somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ "বিশ্বাসঘাতক"

০২ রা এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


=============
আনন্দ ভাগ করে নেয়ার মত খুব বেশি মানুষ নেই আমার জীবনে। বাবা-মা মারা গেছে বহু আগে। চাকরিপ্রাপ্তির সুসংবাদটা সবার আগে দেয়ার মত মানুষ বলতে শুধু মৌ.....

"সত্যি ! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না আসলে ! কি যে খুশি লাগছে আমার......"

মনে হলো- ফোনের ওপাশে মৌ বুঝি কাঁদছে। আমি একটু অবাক হলাম। এতো অল্পে কাতর হয়ে যাওয়ার মেয়ে ও নয়।

আনন্দের দিনটাকে আরেকটু স্মরণীয় করে রাখতে আমি টিউশনির জমানো টাকা থেকে ওর জন্য একটা শাড়ি কিনেছিলাম। অনেকগুলি টাকা বেরিয়ে গেলো ঠিকই, কিন্তু কলাপাতা রঙের শাড়িটা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। অনেককে বলতে শুনেছি- কলাপাতা শাড়িতে নাকি মেয়েদের গ্রাম্য গ্রাম্য লাগে। কিন্তু সোনালি পাড়ের শাড়িটাতে মৌকে কল্পনা করে আমার গভীর তৃপ্তিতে মন ভরে উঠেছিলো। মনে হলো- এই রঙ মেয়েটাকে আরো মায়া দেবে !

এম্নিতে চাকরিটা অবশ্য আহামরি কিছু না। একটা বিদেশী এনজিওর আন্ডারে। আমি সাইকোলজির ছাত্র থাকা অবস্থাতেই শখের বশে পাপেট নাচানো শিখেছিলাম। ঐ যে- বাচ্চাদেরকে যে 'পাপেট শো' খেলা দেখায়- ওটাই ! তখন ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করি নি- মৃত্যুপথযাত্রী বাচ্চাদের পাপেট খেলা দেখানো হবে আমার চাকরি ! রুটি রুজির অবলম্বন। আমি যেহেতু সাইকোলজিতে অনার্স করেছি, তাই চাকরিদাতাদের ধারণা হয়েছিলো- বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়ো- সবার মন মানসিকতা বুঝে সে অনুযায়ী কাজ করতে আমি সক্ষম। সাথে যোগ হলো 'পাপেট শো' করতে পারার অতিরিক্ত দক্ষতা। সব মিলে ফাইনালি চার জন ক্যান্ডিডেটের মাঝখান থেকে তাঁরা আমাকেই নির্বাচিত করলেন। চাকরির কনফার্মেশন লেটারে লেখা ছিলো- "বিভিন্ন মরণব্যাধি (যেমন- ক্যান্সার) আক্রান্ত বাচ্চা, যাদের আয়ু আর বেশিদিন নেই- এমন শিশুদের বাকি দিনগুলো আনন্দে কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে...... প্রযোজ্য ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষেরাও আমাদের ক্লায়েন্ট হতে পারেন..."

আগেই যেমনটা বলেছি- আহামরি কোন চাকরি এটা না। বেতনও সামান্য। কিন্তু তারপরো, আমার আর মৌ এর জন্য গ্রীষ্মের দাবদাহে বৃষ্টির শীতলতা হয়ে এসেছিলো সে চাকরিটুকু। মৌ এর পড়াশোনা শেষ হয় নি তখনো, অনার্স ফাইনাল ইয়ারে ছিলো ও। তারপরো একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসছিলো। পড়লেখা শেষ করার আগে বিয়ে করবে না- এই বলে বলে ঠেকিয়ে রেখেছিলো সে এতোদিন। কিন্তু আমি তো জানি আসল কারণটা কি ! তাছাড়া মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, বাবা-মাও চায় আধুনিক, শহুরে মানসিকতার তুলনায় একটু তাড়াতাড়ি হলেও মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে, তার ওপর মৌ যেখানে সুন্দরী। পড়ালেখা তো বিয়ের পরও করতে পারবে। ভালো পাত্র কি আর সবসময়......

