somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হজরত সুলাইমান (আঃ), জীন ও শেবার রানী

১৯ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৫:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শেবা রাজ্য

গল্পের ছলে হজরত সুলাইমান (আঃ), শেবার রানী বিলকিস ও জীনদের নিয়ে একটা ঐতিহাসিক সত্য কাহিনী বর্ণনা করছি। প্রসিদ্ধ নবী হজরত সুলাইমান (আ.) দাউদ (আ.)-এর পুত্র। আল্লাহ তাআলা তাঁকে নবুয়ত, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও তাঁর পিতার রাজত্বের স্থলাভিষিক্ত করেছেন। মহান আল্লাহ তাঁকে এমন কিছু নেয়ামত দান করেছেন, যা অন্য কোনো নবীকে দান করা হয়নি। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি দাউদের জন্য সুলাইমানকে দান করেছিলাম, সে কতই না উত্তম বান্দা। অবশ্যই সে ছিল আমার প্রতি সদা প্রত্যাবর্তনশীল।’ (সুরা : ছদ, আয়াত : ৩০)

সুলায়মান (আঃ) কে আল্লাহ তায়ালা জ্বীনকে বশীভুত করার ক্ষমতা দান করেছিলেন। সূরা সাবা ১২ নম্বর আয়াতে আছে 'আর আমি সোলায়মানের অধীন করেছিলাম বায়ুকে, যা সকালে এক মাসের পথ এবং বিকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত। আমি তার জন্যে গলিত তামার এক ঝরণা প্রবাহিত করেছিলাম। কতক জিন তার সামনে কাজ করত তার পালনকর্তার আদেশে। তাদের যে কেউ আমার আদেশ অমান্য করবে, আমি জ্বলন্ত অগ্নির-শাস্তি আস্বাদন করাব। তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ'।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَمِنَ الشَّيَاطِيْنِ مَنْ يَّغُوْصُوْنَ لَهُ وَيَعْمَلُوْنَ عَمَلاً دُوْنَ ذَلِكَ وَكُنَّا لَهُمْ حَافِظِيْنَ-(الأنبياء ৮২)-

‘এবং আমরা তার অধীন করে দিয়েছিলাম শয়তানদের কতককে (শয়তান জীন বোঝানো হয়েছে), যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত এবং এছাড়া অন্য আরও কাজ করত। আমরা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতাম’ (সুরা আম্বিয়া ২১/৮২)।

রাজা সুলাইমান (আঃ) এর দরবারে রানী বিলকিস

অন্যত্র বলা হয়েছে,
وَالشَّيَاطِيْنَ كُلَّ بَنَّاءٍ وَّغَوَّاصٍ- وَآخَرِيْنَ مُقَرَّنِيْنَ فِي الْأَصْفَادِ- (ص (৩৭-৩৮)-

‘আর সকল শয়তানকে (খারাপ জীন বুঝানো হয়েছে) তার অধীন করে দিলাম, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী’। ‘এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃংখলে’ (সুরা ছোয়াদ ৩৮/৩৭-৩৮)

বস্তুত জিনেরা সাগরে ডুব দিয়ে তলদেশ থেকে মূল্যবান মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত তুলে আনত এবং সুলায়মানের (আঃ) হুকুমে নির্মাণ কাজ সহ যেকোন কাজ করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকত। ঈমানদার জিনেরা তো ছওয়াবের নিয়তে স্বেচ্ছায় আনুগত্য করত। কিন্তু দুষ্ট জিনগুলো বেড়ীবদ্ধ অবস্থায় সুলায়মানের (আঃ) ভয়ে কাজ করত। আদেশ পালনে সদা প্রস্তুত থাকাটাও এক প্রকার শৃংখলবদ্ধ থাকা বৈ কি! ‘শয়তান’ হচ্ছে আগুন দ্বারা সৃষ্ট বুদ্ধি ও চেতনা সম্পন্ন এক প্রকার সূক্ষ্ম দেহধারী জীব। জিনের মধ্যকার অবাধ্য ও কাফির জিনগুলিকেই মূলতঃ ‘শয়তান’ নামে অভিহিত করা হয়। আয়াতে ‘শৃংখলবদ্ধ’ কথাটি এদের জন্যেই বলা হয়েছে। আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে থাকায় এরা সুলায়মানের কোন ক্ষতি করতে পারত না। বরং সর্বদা তাঁর হুকুম পালনের জন্য প্রস্তুত থাকত।

