বনবিবি/বনদূর্গা এবং তাঁর ভাই শাহ জঙ্গলি কি কোন কাল্পনিক চরিত্র নাকি কিংবদন্তী'র কোন মহান ব্যক্তিবিশেষ? কিংবদন্তী'র হয়ে থাকলে, আসলেই কি তাঁরা এখনো বেঁচে আছেন? তাঁরা কোন ধর্মের অনুসারী ছিলেন- ইসলাম নাকি সনাতন? তাঁরা মুসলমান হয়ে থাকলে, অন্য ধর্মাবলম্বীরা কেন তাঁদেরকে পূজা করেন? আর যদি হিন্দুই হয়ে থাকেন, কেন মুসলমানরা তাঁদের কাছে দোয়া চান? বনবিবি আর দূর্গা একই মানুষ? সুন্দরবনের বনবিবি নামে একটি গল্প লিখতে গিয়ে এমন অনেক প্রশ্ন এসেছে। আমি এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার চেষ্টা করবো আজ।
বনবিবি সুন্দরবনের মানুষদের কাছে অতি পরিচিত এক নাম। নৌকার মাঝিরা যেমন নৌকা ছাড়ার আগে 'বদর, বদর' ডেকে উঠে নিজেদের যাত্রাকে শুভ করতে চান, তেমনি সুন্দরবনের মধু ও মোম আহরণকারী, কাঠুরে এবং মৎসজীবীরা বনে ঢোকার আগে বনবিবি'র নামে দোয়া চেয়ে নেন নিজেদের জন্যে। বনবিবি এই শ্রেণীর মানুষদের বাঘের অত্যাচার থেকে রক্ষা করেন। এমন অনেক কাহিনী চালু আছে সুন্দরবনে যাতে বলা হয়- বনবিবি এই শ্রেনী'র মানুষদের সামনে আবির্ভূত হয়ে বাঘের কবল থেকে রক্ষা করেছেন।
কথিত আছে যে, বনবিবি ও তাঁর ভাই আকাশ থেকে নেমে এসেছিলেন। তখন তাঁদের পরনে ছিলো এক বিশেষ টুপি যা দিয়ে তাঁরা উড়তে পারতেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে বনবিবি আর তাঁর ভাই আরব দেশ থেকে বিশেষ প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়ে আঠারো ভাটির দেশ ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তারপর, সুন্দরবনে এসে অত্যাচারী রাজা দক্ষিণ রায়কে পরাভূত করে সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। ঐ অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করে তাঁরা এখনো বেঁচে আছেন। এই হলো ছোট করে বনবিবি'র ইতিহাস।
প্রথমেই আসি, বনবিবি এবং দূর্গা এক কি না এই প্রশ্নে। এই পোস্টের প্রথমে যে টেবিলটি দেওয়া হয়েছে, সেটি থেকে পরিস্কার যে বনবিবি এবং দূর্গা সম্পূর্ণ ভিন্ন দু'টি চরিত্র। বনবিবি বা বনদূর্গা কাল্পনিক কোন চরিত্র কি না এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় তাহলে এখনো সুন্দরবনের মানুষেরা তাঁকে দেখতে পায় কিভাবে? অনেকেই হয়তো বলবেন, এরা তো আসলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, শহরের স্কুল-কল্বেজ--ভার্সিটিতে পড়ালেখা করেনি। তাই, তাঁদেরকে রেফারেন্স হিসেবে টেনে আনা উচিৎ নয়। এ নিয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে, এ নিয়ে যতদিন কোন গবেষনা না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত সঠিক কোন সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। নাহলে অহেতুক তর্কা-তর্কি হবে। তাই, বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়াই ভালো।
তবে, একথা অবশ্যই বলতে হবে, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে এক এক জায়গায় একেক রকম চল রয়েছে। যেমন- আরবে এক সময় মুখস্থ করে বা গল্প বা কবিতাকারে জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া হতো। আমাদের গ্রামগুলোতে এখনো জ্ঞান এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশনের কাছে এই ভাবেই পৌঁছে দেওয়া হয়।
যদি ধরে নেওয়া যায় যে, তাঁদের অস্তিত্ব আসলেই ছিলো, তাহলে প্রশ্ন আসে তাঁরা কোন ধর্মের অনুসারী? সিলেটের মানুষ হিসেবে আমি জানি, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অনেক মুসলিম সাধুদের প্রনাম করেন। যেমন- হযরত শাহ জালাল (রাঃ)-এর মাজারে হিন্দুদের প্রনাম করতে দে্খা যায়। তাই, বনবিবিকে পূজা করায় কোন বাধা নেই হিন্দুদের। কারণ, তাঁদের ধর্মের উৎস তিনটি- শ্রুতি, স্মৃতি আর প্রথা। প্রথা থেকে অনেক ধর্মাদেশ আসে উনাদের। এরকমই একটি প্রথা হতে পারে বনবিবি বা বনদূর্গাকে পূজা করা।
তাঁরা কি এখনো বেঁচে আছেন? প্রশ্নটা এভাবে করা যেতে পারে- বনবিবি এখনো বেঁচে থাকতে পারেন কি না? এ নিয়ে ইসলামী ধর্মমতে কোন বাঁধা নেই। কোরআনে বর্ণিত হযরত খোয়াজ খিজির (আঃ) এখনো বেঁচে আছেন বলেই মুসলমানরা বিশ্বাস করে থাকেন। এভাবে ইসলামে আরো অনেক চরিত্র আছে যারা দীর্ঘকালব্যাপী জীবিত আছেন। তাই, বনবিবি-ও বেঁচে আছেন তা মুসলমানদের মানতে বাঁধা নেই।
পরিশেষে বলতে চাই, এই মহান দু'টি চরিত্র দু'টি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষদের একই সূত্রে বেঁধেছে যা আমাদের গ্রামাঞ্চলে ধর্মীয় একতার প্রতীক।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০২১ রাত ১০:৫৫