এনজিওর চাকরি পেয়ে আমার সে দুর্ভাবনা কিছুটা কাটলো। নাই মামার চেয়ে কানা মামা তো ভালো ! যদিও চাকরির প্রথম দিনেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম- কাজগুলো এতোটা সহজ নয় !

শুরুর দিনই আমাকে পাঠানো হলো সাগরিকা নামের এক পেশেন্টের কাছে। মেয়েটার বয়স ছয়-সাত। এর মাঝেই কি একটা ক্যান্সার জানি ধরা পড়েছে ওর। ডাক্তার বলে দিয়েছে- আয়ু আছে বড়জোড় মাস ছয়েক। কর্মজীবনের শুরুতে সে সাগরিকাই ছিলো আমার প্রথম "ক্লায়েন্ট"।

মেয়েটা ভর্তি ছিলো আব্দুল্লাহপুরের এক ক্যান্সার হাসপাতালে। প্রথম দিন দুপুর বারোটার দিকে আমি ওর কেবিনে ঢুকলাম।

হাসপাতালের সাদা গাউন পড়া অবস্থায় আধশোয়া হয়ে ছিলো সে। আমাকে নার্স পরিচয় করিয়ে দিলো-
"সাগরিকা, উনি তোমার বন্ধু হয়, কেমন ! "
সাগরিকা কিছু বললো না। বড়বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু।
"তোমরা দু'জন তাহলে খেলা কর, আমি একটু পর আসছি আবার......"- বলে নার্স বেরিয়ে গেলো।
"তোমার আর আমার নামের মধ্যে মিল আছে, জানো?! তুমি সাগরিকা, আর আমি সাগর।"
আমি এমন কোন হাসির কথা বলি নি, কিন্তু সাগরিকা আমার কথা শুনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে হাসলো। কেমোথেরাপি নিয়ে নিয়ে ওর মাথার চুল সব পড়ে গেছে। আমি কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম- মাথার দু'পাশে দুই ঝুটিতে মেয়েটাকে কেমন লাগতো ! দুই ঝুটির, টিপটপ ক্লিপ লাগানো সাগরিকা কারো কথা শুনে হাসছে- দৃশ্যটা খুব ঝলমলে হবার কথা।

আমি আর বেশি দেরি না করে কাজে লেগে গেলাম। এম্নিতেও আমার সময় অল্প। রোগীর এমন অবস্থায় ভিজিটর আধা ঘন্টার বেশি থাকতে দেয় না। আমি আমার ব্যাগ থেকে দু'টো হ্যান্ড পাপেট বের করে হাতে গলিয়ে নিলাম, একটা ব্যাঙ আরেকটা ছাগলের। তারপর অভিনয় করে করে ছাগলের গলায় বললাম-
"এ-ই সাগর, তুমি সাগরিকাকে একটা কথা বলেছ?"
"কি কথা?"
"তোমার সাথে যে আমার নামেরও মিল আছে। সাগর আর ছাগল !"
আমি কপট রাগের ভঙ্গি করি। সাগরিকা প্রথম পরিচয়ের সংকোচ ভুলে হেসে কুটি কুটি হয়। নিজেও অংশগ্রহণ করতে চায় আমাদের (!) কথোপকথনে-
"ব্যাঙ, তোমার চোখে চশমা কেন !"
"আমি যে সবজি খাই না- এজন্য!"
আমার ভেন্ট্রিলোক্যুইজম (ঠোঁট না নাড়িয়ে কথা বলার দক্ষতা, এতে মনে হয় কথাগুলো অন্য কারো কাছ থেকে আসছে) চললো প্রায় বিশ মিনিট। নার্স এসে হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে-
"খুব মজা হচ্ছে না !"