সেবার রানীকে ( রানী বিলকিস) নিয়ে গল্প ইহুদি, খ্রিষ্টান ও ইসলাম তিন ধর্মেই আছে। আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, বর্তমান ইয়েমেনই হচ্ছে দক্ষিন আরবের রাজ্য শেবা। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ মনে করেন শেবা নামক রাজ্যটি আসলে পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া। রাজ্যেটির সঠিক সীমা নিয়ে বিতর্ক আছে বহুকাল ধরে। ইথিওপিয়াই ছিল শেবা, এর পক্ষে যুক্তিদানকারীরা বলেন, শেবার রানীর রাজত্ব ছিল অ্যাকজাম নামক রাজ্যের উপর। কিন্তু রাজা সলোমনের সময়ে এমন কোনো রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না, এমনকি যখন বুক অভ কিংস সম্পাদিত হয় তখনও এমন কোনো রাজ্য ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। আরবরা শেবার রানীকে বিলকিস আর ইথিওপিয়ানরা মাকেদা বলে সম্বোধন করে থাকে।

রানী বিলকিস (শেবার রানী)

খ্রিষ্টানদের ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী শেবার রানীর বর্ণনাঃ
শেবার এই রহস্যময় নারী শাসকের কথা ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে। সেখানে বলা আছে, শেবার রানী যখন জেরুজালেমের রাজা সলোমনের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ঈশ্বরের প্রতি তার অবিচল আস্থা এবং তার রাজ্যের প্রাচুর্যের গল্প শুনলেন তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজে উপস্থিত থেকে রাজা সলোমনের জ্ঞানের পরীক্ষা নিতে সেই রাজ্যে যাবেন। শেবার রানী নিজেও অত্যাধিক জ্ঞান, সম্পদ এবং ক্ষমতার অধিকারিণী ছিলেন। তিনি ঠিক করলেন রাজা সলোমনকে তিনি কঠিন কঠিন প্রশ্ন করে তার জ্ঞানের পরিধীর পরীক্ষা নেবেন। সেই অনুযায়ী তিনি তার সভাসদ, ভৃত্য আর প্রচুর উপহার সামগ্রী নিয়ে জেরুজালেমের পথে রওয়ানা দিলেন। তার কাফেলায় সোনা, মশলা, আর মূল্যবান পাথরের উপহার সামগ্রী ছিল, যা তিনি রাজা সলোমনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি এতই বিচক্ষণ আর বুদ্ধিমতি ছিলেন যে, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে তাকে রাজা সলোমনের সমকক্ষ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

রানী ছিলেন সূর্য-পূজারী আর রাজা সলোমন একেশ্বরবাদী। অবশেষে যখন তিনি তার প্রশ্নের সঠিক আর যুক্তিসঙ্গত উত্তর পেলেন তখন তিনি ঘোষণা দিলেন, “আমি আপনার জ্ঞান আর সাফল্যের যে কাহিনী শুনেছিলাম বাস্তবে তা সেই সীমা অতিক্রম করেছে (১ কিংস ১০:৭)”। সলোমনের জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর ক্ষমতার প্রমাণ পেয়ে তিনি সলোমনের ঈশ্বরে বিশ্বাস স্থাপন করলেন এবং ফিরে গিয়ে নিজের রাজ্যে মানুষের মধ্যে সেই ধর্মের প্রচার করলেন (১ কিংস ১০ ভ. ১-১৩)।

