somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নূর মোহাম্মাদ

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সকাল থেকেই তোঁতাবিবির কথা মনে হচ্ছিল নুর মোহাম্মাদের। সে মহেষখোলা ছেড়েছে এপ্রিলে আর এখন সেপ্টেম্বর। বঊএর সাথে অনেক দিন দেখা নাই। অসুখ বিসুখ মানুষের মন নরম করে দেয়। সাতদিন আগে টাইফয়েড শুইয়ে দিয়েছে তাঁকে। জ্বর জারির সাথে খুব একটা পরিচয় ছিলো না তার। এই জ্বর তাকে অকম্মা বানিয়ে ছেড়েছে। স্ট্যান্ড টু’র (সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের আগে নিয়ম করে সতর্ক অবস্থান নেওয়া) মত নিয়ম করে সকাল বিকাল কাঁপিয়ে জ্বর আসে। প্লাটুন কমান্ডার নায়েব সুবেদার সামাদ তারঁ পেট্রলিং এ যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। শুয়ে বসে দিন কাটনোর লোক নুর মোহাম্মাদ না। কিন্তু সামাদের এক কথা, যুদ্ধ করতে হলে আগে সুস্থ হতে হবে। "আর ক্যপ্টেন সাবের পিয়ারের লোক তুমি। তুমার যত্ন না নিলি আমার খবর আছে"। ক্যম্পের অন্যরা এ দু’জনের খুন সুটিতে মজা পায়। মাস খানেক আগে বর্ণীর যুদ্ধে আহত কোম্পনী কমান্ডারকে কাঁধে করে নিয়ে এসেছিলো নুর মোহাম্মাদ। সে কথা পুরো সাব সেক্টরে ছড়িয়ে পড়তে বেশি দেরি হয়নি।

কিছুদিন আগে কাশিপুর কোম্পানীর একটি প্লাটুনের সাথে গোয়ালহাটি এসেছে নুর মোহাম্মাদ। গুলবাখপুর প্রাইমারি স্কুলে ঘাঁটি গেড়েছে তারা। অস্ত্রশস্ত্র বলতে একটি এলএমজি, কয়েকটা এসএলআর আর থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রায় তিন ক্রোশ দক্ষিণে গঙ্গানন্দপুরে পাকিস্তানিদের ঘাঁটি। কিছু রাজাকারসহ পাকিস্তানিদের আরেকটি ক্যাম্প ছুটিপুরে। তাদের হাতিয়ারের তুলনায় এসব তো কিছুই না। তার পরেও ক্যাপ্টেন সাহেব তাদের এখানে পাঠিয়েছে, দলে নুর মোহাম্মাদের মত ছেলেরা আছে বলে। ক্যাপ্টেন সাহেবের কথা মনে হতেই হাসি পেয়ে গেল নুর মোহাম্মাদের, তার মত ৩৫ বছরের সৈনিককেও তিনি বাচ্চু বলে ডাকেন । অথচ তাঁর বয়স এখনও ২৫ পেরিয়েছে কীনা বলা মুসকিল। নুর মোহাম্মাদদের তেমন কোন কাজ নেই এখানে। প্রতিদিন গোয়ালহাটি বাজারের কাছে একটা স্ট্যন্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়, দূর থেকে ছুটিপুর ক্যাম্পে নজরদারি করার জন্যে। সেকটর কমান্ডার সাহেবের ইচ্ছা সময় সুযোগ মত ছুটি পুর, গঙ্গানন্দপুরের বারোটা বাজানো।
এই নিস্তরঙ্গ দিন রাত্রি নুরের ভাল লাগে না। ৬৫ সালের যুদ্ধে খেতাব পাওয়া সৈনিক সে। “এত ভাবনা চিন্তার কি আছে?গিরামের লোক জন নিয়ে শালাগের ঘিরে ফেললিই হয়”।