তখন ব্যাঙ আর ছাগল মারামারি করছিলো। সাগরিকা হেলান দেয়া থেকে উঠে বসে হাসছে আর ওদের মারামারি থামানোর চেষ্টা করছে। নার্স একটা ফাইল নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো- "আজকে টাইম ওভার মিস্টার সাগর। নেক্সট কবে আবার শিডিউল দেয়া হবে, সেটা আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেবো।"

সাগরিকার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আরেকজন ক্যান্সার পেশেন্টের কাছে গিয়েছিলাম। ওর বয়েসও ছয় সাতই হবে। ছেলেটার নাম রুশো। শ্যামলা গায়ের রঙ, বড়দের মত ভ্রু কুচকে থাকে সবসময়। কোনো একজন রোগীর কাছে যাওয়ার আগে তার প্রোফাইল ঘেঁটে যাবার নিয়ম। আমিও সাগরিকা, রুশো ওদের সবার ব্যাপারে একটু স্টাডি করে নিয়েছিলাম আগে থেকেই। তখনই জানতে পারলাম- রুশো ছেলেটার মেজাজ নাকি খুব খিটখিটে। ও নাকি নিজের বাবা-মা'র সাথেও খুব খারাপ ব্যবহার করে।

এক ছুটির দিন কার্জনের মাঠে বসে গল্প করতে করতে মৌ'কে বলেছিলাম রুশোর এই খিটখিটে মেজাজের ব্যাপারে। মৌ দুঃখী গলায় বললো- "বেচারা ! হয়তো ভেতরে ভেতরে শরীর অনেক খারাপ লাগে, কাউকে ঠিকমত বোঝাতে পারে না। সামান্য একটু অসুখেই তো মুড নষ্ট হয়ে যায় আমাদের মত বড় মানুষদের, সেখানে বাচ্চা একটা ছেলে..."

"কিন্তু সাগরিকা তো এমন না ! ওকে তো একটু বেশিই উৎফুল্ল মনে হয় আমার কাছে। কখনো কখনো বরং প্রয়োজনের চেয়েও বেশি..."
"মনে হয় সাগরিকা তোমার প্রেমে পড়েছে!"- মৌ চাপা হাসতে হাসতে আমাকে বললো !
আমিও হাসলাম। মৌ ঘাসের ডগা আঙ্গুলে পেচাতে পেচাতে বলে- "আমাকে একদিন নিয়ে যাবে সাগরিকার কাছে! আমার কেন জানি মনে হয় মেয়েটা অনেক দুঃখী !"
"দুঃখী তো বটেই। এই বয়সেই মরণব্যাধি শরীরে বাসা বেঁধে ফেলেছে......"
"না আমি সেরকম দুঃখের কথা বলি নি! আসলে বোঝাতে পারি নি তোমাকে কথাটা।"- মৌ থেমে থেমে বলে চুপ করে গেলো।

আমি সাইকোলজির ছাত্র হয়েও যেটা অনুমান করি নি, মৌ কেমিস্ট্রির ছাত্রী হয়ে- কেবল আমার মুখে মুখে সাগরিকার কথা শুনে ওর জীবনের একটা বড় সত্যের কথা আঁচ করে ফেলেছিলো। আমিও পরবর্তীতে সাগরিকার মুখ থেকেই জানতে পেরেছিলাম- মেয়েটা আসলেই খুব দুঃখী !

একদিন ব্যাঙ আর ছাগলের পাপেট খেলা দেখিয়ে ফেরত আসার সময় সাগরিকা আমাকে থামালো-
"সাগর ভাইয়া! তুমি একদিন না আমার কাছে জানতে চেয়েছিলে আমি কেন এতো বেশি হাসি। শুনবে !?"
খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন। ভিজিটর'স আওয়ার শেষ হবার পরও নার্স আমাকে তাড়া দিতে ভুলে গেলো। সম্ভবত ঝড়জল মানুষের পুরো সত্তাকে অবসাদগ্রস্ত করে তোলে। কাজকর্ম সহ গোটা জীবনকান্নাই শ্লথ বানিয়ে দেয় সকলের।

সাগরিকা তার গায়ের চাদরটা টেনে নিলো। তারপর ক্লান্ত গলায় বললো- "আমি আগে এতো হাসতাম না, জানো ! আমার আম্মু যখন মারা গেলো, এরপর থেকে তো হাসতে ভুলেই গেছিলাম। কিন্তু যখন ডাক্তার আংকেল বললো- আমার নাকি ক্যান্সার হয়েছে, আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না, তখনই আমার মনে অনেক আনন্দ হলো ! আমার মনে হলো- মরে যাওয়ার পর আমি আবার আম্মুর সাথে থাকতে পারবো। পারবো না সাগর ভাইয়া !"