ইহুদি ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী শেবার রানীর বর্ণনাঃ
তারগুম শেনিতেও (দ্বিতীয় তারগুম – ইহুদী ধর্মগ্রন্থ) এই গল্পের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। সেখানে একটু ভিন্নভাবে গল্পটাকে উপস্থাপন করা হয়েছ। তারগুম শেনি মোতাবেক, রাজা সলোমন গাছপালা, পশু-পাখী এদের কথাবার্তা বুঝতে পারতেন (১ কিংস ৪:৩৩)। একদা তিনি সব প্রাণীকে এক ভোজের নিমন্ত্রণ দিলেন। সমস্ত পশু-পাখি তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও বনমোরগ তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করল না, কারণ ওর মতে, রাজা সলোমন আসলে সবচেয়ে ক্ষমতাবান আর মহান রাজা নন, বরং শেবার রানীই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। সুতরাং রাজা সলোমন এই সম্মানের দাবীদার হতে পারেন না। এ কথা শুনে রাজা সলোমন শেবার রানীকে তার প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন তাকে সম্মান দিতে এবং অসীম ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে মেনে নিতে। এবং রানী যাতে তার ক্ষমতায় মুগ্ধ হন তার জন্য তিনি তার অনুগত এক জ্বীনকে দিয়ে শেবার রানীর পুরো রাজ্য তার রাজ্যে নিয়ে এসে রানীর সামনে উপস্থাপন করেন। এরপর মুগ্ধ রানী সলোমনের প্রাসাদের পানির মতো স্বচ্ছ কাঁচের মেঝেতে হাঁটতে হাঁটতে সলোমনকে কঠিন কঠিন সব ধাঁধাঁ জিজ্ঞেস করেন এবং রাজাও তার ঠিক ঠিক উত্তর দিলে রানী সন্তুষ্ট হয়ে রাজা সলোমনকে তার থেকে ক্ষমতাবান বলে মেনে নেন এবং তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। বনমোরগও সন্তুষ্ট হয়ে রাজার দাওয়াত কবুল করে।

কোরআনে ও হাদিসে শেবার রানীর বর্ণনাঃ
কোরআনে সুরা আল-নামল এ সুলাইমান (আ) এবং শেবার রানী সম্পর্কে আয়াত আছে। আরবরা তাকে ‘বিলকিস’ নামে অভিহিত করে। যদিও কোরআনে কোনো নামে তাকে সম্বোধন করা হয়নি। সুরা আল-নামল এর ৩২ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতে উঠে এসেছে শেবার রানী ও রাজা সুলাইমানের কাহিনী। নবী হিসেবে হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে আল্লাহ অসীম ক্ষমতা, জ্ঞান আর প্রজ্ঞার অধিকারী বানিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষ, জ্বীন এবং পাখি এই তিন প্রজাতি ছিল সুলাইমান (আঃ) এর সেনাবাহিনীর অংশ। সুলাইমান (আঃ) পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন।

আল্লাহ হজরত সুলাইমান (আ.)-কে বিরল ক্ষমতার অধিকারী করেছিলেন। পশুপাখি, জিন থেকে শুরু করে প্রবাহিত বাতাস পর্যন্ত তাঁর অনুগত ছিল। তাঁর বাহিনীতে অসংখ্য জিন ও পশুপাখি সংযুক্ত ছিল। একদিন হজরত সুলাইমান (আ.) তাঁর অনুগত ‘গোয়েন্দা পাখি’ হুদহুদকে অনুপস্থিত দেখলেন। এতে রাগান্বিত হলেন এবং বললেন, যথাযথ কারণ দর্শাতে না পারলে হুদহুদ কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হবে। কিছুক্ষণ পর হুদহুদ ফিরে এলো এবং রানি বিলকিসের রাজ্য, রাজত্ব, ক্ষমতা, প্রাসাদ ও সিংহাসন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল। তিনি রানিকে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠান। উত্তরে রানি বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন প্রেরণ করেন হজরত সুলাইমান (আ.)-এর দরবারে। এতে ছিল নগদ স্বর্ণ-রৌপ্য, দাস-দাসিসহ বহু মূল্যবান সামগ্রী। সঙ্গে পাঠান ৪০ সদস্যের উচ্চতর কূটনৈতিক দল। কিন্তু জাগতিক এই ধন-সম্পদের প্রতি কোনো মোহ ছিল না হজরত সুলাইমান (আ.)-এর। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করলেন এবং জানালেন, মানুষকে কুফর ও শিরকমুক্ত করে একত্ববাদের পথে নিয়ে আসাই তাঁর মূল চাওয়া। আল্লাহ হজরত সুলাইমান (আ.)-কে যে ক্ষমতা, ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্য দান করেছেন, রানি বিলকিসের প্রতিনিধিদের সে সম্পর্কেও ধারণা দিলেন তিনি।

