিয়ে আসলাম একদিন। তারপর যত্ন করে গুছিয়ে রাখলাম- এডগার এলেন পো-কবিতাসমগ্রের পাশে। কিম্ভূতকিমাকার আমার কাছে একটা কবিতার বই চেয়েছিলো। আমার ইচ্ছা- তাকে জীবনানন্দের সমগ্রটাই দেবো।

শরতের এক ঝলমলে সকালে আমি ঘুম থেকে উঠে দেখলাম- ঋণের প্রতিদান হিসেবে যত্ন করে রাখা জীবনানন্দের কবিতাসমগ্রটা হাওয়া হয়ে গেছে টেবিল থেকে। আর কিম্ভূতকিমাকারের দেয়া বইটার জায়গায় উজ্জ্বল হয়ে পড়ে আছে একগুচ্ছ লাল গোলাপ !

আমার স্পষ্ট মনে হলো- নিশ্চই পো'র কবিতাসমগ্রটা কাল রাতে গোলাপে পালটে গেছে, একদিন গোলাপ যেমন পালটে গেছিলো কবিতায় !

("কার মুখ?- আমলকী শাখার পিছনে
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ একদিন দেখেছিলো, আহা,
সে-মুখ ধূসরতম আজ এই পৃথিবীর মনে।

তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র’বে না আর, র’বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ
সেই মুখ আর আমি র’বো সেই স্বপ্নের ভিতরে।")
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২০ দুপুর ২:৩৪
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×