আমি কিছু না বলে চুপচাপ সাগরিকার বিছানার পাশে বসে ছিলাম সেদিন। হাসপাতালা কেবিনের বৃষ্টিভেজা, ধোঁয়া ধোঁয়া জানালার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিলো- আজই চাকরি থেকে রিজাইন দিয়ে দিলে কেমন হয় ! নিজেকে অপরাধী লাগছিলো ভীষণ। মনে হচ্ছিলো- নিষ্পাপ কিছু শিশু আজ অসুস্থ হয়েছে দেখেই বুঝি আমি দু'টো পয়সা কামাতে পারছি। অথচ আমি খুব ভালোমত জানি- আমাদের এনজিও একটি দাতব্য সংস্থা। মানুষের অসুস্থতা বা মৃত্যুর সাথে এর ফান্ডের কোন সম্পর্কই নেই।

রুশোর ব্যাপারটা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম আরো। ততদিনে ওর সাথে আমার একটা বেশ ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাপেট খেলায় রুশোর পছন্দের চরিত্র ছিলো একটা ডাইনোসর আর হাতি। আমাকে রুশো পাপেট ভাইয়া ডাকতো।
সেদিন রুশোর শরীরটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো হঠাৎ। আমাকে ও কাছে ডেকে ফিসফিস করে বললো-
"পাপেট ভাইয়া, আমি শুরুর দিকে তোমার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করতাম। তার জন্য স্যরি !"
আমি অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বললাম- "আরে, তুমি আবার আমার সাথে খারাপ ব্যবহার কবে করলা? এই ডাইনো, হাতি- তোরা জানিস নাকি ও কিসের কথা বলছে?!"
ডাইনোসর আর হাতি মুখ নাড়াতে নাড়াতে একসাথে বললো- "পাগল ছেলে পাগল ছেলে ! উলটাপালটা কথা বলে......"
"তোমাকে একটা সিক্রেট কথা বলি। তুমি কাউকে বলো না কিন্তু প্লিজ! আব্বু আম্মু আর নার্স আন্টিকে তো কখনোই বলবা না। ওকে?"

আমি মাথাটা নিয়ে রুশোর দিকে ঝুকলাম। ও ফিসফিস করে বললো- "আমি আসলে সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করতাম যেনো আমি মরে যাওয়ার পর কেউ দুঃখ না পায় ! ভালো ব্যবহার করলে সবাই ভাববে- ইশ! এতো গুডবয় একটা মরে গেলো! এখন আর কেউ এগুলো বলবে না, তাই না ! সবাই ভাববে- খারাপ একটা ছেলে মারা গিয়েছে। আব্বু-আম্মুও কষ্ট কম পাবে !"

আমি থ' হয়ে গেলাম। কোন একটা বইতে এমন ঘটনা পড়েছি, সম্ভবত বাস্তব জীবনের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে লেখা। সেখানে এমন একজন রোগীর কথা ছিলো, যে নাকি জেনেশুনেই, ইচ্ছাকৃতভাবে সবার সাথে দুর্ব্যবহার করতো। রোগীর যুক্তি হলো- এতে সে মারা যাওয়ার পর তার আপনজনেরা কষ্ট কম পাবে......
পশ্চিমা কোন দূরদেশের এক লেখিকার লেখা বই রুশোর জীবনের সাথে এতো মিলে গেলো কিভাবে !? ছয়-সাত বছরের একটা বাচ্চা কিসের ইশারায় এমন কৌশলী একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারলো ?! তাহলে সবখানে কি একই নাটক চলছে আসলে? শুধু পাত্র-পাত্রী আলাদা?