রানি বিলকিস তার দেশের সেনাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিলেন। সেনা সমাবেশ ঘটানো হলো এবং যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতিও নেওয়া হলো। রানি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ‘যদি সুলাইমান (আ.) আমাদের উপহার গ্রহণ করেন, যুদ্ধ না করে আল্লাহর পথে আহ্বান জানান, তাহলে বুঝতে হবে তিনি সত্য নবী। আর যদি তিনি উপহার প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে তিনি পৃথিবীর অন্যান্য রাজার মতোই একজন রাজা। আমরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করব। কোনো শক্তি আমাদের পরাজিত করতে পারবে না। আর তিনি যদি সত্যি নবী হন, কোনো শক্তি আমাদের রক্ষা করতে পারবে না।’

রানি বিলকিসের প্রতিনিধি দল হজরত সুলাইমান (আ.)-এর দরবার থেকে ফিরে তাঁকে জানাল, আল্লাহর শপথ! তিনি কোনো সাধারণ রাজা নন। আমরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি রাখি না। কোনো দিক বিবেচনায় আমরা তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই। প্রতিনিধিদলের উত্তর শুনে হজরত সুলাইমান (আ.)-এর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেন রানি বিলকিস। তিনি বার্তা পাঠান, ‘আমি আমার রাজ্যের নেতাদের নিয়ে আপনার কাছে আসছি। আমি আপনার রাজত্ব ও ধর্ম—দুটিই নিজ চোখে দেখতে চাই।’

হজরত সুলাইমান (আ.)-এর দরবারে যাওয়ার আগে তিনি সাধারণ মানুষের উদ্দেশে বলেন, ‘হে দেশবাসী! তোমরা আল্লাহর মনোনীত জাতি! তিনি তোমাদের বহু দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সুলাইমান ইবনে দাউদ (আ.)-এর মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করছেন। যদি তোমরা ঈমান আনো এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও তাহলে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ বাড়িয়ে দেবেন। আর যদি তোমরা অস্বীকার করো তাহলে তিনি তাঁর নিয়ামত ছিনিয়ে নেবেন। তোমাদের ওপর দুর্ভোগ চাপিয়ে দেবেন।’ জনসাধারণের পক্ষ থেকে জানানো হলো, সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। অতঃপর তিনি এক লাখ ১২ হাজার সেনার এক বিশাল বাহিনী নিয়ে রওনা হন।

অন্যদিকে সুলাইমান (আ.) তাঁর বাহিনীকে বললেন, ‘কে রানি বিলকিসের সিংহাসন আমার সামনে উপস্থিত করতে পারবে সে উপস্থিত হওয়ার আগেই?’ তাঁর অনুগত একটি জিন রানি বিলকিসের সিংহাসন তাঁর সামনে উপস্থিত করে। তখন একটি কাচের তৈরি সুরম্য প্রাসাদও তৈরি করেন তিনি, যার নিচ দিয়ে ঝরনাধারা বয়ে যেত। সুলাইমান (আ.)-এর দরবারে নিজের সিংহাসন দেখে হতভম্ব হয়ে যান রানি বিলকিস এবং সুলাইমান (আ.)-এর প্রতি বিনয় ও আনুগত্য প্রকাশ করেন। তিনি ও তাঁর সভাসদরা ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রসিদ্ধ মতে তাঁদের বিয়ে হয়।

সুরা নাম’ল এর ২০ থেকে ৪৪ নং আয়াতে যেভাবে আছে;