তবে আজকের সকালটা অন্য রকম। পেট্রলপার্টি চলে গিয়েছে তাও অনেক ক্ষণ হয়। নুর মোহাম্মাদকে আজ নস্টালজিয়া পেয়ে বসেছে। তাদের চিত্রা নদীটির মত আর কোন নদী সে দেখেনি। পরিষ্কার সবুজ তার পানি। বাপজান আমানত শেখের কাছে সাঁতার শিখেছিলো সে এই নদীতেই। তবে বাপজানকে সে বেশি দিন পায়নি। ইউপি (আপার প্রাইমারী) দেবার আগেই একদিন চলে গেল বাপজান। একেবারে না বলে কয়ে। এমন ভাবে যে কারো মৃত্যু হতে পারে নূর মোহাম্মাদ কোনদিন ভাবেনি। অবশ্য সেটাই প্রথম তাঁর মৃত্যু দর্শন। ক’দিন পর যখন মা জিন্নাতুন্নেসাও তাঁকে ছেড়ে গেল, খোদার উপর খানিকটা অভিমান হয়েছিলো তাঁর। গোঁ ধরেছিলো কিছুতেই মাটি দিতে দেবেনা মাকে। ওই সময় চাচী আদর দিয়ে কোলে তুলে নিয়েছিলো তাকে। চাচী জানতেন নিজের ছেলের ভালোবাসা পাবার জন্যে কোন কেরামতির দরকার হয়না। পরের ছেলেকে আপন করতে হলে অনেক ছাড় দিতে হয়। লেখা পড়ায় মন ছিলো না বলে চাচার গাল মন্দ শুনতে হত তাঁকে।ক্লাশ টেনে উঠে যাত্রা দলে নাম লেখালো নুরু। চাচার ভয়ে বাড়ি আসা ছেড়ে দিলো। তবে চাচাও বেশিকিছু করতে পারতেন না। ‘বিটার আর কোন কাজ নেই খালি এতিম ছাওয়ালডার পিছনে লাগা ছাড়া। বাপ আমার যতটুক লিহা পড়া শিহিছে ওতিই হবেনে। পাল্লি এট্টা বউ ঘরে আনার কথা ভাবো দিন’। বউ আনার আগেই একদিন দুম করে মরে গেলো চাচী। বাড়ির সাথে চাচির কারনে যে আলগা বাঁধনটা ছিলো সেটাও আর রইলো না। ডাঙ্গার জমি বেচে কলের গান কিনে নিয়ে এলো নুর মোহাম্মাদ। সেদিন তো প্রায় সারা গ্রামের লোক তাঁর উঠোনে জড় হয়েছিলো কলের গান শুনতে। পাড়ার মুরুব্বিরা বুঝলেন এই বাউন্ডুলের ঘরে রাখার একটায় উপায় জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। তোঁতা বিবির সাথে তখন থেকে গাঁটছাড়া। বঊটা তার ভালো। বড় মেয়েটা প্রায় বিয়ের যুগ্যি হয়ে উঠেছে কিন্তু এই বিশ বছরেও বউটা পুরোনো হয়নি একটুও। এসব ভাবতে ভাবতে ছোখটা একুটু লেগে এসেছিলো, ঘুম ভাংলো প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে। গোয়ালহাটির দিক থেকেই আসছে গুলির শব্দ। ল্যান্স নায়েক মোস্তফা গিয়েছিলো আজ পেট্রোল কমান্ডার হিসাবে। পাকিস্তানিরা আইসে গেছে না কি? ছুটে বেরিয়ে পড়ে সে স্ট্যান্ডিং পেট্রোলের দিকে।
একটু দূরে সিপাই নান্নু মিয়ের সাথে দেখা হল। ক্যাম্পের একমাত্র এলএমজিটি নিয়ে লড়ে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ একটা গুলি লাগে তার গায়। নূর মোহাম্মাদ তাঁকে কাঁধে তুলে নেয়, হাতে তুলে নেয় তার এলএমজি। একটি ফেরি তে করে ছূটিপুরের দিকে যাচ্ছিল এক দল পাকিস্তানি সৈন্য। সংখ্যায় তিরিশের মত। এদের উপর গুলি ছুঁড়েই বিপদে পড়ে গিয়েছে মুক্তি বাহিনী। ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানিরা। অবিরাম বর্ষণ করে যাচ্ছে বিভিন্ন রকম অস্ত্রের গুলি। নূর মোহাম্মাদরা সংখ্যায় হাতে গোনা কয়েকজন। এভাবে হবে না। বুঝে যায় নুর মোহাম্মাদ। পাকিস্তানিদের বুঝতে দেয়া যাবে না তাদের সঙ্খ্যাল্পতার কথা। নান্নু মিয়াকে কাঁধে নিয়েই, বার বার জায়গা পাল্টে গুলি ছুড়তে থাকে সে। বিভিন্ন দিক থেকে গুলি আসতে দেখে পাকিস্তানিরা একটু ভড়কে যায়। তা কিছুক্ষনের জন্যে মাত্র। তারপর তিন দিকে ঘিরে ধরে নুর মোহাম্মাদদের। একটি মর্টারের গোলা আসে পাশে কোথাও পড়ে। সেখান থেকে ছুটে আসা ছররায় ঝাঁঝরা হয়ে যায় নুর মোহাম্মাদের কাঁধ। সহ যোদ্ধা মোস্তফা কামাল ছূটে আসে তাঁর কাছে। ওস্তাদ আপনার গুলি লাগিছে, লন যাই। নুর মোহাম্মাদের মাথায় তখন খুন চেপেছে। সে বলে “আপনি নান্নুরে নিয়ে চলে যান। আমি কভার দিচ্ছি”। কামাল নুর মোহাম্মাদকে ফেলে যেতে রাজি হয়না। “উস্তাদ আপনার কান্ধে গুলি লাগিছে। আপনারে থুয়ে যাওয়া যাবে না”। সে হাত ধরে টানতে থাকে নুর মোহাম্মাদকে। হঠাত চীৎকার করে ওঠে নুর মোহাম্মাদ। হারামজাদার ছ’ল আমারে যুদ্ধ শিখাইস। ৬৫ সালে মেডেল পাওয়া মানুষ আমি যা বলতিছি তাই কর”। সে চিৎকার কতকটা মোস্তফার কানে আসে কতকটা পাকিস্তানি গুলির শব্দে ঢাকা পড়ে। নুর মোহাম্মাদ মোস্তফাকে নিজের এলএমজিটি দিয়ে তার এসএলারটি হাতে নেয়। “ দোস্ত, ভাই আমার, তুই, নান্নু আর এলএমজিটা নিয়ে যা। অস্ত্র যেন হারামজাদাগে হাতে না। পড়ে। আমি অগে ঠিয়াই (ঠেকায়) রাখতিছি”। নুর মোহাম্মাদের এই মিনতি মোস্তফার হ্রদয় বিদীর্ণ করে দেয়। সে নান্নু মিয়াকে কাঁধে নিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে থাকে। অন্ততঃ কাশি পুরে একটা খবর দেওয়া দরকার।

পেট্রোলের সবাইকে বাঁচানোর কথা ছাড়া নুর মোহাম্মাদের আর কিছু মনে থাকে না। এসএলআর দিয়ে আগের মতই সে জায়গা বদলে বদলে গুলি করতে থাকে। একটু পর কাঁধের ব্যথায় তার শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে। চোখ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে ক্লান্তিতে। নুর মোহাম্মাদ একটি গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসার চেষ্টা করে সে। তার মাথার ভিতর টা ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ মনে হয় দূর থেকে ভেসে আসছে পাকিস্তানিদের কণ্ঠস্বর, বুটের শব্দ। কেঊ এক জন তাঁকে লাথি মেরে মাটিতে শুইয়ে দেয়। বুকের পরে লাফিয়ে ওঠে একজন। নুর মোহাম্মাদ কিছুটা টের পায়, কিছুটা টের পায় না। গভীর ঘুম তাঁকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চায়। সে জোর করে চোখ মেলার চেষ্টা করে। এসময় এক জন ঘ্যাচ করে তার চোখের ভেতর বেয়নেট ঢূকিয়ে দিয়ে বলতে থাকে সালে গাদ্দার কি বাচ্চে ...
সে কথা নুর মোহাম্মাদের কানে পৌছে না।
গাছের উপর বসে থাকা পাখি গুলো, তীব্র স্বরে চিৎকার করতে থাকে। দূর থেকে পাখির এই কোলাহল কে কান্নার মত মনে হয়।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×