একবার আমি মৌ'কে সাথে করে নিয়েই সাগরিকার ওখানে গেলাম। আসলে গিয়েছিলাম অফিসের কাজেই, স্রেফ মৌ'কে সাথে নিয়ে যাওয়া আর কি ! ততদিনে সাগরিকাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাসপাতাল থেকে বলে দিয়েছিলো- এখন হাসপাতালে রাখা যা, বাসায় রাখাও তা-ই। শুধু ট্রিটমেন্টের সময়টাতে ওকে হাসপাতালে আনলেই চলবে।

আগেই বলেছি- মৌ সাইকোলজির ছাত্রী না, কিন্তু তারপরো দেখলাম ও অল্প সময়েই সাগরিকার সাথে ভাব জমিয়ে নিয়েছে। মৌকে আমি সাগরিকার আম্মুর ব্যাপারটা বলেছিলাম, শুনে সাংঘাতিক মন খারাপ করেছিলো সে। আহত গলায় বলেছিলো- "আহারে, এতো ছোট একটা মেয়ের কত কষ্ট !"

অবশ্য সাগরিকার সাথে দেখা হওয়ার দিন মৌ খুব স্বাভাবিক ছিলো। স্বাভাবিকভাবেই কথাবার্তা বললো, গল্প করলো সাগরিকার সাথে- ওর কি খেতে ভালো লাগে, গল্পের বই পড়ে কি না, কোন কার্টুন প্রিয়- এসব ! বিদায় নিয়ে চলে আসার মুহূর্তে আমি দেখলাম মৌ গোপনে নিজের চোখের পানি মুছছে।

সেদিনই আমি ফিসফিস করে মৌকে বললাম- "মৌ, আমি যদি এই চাকরিটা ছেড়ে দেই! তুমি আর কয়েকটা দিন বাসায় ম্যানেজ করতে পারবে না? "
মৌ রিকশায় উঠে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলো। আমার কথা শুনে কিছু বললো না। আমি যখন আমার করা প্রশ্নটাকে ভুলতে বসেছি, তখন সে চোখ মুছে জবাব দিলো -
"পারবো ! তোমার বেশি খারাপ লাগলে তুমি চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারো। অসুবিধা নেই।"
"খারাপ তো লাগেই। একেকদিন একেকজনের সাথে পরিচয় হয়, তারপর ঘনিষ্টতা। একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে না উঠতেই আবার হারাই ওদেরকে।"- তারপর একটু থেমে বললাম- "আমি বোধহয় এখনো অত প্রফেশনাল হয়ে উঠি নি মৌ, তাই সবকিছু প্রফেশনালি চিন্তা করতে পারি না !"
সে হঠাৎ চঞ্চল গলায় বলে- "তোমাকে একদিন বলেছিলাম না, আমাদের একটা মেয়ে হলে ওর নাম রাখবো হৃদি? আচ্ছা মেয়েটার নাম যদি সাগরিকা রাখি......"
আমি কোমল গলায় মৌ এর হাত ধরতে ধরতে বললাম- "আর ছেলে হলে কি রুশো রাখবে?"
মৌ কোন কথা না বলে মাথা নীচু করে রইলো। আমি টের পেলাম ওর হাত জড়াজড়ি করে রাখা আমার হাতের ওপর একটা দু'টো পানির ফোঁটা পড়ছে, গরম মোমের মতন। মৌ কাঁপা কাঁপা গলায় বললো- "আসলে সাগরিকাকে দেখে আসার পর থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না কেন জানি ! অথচ আমি যথেষ্ট শক্ত মেয়ে......"
বাকি পথটা রিকশায় আর কোন কথা হলো না।
--------
এর ঠিক দেড় মাস পর যথারীতি সাগরিকার দায়িত্বে গিয়ে জানলাম মেয়েটা মারা গেছে। সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই চাকরিটা ছেড়ে দেবার। রুশো মারা গিয়েছিলো আরো আগেই। সেদিন রুশোর হাসপাতালে যাবার আগ পর্যন্তও আমি জানতে পারি নি খবরটা। গিয়ে দেখি- সব আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীর ভিড় করে আছে ওখানে। খুব কাঁদছিলো রুশোর মা-বাবা দু'জনই। ওর "খারাপ ব্যবহার তত্ত্ব" শেষমেষ ভুল প্রমাণিত হলো !

