আমি যখন ক্লাস টুতে পড়ি ১৯৮০ সালে তখন আমরা ৫ পয়সা দিয়ে আইসক্রিম খেয়েছি। আমার চেয়ে বয়সে বেশী ব্লগাররা হয়তো বলবে এই অর্বাচীন বালক আমাদের কি শুনায়। তার পরও এই দেশের আর্থসামাজিক বিবর্তন সম্পর্কে একটু আলোচনা করার জন্য লিখছি। আমি আশা করি আমার চেয়ে বড়রা লিখবেন ১ পয়সার আইসক্রিম খাওয়ার কথা। অথবা কুলফি আইসক্রিমের কথা অথবা আরও অন্য কিছু যা আমরা জানি না। আমাদের সময়ও কুলফি ছিল কিন্তু আমার এখন ভালো করে মনে নাই। আমি কুলফি মনে হয় কমই খেয়েছি। আর ছোটরাও তাদের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা লিখবে। বিভিন্ন প্রজন্মের ছোটবেলার কিছু চিত্র হয়তো আমরা পাবো। ফলে একই সাথে সৃতি রোমন্থন এবং সামাজিক বিবর্তনের পাঠ দুইটাই হবে বলে মনে করি। আমার বর্ণনার কিছু মফস্বল শহরের কিছু ঢাকার। তবে গ্রামে থাকার সৌভাগ্য আমার হয় নাই। এই জন্য আমি আমার পিতা মাতাকে সর্বদা দোষ দিতাম। তবে হয়তো জীবনের বাস্তবতার কারণে তাদের পক্ষে আমার আবদার পূরণ করা সম্ভব হয় নাই।
আমি এক পয়সা দেখেছি। তবে তখন এক পয়সা দিয়ে কিছু কেনা যেত না। আগে নাকি ফুটো পয়সা ছিল। বড়দের কাছে শুনেছি তবে দেখি নাই। ৫ পয়সার যে আইসক্রিমের কথা বলেছি সেটা আসলে মূলত একটা রঙ্গিন বরফ খণ্ড যার সাথে কিছু সেকারিন মনে হয় মিশিয়ে দেয়া হত মিষ্টি স্বাদের জন্য। এটা হোল সবচেয়ে সস্তা আইসক্রিম। এর চেয়ে ভালটা ১০ পয়সার। তার চেয়ে ভালটা ২৫ পয়সার। এটাতে মনে হয় কিছুটা নারকেল এবং হালকা দুধ জাতীয় জিনিস থাকত। প্রকৃত আইসক্রিমের কিছুটা স্বাদ এটা থেকে পাওয়া যেত। তবে আমরা সচরাচর ৫ বা দশ পয়সার আইসক্রিম খেতাম। আর এক টাকার আইসক্রিম হল প্রকৃত আইসক্রিম যাকে বলে সেটা। এটা অনেকটা এখনকার ৩০ বা চল্লিশ টাকা দামের আইসক্রিমের মতো। এর চেয়ে ভালো কিছু মনে হয় রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি হত না তখন।
রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করা লটারির আইসক্রিম বলে একটা জিনিস ছিল। আইসক্রিম ওয়ালার বাক্সের উপরে একটা কাঠি রাখা থাকত যেটা মুক্তভাবে এর কেন্দ্রের চারপাশে ঘুরতে পারে। অনেকটা কাসিনো স্টাইলে এটাকে ঘুরিয়ে দেয়া যেত। বৃত্তের পরিধি বরাবর ১২ টা সংখ্যা থাকত বিভিন্ন স্থানে। কোথাও ১, কোথাও ২, কোথাও ৩ ইত্যাদি থাকত। তবে ১ বেশী থাকত। বাচ্চারা যত টাকা দামের আইসক্রিম কিনতে চায় সেই টাকা নেয়া হত (১ টা আইসক্রিমের দাম)। তারপর বাচ্চাকে এই কাঠি ঘুরাতে বলা হত। ১ এর ঘরে থামলে ১ টা, ২ এর ঘরে থামলে ২ টা, ৩ এর ঘরে থামলে ৩ টা আইসক্রিম দেয়া হত ঐ দামেই। আমার বলায় হয়তো কিছু ভুল থাকতে পারে। অনেক আগের কথা।
তবে কখনও কখনও মায়ের সাথে ঢাকা নিউ মার্কেট গিয়েছি। সেখানে সেই ১৯৮২ সালের দিকেও সম্ভবত একটা আইসক্রিম পার্লার ছিল। হয়তো আরও আগে থেকেই ছিল। আমি বলছি, যখন থেকে আমি দেখেছি বলে মনে আমার মনে পরছে।এখানের আইসক্রিমের দাম সম্ভবত তখনই ২০ বা ৩০ টাকা ছিল। এটা পরিবেশন করা হত বাটিতে। বিভিন্ন ফ্লেভারের ছিল। এই পার্লারটা সম্ভবত এখনও আছে। আইসক্রিমের এত দাম হতে পারে সেটা নিয়ে ঐ সময়ই খুব বিস্মিত হতাম। কি এমন জিনিস ওর মধ্যে থাকবে যে এত দাম। তবে ওখানে যেতাম কদাচিৎ। অনেকটা কদাচিৎ চাইনিজ খাওয়ার মতো। আমি মনে হয় দুই বা তিন বারের বেশী যাই নাই। আমরা মধ্যবর্তী পরিবারের ছিলাম। তাই বেশী অভাবও দেখি নাই আল্লাহর রহমতে আবার বিলাসিতার সুযোগও ছিল না।
