এবার আরো কিছু টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির! এ পর্বে প্রবাসে নিজের ভারতীয়দের সাথে আরো কিছু অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে কেন ওরা আমাদের বাংলাদেশকে ছোট করে দেখে তা বিশ্লেষন করার চেষ্টা করব।
আগের পর্বগুলো:
কানাডার স্কুলে প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (২য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (৩য় পর্ব)
কানাডার স্কুলে প্রথম দিন (চতুর্থ পর্ব)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৫)
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৬) ১৮+
কানাডার স্কুলে এক দিন (পর্ব ৭) আমার ভারতীয়, পাকিস্তানী অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য
আগের পর্বে এক ভারতীয় সহপাঠির কথা বলেছিলাম! এ পর্বে টিচারের কথা বলছি!
আমার E.S.L. ক্লাসের টিচার ছিলেন মি.জি., একজন মধ্যবয়স্ক কানাডিয়ান, প্রচন্ড বিনয়ী, ফ্যামিলিম্যান। আগের কোন পর্বে ওনার কথা বলেছি। আমাদের ক্লাসের কাছেই ছিল মি.জির বন্ধু মি.ল. এর কম্পিউটার ক্লাস। মি.ল. ইয়াং টিচার, অনেক লম্বা ছিলেন, আর গায়ের রং আমাদে মতো শ্যামলা। মাথায় পাগড়ি, দাড়ি ছিল না কিন্তু হাতের বালা দেখে বুঝেছিলাম শিখ। আজকালকার আধুনিক শিখেরা অন্যসব কিছু না মানলেও হাতের বালাটা অবশ্যই পরবে! পাশাপাশি দুই বন্ধু হওয়ায় একটু সময় পেলেই দুজনে একে অপরের রুমে যেতেন কিছুক্ষন গল্প করে আবার নিজেদের ক্লাসে ফিরে যেতেন। আমি তখন মি.জি. এর T.A. ছিলাম। সেমিস্টারের শেষ ক্লাস। প্রায় সব ছেলেমেয়ে নিজের নিজের দেশে চলে যাবে, তাই মি.জি. বললেন ওয়ার্ল্ড ম্যাপের সামনে দাড়িয়ে আমরা সবাই ছবি তুলে রাখি! স্মৃতি হিসেবে সবার কাছে থাকবে। সেসময়ে মি.ল. রুমে ঢুকলেন, তাই মি.জি. তাকেই ছবি তোলার দায়িত্ব দিলেন! সবাই ছবি তোলার জন্যে দাড়িয়ে আছে। মি.জি. মাঝখানে, আর বাকি সবাই আমরা পিছনে হাইট ওয়াইজ। ম্যাপের সামনে সারি সারি লকার ছিল, তার সামনে ক্যামেরা হাতে দাড়িয়ে মি.ল. ।
ছবি তুলতে যাবেন এমন সময়ে মি.ল. কমপ্লেনের সুরে বললেন, "ব্যাংলাদেশী মেয়েটা অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, ওকে সামনে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাকতে বল।" ওনার কোন ক্লাস আমি কখনো করিনি, কিন্তু তাও উনি যখন আমার দেশের নাম জানেন তাহলে ওনার আমার নামও জানার কথা। আর না জানলেও বাংলাদেশকে ভুল উচ্চারন করা, এবং নিজে না বলে মি.জি. কে দিয়ে পরোক্ষভাবে বলার কারন কি আমি জানিনা। ওনার গলার স্বর খুব রুড ছিল। যেন পুরানো কোন রাগ আমার সাথে! মি.জি. পর্যন্ত অপ্রস্তুত। আজকাল অনেক ভারতীয় কানাডিয়ান একসেন্ট নকল করে বাংলাদেশকে ব্যাংলাদেশ বলে! আমাকে কে কি বলল যায় আসে না, কিন্তু এসবে মাথা গরম হয়ে যেত। বয়সে বড়, তারপরে আবার টিচার, আর হতভম্ব অবস্থায় কিছুই বলার জো ছিলনা। সব হয়ে যাওয়ার পরে আমাকে ডেকে নিয়ে মি.জি. বলেছিলেন, "তুমি কিছু মনে করোনা, ও একটু সারকাস্টিক, আমাকেও অনেক কিছুই বলে! But, he is a good man, he helps me a lot." মি.জি. সেরে নিলেন আর কি! আমি ভুল হতে পারি কিন্তু কিছু কিছু ভারতীয় অন্যকে হেল্প করে শুধুমাত্র পরে খারাপ ব্যবহার করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে যে আমার অবস্থান তোমার চেয়ে বড়।
তবে সবাই এক না, এরকমই আলাদা একজনের কথা বলছি!