মৌ তার কথা রেখেছিলো। আমি চাকরি ছেড়ে দেবার পর অনুমান দুই বছর বিয়ে আটকে রেখেছিলো সে। বাবা-মা'র সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত লাগতো মৌকে। চোখের নীচে কালি জমে গেছিলো। ওকে দেখে দুঃখে, হতাশায় নিজেকে খুব ছোট লাগতো মাঝে মাঝে। হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। প্রায়ই বিড়বিড় করে বলতাম- "তুমি না হয় এক কাজ কর। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির যে লেকচারার তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো, উনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও..."

আমার কথা শুনে রেগে যাওয়ার বদলে বাচ্চা মানুষদের মত প্রবোধ দিত আমাকে- "তুমি তো চেষ্টা করছ সাগর। বাকিটা আল্লাহ ভরসা। এসব নিয়ে মন খারাপ করো না। বাদ দাও তো ! তুমি বরং আমাকে সাগরিকার গল্প বলো। ওর সাথে তোমার শেষ দেখা কবে হয়েছিলো?"

আমি তখন শরতের ঝলমলে দুপুরে মৌ এর সাথে সাগরিকা, রুশো, সাদাফ কিংবা দিহানের গল্প করি। ওরা সবাই আমার একেকজন "ক্লায়েন্ট"। শেষদিকে একজন বয়স্ক মানুষও লিস্টে যোগ হয়েছিলো। উনার দুই কিডনীর কোনটিই নাকি কাজ করছে না। ভদ্রলোকের কথা বলার মতও কেউ নেই। আমার দায়িত্ব পড়েছিলো ওনার সাথে গল্প করে হলেও যেনো উনার শেষ দিনগুলো কিছুটা শান্তি দিই।
মৃত্যুগন্ধী গল্প করতে করতে যখন আমার দমবন্ধ লাগতো, তখন সেটা কিভাবে জানি মৌ বুঝে যেতো। টিএসসি থেকে উঠে ওড়না ঝাড়তে ঝাড়তে বলতো- "চলো একটু হাটি। ঝালমুড়ি খাওয়াও তো আমাকে ?!"

আমরা ক্লান্ত হবার আগ পর্যন্ত ফুলার রোড ধরে হাটতাম। আমার অস্থিরতা কমে আসতো একসময়। পড়ন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে কেন জানি ভীষণ মন খারাপ হয়ে যেতো। আমি তখন মৌ এর হাত স্পর্শ করে বলতাম- "আমাকে কখনো ছেড়ে যেও না প্লিজ !"

সেই মৌ-ই কি না বেইমানি করলো আমার সাথে ! ওর মোটর নিউরন ডিজিজ ধরা পড়লো অক্টোবর মাসে। বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং এর নাকি এই রোগ ছিলো। ডাক্তাররা বললো টেনেটুনে ওর আয়ু আছে বড়জোড় আর কয়েক মাস। ব্যাপারটাকে আরো কঠিন করে তুলতে- মৃত্যুর আগে নাকি ধীরে ধীরে ওর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসবে। যদি একটু বেশিদিন বাঁচেও, সেটাও নাকি বেঁচে থাবে পুরোপুরি প্যারালাইজড অবস্থায় ।

মৌকে হসপিটালাইজ করার পরদিনই আমি ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। ততদিনে ওর বাসার সবাই আমার কথা জেনে গেছে। মৌ ওর বাবা-মা, ভাই সবার সামনেই আমাকে চূড়ান্ত অপমান করলো। গলার স্বর উঁচু করে বলছিলো- "ওকে বের হয়ে যেতে বলো আমার সামনে থেকে! বেকার একটা ছেলের জন্য অপেক্ষা করে করে আমার জীবনটা ছারখার হয়ে গেলো। না পেলাম বাবা-মায়ের সুদৃষ্টি, না পেলাম নিজের জীবনটা গোছাতে। বেরিয়ে যেতে বল ওকে এক্ষুণি! অপদার্থ কোথাকার ! ."

