দৃশ্যপট ১
ছোট্ট একটা মানুষ। মিষ্টি চেহারার ফোলা ফোলা গালওয়ালা বছর ৪/৫ এর একটা ছেলে। ক্ষণে ক্ষণে স্থান আর ভঙ্গি বদল করতে থাকা পিচ্চিটার দিকে মায়াভরা সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন একদম হুবহু সন্তানের চেহারার অধিকারিণী মা। ছেলেটার পরনে লাল টুকটুকে ফুলহাতা গেঞ্জি, সাদা ফুলপ্যান্ট, কপালে ‘কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’ লেখা ফিতা আর তাতে কপালের দুই পাশ দিয়ে গোঁজা ছোটো কাঠির মাথায় বাংলাদেশের পতাকা।
চারপাশের হাজারো জনতার হুংকারে চাপা পড়ে যাচ্ছে কচি রিনরিনে গলার ‘তুই রাজাকার’ স্লোগান, কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে মহানন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে স্লোগান দেয়া ঠিকই চলছে তার। লাফালাফির এক পর্যায়ে একটা পতাকা খুলে পড়ে গেলো নিচে। মা কুড়িয়ে নিলেন পতাকাটা, ছেলেকে কাছে ডেকে আবার মাথায় জুড়ে দিতে দিতে বললেন, ‘বাবা, পতাকা মাটিতে ফেলে না। মনে থাকবে?’ মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে নিরবে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয় ছেলে। এক মুহূর্ত পরেই আবার সেই লাফ আর স্লোগান শুরু, কিন্তু এবার কপালের দুই পাশে দুই হাত দিয়ে পতাকা দুটো আগলে রেখে!
ছোটো একটা বাচ্চা, কতোটুকু আর বোঝে সে রাজাকার, যুদ্ধাপরাধীর বিচার আর তাদের ফাঁসির? কিন্তু ওর মা? উনি তো সব বুঝে শুনেই তার ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে চলে এসেছেন প্রজন্ম চত্বরে।
কি বলবেন আপনি এই ঘটনাটিকে? আদিখ্যেতা? বলতেই পারেন, কিন্তু আমি বলবো, সন্তানের বুকে দেশপ্রেমের বীজ বুনে দিলেন মা।
দৃশ্যপট ২
ধবধবে ফর্সা, কালো ফ্রেমের ভারি চশমা পড়া, রোগা হাত পা আর এলোমেলো চুলের ছেলেটাকে দেখেই প্রথম যে কথাটা মনে পড়লো তা হল, কোন এক সায়েন্স ফিনশন গল্পের পাগলা বিজ্ঞানী। হাতে বই আর লাইব্রেরীর বাইরে সাধারণত এই জাতীয় ছেলেপেলেদের দেখা পাওয়া দুষ্কর। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো, প্ল্যাকার্ড হাতে, তাও আবার স্লোগানে লিড দেয়া অবস্থায় ছেলেটাকে দেখে জটলাটার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে গেলাম। ১০/১২ জনের দলটার সবার হাতে প্ল্যাকার্ড, কয়েকটা মশাল আর সামনে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা।
অনভ্যস্ত গলায় জোরালো স্লোগান শুনতে খারাপ লাগছিল না। ‘ছাত্রলীগ’ আর ‘আওয়ামি লীগ’ এর মিছিলের স্লোগানের সুরের অনুকরণে ‘জয় বাংলা’ চিৎকারের এক ফাঁকে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বের হয়ে গেলো! স্লোগানটা অর্ধেক দিয়েই মুখ চেপে বসে পড়লো অপ্রস্তুত ছেলেটি। গণজাগরণের এই মঞ্চে তার নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত সুরস্খলনে পুরো আয়োজনের তাল কেটে যাওয়ার আশঙ্কায় হতচকিত ছেলেটি। জটলার সবাই একসাথে হৈ হৈ করে উঠলো, আর আশে পাশের বন্ধুরা হালকা গণধোলাই দিয়ে দিল বেচারার পিঠে। ছেলেটার লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা কান গুলো মশালের আলোতেও পরিষ্কার বোঝা গেলো।
আপনি কি বলবেন এই ছেলেটিকে? বন্ধু বান্ধব নিয়ে পিকনিক করতে আসসে? দুই চারটা স্লোগান দিয়া দেশ উদ্ধার করতে ফেলতেসে? বলতেই পারেন, কিন্তু আমি বলবো, এই ছেলে নিজের মনের তাগিদে হাতের বই রেখে ঘর ছেড়ে বেড়িয়েছে। ওরা এভাবেই তৈরি হচ্ছে দেশের ডাকে বারবার পথে নামার জন্য।
দৃশ্যপট ৩
বেশ বড়সড় দলটার ভেতর নীল সাদা সালোয়ার কামিজ পড়া আপুটার মায়াভরা মুখটার ওপর নজর আটকে গেলো কেন যেন। মেক আপ বিহীন সাদাসিধে চেহারা। হাসিখুশি চেহারায় সামান্য ক্লান্তির আঁচর। মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস গুলোয় যেমন সবসময় তেজি চেহারার একটা মেয়ে চরিত্র থাকে, একদম ঐরকম।
হাসলে টোল পড়া গাল ওয়ালা মুখ থেকে হঠাৎ করেই স্লোগান বের হল, ‘ধইরা ধইরা জবাই কর!!’। থমকে গেলাম। আবার স্লোগান শোনা গেলো, ‘একটা কইরা রাজাকার ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর!!’ এমন মায়াময় একটা চেহারার একটা মানুষের মুখে এমন ভয়ঙ্কর কথা!! একটু ভাবলাম, কই, একটুও বেমানান লাগলো না তো!