এক ভারতীয় শিখ মহিলা, বয়স্কা, সদা হাশিখুশি, ছোটখাট টাইপের মানুষ। ইনি আমার মায়ের বান্ধবী। একটা ইংলিশ কোর্স করতে গিয়ে দুজনের পরিচয়। এখন থেকে যা বলছি তা আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা।
প্রথমদিন ক্লাসে মহিলা শার্ট, প্যান্ট এবং মাথায় কাপড় দিয়ে এসেছিলেন। আমার মা বরাবরের মতোই সালোয়ার কামিজ পরেছেন। রুমে ঢুকতেই কোন কথা না বলেই আমার মাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মা হতভম্ব ভাব কাটিয়ে শুনতে পেলেন তিনি বলছেন তিনিও ভারতের। তখন মা বললেন আমি ভারতের না বাংলাদেশের। উনি বললেন আরে আমরাতো একই দেশের ছিলাম! তুমি আমার দেশেরই। কোন ভারতীয়কে এসব বলতে দেখলে বুঝবেন আপনার কোন ক্ষতি করবেনা, কারন ওরা "নিজের দেশের" মানুষের ক্ষতি করে না। ইউনিটি আছে ওদের মধ্যে!
উনি মাকে জিগ্যেস করলেন সালোয়ার সুট পরেছ, কেউ কিছু বলেনি? আমি এবং আমার মা কেন যেন এসবে কোন হেসিটেশন কখনোই ফিল করিনি! কিন্তু সাধারণত আমাদের এদিকের মানুষ কালচার নিয়ে হিনমন্নতায় একটু হেসিটেট ফিল করে! যাই হোক, যখন দেখলেন মায়ের কোন সমস্যা হচ্ছে না, উনি নিজেও পরেরদিন থেকেই সালোয়ার কামিজ পরে আসতেন। আমাদের মতো কামিজ আর পান্জাবীদের ঢিলাঢালা ধুতি! ক্লাস চলাকালিন অনেক মজার গল্প আছে ওনাদের মধ্যে। তবে আমি কোর্স শেষ হয়ে যাওয়ার কয়েক মাস পরের এক গল্প বলব। একদিন আমার মা মোবাইলে ফোন পেলেন ওনার কাছ থেকে যে তোমাদের বাসার সামনে গ্যারেজে এসে দাড়াও। খুব জরুরি। আমার মা চিন্তায় পরে গেলেন, এই বরফের মধ্যে, দুই ঘন্টা ড্রাইভ করে বয়স্কা এসেছেন, নিশ্চই খুব সিরিয়াস ব্যাপার! মা কোন রকমে জ্যাকেট পরে, ওড়না মাথায় জরিয়ে দৌড় দিলেন!
এদিকে আমিও চিন্তা করছি কি হতে পারে? আসলে উনি বাড়িতে দেশি ঘিয়ের লাড্ডু করেছিলেন! মাকে না দিয়ে খাবেন? তাই এত কষ্ট করেছেন! হা হা। আমার মা বললেন বাড়ির কাছাকাছি এসে ফিরে যাবেন নাকি, জলদি বাসায় চলুন। উনি বললেন, " না না তোমার মেয়ের পরীক্ষা, মেহমান গেলে ডিস্টার্ব হবে। In our country, study is the main priority, not like Canada!"
উনি কানাডার ইয়াংদের দেখতে পারতেন না একদম, পড়াশোনা করেনা, খালি বয়ফ্রেন্ড/ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এসব কারনে। আমার পরীক্ষা চলছে এটা ওনাকে বলা হয়নি তবে তখন পরীক্ষার সিজন চলছিল, তাই বিচক্ষন উনি বুঝে গিয়েছিলেন। আমার মা কোনভাবেই আনতে পারলেন না বাড়িতে। মা হাসতে হাসতে বাড়ি আসলেন ওনার এই পাগলামি দেখে, সত্যিই সেই লাড্ডুর স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে!