আমি কিছু না বলে অবাক হয়ে মৌয়ের হিংস্র চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এ তো সেই মেয়েটা নয়- যে কি না আমার চূড়ান্ত হতাশার দিনে আমাকে আশার বাণী শোনাতো। জীবনের চরম কঠিন মুহূর্তে যার হাত ধরে নির্ভাবনায় আমি ফুলার রোড ধরে হেঁটে গেছি, কার্জন হলে বসে পার করেছি অসংখ্য জাদুগ্রস্ত বিকেল......... আমার হিসেব মেলে না ! প্রতিউত্তরে কিছু একটা বলার আগেই মৌ এর ভাই এসে আমার হাত টেনে বাইরে নিয়ে গেলো।

এরপরো আমি যতবার মৌকে দেখতে গেছি, ও ততবার আমার সাথে বিকারগ্রস্তের মত আচরণ করেছে। শেষমেষ ওর বাবাই আমাকে বললো- "তুমি আর এসো না প্লিজ ! ডাক্তার সাহেবও বলে দিয়েছেন- উত্তেজিত হওয়াটা মৌ এর জন্য খারাপ।"

মৌ মারা গেলো এর মাস চারেক পর। তার মৃত্যুর খবরটা আমাকে জানিয়েছিলো মিথিলা। মিথিলা মৌ'এর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সব থেকে কাছের বন্ধু ছিলো। ফাগুনের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে মিথিলা কাঁদতে কাঁদতে ফোনে জানালো-"মেয়েটা আজ ভোরে মারা গেছে সাগর ভাই। মৃত্যুর সময় ওর পরনে ছিলো আপনার দেয়া কলাপাতা-রঙ শাড়িটা। কি ভালোবাসাই না এক জীবনে পেলেন আপনি !"

সেদিন রাতেই আমি সাগরিকা আর রুশোকে স্বপ্নে দেখলাম । দেখি সাগরিকা ওর মতই চেহারার একটা মেয়ের সাথে ঘুরছে । চারপাশে অপূর্ব রঙ্গীন বাগান, নীলাভ-পাহাড়ি অরণ্য। আমাকে ঝলমলে গলায় বললো- "মৌ আপুকে বলে দিও- ওকে আমি ভালোবেসেছিলাম !"

রুশো প্রথমে কিছু বললো না। ও আপনমনে ডাইনোসর আর হাতির পাপেট নিয়ে খেলছিলো। স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে রুশোকে স্পষ্ট বলতে শুনলাম- "পাপেট ভাইয়া, জানো! মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষদেরকে দূরে সরাতে হয়......"

আমি কাঁদতে কাঁদতেই ঘুম থেকে জেগে উঠি। আমার মনে হলো- আশ্চর্য, এই সহজ জিনিসটা আমি বুঝতে পারলাম না এতোদিনে ! মৌ ইচ্ছাকৃতভাবেই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে আসছিলো ! ঠিক রুশো যেমন করতো ওর নিশ্চিত মৃত্যু জেনে !

সেদিন গভীর বিষণ্ণ হৃদয় নিয়ে আমি ফুলার রোড ধরে একা একা হাটলাম। জাদুগ্রস্ত গোধূলি নামলো ওখানকার দানবীয় রেইনট্রি গাছগুলির মাথায়, টিএসসি ভবনে, কার্জন হলের ঘাসে। আমার মনে ঘুরতে লাগলো শুধু রুশোর বলা শেষ কথাগুলি- "......মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষদেরকে দূরে সরাতে হয়, জানো !"

আমি নিজের অজান্তেই হাতের তালু দিয়ে নিজের চোখ মুছি। তারপর বিড়বিড় করে নিজের মনেই আবৃত্তি করি -

"তারপর
প’ড়ে থাকে, নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,
হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ- দু-একটা কল্পনার হাঁস;

মনে প’ড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক

কল্পনার হাঁস সব- পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।"

***

(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা এপ্রিল, ২০২১ রাত ৮:০৫
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×