somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চীনের যে রাজা যুদ্ধকে বেআইনি বলে ঘোষণা করেছিলেন

১৭ ই আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৪:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



চিন শি হুয়াং-এর জীবনকে ঘিরে দুটো রহস্য রয়েছে। একটি চীনের প্রথম সম্রাট হওয়া নিয়ে, আর অপরটি বড় একটি ষড়যন্ত্রকে ঘিরে। এই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত দুটি ঘটনা চীনের সীমানা ছাড়িয়ে অন্যান্য ভূমিগুলোতেও প্রভাব ফেলেছিলো, এখনো ফেলে যাচ্ছে।

যে তরুণ রাজপুত্রকে একসময়ে চিন রাজ্যের উত্তরসূরি হওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিলো, তিনি নিজেও ভাবেননি এক সময়ে পুরো একটি দেশের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে হবে। কিন্তু, সেই দেশে কিছু মানুষ ছিলেন যারা তার মধ্যে সে ধরণের প্রতিভা দেখেছিলেন। হঠাৎ একদিন চিন শি হুয়াং-এর সাথে সেই সময়কার এক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ লু পু-ওয়েই’র সাথে দেখা হয়ে যায়। খুবই সতর্কতার সাথে কিছু দিন শিক্ষা দেওয়ার সাথে সাথে আদালতের ষড়যন্ত্র এবং ভাগ্যের অনেক বড় সহায়তায় তরুণ রাজপুত্র চেং মাত্র ১৩ বছর বয়সে সিংহাসনে আসীন হোন। এর মাঝে রাজকীয় পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের মৃত্যুও তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করে। কে ভেবেছিলো এই তরুণটিই মাত্র ২৬ বছরের মধ্যেই ২০০ বছর ধরে চলা এক যুদ্ধকে থামিয়ে দিয়ে একটি জাতির গোড়াপত্তন করবে? অথচ, পরবর্তীতে তা-ই ঘটেছিলো।


যে শিশুটি যুদ্ধকে বেআইনী ঘোষণা করেছিলো


চিন শি হুয়াং এমন এক বৃহৎ রাজ্যের দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন যার রাজারা বংশ পরম্পরায় যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। চিন শি রাজ্যের নতুন একটি রাজধানী স্থাপন করে নতুন এক সরকার ব্যবস্থা চালু করার ব্যবস্থা নেন। এরপর, তিনি রাজ্যের সামন্ততন্ত্র বিলুপ্ত করে কর্মদক্ষতাকে চাকরী পাওয়া এবং উন্নতি লাভের আবশ্যিক শর্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বলে রাখা ভালো, ইউরোপে সেই সময়ে সামন্ততন্ত্র বিলোপ সাধনের কথা চিন্তাও করা যেতো না। এরপরে চিন শি সামরিক শক্তি আর ধর্মীয় প্রভাব থেকে আসা বিশেষাধিকারগুলো বিলুপ্ত করে দেন। আর এরফলে, নতুন সেই জাতিতে আইনের শাসন, সাম্যতা এবং বিশেষত – শান্তি – দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

কিভাবে এই তরুণ রাজা মাত্র কয়েক বছরে চিন্তা করে বের করে ফেললেন কিভাবে একটি যুদ্ধ বন্ধ করে এমন একটি জাতি প্রতিষ্ঠা করা যায় যার ভিত্তি হবে ‘শান্তি’ এবং বাস্তবেও যা পরিণত করে দেখালেন? রাজা আসলে আইনের শাসনের প্রতি দৃঢ় ভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন আর নিজের চারপাশে সবচেয়ে দক্ষ পরামর্শক ও প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিলেন।

তার সভা এশিয়ার সেরা মস্তিস্কগুলোকে খুঁজে বের করে তাদেরকে চীনের একাডেমীগুলোতে নিয়ে আসে। চিন শি’র প্রতিষ্ঠা করা এই একাডেমীগুলোতে তখন জ্ঞান আর উন্নয়নের ব্যাপারে শিক্ষা দেওয়া হতো। একদিন, তিনি এইসব শিক্ষাগারের পণ্ডিতদের অবিশ্বাস্য এক চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন। তিনি তাদেরকে বললেন যে তিনি চিরদিনের জন্যে যুদ্ধের অবসান চান।




শান্তির অনুরাগী রাজা

পণ্ডিতরা অনেক দিন ধরে কঠিন পরিশ্রম করলেন। অবশেষে, তারা এমন একটি মূল নীতি খুঁজে বের করলেন যা আমরা আজকের দিনে চিন্তাও করতে পারি না। তারা বললেন – ‘’যুদ্ধের মাধ্যমে ‘শান্তি’ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। একমাত্র শান্তিপ্রিয় উপায় অনুসরণেই শান্তিকে অনুধাবন করা যায়।‘’