বিশ্লেষন: আগের পর্বের মতো এ পর্বও ভালো খারাপ অভিজ্ঞতা দিয়ে সাজানো। এবং এ পর্বেও বয়স্কদের মহানুভতা, এবং কমবয়সীদের অভদ্রতা উঠে এসেছে। কেননা তাই আমাদের সাথে সবসময়ে হয়েছে! আসলে ভারতীয় ইয়াংদের অনেকে ভাবে ভারত এবং পাকিস্তানের যুদ্ধ বাংলাদেশকে সৃষ্টি করেছে!! বাংলাদেশ ওদের কাছে ভারতের "হেল্প" নিয়ে জন্মে যাওয়া এক দেশ। ওদের দয়া দাক্ষিনে বেচে থাকা এক দেশ! ওদের চেয়ে ছোট এবং কম ক্ষমতার একটা দেশ। যেন ওদের কোন অগুরুত্বপূর্ণ অংগরাজ্য আমরা। তাই ওরা আশা করে আমাদের মাথাটা নিচু থাকবে ওদের সামনে সবসময়। কিন্তু বয়স্করা সেযুগ দেখেছেন যখন আমরা এক দেশ ছিলাম, তাই এ ভালবাসা বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা না, বাংলাদেশ যে কখনো ইন্ডিয়ার অংশ ছিল সে বিষয়টাকে ভালবাসা।
কানাডা আয়তনে অনেক বড় আর আমেরিকার চেয়ে পিসফুল হওয়ার পরেও আমেরিকানরা কানাডাকে তেমন পাত্তা দেয়না। ওদের নিয়ে কমেডি হয় সব আমেরিকান শোতে। আমেরিকার সব শো কানাডায় পপুলার কিন্তু কানাডার দুই একটা শোই আমেরিকায় ঝড় তুলতে পারে। ছোট্ট একটা উদাহরন দেই, আমার কানাডিয়ান বন্ধুরা Master chef America দেখে, কিন্তু Master chef Canada দেখে না। দুটো দেশই বড়লোক, বাজেট, সেটের কোন পার্থক্য নেই, কিন্তু ওই যে world superpower ওরা! ওদের সম্মানটাই আলাদা। অনেক কানাডিয়ানদেরই দুঃখ করতে দেখেছি এটা বলে যে আমরা ওদের সব নামি মানুষদের চিনি, কিন্তু ওরা আমাদের কাউকে চেনেনা! আমার এক Canadian social studies টিচার দুঃখ, ক্ষোভ করে বলেছিলেন, " I fail to understand why Americans think that Canada is just another province of America!"
কয়েক মাস আগে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে এক ব্রিটিশ জার্নালিস্ট প্রশ্ন করেছিল যে কানাডা কি কখনো আমেরিকার অংশ হতে চায় কিনা? ট্রুডো বলেছিলেন, "কানাডা কখনো আমেরিকার অংশ হবে না, তবে আমেরিকা কানাডার অংশ হতে চাইলে they are most welcome to." ভাবেন, স্বাধীনতার ১৪৯ বছর পরেও, এত উন্নত, বড়লোক, শান্তিপূর্ণ হয়েও এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ওদেরকে!
এসব কথা বলার মানে হচ্ছে যে ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশের বড় ভাই, ছোট ভাই দ্বৈরথও অনেকদিন চলবে! হয়ত কখনোই শেষ হবেনা। কিন্তু এর তীব্রতা কমানোর জন্যে আমাদেরকে অনেক শক্তিশালী হতে হবে, আমরা যতোই উন্নতি করিনা কেন ওরা আমাদের হয়ত সম্মানের চোখে দেখবেনা। কিন্তু আমাদের আত্মসম্মানবোধ, আত্মবিশ্বাস বাড়বে। বিশ্বের চোখে আমাদের মর্যাদা বাড়বে। Then who cares what India thinks about us?
ওরা ভাবলেও আমাদের দেশটা মহান, না ভাবলেও মহান। ওরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে বললেই মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা মিথ্যে হয়ে যাবে না। ওরা নিজেদের হিন্দি আমাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার যতো চেষ্টাই করুক না কেন আমাদের মহান একুশের শহীদ মিনারের সূর্যের দিপ্তী তাতে কমে যাবে না! ওরা আমাদের ক্রিকেট নিয়ে যতোই হাসি তামাশা, ষড়যন্ত্র করুক না কেন মুস্তাফিজ, সাকিব, মাশরাফি ভাইয়ের মতো প্লেয়ার আসা বন্ধ হয়ে যাবেনা। যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম তাতে ফিরে যাচ্ছি। ভারত বাংলাদেশকে যতোসব কারনেই ছোট করে দেখুক না কেন আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। কেননা ওরা ভাবলেই বাংলাদেশ ছোট হয়ে যাবে না। লাল সবুজের পতাকা উড়তে থাকবে, এবং উড়তেই থাকবে গৌরবের সাথে! লাল সবুজের জয় হোক।
বিশেষ কথা: এমন অনেক প্রবাসি আছে যাদের ক্লোজ ভারতীয় বন্ধু আছেন, এবং ব্লগের কিছু ভারতীয় বাংগালিও আমার এ লেখা পড়ে ক্ষুদ্ধ হতেই পারেন। তাদেরকে বলছি এটা আমার প্রবাস জীবনের, আমার অভিজ্ঞতার গল্প। আপনাদের সাথে না মেলাটা নিশ্চই আমার দোষ না। আর সবাই এক না তাতো আমি সবসময় বলিই! ভারতে থাকা বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষীদের সবসময়েই প্রানঢালা শুভেচ্ছা আমাদের পক্ষ থেকে।
এ পর্ব কেমন লাগল এবং পরের পর্বে কি লিখব তা নিয়ে বলুন প্লিজ। ধন্যবাদ।
এ বিষয়ে মি:জির দেখানো একটা ভিডিও দিয়ে শেষ করছি! এ ভিডিওটা দেখে আমারই রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল, এই এডে একজন কানাডিয়ান ছেলে, কানাডিয়ান স্টেরিওটাইপ, এবং কানাডা আর আমেরিকার পার্থক্যগুলো নিয়ে কথা বলে!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৮