(২০) সুলায়মান পক্ষীদের খোঁজ খবর নিলেন, অতঃপর বললেন, কি হল, হুদহুদকে দেখছি না কেন? নাকি সে অনুপস্থিত? (২১) আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা হত্যা করব অথবা সে উপস্থিত করবে উপযুক্ত কারণ। (২২) কিছুক্ষণ পড়েই হুদহুদ এসে বলল, আপনি যা অবগত নন, আমি তা অবগত হয়েছি। আমি আপনার কাছে সাবা থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি। (২৩) আমি এক নারীকে সাবাবাসীদের উপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে। (২৪) আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সেজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলী সুশোভিত করে দিয়েছে। অতঃপর তাদেরকে সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। অতএব তারা সৎপথ পায় না। (২৫) তারা আল্লাহকে সেজদা করে না কেন, যিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের গোপন বস্তু প্রকাশ করেন এবং জানেন যা তোমরা গোপন কর ও যা প্রকাশ কর। (২৬) আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই; তিনি মহা আরশের মালিক। (২৭) সুলায়মান বললেন, এখন আমি দেখব তুমি সত্য বলছ, না তুমি মিথ্যবাদী। (২৮) তুমি আমার এই পত্র নিয়ে যাও এবং এটা তাদের কাছে অর্পন কর। অতঃপর তাদের কাছ থেকে সরে পড় এবং দেখ, তারা কি জওয়াব দেয়। (২৯) সাবার রানি বলল, হে পরিষদবর্গ, আমার প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে। (৩০) সেই চিঠি সুলায়মানের পক্ষ থেকে। (এতে বলা হয়েছে,) পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল আল্লাহর নামে শুরু; (৩১) আমার অবাধ্য হয়ো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার কাছে উপস্থিত হও। (৩২) (পত্র শুনিয়ে) রানি বলল, হে নেতৃবৃন্দ। আমার কাজে পরামর্শ দিন। আপনাদের বাদ দিয়ে তো আমি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি না। (৩৩) তারা বলল, আমরা শক্তিশালী এবং কঠোর যোদ্ধা। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আপনারই। অতএব আপনি ভেবে দেখুন, আমাদেরকে কি আদেশ করবেন। (৩৪) সাবার রানি বলল, রাজা বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে, তখন সেটাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার মর্যাদাশালীদের লাঞ্ছিত করে। এ রকম কাজ করাই তাদের রীতি। (৩৫) আমি তাঁর কাছে কিছু উপঢৌকন পাঠাচ্ছি; দেখি আমার দূতেরা কী জবাব নিয়ে ফেরে। (৩৬) অতঃপর যখন দূত সুলায়মানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বললেন, তোমরা কি ধনসম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদেরকে প্রদত্ত বস্তু থেকে উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক। (৩৭) ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমি তাদের বিরুদ্ধে এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসব, যার মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। আমি অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কৃত করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত। (৩৮) সুলায়মান বললেন, হে পরিষদবর্গ, তারা আত্নসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে বিলকীসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে? (৩৯) জনৈক দৈত্য-জিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পূর্বে আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে শক্তিবান, বিশ্বস্ত। (৪০) কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বলল, আপনার দিকে আপনার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনাকে এনে দেব। অতঃপর সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত দেখলেন, তখন বললেন এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে নিজের উপকারের জন্যেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং যে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে জানুক যে, আমার পালনকর্তা অভাবমুক্ত কৃপাশীল। (৪১) সুলায়মান বললেন, তার সামনে সিংহাসনের আকার-আকৃতি বদলিয়ে দাও, দেখব সে সঠিক বুঝতে পারে, না সে তাদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের দিশা নেই ? (৪২) অতঃপর যখন (রানী) এসে গেল, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তোমার সিংহাসন কি এরূপই? সে বলল, মনে হয় এটা সেটাই। আমরা পূর্বেই সমস্ত অবগত হয়েছি এবং আমরা আজ্ঞাবহও হয়ে গেছি। (৪৩) আল্লাহর পরিবর্তে সে যার এবাদত করত, সেই তাকে ঈমান থেকে নিবৃত্ত করেছিল। নিশ্চয় সে কাফের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। (৪৪) তাকে বলা হল, এই প্রাসাদে প্রবেশ কর। যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল সে ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলায়মান বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। বিলকীস বলল, হে আমার পালনকর্তা, আমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আল্লাহর কাছে আত্নসমর্পন করলাম।

শেবার রানী রহস্যে ঘেরা এক চরিত্রের নাম, যাকে নিয়ে নানা গল্প যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে হলিউড চলচ্চিত্রও। এখনও শিল্প সাহিত্যে একজন ক্ষমতাশালী রানী হিসেবে তার সরব উপস্থিতি বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও তা চলবে।