এরকম বিস্ময়কর অনুধাবন লাভ করার পর, তারা ঠিক করলেন সেই শান্তিপ্রিয় উপায় কি হতে পারে তা রাজাকে জানাবেন। তারা রাজাকে বললেন যে, তাকে এক ব্যাটালিয়ন শান্তির ‘প্ররোচনাকারী’-কে নিযুক্ত করতে হবে যারা মধ্য রাজ্যে ঘুরে বেড়াবে। সেই সময়ের জনগণের মাঝে এই ধরণের এক উপলব্ধি আর অনুমান প্রচলন ছিলো যে, যুদ্ধ একটি সাধারণ ব্যাপার এবং একে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। মানুষের এই বিশ্বাসকে ‘প্ররোচনাকারী’-রা চ্যালেঞ্জ করবে। শুধু তা-ই নয়, তারা মানুষকে এমন একটি সময়ের কথা ভাবতে প্ররোচনা দিবে যখন রাজ্যের মানুষেরা মিলে-মিশে থাকতো, জমিগুলো চাষ করা হতো আর সাধারণ মানুষদের সত্যিকার অর্থে আরাম ও অগ্রগতির সম্ভাবনা ছিলো। এই ‘প্ররোচনাকারী’-রা নিজেদের ক্ষেত্রে একেকজন ওস্তাদ ছিলেন। তারা এটা ছোট ছোট দলের মাঝে অনুশীলন করার সাথে সাথে রাজ্যসভাতেও চর্চা করতেন।

এই প্ররোচনাকারীদের একাডেমীগুলোতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো, আর তারা যেহেতু অনবরতঃ ভ্রমণ করার মাঝে থাকতেন, তাঁদের কাছে ছোট একটি ম্যানুয়েল থাকতো। যখনই দরকার হতো, তাঁরা সেই ম্যানুয়েল পড়ে নিজেদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করে নিতেন। এই ম্যানুয়েলটি পকেট সাইজের ছিলো আর তা চীনের সান স্যু স্কুল থেকে বের করা হয়েছিলো।




রহস্যময় ম্যানুয়েল

ম্যানুয়েলের কোন নাম ছিলো না। যদিও সময়ের পরিক্রমায়, এটা ‘রণকৌশল’ নামে পরিচিত লাভ করে। এটা আসলে একটি আবিস্কার। ম্যানুয়েলের প্রথম বাক্যটি শুরু হয় ‘রণকৌশল...’ শব্দগুলো দিয়ে। প্রাচীন চীনে, এই শব্দের মানে ছিলো ‘পিং-ফা’। ২৩০০ বছর আগে পিং-ফা’র অর্থ ছিলো ‘কূটনীতি’র শিল্প’। অনেকে মনে করেন, সেই সময়ের চীন রাজ্যের একাডেমীগুলোতে ‘কূটনীতি’ বলতে যা শিখানো হতো, তা হচ্ছে- ‘কোনরূপ মতবিরোধ ছাড়াই কিভাবে কোন কিছু ম্যানেজ করতে হয়’। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় রকমের দ্বন্দ্বে এই শিক্ষা দিয়ে কাজ করার সুযোগ ছিল।

কেউ যদি প্ররোচনাকারীদের ম্যানুয়েলটি হাতে নিতো, তাহলে ভাবতো এটা কোন বিশৃঙ্খল কোন কৌশল বা অস্বাভাবিক, দূর্বোধ্য কোন রণবিদ্যার বই। যদিও, এটাতে সৈন্য-সামন্ত, যুদ্ধ, দুর্গের উপর আক্রমন আর কিভাবে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায় সেগুলোর ব্যাপারে কথা বলা আছে। একাডেমীতে গুরুর কাছে শিক্ষা লাভের কারণেই, প্ররোচনাকারীরা এই শব্দগুলো আসল অর্থ জানতেন। একমাত্র তাঁরাই বুঝতেন যে, এই শব্দগুলো আসলে রুপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে যা তাঁদেরকে শান্তি স্থাপনে সাহায্য করবে।

আরেকটি কারণে বইটি’র ভাষা এমন দূর্বোধ্য করে লেখা হয়েছিলো, সেটা হচ্ছে, যদি কখনো কোন প্ররোচনাকারীকে গুপ্তচর মনে করে জেলে অন্তরীন করা হয়, কি পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে সে সম্পর্কে ম্যানুয়েলটি থেকে কোন কিছু বের করা সম্ভব হবে না। পিং-ফা যদি অরুপক আর অসামরিক শব্দ ব্যবহার না করে লেখা হতো, চিনের শান্তিপূর্ণ বিজয় লাভের পরিকল্পনা প্রকাশ হয়ে পড়তো। আর, সেটা কোনক্রমেই হতে দেওয়া যেতো না। এটা জেনে আশ্চর্য হতে হয় যে, এই কৌশলগুলো এমনকি এই একুশ শতকেও ব্যবহার করা হয়।


পরিশেষ

আজ, পিং-ফা রণকৌশলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, বইয়ের দোকান কিংবা গ্রন্থাগারেও তা পাওয়া যায়। এই ম্যানুয়েলটি এখন সামরিক একাডেমী থেকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বোর্ডরুম, ফিটনেস ক্লাবেও পাওয়া যায়। আসলে, যেখানেই কড়া কমান্ড আর নিয়ন্ত্রণের দরকার হয়, সেখানেই এই ম্যানুয়েলের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। যেসব প্রতিষ্ঠানই এই দর্শনে বিশ্বাসী, তাদের সদস্যকেই এই বইটি পড়তে বলা হয়।

এখন ম্যানুয়েলটি যেভাবে সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, আসলে বইটি’র মূল বিষয়বস্তু তা ছিলো না। শান্তি স্থাপনই ছিলো বইটি লেখার মূল উদ্দেশ্য।




তথ্যসূত্রঃ
Jones, David G. (2012) ‘The School of Sun Tzu: Winning Empires without War.’ Published by iUniverse

Giles, Lionel (1910) ‘The Art of War’. Published by Allandale Online Publishing [Online] Available at: Click This Link

Huang, J.H., ed. (1993) ‘The Art of War: The New Translation’. Published by HarperCollins Canada / Non-Fiction; 1 edition
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৫:১৪
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×