আমার মনে হয় তখন ধনী লোক অনেক কম ছিল। তখন নামী স্কুলের সামনে বড় জোর ৮ বা ১০ টা গাড়ি দেখেছি ১৯৮৫ সালের দিকে। এখন তো কয়েক শ গাড়ি দেখা যায়। তবে স্কুলে পড়ার সময় বুঝেছি ( এখন বুঝেছি আসলে, তখন শুধু দেখতাম ) যে অনেকের আর্থিক অবস্থা বেশী ভালো ছিল না। অনেকে স্পঞ্জের স্যান্ডেল পায়ে স্কুলে আসত। মফঃস্বলে দেখেছি বেশীর ভাগেরই স্কুল ব্যাগ নাই। সবাই বুকের কাছে বইগুলি উন্মুক্তভাবে জড়ো করে হেটে স্কুলে আসত। অনেকে পাটের ঝোলার ব্যাগে (কবিদেরগুলি) বই আনত। বৃষ্টি আসলে অনেককে দেখেছি বই বাঁচানোর জন্য ছেলেরা গায়ের শার্ট খুলে বই আবৃত করতো।
অনেক সময় স্কুলে বৃষ্টির মধ্যে এসে শুনি যে বৃষ্টির কারণে স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে। তখন খুব ভালো লাগতো। স্কুল ইন্সপেক্তর আসার আগের দিন আমাদের ভালো পোশাক, জুতা পড়ার নির্দেশ দিত স্কুল থেকে। ইন্সপেক্টর যাওয়ার পর সাধারণত ছুটি দিত পরের দিন। একদিন স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে নীচে নেমে শুনি যে সব স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে কারণ জেনারেল এরশাদ সামরিক আইন জারি করেছেন। আমরা খুব খুশি হলাম শুনে।
৫ পয়সায় আচার পাওয়া যেত। ঐ সময় দেখেছি খুব কম ছেলে মেয়েই টিফিন আনত। অনেকে ৫ পয়সা, ১০ পয়সা, ২৫ পয়সা বা ৫০ পয়সা আনত টিফিন টাইমে ( নিয়মিত না ) কিছু কিনে খাওয়ার জন্য। আবার অনেককে দেখেছি যে টিফিনও ও আনত না আবার কিছু কিনেও খেত না। এখন বুঝতে পারি এর কারণটা। তখন বুঝতাম না। শিক্ষকরা অনেকে খুব মারধর করতো। একবার ক্লাস ফোরে থাকতে শুনি যে আমাদের পাসের সেকশনের একটা ছেলেকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছে শিক্ষক। একটা শীতল আতংক মনের মধ্যে ছেয়ে গিয়েছিল কথাটা শুনে।
১৯৮১ সালে ৩ টাকায় এক হালি দেশী মুরগির ডিম পাওয়া যেত। আমার বাবার সাথে একবার ১৯৭৯ সালে মফঃস্বলে বাজারে গেলাম। ১০ টাকায় পুরা বাজার করা শেষ ( মাছ, মাংস হয়তো ছিল না। মাছ থাকলেও ছোট মাছ হয় তো ছিল)। লাউ এর দাম নিল ১ টাকা।
আমি যখন থ্রি তে পড়ি ( ১৯৮১) তখন মফঃস্বলে আমি আর আমার ছোট ভাই একসাথে একা ( বড় কেউ থাকত না) রিকশায় করে স্কুলে যেতাম। যেতে লাগতো প্রায় ২৫ মিনিট। সেই হিসাবে এখন মনে হয় ভাড়া হওয়া উচিত অন্তত ৫০ টাকা। তখন আমাদের কাছ থেকে নিত ১ টাকা। উদার রিকশাওয়ালা দুই একবার আট আনাও নিয়েছে। প্রাইমারী স্কুলের চাঁদা ছিল মাসে এক টাকা। তখন ঢাকাতেও দেখেছি অনেক নামী স্কুলের মাসিক বেতন ছিল বড়জোর ৭০ টাকা। সাধারন স্কুলে আরও কম।
পোস্ট বেশী বড় হয়ে যাচ্ছে তাই এখানেই থামলাম। সময় সুযোগ হলে আবার লিখব ইনশাল্লাহ। আমি বয়সে ছোট ও বড় ব্লগারদের তাদের অনুরুপ অভিজ্ঞতার বর্ণনা আশা করছি। এখানে যা লিখেছি তা সৃতি থেকে ( কারও সাহায্য ছাড়া)। তাই তথ্যগত ভুল থাকতে পারে। আশা করি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন সবাই।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:২৯