নবী হিসেবে হযরত সুলাইমান (আঃ)-কে আল্লাহ অসীম ক্ষমতা, জ্ঞান আর প্রজ্ঞার অধিকারী বানিয়ে দিয়েছিলেন। মানুষ, জ্বীন এবং পাখি এই তিন প্রজাতি ছিল সুলাইমান (আঃ) এর সেনাবাহিনীর অংশ। সুলাইমান (আঃ) পশু-পাখির ভাষা বুঝতেন।

বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণে জীনদের ভুমিকা:

বায়তুল মুক্বাদ্দাসের (জেরুসালেমে অবস্থিত) নির্মাণ সর্বপ্রথম ফেরেশতাদের মাধ্যমে অথবা আদম (আঃ)-এর কোন সন্তানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় কা‘বাগৃহ নির্মাণের চল্লিশ বছর পরে। অতঃপর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে হযরত ইয়াকূব (আঃ) তা পুনর্নির্মাণ করেন। তার প্রায় হাযার বছর পরে দাঊদ (আঃ) তার পুনর্নির্মাণ শুরু করেন এবং সুলায়মান (আঃ)-এর হাতে তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু মূল নির্মাণ কাজ শেষ হ’লেও আনুসঙ্গিক কিছু কাজ তখনও বাকী ছিল। এমন সময় হযরত সুলায়মানের মৃত্যুকাল ঘনিয়ে এল। এই কাজগুলি অবাধ্যতা প্রবণ জিনদের উপরে ন্যস্ত ছিল। তারা হযরত সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত। তারা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলে কাজ ফেলে রেখে পালাতো। ফলে নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তখন সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে তাঁর কাঁচ নির্মিত মেহরাবে প্রবেশ করলেন। যাতে বাইরে থেকে ভিতরে সবকিছু দেখা যায়। তিনি বিধানানুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন, যাতে রূহ বেরিয়ে যাবার পরেও লাঠিতে ভর দিয়ে দেহ স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটাই হ’ল। আল্লাহর হুকুমে তাঁর দেহ উক্ত লাঠিতে ভর করে এক বছর দাঁড়িয়ে থাকল। দেহ পচলো না, খসলো না বা পড়ে গেল না। জিনেরা ভয়ে কাছে যায়নি। ফলে তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কাজ শেষ করে ফেলল। এভাবে কাজ সমাপ্ত হ’লে আল্লাহর হুকুমে কিছু উই পোকার সাহায্যে লাঠি ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং সুলায়মান (আঃ)-এর লাশ মাটিতে পড়ে যায়। উক্ত কথাগুলি আল্লাহ বলেন নিম্নোক্ত ভাবে-

فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ الْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَى مَوْتِهِ إِلاَّ دَابَّةُ الْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنْسَأَتَهُ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ الْجِنُّ أَن لَّوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ الْغَيْبَ مَا لَبِثُوْا فِي الْعَذَابِ الْمُهِيْنِ- (سبا (১৪)-

‘অতঃপর যখন আমরা সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন ঘুনপোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সুলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, যদি তারা অদৃশ্য বিষয় জানতো, তাহ’লে তারা (মসজিদ নির্মাণের) এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির আযাবের মধ্যে আবদ্ধ থাকতো না’ (সাবা ৩৪/১৪)।

সুলায়মানের (আঃ) মৃত্যুর এই ঘটনা আংশিক কুরআনের আলোচ্য আয়াতের এবং আংশিক ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে (ইবনে কাছীর)।

সুলাইমান (আঃ) ও শেবার রানীর ঘটনা ও এতে জীনদের ভুমিকা কোরআন দ্বারা স্বীকৃত একটি সত্য কাহিনী। তবে কোরআনের ও সহি হাদিসের বাইরে অনেক তথ্য এসেছে যেগুলি যাচাই করা সম্ভব না, তা সত্ত্বেও যুগ যুগ ধরে এই কাহিনী গুলি চলে আসছে মূল কাহিনীর অনুষঙ্গ হিসাবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৯:০৯
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×