আপনি কি বলবেন ঐ মেয়েটিকে? ঢং করার আর জায়গা পায় নাই, অ্যাডভেঞ্চার করতে বের হইসে!!? বলতেই পারেন, কিন্তু আমি বলবো, প্রয়োজনে আমার মা বোনেরাও প্রতিবাদের হাতিয়ার তুলে নেবে এটা তার একটা ছোট্ট প্রমাণ।
এই প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, কিন্তু রাজাকাররাও এ প্রজন্মের যুদ্ধ দেখেনি…….
অনেক প্রশ্ন, অনেক সন্দেহ, অনেক চক্রান্তের সুচতুর চালের উপস্থিতির কটু গন্ধে নাক কুঁচকে আছেন অনেকেই। কেন ওরা বিচার না চেয়ে ফাঁসি চাচ্ছে? বিশ্বজিৎ কে খুন করার পর কোথায় ছিল এই জনতা? সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর কেন এমন প্রতিবাদ হল না? শেয়ার বাজার কেলেংকারি আর পদ্মা সেতু নিয়ে মহাকাব্য ‘মাল-নামা’ মঞ্চায়িত হওয়ার সময় কোথায় ছিল এই গণজাগরণ? মেয়াদের শেষ মুহূর্তে জনগণের আবেগ নিয়ে খেলা করে জনতার রায় নিজেদের পক্ষে নিতে এই আয়োজন আওয়ামি লীগের নতুন কোন চক্রান্ত কিনা? এবং এটা হুজুগে বাঙ্গালির আরেক নতুন হুজুগ মাত্র …. ইত্যাদি ইত্যাদি……
আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। সুগভীর চক্রান্ত, পাবলিসিটি স্টান্ট, পলিটিক্যাল শো-অফ, অন স্টেজ ড্রামা এগুলর কোনটাই ভালো বুঝি না। কিন্তু এতটুকু বুঝি, জাতির পিতার হত্যাকারীর শাস্তি যদি ফাঁসি হয়, ৩০ লাখ শহীদের সন্তানদের পিতার হত্যাকারীদের শাস্তিও ফাঁসিই হওয়ার কথা।
আর মুক্তিযুদ্ধ নিশ্চই একদিনে শুরু হয়ে যায়নি, ছোটো ছোটো অনেকগুলো ঘটনার ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়েই স্বাধীনতা যুদ্ধের দোরগোড়ায় পা রেখেছিলো এ দেশ। সেই সব গুলো ছোটো ঘটনাতেই নিশ্চই একসাথে সবার অংশগ্রহণ ছিল না। অল্প অল্প করে, একটি একটি ঘটনার ফলশ্রুতিতে একসময় পুরো দেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে, একসাথে। আমাদের শাহবাগের আন্দোলনটা কি তেমন একটা গণজাগরণের সূচনা হতে পারে না? প্রজন্ম চত্বরের অনুপ্রেরণায় আমরা এক এক করে সবগুলো অন্যায় আর অবিচারের জবাব কি চাইতে পারব না?
আমি লাখো মানুষের ভিড়ে হেঁটে হেঁটে নিজেকে দেখেছি, আমার ভাইদের দেখেছি, পাশের বাড়ির জানালার আপুটাকে দেখেছি, ক্লাসের গুড বয়টাকে দেখেছি, খেলার মাঠে কিছু পারে না বলে যাকে আম্পায়ার বানিয়ে রাখি তাকে দেখেছি। হোক হুজুগ, যদি এই হুজুগের মধ্যে দিয়ে প্রজন্ম চত্বরে উপস্থিত মানুষ গুলোর মনের একটা ক্ষুদ্র কোণাতেও দেশ আর দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হয়, তাহলে আমি সেই হুজুগে গা ভাসাতে রাজি আছি।
আমাদের বাংলাদেশকে কেউ যদি ইন্ডিয়া বা পাকিস্থানের কাছে বিক্রি করতে চায়, তাহলে আগে আমাদের প্রত্যেককে এক এক করে খুন করে নিতে হবে। কারণ আমার দেখা সেই মা, টোল পড়া হাসিমুখটা, চশমা পড়া ছেলেটা অথবা সামনে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে থাকা সেই অশীতিপর বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা কেউ প্রাণ থাকতে বাংলা মা-এর পতাকা ভূলুণ্ঠিত হতে দেবে না, দেবও না।